[ কিছু কথাঃ বন্ধুরা আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন বাড়ি থেকে হেটে যেতে হত চার কিমি. পথ। স্কুলে যাওয়ার পথে কান্দির পাড় নামক স্থানে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখতাম ভাঙা কলপাড় বসে থাকতে। সেই অর্ধনগ্ন বৃদ্ধার নাম 'বিশাখা' তার স্বামীর নাম 'গনেশ' এবং সতীনের নাম 'আলো'। সেই কাঁচা বয়সে তার জীবন কাহিনী নিয়ে লিখে ছিলাম এমন একটি আনাড়ি কবিতা। বৃদ্ধার মৃত্যুর আগে পড়েও শুনিয়েছিলাম কবিতাটি। আজ আমি তোমাদের শোনাতে চাই সেই জীবন থেকে নেয়া সত্য কিছু কথা। ধন্যবাদ ]


বহুকাল যাবৎ আকড়ে আছি পৃথ্বির শেকড় খানি
বহুকাল যাবৎ টেনে চলছি অচল পঁয়সার ঘানি।
রোজকারদিন ভাবি বসি হায় আজ বুঝি শেষ হবে
টানা-হেঁচড়া আর হবেনা মুক্তি মিলবে তবে।
          কিন্তু আশা আর গঞ্জনা মিলে--
একটু একটু চলৎ শক্তি খাচ্ছে যে মোর গিলে।
প্রভাত হলে পাঁজাকোল করে রেখে দেয় শানের পর
দাঁত খিচিয়ে বলতে থাকে এইখানে তুই মর!
এমনি করে কতকাল গেল মৃত্যু আসেনা মোর
অন্তিম না এলেও আসতে থাকে অত্যাচারের ঘোর।
সকালের খবার দুপুরেতে খাই,দুপুরের খাবার রাতে
ক্ষুধার জ্বালায় পেট পুড়ে যায় কার কী এসে তাতে।
পড়নের বসন নোংরা হয়েছে, ছিন্ন হয়েছে কবে
ইজ্জতেরও বয়স বেড়েছে ঢেকে রাখা কেন তবে!


পুরোনো দিনের কত কথা আজ বারে বারে পড়ে মনে
শিশিরকণা শক্ত হয়েছে জমে চোখের কোনে।
মা-বাবা গেল চল্লিশ হল, স্বামী গেল হয় ত্রিশ
একযুগ ধরে অসুখের সাথে থাকছি অহর্নিশ।
শৈশব কালের কত স্মৃতি আজ মনেতে উঁকি দেয়
সন্ধ্যের আগে ঘরে না এলে গালাগাল করত মা'য়।
বাবার সাথে হাটেতে গেলে খুরমা কিনে দিয়ে
নৌকায় বসে থাকতাম আমি সে আসত সওদা নিয়ে।
বয়স যখন হাটি হাটি করে চৌদ্দতে দিল পা
বিয়ের শেকল পড়িয়ে দিল আমার বাপ ও মা।
নতুন ঘরে এলেম আমি নূতন বধূ বেশে
অনেকটা দিন ভ্রমিলাম কভূ স্বমীর হৃদয় দেশে।
বছরের পর বছর গেল সন্তান এলোনা ঘরে
শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি দোষ চাপাল আমার মাথার পরে।
গঞ্জনা শুনি, বঞ্চনা শুনি, আমি নাকি ষাঁড়া নারী
সন্তান যদি না আসে ঘরেতে ছাড়তে হবে যে বাড়ি।
নিয়তী বুঝি বাঁধ সাধল চাইল না মুখ পানে
অপয়া আটকুড়া আরো কত কথা আসতে থাকে যে কানে।


একদিন দেখি সাঁঝ বেলাতে জমকালো কলরব
আমারে না বল প্রভূ সোয়ামী আয়োজন করে সব।
পশ্চিম হতে মাঝ রাত্রিতে আলো এলো আলো করে
রাণী থেকে আজ হলাম দাসী আমার আপন ঘরে।
আড়ম্বর এ বিয়ে বাড়িতে লোকের সমাগম
ইশান কোনের খুঁটি ধরে কাঁদি বের হয়ে যায় দম।
বাপের বাড়ির লোকজন এসে শান্ত্বনা দেয় মোরে
স্বামীর পায়ে স্বর্গ নারীর, থাকতে হবে তাই ঘরে।
দেখতে দেখতে যুগল বছর কখন চলে গেছে
গনেশ-আলোর সব প্রচেষ্টা হল যে আজ মিছে।
সেমিনাল ফ্লুইডে সমস্যা ছিল আমার সোয়ামীর
দোষ গুলো সব মোদের দিয়ে সে সেজেছে বীর।
বন্ধা বলে পাড়া-পড়শী বলত কত কথা
স্বামীও তাদের সাথে মিলে জ্বালত হিয়ার ব্যাথা।


শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি সেই কবে গেছে, স্বমীও গেলে ছেঢ়ে
নিতী মোরে বাঁচিয়ে রাখে সতীনের কৃত্রিম জেলে।
দেবর-ভাসুরের ছেলেরা সব বসে ভাবে একি সাথ
ভিটে মাটির অধিকার থেকে দিতে হবে যে বাদ।
আলো এবার ঝলসে ওঠে আলোর সমিক্ষায়
ভিটে মাটি রক্ষা করার কঠীন পরিক্ষায়।
আইন-আদালত সবই হল বার কয়েক হল শালিশ
মোদের কথা কেউ শোনে না যতই করি নালিশ।
সন্তানহীনা আমরা দুজন আর কেউ যে নাই
     বাঁচতে হলে এই সমাজে অর্থ-শক্তি চাই।
         বহু কষ্টে রক্ষা হল বসত-ভিটা খানি
বিপদ মোদের শেষ হয়নি তাও আমরা জানি।
সর্ব সময় শঙ্কিত মন কখন কী যে হয়
সকল সময় অন্তদ্বন্দ্ব কার হবে গো জয়।
রাধার পরশ পাইনি আমি কলির বিশাখা
যজ্ঞকুণ্ডে ভষ্ম হল মনের প্রশাখা।
নক্ষত্রের সাতাস ভাইয়ে মিট মিটিয়ে হাসে
মোর প্রাণের ক্ষীণ প্রদীপ আজও কেন ভাসে?