বেশ কিছু জনের ধারণা অভিধান নিষ্কাশিত অলঙ্কারমন্দ্রিত কঠিনস্য কঠিন শব্দ প্রয়োগে কর্ণবিদারী কিয়ত শব্দরাজি সম্মেলনই উৎকৃষ্ট কবিতা বলে গণ্য হবে, অথবা পরস্পর সম্পর্কহীন বা সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন কিছু শব্দ বা কোথায় দুরূহ কিছু ভাব ছুঁড়ে দিলেই তা আধুনিক কবিতা। আবার বেশ কিছু জন এর বিরুদ্ধে সরব। এনিয়ে চুটকিও প্রচলিত আছে, "যা বোঝা যায়না, তাই আধুনিক কবিতা।"
শেষ বিষয়টি নিয়ে অনত্র কেউ কেউ আলোচনা করেছেন, আমি প্রথম বিষয় মানে কবিতায় ভাষা প্রয়োগের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। বাংলা কবিতায় বাংলা ভাষাতে লেখা হয়। এই বাংলা ভাষার ব্যাপারেই কিছু জানা যাক।
বাংলায় বহুজন ভাষাবিদ হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও প্রকৃত গুণিজনেরা উপেক্ষিত থেকে গেছেন। তেমনই একজন উপেক্ষিত, পশ্চিমবঙ্গে বিস্মৃতপ্রায় এক ভাষাতাপসের কথা শুনতে হয়_
"যেমন আমরা বাঙালী হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এক মিশ্রিত জাতি, আমাদের ভাষা বাংলাও তেমনি এক মিশ্রিত ভাষা। বাংলার উৎপত্তি গৌড় অপভ্রংশ থেকে। সংস্কৃতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা অতিদুরের। তবুও যেমন কেউ বড় মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আবিস্কার বা উদ্ভাবন করেন আত্মগৌরবের জন্য, তা তিনি মেসো মশাইয়ের খুড়তুতো বোনের মামাশ্বশুরের পিসতুতো ভাই হোন না কেন, সেই রকমই আমরা বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের কুটুম্বিতা পাতাই। কথাটা কিছু অতিরঞ্জিত হ'ল বটে। বিশেষ করে সংস্কৃতের ঋণ বাংলা ভাষাকে আপাদমস্তক এমন ভারাক্রান্ত করেছে যে, সম্পর্কটা স্বীকার না করেই অনেকে পারেন না। ভাষাতত্বামোদীদের জন্য একটা উদাহরণ দেই- "তোমরা ঐ গাছটা দেখ"। এর গৌড় অপভ্রংশ হবে "তুমহেলোআ ওহি গচ্ছং দেকখহ"; এর সংস্কৃত হচ্ছে "য়ুয়ং অমুং বৃক্ষং পশ্যত।" য়ুয়ং-তোমরা, অমুং-ঐ, বৃক্ষং-গাছ, পশ্যত-দেখ,-বাংলার কোন শদই সংস্কৃত থেকে আসেনি।" _ মহম্মদ শহীদুল্লাহ
তাহলে এখনকার চেহারায় বাংলা ভাষা এল কি করে, এই প্রশ্নের উত্তরে পিছিয়ে যেতে হয় ইংরেজ শাসনের শুরুর দিকে। যখন ফার্সী ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে, এবং বঙ্গসমাজ কলকাতাকেন্দ্রিক এক নবরূপে নবপথে এগোতে থাকে রামপ্রসাদী গান, এন্টনি কবিয়ালদের লড়াই পেরিয়ে। এই পথের অন্যতম পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর উদ্যোগে বাংলা ভাষা সংস্কৃতাপন্ন হয়ে ওঠে। যদিও তিনি 'ভাইপোস্য পরিবেদনা' নামে বইয়ে চলতি ভাষার হাত ধরেছিলেন, তাঁর বেশিরভাগ রচনাই থেকে গেছে সংস্কৃতিত।(সংস্কারreform+ষ্ণিত/ised=সংস্কৃত+ষ্ণিত/ised=সংস্কৃতিত, i.e. reformisedised!!!) বিদ্যাসগর মশাই সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন, তাই সেই রচনায় মান নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যায়নি। অন্যদিকে তাঁর এই প্রক্রিয়ায় কিছু অনুসারী জুটে যায়, যাঁরা আদৌ সেই দক্ষতার ধারে কাছে যান নি। তাঁদের লেখাকে জাতে তুলতে বাংলা ভাষাটিকেই দিলেন খোলনলচে বদলে।
"একদল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত-ঘেঁষা করতে চেয়েছে, তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবী-পারসী ঘেঁষা করতে উদ্যত হয়েছে। একদল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে বলি দিতে, আর এক দল চাচ্ছে 'জবে' করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া, আর এক দিকে কসাইয়ের ছূরি।"_মহম্মদ শহীদুল্লাহ
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তির প্রবল প্রতিবাদ করলেন। এবিষয়ে তিনি অন্তত দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যার একটির নাম মনে পড়ছে 'নূতন কথা গড়া'। রামরাম বসু প্রমুখ ফারসী সমৃদ্ধ বাংলায় লিখে চললেন। কিন্তু কালের গতি রুখতে পারলেন না। অন্যদিকে বহুশাস্ত্রে অতুলনীয় প্রজ্ঞার অধিকারী মাইকেল মধুসূদন সফল ভাবেই এই সংস্কৃতঘেঁষা কাব্য লিখে সার্থকতা লাভ করেন। তাসত্ত্বেও তাঁর গদ্য সাহিত্যে তৎকালীন বাংলা চলিত ভাষার যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' নাটক এবিষয়ে লক্ষণীয়। পরবর্তী কালে যাঁরা বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে ভাষাবৈচিত্র্য ও সর্বস্তরের ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কৃতি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি পদ্যসাহিত্যে ভাবোচ্ছাস সহকারে 'জাহান্নাম ও 'পুষ্প' একই পংক্তিতে বলে গেছেন এরকম বেশুমার ওয়াকিয়া তাঁর গুলবাগিচা থেকে তুলে আনা যাবে। তাঁর 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসটিতে প্রথম উঠে আসে অন্ত্যজ সমাজের ভাষা ও কথা। তেমনই এই উপন্যাসেই প্রথম প্রবলভাবে বাংলার খ্রীস্টান সমাজের কথা আসে। অন্যদিকে গদ্যসাহিত্যে ভাষা বৈচিত্রে এই উচ্চতায় উঠেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি।
অন্যান্য কবিসাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই চলতি রূপে কিছু কিছু লেখা লিখেছেন। রবি ঠাকুরের বেশ কিছু লেখা আছে, আগল ভেঙে যাওয়ার পর সুকান্ত, সত্যেন্দ্রনাথ সহ অনেকেই লৌকিক ধাঁচকে সফলতা দিয়েছেন। পরে তা জীবনানন্দ ও কল্লোল যুগে প্রচলিতভাবে অনুসৃত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তা আবার সাবেক ফার্সী ঘেঁষা হয়ে ওঠেনি।
তারপর স্বাধীনতার হাত ধরে আসা দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মুক্তি যুদ্ধ, নকশাল আন্দোলনের মত একের পর এক গণ আন্দোলনে বাংলা কবিতা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। অন্যদিকে বেশ কিছু কাব্যিক আন্দোলন ও চলেছে।
এই ভাবে বাংলা ভাষার রূপরেখা চলেছে। সবটা আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই, পরিসরও এখানে কম।
যাই হোক এক জায়গায় গিয়ে শেষ করতে হবে। ভালো থাকবেন।