সেই আল-আন্ধারা কুঁকড়া ডাকা ভুরেই শুনত্যে পাছিলি
ঢাকের ঢ্যাং কুড়া কুড়,
সুয্যি উঠলেই উপর কুলির বামুনদের ছিল্যা বুঢ়া বহু বিটিরা
লত্যন কাপড় পরে, শাঁখ বাজায়ে, উলু দিয়ে
মা ঠাকরনের ঘট আনত্যে যাবেক বামুন পখুরে ।
আর তখনই নীচ কুলি দিয়ে একটো সাইকিল ভ্যানে
বস্তা মুড়া লাশটো চুপসাড়েই হামদের বাখুল্যে ঢুকবেক ।
রাতভর কান্দে কান্দে চইখ্যের জলও শুঁখাই গেছে,
শুকার বাপের রক্তমাখা লাশটো দেখেও
আর কি চইখ্যের জল ঝরবেক ?


কোলের ছিল্যাটো কবেরল্যে ঘ্যানর ঘ্যানর কচ্ছে,
ও মা, বাপ কবে আসবেক ?
উঁয়ার বাপ বল্যে গেছে – শহুরল্যে ঘুরবার সময়
দু’বেটার ফুলপ্যান, কামিজ আর চকচক্যা জুতা আনবেক ।
হামকে সুহাগ করে বল্যে গেছে – কমলিরে, তুর লাগ্যে
সিলিকের শাড়ী আর জরিয়ালা বেলাউজ আনব্য ।


গাঁয়ে হীরু মড়লের ঘরে মান্দারের কাজ করে শুকার বাপ,
ভাত, মুড়ি আর দিনমজুরী কটা টেকায় কি ঘরের
চারটা পেটের ইঁদুর গাঢ়া বুজান যায় ?
তাই উপরি রজকারের লাগ্যে কভু কভু শহুরে দৌড়াত,
বিয়াঘর, পূজা পাব্বনের প্যান্ডিলের বাঁশ বাধত্যে ।
প্যান্ডিলয়ালা দিনখুরাকী ছাড়্যেও হাতে কড়কড়্যা তিন পাত্তি দিথ,
উসব করেই’ন বেটাদের বই, খাতা, পিনছিল, মাষ্টরের বেতন ।


ইবার দুগ্গা পূজার ঢের আগে শহুর যাত্যে হল্য,
কি বলছিল – কুথায় ন’কি আকাশ ছুঁয়া প্যান্ডিল বনবেক,
কি যেমন নামটো বলল্য – আইফিল ন রাইফিল টায়ার –
বাপ, ইমন নাম বাপের জম্মেও শুনি নাই ।
বাঁশ বাঁধা কুন ছিল্যা খিলা লয় বাবু,
বাঁশের উপর বাঁশ, আড়ে বাঁশ, পিছে বাঁশ
তবে ন প্যান্ডিল খাঁড়া থাকবেক !


উঁয়ার ভাগ্না গগনার মুঁহে খপর পাঠাঞ্ছিল,
আর দু’এক দিনেই বাঁশ বাঁধা খতম হবেক –
টঙের ছাঁওড়াটো বাঁধেই ঘর ঘুরবেক
ছিল্যাদের প্যান, জামা, জুতা আর হামার শাড়ী লিয়ে ।
গগনার বাপের হাঁপটো বহুৎ বাড়্যেছিল –
কালক্যে শহুরে দাওয়াই আনত্যে যাঁয়ে শুনল্য –
মামা মাচারল্যে ভুঁয়ে পড়ে গেছে ।
শহুরল্যে ঘুরেই গগনা হামদের বাখুল্যে সটান –
হাঁও মাও করে কান্দে বলল্য – মামা আর নাই’গ মামী !
শুনলি আকাশ ছুঁয়া প্যান্ডিলের টঙের ছাওড়া বাঁধত্যে যাঁয়ে
মাচারল্যে ভুঁয়ে পড়ে শির ফাট্যে চৌচির – ঘিলু বাহিরাঞ গেছে ।
লাশটো হাসপাতালে কাটা ছিড়া করে আজ ঘর পাঠাবেক ।


ভাদ্যোরার বুক ফাটা কান্নায় ছিতছাতুর হয়ে গেল বুকটো,
চইখ ফাট্যে ঝরঝরায় জল, কিন্তুক মুহে আবাজ নাই ।
হামি কি গঙা হয়ে গেলি ? চইখ্যে ঘুটঘুট্যা আন্ধার –
পায়ের তলে পীরথিমীটো ঘুরপ্যাক খাছে –
বাগদী পাড়ার ঝুপড়িগুল্যাল্যে পিলপিলায় লক বাহিরাঞ আল্য –
হামি আর লিজেকেই লিজে চিনতে লারলি ।


প্যান্ডিলয়ালা গগনার হাতে দশ হাজার টেকা পাঠাঞ্ছিল –
গগনা লোটের তাড়াটা হামার হাতে গুঞ্জে দিতেই –
দিমাগের রক্ত টকবগায় ফুটে উঠল্য ।
তাড়াটো ভুঁয়ে ফাবড়াঞ দিহে গুরগুরাই উঠলি –
গগনা, ই লোটগুল্যান হুঁই মারিভঁয়া প্যান্ডিলয়ালাকে ঘুঁরাই দিহে বল –
ইটো কি শুকার বাপের জানের দাম ন’কি ঘুঁষ ?
বল্যে দিবি – হামি থানায় রেপট দিব – গরীব মানুষের জান লিয়ে
ছিল্যা খিলা করার হক উ দিকে কে দিয়েছে ?
উঁরা গরীবের লাশের পাহাড়ে চাপ্যে আকাশ ছুঁবেক ?


শুকা শুনছিস – ঢাকের আবাজ ?
উপর পাড়ায় মা ঠাকরন আল্যেন ।
বামুনদের আটচালা টিনের মন্দিরে উনার কনই আপত্তি নাই
কি দরকার আকাশ ছুঁয়া আইফিল টায়ার ?
মা দুগ্গাকে লিয়েও কতক লক বেওসা ফাঁদেছে,
পূজা লয় সিরিফ পেরাইজের লাগ্যে বুভুক্ষা হয়ে গেছে ।
তুর মরা বাপের নামে পিতিজ্ঞা করছি –
যারা তুদের বাপকে মারেছ্যে, হামার সিন্দুর মিটাঞ্ছে
তাদের কাউকেই হামি ছাড়ব্য নাই –
উদিকে ফাঁসীতে লটকাঞ আকাশ ছুঁয়াতে না পারল্যে
হামার নামও কমলি বাগদী লয় ।


(কবিতাটি পশ্চিবঙ্গের বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জেলার গ্রাম্য কথ্য ভাষায় রচিত)


কিছু আঞ্চলিক শব্দের বাংলা অর্থ -
কুঁকড়া (মোরগ); চুপসাড়ে (চুপিচুপি); বাখুল্যে (ঘরে); মান্দার (রোজকার গরু-বাছুর, চাষের কাজের লোক); গাঢ়া (গর্ত); বুজান (ভর্তি করা); পিনছিল (পেনসিল); টায়ার (টাওয়ার); ছাওড়া (প্যান্ডেল); আবাজ (আওয়াজ); পীরথিমী (পৃথিবী); ফাবড়াঞ (ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া); রেপট (রিপোর্ট); পিতিজ্ঞা (প্রতিজ্ঞা); মারিভঁয়া (গালি-গালাজ বিশেষ)