টান / অনিরুদ্ধ আলম


এক।।
বর্ষা এলেই ফরসা  হাঁসের ঘন উচ্ছ্বাস মেখে  
বুনো ঘাসগুলো ফুসমন্তরে আকাশ ওড়ায় কত
ঢালতলোয়ার মেঘে-মেঘে বাজে। ধুলোর চাতাল ঢেকে
বৃষ্টিরা নাচে। হাসে। কাঁদে। গায়। গলা সাধে। কেউ-কেউ কৌতুক করে
অল্প আলাপে বিষয়বস্তুবিহীন গল্প ঝরে।  
হোক-না আলাপ যেমন-তেমন। টিনের চালাতে বাহাদুরি যত শত  
মিষ্টি সে-তালে পাতাগুলো হয় কাকভেজা অবিরত।  
সকল সত্তা ছাপিয়ে শ্রাবণী বাচালতা বেজে ওঠে
যার যেমনটি ইচ্ছে তেমন করেই কদম লাবণ্যে এসে জোটে।      
কালো জল বাড়ে। কালো জলজুড়ে ঝাঁক বেঁধে পাতা চড়ে
নিতল নদীর চিতলের চোখে নীরব-নীরব অধীরতা ভর করে।
অধীর বর্ষা ঘুরেঘুরে আসে গহীনা গাঁয়ের মেঠো ঘাটখানা বেয়ে
বর্ষা হাঁটছে মাঠমহলের সবুজের হাট ছেয়ে।  
বলতে-বলতে কোথায় হারাল লগ্নের অন্দরে
বাদল-কাঙাল বাঙময় কোন চালতার-চরাচরে?  
এমন করেই রোদহাওয়া বেয়ে উবে যায় ওই মেয়ে
উবে যায় দূরে। নদীর ওপারে হয়ে যায় এক তিল  
ওখানে জীবন ভীষণ রঙিন! খুব বুঝি ঝিলমিল?
বুঝি রাতভর ডোল ডাহুকের ডাক  
স্বপ্ন দেখায় – এই জীবনটা জীবনের মতো থাক?  

দুই।।
এপারে রয়েছে প’ড়ে ধনেশের ক’খানা পালক আর
নতুন চরের অদম্য চোরা টান।
এই তো বয়সী বঁইচির বীজ ফুঁড়ে জেগে ওঠে ব্যাকুলতা বারবার
ছপাতছপাত বৈঠার বুনো গান
গান আর গীত। গীত আর গান। লাল নীলে বর্ণিল
শঙ্খের ধ্বনি হয়ে মাতে বিলে অবিরাম অনাবিল।
ভাবলেই ভালো লাগে –  
এখানে কেউ তো এসেছিল ঠিক হাজার বছর আগে
বাসা বেঁধেছিল অমোঘ আশায় ভালবাসা-অনুরাগে
সেই ভালবাসা ফুরোয় নি আজো। ঝুম সজনের জৌলুসে রোজ জাগে।
সজনের ফুল উড়ছে। খেলছে। মেলছে রঙের ঝাড়    
দুলছে ঝোপের খোপখোপ খোপা। কী দারুণ আলো-আঁধারির সংসার।
স্বর্ণলতার মায়ামায়া স্নেহে বোতাম পোকারা গড়ে খায় লুটোপুটি    
স্নেহমমতায় নিকিয়ে নিয়েছে চোখের সকল চাওয়া
কখনো ভোলে নি ফাগুনের চলে যাওয়া।
কিছু কিছু ভুল করা ভালো। তাই বুঝি  
যতখানি চাওয়া তার চেয়ে বেশি খুঁজি?  
করেছিলে ভুল এক কুড়ি ফুল শিমুলের মতো ক’রে
হরিণ ডাঙার পাড়ে এলে ফিরে। নানান ছন্দে আনন্দধারা ওড়ে  
জংলা রৌদ্র জাপটে ধরেছে লাল মোরগের ঝুঁটি
হলুদ ফিতেরা পড়ে আছে আলে। দখিনের ময়দানে
পথের শরীর ক্লান্তশ্রান্ত। হাঁটিহাঁটি করে পাড়ি দেয় কোনখানে?
বনানীর বাঁকে বড়ো উন্মুখ জীবনের জয়গানে।


তিন।।
এ পাড়ে ও পাড়ে দুপুরে রোদের ফসল ফলায় রঙচঙে মাছরাঙা
ছিপ নৌকার পালের মতন উজানি প্রতিটি বেলা
শামুকের বুকে সুখ তুলে রাখে। বেলা-অবেলায় মেলা
শালিকের ঝাঁক জলকবুতর ঝলমলে কাচরাঙা
বকুলের ঘ্রাণে অফুরান প্রাণে বাঁচে।
বকুলগুলোও বকদের মতো নদীর স্বপ্ন দেখে
পদ্মপাতার পদ্যখাতায়  নদী জলরঙে চিত্রল লিপি লেখে।  
একটি ফড়িঙ লাউমাচাটার কাছে  
প্রফুল্ল লয়ে পাখা মেলে বলে, ‘শোনো, আছে। আরও আছে
শিশিরের নুড়ি। পুলিন পুকুর। পুকুরের পাড় ধ’রে কেঁদো পুস্তানি
ক্ষণে জ্বলে-ওঠা ঝিঙের জাংলাখানি।
আছে ভালো-থাকা জোছনার কিশলয়ে
আকুল সময়-সোঁতায় পলকে কিশলয় যায় ক্ষয়ে।
আদিম ছাতিমতলে
ধুলোর দ্রাঘিমা বেয়ে অদ্ভুত ভালোলাগাগুলো হরদম হেঁটে চলে
এতটুকু দূরে গেলেই উতালা উদ্দাম এক ঘোর
প্রাণপণে কাছে টানে
সকাল-সন্ধে হৃদয়-উঠানে জেগে থাকে রাঙা ভোর  
এখানে আমরা ঝিনুকের মতো ক’রে জেনে নেই এক জীবনের মানে।‘