প্রিয় সুচি
আপনাকে দেখতাম, সৌম্যদর্শন কান্তিময়ী মুখ টেলিভিশন বা
পত্রপত্রিকা; যখন যেখানেই-
বুকের ভিতর সবসময় দিন বদলের স্বপ্ন ও আশার সঞ্চার হতো
এই মানুষ পৃথিবী ও জীবনের প্রতি বড় ভালবাসা অনুভূত হতো
আপনার সেই কোমলতা ভরা নিটোল সহাস্য মুখ
হাত নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলা সাংবাদিক পরিবেষ্টনে
শান্ত দৃপ্ত সদা উচ্চকিত কণ্ঠস্বর
অকুতোভয় জ্বলজ্বলে দুটো সুগভীর চোখ
নিটোল মুগ্ধতায় ভরে দিয়ে গেছে মন বারবার।
গণতন্ত্রের জন্য
শোষিত বঞ্চিত ভাগ্যাহত মানুষের মুক্তির জন্য
আপনার জীবনব্যাপী নির্ভীক আপোষহীন সংগ্রাম
ও লক্ষ্য অর্জনের তরে ধনুক-ভাঙ্গা পণ
আপনার ত্যাগ
বর্বর সামরিক জান্তার শত নির্মম অত্যাচার নিপীড়নেও অক্লেদে
বীরদর্পে এগিয়ে চলা আগুন ঝরা পথের 'পরে-মাথা উঁচিয়ে-
সবই তো ছিল জ্বলজ্বলে উত্তম দৃষ্টান্ত এই পৃথিবীর বুকে
একজন আদর্শ নেতার।
আপনি জীবদ্দশাতেই হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তী
আপনাকে দেখলে সতত প্রাণ ভরে উঠতো
উদ্বুদ্ধ হতাম, অনুপ্রাণিত হতাম- এই মাটি ও  মানুষের জন্য
নিজেকে অকাতরে নিঃশর্তে বিলিয়ে দেবার  
আমাদের এখানেও যে অনেক অন্যায়-অবিচার প্রিয় সুচি
এখানেও গণতন্ত্র নেই মানুষের, মুক্তিও সুদূর পরাহত
কুকুরের অদৃশ্য ভৌতিক লাগাম গলায় আমরা বেঁচে আছি
অদৃশ্য সেই লাগাম অজ্ঞাত কারও হাতে
আমরা এগোতে চাইলেও এগোতে পারি না
সেই অদৃশ্য লাগামের অকস্মাৎ টানে বারবার শুধু থমকে যাই
মুখ থুবড়ে পরি!


অং সান সুচি- কী গর্বিত একটি নাম হয়ে উঠেছিল পৃথিবীজুড়ে  
শোনামাত্রই বুকের ভিতর দপদপ করে জ্বলে উঠতো আগুন;
প্রেরণা পেতাম তাবৎ প্রতিকূলতার মাঝেও লড়াই করে বাঁচার
এক নতুন-আলোকিত দিনের প্রত্যাশায়।
আপনি গণতন্ত্র ও মানব মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন,
মায়ানমার শুধু নয়, সারা পৃথিবীরই।  
মনের কোণে অহর্নিশি এক আক্ষেপ পুষে রেখেছিলাম যে,
আমাদের এখানে একজন সুচি নেই- এই  দুর্ভাগা দেশে;
আমাদের একজন সুচি'র বড্ড প্রয়োজন।
চে গুয়েভারা, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  
আমি তাদের দেখিনি- পড়ে জেনেছি
বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য
তারা অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন নিজেদের
কণ্টকাকীর্ণ, ভীষণ দুর্গম পথে জীবন যৌবন বাজি রেখে
তারা হেটে গেছেন নির্ভয়ে, অকপটচিত্তে;
শত বাধা বিপত্তি ঝর ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে
তারা পৌঁছেছিলেন অভীষ্ট লক্ষ্যে।
অবশেষে তাদের হাতে ধরেই এসেছিল মুক্তি মানুষের
রক্ত ও দগদগে ক্ষত নিয়ে তারাই হেসেছিল বিজয়ীর হাসি;
মুক্তি এসেছিল
দিন বদলেছিল
অভিশাপমুক্ত হয়েছিল এই পৃথিবী ও সভ্যতা।
সে সব ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখে-সযত্নে সংরক্ষিত করে
রেখেছি আমরা, ছড়িয়ে দিয়েছি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
সে সব ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবেও চিরদিন।
জানি, পথ-লক্ষ্য-সময় ভিন্ন কিন্তু তবু আপনাকে দেখলে
আমার মনে পড়ে যেত সেই মহামানবদের;
একজন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা
মহাত্মা গান্ধী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান;
আপনাকে ভাবতাম, সেইসব মহান অগ্নি পুরুষদেরই উত্তরসূরি...


কিন্তু সুচি, আজ একী দেখতে পাই আপনার মায়ানমারে-
নাফ নদী আজ ভেসে গেছে কাদের তাজা লাল রক্তে
এই রক্ত কাদের সুচি
কাদের আর্তনাদ দূর থেকে ভেসে আসে থেকে থেকে;
প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে স্রোতের মতো সার বেধে
ছুটে আসছে অগণন অসহায় মানুষ
আবাল বৃদ্ধ বনিতা, ক্রন্দনরত উলঙ্গ শিশু
লাঠি হাতে থুকথুকে বুড়ো বুড়ি
রূগ্ণ শীর্ণ ফ্যাকাসে রক্তশূন্য ভয়ার্ত মুখ সকলের
সেখানে আমি দেখেছি অনেক সঙ্গী সাথীহীন অবুঝ শিশুও
ছোট ছোট ত্রস্ত পা'য়ে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে ওরা প্রাণ নিয়ে-
একা।
ওরা জানে না ওদের পিতামাতা বা স্বজনদের কোনও খবর
ওরা এতো ছোট যে, ওদের কোনও প্রশ্নও করা যায় না
শুধু ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে চেয়ে থাকে ভয়ার্ত চোখে।
মৃত্যু ভয়ে ভীত ওদের সেই কোটরাগত চোখগুলো...
ওহ সুচি, আমি দেখেছি মৃত্যু ভয়ে ভীত সেই চোখগুলো!
আপনি জানেন না, আমার এই হৃদয়কে কাঁচের মতো
ভেঙ্গেচুরে গুড়ো গুড়ো করে দেয় ওরা
আর আমি বারবার শুধু গা'য়ে চিমটি কেটে দেখি
খামচি দেই নিজেই নিজের শরীরে
ভাবি, আমি নির্ঘাত একটি দুঃস্বপ্ন দেখছি
সব কেবলই একটি দুঃস্বপ্ন
ঘুম ভাঙলেই আবার সব ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে
কিন্তু আমি যে শরীরে তবু ব্যথা পাই সুচি-
আমি কেন ব্যথা পাই!


প্রিয় সুচি
আপনি বলুন এ সব সত্য নয়
আমি নির্ঘাত ঘুমের মাঝে বীভৎস কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি
সব দুঃস্বপ্ন
এই বারবার গা'য়ে চিমটি কেটে ব্যথা পাওয়াটাও সে দুঃস্বপ্নেই;
হ্যা দুঃস্বপ্নই- সব দুঃস্বপ্ন
নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন
আমি নিশ্চিত, আমি এখন একটি দুঃস্বপ্নের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি
আমি আসলে ঘুমিয়েই আছি
এর কোনটাই সত্য নয়
এ সব সত্য হতে পারে না
কিন্তু আমি শুধু জানি না- আমি কি করে নিশ্চিত হতে পারি,
কারণ আমি যতবার গা'য়ে চিমটি কাটি, খামচি দেই
আমি যে তবু ব্যথা পাই সুচি-
কেন!
আমি তো শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটি দুঃস্বপ্ন দেখছি মাত্র!
আপনি বলুন সুচি, বলুন, আমি কি করে নিশ্চিত হতে পারি
আমি যা দেখছি তা একবিন্দুও সত্য নয়
সব কেবলই একটি দুঃস্বপ্ন
ঘুম ভাঙলেই আবার সব ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে?
ইরাবতী নদীর স্নিগ্ধতা ধারণ করা সেই প্রিয়দর্শিনী
কান্তিময়ী মেয়েটির দেশে
বিপন্ন মানবতার এই মর্মন্তুদ করুণ আর্তনাদ...
না না না- এ সত্য নয়
আমি নির্ঘাত একটি দুঃস্বপ্ন দেখছি
আমি আসলে এখনও ঘুমিয়ে আছি
আমি জানি- এ সত্য নয়
এ সত্য হতে পারে না
আপনি বলুন সুচি
আপনি বলুন- এ সব কেবলই আমার একটি দুঃস্বপ্ন
আপনি আর চুপ করে থাকবেন না প্রিয় সুচি
দোহাই আপনার
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আজ ক্ষত বিক্ষত হয়ে চলেছে আমার হৃদয়
আমার বুকের ভিতর দারুণ দহন
দয়া করে আর চুপ করে থাকবেন না প্রিয় সুচি
আমার এ দুঃস্বপ্নে, এ নষ্ট ঘুমো ঘোরে এসে একবার,
শুধু একবার আপনি বলুন যে, এ সবই মিথ্যে
আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেবল একটি দুঃস্বপ্ন দেখছি মাত্র
আর কিছু নয়
আপনি বলুন সুচি, আপনি আর চুপ করে থাকবেন না
দোহাই আপনার
আমি যে এই নরক যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না,
আমি আর পারছি না...
আমাকে মুক্তি দিন এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে
আমি করজোড়ে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়েছি, আপনার পা'য়ে
আপনিই আমার ঈশ্বর সুচি
আপনিই এই পৃথিবীর ত্রাণকর্ত্রা
কেবল আপনিই আমাকে মুক্তি দিতে পারেন-
এই বীভৎস নরক যন্ত্রণা থেকে
আমার হৃদয় প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত হয়ে চলেছে-
উফ কী অসহ্য-অসহ্য এই যন্ত্রণা!
আমাকে আপনি মুক্তি দিন সুচি
মুক্তি দিন;
আপনি একবার- শুধু একবার বলুন সব মিথ্যে
সব কেবলই আমার একটি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন
আমি আসলে এখনও ঘুমিয়ে আছি
ঘুম ভাঙলেই আবার সব ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে
আপনি বলুন সুচি...