‘‘কথাগুলো বিশ্বাস করতে বলছ?
কি আশ্চর্য তোমার অনুভব শক্তি!’’
এ কথায় তোমার ভেতরে জেগে ওঠেনি কোন সংশয়, জিজ্ঞাসা?


এইতো সেদিন এক রোদেলা দুপুরে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে, চিরাচরিত
চটের ব্যাগটা একাঁধ থেকে ওকাঁধে নিতে নিতে বললো,‘‘জানিস, আজকাল
একদম ভাল লাগে না, অর্থহীনতা, সংসদ থেকে একদম অন্ধগলি পর্যন্ত
নিদারুণ গড়াগড়ি খাচ্ছে, সর্বত্র। দারুণ শ্বাসকষ্ট।’’
তারপর একচিলতে ম্লান হাসিতে  ‍দু’এক ক্ষণের জন্য
উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুখটা, বিমর্ষতা আক্রান্ত হৃদয়ের ভেজা হাসি যেন।
ওই মুখে কর্মহীনতার যন্ত্রণা থাকতে পারে,
এটুকু মেনে নেয়া যায়, কিন্তু এর অধিক?
স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না।


টাউন সার্ভিসে বাদুর ঝোলা হয়ে ঝুলতে ঝুলতে যাবার সময় বলছিল
‘‘সারাটা জীবন যদি এরকম কাটাতে হয় তাহলে কী করবি, বলতো?’’
এ রকম অবস্থায় কথা বলা যায় না, কিন্তু রুদ্রের কথার পিঠে
বলার মত কথা আপনাতেই চলে আসে, বলতে হয়।
উত্তপ্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,
‘‘জীবনের বড় প্রাপ্তিটা থাকে সরলতার মধ্যে, ধনে জনে বৈভবের ভারে
পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে অনড় থাকার চেয়ে লড়াই করে এ বাঁচায়
স্নিগ্ধতার মতো আনন্দ আছে।
অামি চাই ব্যক্তির ভেতরের নিরবতা, সহনশীল নিরবতা, সৃজনশীল নিরবতা,
আর বাইরে দুরন্ত চঞ্চল গতি, ছুটে চলা।’’
রুদ্রর কন্ঠটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলেও শীতলতা ছিল না, বাসের হর্ণের সাথে
কন্ঠ মিলিয়ে আর্তনাদের মতো যেটুকু ধ্বনি বাতাসে ভাসছিল,
‘‘জীবন মনে হয় এবার সার্থকতা খুঁজে পাবে।’’
আমি বললাম ‘’ এ সার্থকতা প্রকৃত অর্থে সার্থকতা নয়, শিশির বিন্দুর মতো
সুন্দর অস্থায়ীত্ব।’’
রুদ্র বললো,‘‘এতো আমার কথার প্রতিধ্বনি।’’
আমি বললাম ‘’ঠিক তাই। এ অস্থায়ীত্ব চিরকালের, সময় বদলাবে, অবস্থা বদলাবে না’’
সে বললো,‘‘ তুই তা মানছিস? এক সূর্যের আলোতে মুখ লুকাবে, অস্তিত্ব হারাবে;
সূর্য হারালে শিশিরের পুনরুজ্জীবন, লুকোচুরি খেলা’’
ওটা ছিল আমাদের শেষ কথোপকথন।তারপর দু’জনে দু’জনার দিগন্তে সুপর্ণ।
এ তো তোমার সংবাদের পূর্বাভাস দেয়নি।


ওটা ছিল রুদ্রের সঞ্জীবনী বার্তা, আহতের চীৎকার নয়। আজ কাল পাত্রে দেখছি
সে কথাই সত্য হতে চলেছে, রাতের আঁধারে এখনো জমছে শিশির।
রুদ্র আমাদের ভিতরে আছেই। এ রুদ্র কখনো হারায় না।
বন্ধু তুমি কখনো হারাতে পারো না।
কারণ, এখনো কিষাণ শস্য ফলায় অফুরান, কিন্তু গোলা ভরে না, প্রচেষ্টা প্রাপ্তিহীন;
এখনো মানুষ ভাসে সাগরে, উত্তাল জলরাশির তান্ডবের সাথে
মানুষ-রূপী শত শত হাঙ্গরের পেটের ভিতর খাদ্য-পানি-ভূখন্ড হীন;
এখনো পৃথিবী পায়নি আসল আদল,
এখনো পৃথিবী হয়নি‘‘আল্‌ হীন একখন্ড মানব-জমিন’’।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//০২.০৭.১৯৯১. ধানমন্ডী ১৫ নং//ঢাকার জীবন


[প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ স্মরণে। পরলোক গমন ২১ জুন ১৯৯২। ]
[আজও পায় না কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য, আজও যখন সাগরে ভাসে মানুষ ভূখন্ডহীন।]