বাংলা ভাষায় এমনিতেই ঝোক বিশিষ্ট শব্দ কম।ইংরেজি বাক্যের মত তার এত ঘাত-প্রতিঘাত নেই-যা শুনামাত্র পাঠকের মনে বিক্ষেপ সৃষ্টি করতে পারে।তাই ছন্দ ও সুরকে আশ্রয় করে প্রাচীন-মধ্য ও রবীন্দ্রযুগ পর্যন্ত কবিগণ পুষিয়ে নিলেন ভাষায় ঘাত-প্রতিঘাতের এই অভাব।কিন্তু তিরিশের দশক থেকে যখন গদ্যছন্দ প্রাধাণ্য বিস্তার করলো,তখন কবিতার ভাষা হয়ে ওঠলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মসৃণ ও সমতল।তাই চিত্রকল্প ও উপমার সার্থক প্রয়োগে তারা কবিতাকে করে তুলতে চাইলেন রূপ-কল্পনায় দৃষ্টিগ্রাহ্য ও চিত্তাকর্ষক।জীবনানন্দ এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল।কবিতায় বিচিত্র তরঙ্গের পরিবর্তে প্রাধাণ্য পেল একই ধরনের তরঙ্গের টানা বিস্তার,শব্দের পরতে পরতে সৃষ্টি হল ঘোর ও রহস্যের।


পক্ষান্তরে কেউ কেউ ছন্দ-সুরের প্রাথমিক ধারণা না রেখেই-চিত্রকল্প উপমার খাপছাড়া বল্গাহরিণ চালিয়ে,সামঞ্জস্যহীন শব্দসমবায়ের নির্বোধ কুন্ডলী পাঁকানোয় ব্যাপৃত হলেন।পাঠকের বোধে বেশিরভাগ সময়েই যা নাড়া দিতে ব্যর্থ হল।কেউ কেউ বাজিমাত করার জন্য,নিজের চমতকারিত্ব প্রকাশের জন্য নিলেন নান্দনিক কৃত্রিমতার আশ্রয়।কঠিন কঠিন শব্দের সংযোগহীন ব্যবহারে কবিতাকে করে তোললেন বাগজাল সর্বস্ব।ফলে অভিযোগ ওঠলো দুর্বোধ্যতার,কবিতাও হারালো তার কাঙ্ক্ষিত পাঠকপ্রিয়তা।তবে এসবের ভেতর দিয়েই কেউ কেউ এগিয়ে যাচ্ছেন তাদের গন্তব্যের দিকে,যাদের হাত ধরেই প্রত্যাশিত মোড় নেবে সাম্প্রতিক কবিতা ও তার পরিমণ্ডল।


******


ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চা খুব বেশি দিনের নয়।মোটামুটিভাবে  আঠারশো শতক থেকে ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ইতিহাস চর্চা শুরু হয়।ভারতীয়রা ইতিহাস বোধ বর্জিত জাতি--এ কথা বলে ব্রিটিশরা আমাদের টিপ্পনি দিতেও ছাড়েনি।লুঠ করতে এসে ব্রিটিশরা কেন এদেশের ইতিহাস চর্চায় মন দিলেন তা প্রাথমিক চিন্তায় বোধগম্য ব্যাপার নাও মনে হতে পারে।মূলত ব্রিটিশরা বুঝেছিল এ দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে,বিপুল ভূভাগকে শুধু শক্তি প্রয়োগে শাসন করা সম্ভব নয়।তাই তারা এদেশের মানুষের  সংস্কৃতি,ঐতিহ্য,খাদ্যাভ্যাস,ভাষা,লিপি,প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদির ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ আবিষ্কারে মন দেয়।একদিকে তারা খ্রিষ্টান মিশনারির পত্তন ও এদেশীয় নারীদের বিয়ে না করার আইন করে নিজেদের স্বাতন্ত্র‍ ধরে রাখায় মনোযোগী হয় অন্যদিকে সমাজের কোন কোন নিয়ামকের উপর প্রভাব বিস্তার করে,কোন কোন অংশের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে এদেশকে নির্জলভাবে শাসন করা যাবে তা জানতে অধিক হারে সংস্কৃতি চর্চায় আত্মনিয়োগ করে।


প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায় অনেক তথ্য সাহায্য করলেও ইতিহাসের পযায়ক্রমিক বিভাগের মাঝে যে বিস্তর অন্ধকার অংশ রয়ে গেছে তা উদ্ধার করার কোন উপায় আজ আর নেই।এদেশে প্রচুর নদ-নদীর উপস্থিতি ও তার গতি পরিবর্তন,উর্বর মাটির উপরিভাগে নানা রূপান্তর ইত্যাদি কারণে প্রাচীন সমাজের জীবনযাত্রা আবিষ্কারের ঐতিহাসিক উপাদান এখানে খুব কম পাওয়া যায়।তাছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ধর্ম সনাতন ধর্মানুযায়ী মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয়া হয় বলে প্রাচীন ভারতের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা,প্রাচীন অধিবাসীদের অলংকার খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সম্পর্কেও তেমন গবেষণার উপকরণ পাওয়া যায় না।নানা ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে চাপা পড়া অল্প কিছু কঙ্কালের আবিষ্কারই এখন ভারতীয় নৃবিজ্ঞান চর্চার একমাত্র উপকরণ হয়ে আছে।বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত বিভিন্ন রাজার তাম্রশাসন,পাথরের উপর খোদাই করা প্রশস্তি,ধর্মীয় শ্লোক,মুদ্রা,মুদ্রার উপর অঙ্কিত চিত্র এসবের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকগণ তাদের ইতিহাস চর্চার নানা দিককে আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন।খ্রীস্টপূর্ব পনেরশো সাল থেকে খ্রীস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে লেখা বেদ,মহাভারত,গীতা প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের আলোকে ঐতিহাসিকগণ প্রাচীন ভারতের কিছু ঐতিহাসিক বিষয়কে নির্দেষ করেছেন।বিভিন্ন ভাষায় রচিত প্রাচীন সাহিত্য যেমন--কালিদাসের মেঘদূত,অভিজ্ঞান সকুন্তলম,বাৎস্যায়নের কামসূত্র,বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ,মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন,মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি থেকেও সেই সময়ের সমাজজীবন সম্পর্কে আংশিক পরিচয় পাওয়া গেছে।এইসব সাহিত্য থেকে সেই সময়ের মানুষের পেশা,পোশাক-পরিচ্ছদ,জীবনের সংকট,দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি আমরা জেনেছি।সাহিত্যে জীবনের প্রকৃত রূপ প্রতিফলিত না হলেও কবির কল্পনা ও অনুভূতি সেই সমাজ ও মানুষের সম্মিলিত দানেই পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে।


তাছাড়া গ্রীক,চীনা ও অল্পকিছু ইউরোপীয় পর্যটকগণ তাদের নিজস্ব ভাষায় নানা সময়ে এদেশ ভ্রমণের যেসব বর্ণনা দিয়েছেন,কোন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছাড়াই ইতিহাসের সেসব উপাদান গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।ইতিহাসের উপাদানে এত দুষ্প্রাপ্যতার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন যুগ আমাদের কাছে আরও সুপ্রাচীন মনে হয়।একারণে আজ থেকে এক হাজার বছর আগের কোন বাঙালীর জীবনযাত্রা বা দিনলিপির কোন উপাদান পাওয়া গেলে,তাদের ব্যবহার্য কোন তৈজসপত্র বা হাতিয়ারের সন্ধান পাওয়া গেলে অতি কৌতূহলে আমরা নড়েচড়ে বসি।দৃষ্টির মাঝে অসংখ্য বাধা থাকার কারণে এক হাজার বছর আগের এই মানুষদের আমাদের কাছে যেন খ্রীষ্টপূর্ব যুগের সক্রেটিস,প্লেটোর চেয়েও প্রাচীন মনে হয়!


ইংরেজদের হাত ধরেই আমরা প্রথম ইতিহাস চর্চার বিস্তৃত ধারায় প্রবেশ করি।ইংরেজ অফিসার ও বণিকদের বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য তারা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করে।বাংলা ভাষার আধো আধো বোলের প্রথম লিপিবদ্ধ বইগুলো প্রথম তারাই প্রকাশ করে।তারা প্রাচীন বিষয়ের গবেষণার জন্য ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে তোলে।এভাবে তারা ভূমি ব্যবস্থা,প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার,ধর্মীয় নিদর্শন উদঘাটন,প্রাচীন সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে এদেশীয় তুলনামূলক অগ্রগামী শিক্ষিত সমাজে নিজেদের শাসক হিসেবে টিকে থাকার যোগ্যতা উপস্থাপন করে।উদ্দেশ্য যাই হোক তাদের এই চেষ্টাকে কৃতিত্ব না দিয়ে উপায় নেই।


হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নামক প্রায় ৫ হাজার বছর আগের ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতা তাদেরই আবিষ্কার।এই আবিষ্কারে ভারতীয়বাসী চরম রোমাঞ্চ অনুভব করে।আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগেও তাদের পূর্বপুরুষ এরকম একটি সুশৃঙখল নগর সভ্যতার পত্তন করেছিল এই কল্পনা তাদের মনে বিশেষ গর্ব তৈরী করে।মধ্যপ্রাচ্য,ইউরোপ বা চীনের সভ্যতার চেয়ে ভারতীয় সভ্যতা যে কম প্রাচীন কিছু নয়, তা জেনে পরাধীনতার মাঝেও,দারিদ্র‍্যের মাঝেও তারা পৌরুষদীপ্ত এক আনন্দ লাভ করে।অথচ হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর লিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি,সম্ভব হলে  আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ না হোক অন্তত এই দেশের পূর্ব বাসিন্দাদের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম।ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর কোন ভারতীয় বা পাকিস্তানি সে চেষ্টা অল্পই করেছে,সরকারীভাবেও এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেয়া হয়নি।অন্যদিকে বাংলাদেশের তো এসব বিষয়ে মাথা খাটাবার প্রশ্নই আসে না।বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন পূর্ববর্তী ঘটনাকে  ইতিহাস চর্চা থেকে এক প্রকার ছাটাই করে দিয়েছে।এই কারণে ইংরেজ বিতারণে ব্রিটিশ আমলে বাংলার প্রচুর অবদান থাকা সত্ত্বেও ইংরেজ বিতারণ নিয়ে কোন আচার-অনুষ্ঠান আমরা করি না।তা করতে গেলে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে নতুন কোন বিতর্কের জন্ম দেয় কিনা--তাই এই সতর্কতা।অথচ ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনও যে আমাদের স্বাধীনতার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এ কথা তো মিথ্যে নয়।মাস্টারদা সূর্যসেন,প্রীতিলতা,ক্ষুদিরাম এসব স্মরণীয় মহামানবদের নাম কৈশোরকালীন পাঠ্যপুস্তকে অল্পবিস্তর পাওয়া গেলেও আমাদের সংস্কৃতি চর্চায়,রাজনৈতিক আলোচনায়,বক্তৃতা,টকশো কোথাও তাদের নাম নেওয়া হয় না।শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক,সোহরাওয়ার্দী,মাওলানা ভাসানী বাঙালীর এসব মহান সন্তানদের আমরা খুব সচেতনভাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি।ফলে ক্রমেই আমরা ইতিহাস জ্ঞানহীন এক ফাঁপা প্রজন্মের কাছে আমাদের ভবিষ্যতকে ছেড়ে দেয়ার পথ প্রশস্ত করছি।বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসের পার্থক্য নির্ণয় করতে  আত্ম--অচেনা এই প্রজন্মকে কোনদিন যদি জ্যোতিষীর কাছে যেতে হয় অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।


কিছু সমদ্রবন্দর,ব্যবসায়িক কেন্দ্র,জমিদার বা রাজবাড়ি ছাড়া প্রাচীন ভারতের বিস্তীর্ণ জনগণের আবাসন ব্যবস্থা ছিল মূলত প্রকৃতি নির্ভর।হাতের কাছে পাওয়া গোলপাতা,বাঁশ,শন,খড় ইত্যাদি দিয়েই তারা মূলত ঘরবাড়ি তৈরী করত।মেঝে থাকতো মাটির।আবার কোন কোন অঞ্চলে সমস্ত ঘরটাই মাটি দিয়ে তৈরি হত।এখনও গ্রামাঞ্চলে গৃহ নির্মাণের এই ধারা চোখে পড়ে।আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।তার মানে ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অংশ দীর্ঘকাল যাবত সামাজিক বিবর্তনের এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছিল।ঘড়বাড়ি এরকম পঁচনশীল উপাদানে তৈরী ছিল বলে সেই সময়ের স্মৃতিচিহ্ন ইতিহাসবিদদের অল্পই সাহায্য করেছে।প্রথম দিকে ভারতীয় জন-জীবনের প্রধান কাজ ছিল পশুপালন।ফলে পশু ও নিজেদের খাদ্যের সন্ধানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তারা যাতায়াত করতো।কোথাও স্থায়ী আবাসন গড়তো না।পরবর্তীতে কৃষিতে মনোযোগী হওয়ার পরও অতিরিক্ত রাজস্বের ভারে প্রায়ই তারা এক এলাকা থেকে পালিয়ে আরেক রাজার অধীনে চলে যেত।তাছাড়া তারা চাষবাসে খুব সীমিত ধরনের ধাতুর তৈরী হাতিয়ার ব্যবহার করতো।সময়ের ব্যবধানে সেসবে অল্পই ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।তাদের পানপাত্র,নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য উপাদান বেশির ভাগই কাঠ দিয়ে অথবা মাটি পুড়িয়ে তৈরী করা হত।ফলে আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের জীবন-যাপন আবিষ্কারের সূত্রের ব্যাপারে আমাদের মোটামুটি অন্ধকারেই রেখে গেছেন।


তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বলতে আমরা যা জানি তা মূলত রাজ-রাজাদের উত্থান পতনের কাহিনী।এক রাজার পরে আরেক রাজা এল,এক বংশের পর আরেক বংশ সাম্রাজ্য গড়লো কিন্তু তাতে সামাজিক জীবনে কোন অংশে কী পরিবর্তন এল সেসব আমাদের বেশি জানা নেই।প্রাচীন ভারতের সামাজিক ইতিহাস বিষয়ে প্রথম বিস্তৃত আলোকপাত করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায় তার 'বাঙালীর ইতিহাস--আদিপর্ব' গ্রন্থে।প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়,এই বইটি তিনি নির্মাণ করেছেন মূলত নানা ঘটনা ও উপকরণের পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ইতিহাস সম্মত যুক্তির উপর ভিত্তি করে।নানা উপকরণের সীমাবদ্ধতার কারণে তার পক্ষেও প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবন স্পষ্টভাবে অঙ্কন করা সম্ভব হয়নি।তবে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন এবং পরবর্তীকালের গবেষকদের জন্য  নতুন নতুন  গলিপথের সন্ধান দিয়ে গেছেন।কিন্তু সেই গলেপথে আলো হাতে নিয়ে অগ্রসর হবে সেই নতুন ঐতিহাসিকের আজ বড় অভাব।


ভারতীয় ইতিহাস চর্চার আরেকটি বাধা হল এর টেকনিক,যা শিখেছি আমরা ইউরোপীয়দের কাছে।তারা তাদের টেকনিক আবিষ্কার করেছে তাদের দেশের আবহাওয়া ও ঐতিহাসিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে।ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের ঐতিহ্যগত উপাদানে একই পদ্ধতি সমান ফল দেবে না--এটা সহজেই বোঝা যায়।আবার ইতিহাস চর্চায় নিজস্ব পদ্ধতি অর্জনের জন্য যে উদ্যোগ থাকা দরকার,কতিপয় আত্মত্যাগীর যে নিরলস পরিশ্রম দরকার তারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে আমাদের।শুধু ইতিহাস চর্চা কেন সামান্য সুঁই থেকে শুরু করে কল-কারখানার যন্ত্রপাতি সবকিছুইতেই তো আমরা একান্ত ও নির্লজ্জভাবে পাশ্চাত্য নির্ভর হয়ে বেঁচে আছি।


ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবর্তন না জানার কারণেই মূলত ভারতীয়রা নিজেদের ঐক্যের সূত্র আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়।নানা জাতি,নানা ভাষার এক জটিল সহাবস্থান তাদের ঐক্যসূত্র নির্ণয়ে বিরাট দেয়াল হয়ে দেখা দেয়।তাই শেষ পর্যন্ত ধর্মকে আশ্র‍য় করে প্রাচীন এই ভূখন্ড নিজেদের পরিচয় খুঁজতে থাকে এবং তার ফলশ্রুতিতে সাতচল্লিশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রসব করে।শেষ পর্যন্ত ধর্মের এই আরোপিত ঐক্য তাদের ধরে রাখতে পারেনি।পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ভারতের নানা রাজ্যের বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন স্পষ্টভাবে তাই প্রমাণ করে।


//ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চার ধারা ও প্রতিবন্ধকতা//


*********


প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প ও সাহিত্যমঞ্চের বাইরে লোকশিল্প এক বিরাট অধ্যায়। বলা যেতে পারে লোকশিল্প মানুষের  একমাত্র অকৃত্রিম শিল্প। এটা শিল্পের জন্য শিল্প নয়,জীবনের সতঃস্ফূর্ত উৎসারণই এর মূল।প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীরা যেরকম খাতা-কলম নিয়ে তাদের শিল্প সৃষ্টিতে নিয়োজিত হন,লোকশিল্পের শিল্পীদের ক্ষেত্রে তা হয় না।ফলে শিল্প-সাহিত্যের কাঠামো,শব্দভারসাম্য,আদর্শ ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন না থেকেই তারা শুধুমাত্র তাদের প্রাণের কথাটুকুই উচ্চারণ করেন।ফলে নন্দনতত্ত্ব ও শিল্প আদর্শের কৃত্রিমতা এড়িয়ে তা সহজেই মানুষের হৃদয়গ্রাহী হয়ে গড়ে ওঠে।প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-সাহিত্যও হৃদয়গ্রাহী হয় তবে তার এই হৃদয়গ্রাহীতা অনেক সময়ই আবিষ্কার করে নিতে হয়,কৃত্তিমতা এড়িয়ে তার অকৃত্রিমের সন্ধান করতে হয়।কিন্তু লোকশিল্পের পুরোটাই অকৃত্রিম,কেননা তা হৃদয়ের সম্পদ।লোকশিল্প কোনকালেই শিল্পের দাবি নিয়ে ভদ্র সমাজে উপস্থিত হয়নি,তার প্রয়োজনীয়তাও তার নেই।মঞ্চ, খ্যাতি,সমারোহ এসবকে বরাবরই সে অগ্রাহ্য করেছে।অগ্রাহ্য কথাটা বলাও বাতুলতা,কেননা এ ব্যাপারে সে সচেতনই নয়।জীবন ও পারিপার্শ্বিকের প্রয়োজনে তার উদ্ভব।প্রকৃতি ও জীবনের সাথে সংগ্রাম,সম্পর্ক ও বিরোধই তার শিল্পের মূল কথা। ফলে এর বাইরে তার আর কোন প্রত্যাশা নেই। অর্থাৎ শিল্প সৃষ্টিতে সে সচেতন নয়,একান্ত অন্তর্মুখী।অথচ এই লোকশিল্প আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের সূতিকাগার।লোকশিল্প,লোকআদর্শ,লোকধারণা,লোকগান, লোকাচার ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করেই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক জীবন গড়ে উঠেছে।তাই ভদ্র সমাজ লোকসংস্কৃতির স্বীকৃতি দিক বা না দিক,তার অবদানকে অবচেতনে নিজের ভেতরে সে বহন করে বেড়াচ্ছে এ কথায় কোন সন্দেহ নেই।


লোকসাহিত্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার সরলতা ও সহজবোধ্যতা।একান্তভাবে তার লোকজীবনের সাথে সম্পৃক্ত বলেই লোকসাহিত্য এত প্রাঞ্জল হয়ে সৃষ্টি হয়।লোকসাহিত্য একজনের সৃষ্টি নয়।প্রথমে তা একজনের মাধ্যমে সৃষ্টি হলেও পরবর্তীতে সমাজের মানুষের মুখে মুখে ও আচরণের ভিতর দিয়ে বিবর্তিত হয়।ফলে সবসময়ই সমাজে তার উপযোগিতা থাকে।তাই লোকসাহিত্যকে গবেষকগণ সমাজের সৃষ্টি বলে উল্লেখ করে থাকেন।তবে লালন ফকির,শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ শিল্পীদের সৃষ্টিতে লোকজ ভঙ্গি ও লোকজ উপকরণ থাকা সত্ত্বেও তাদের ব্যক্তিগত উচ্চমার্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পআদর্শের কারণে সমাজ তাদের নামকে আড়াল করতে পারে না।সমাজ সেখানে ব্যক্তির নামেই উপস্থিত হয়।


লোকশিল্পের সাথে প্রকৃতির থাকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মূলত প্রকৃতির উপর ভিত্তি করেই লোকশিল্প রূপ লাভ করে। ছড়া,প্রবাদ,লোককাহিনী,গীতিকা, লোকগান সকল ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। যেহেতু প্রকৃতি মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং জীবনের সারকথাই লোক সাহিত্যের প্রধান উপাদান,তাই প্রকৃতির সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক।ফলে একই ভাষা ও জাতীয়তা বহন করেও বিভিন্ন স্থানের লোকসাহিত্য বিভিন্ন রকম হয়। এজন্য উত্তরের ভাওয়াইয়া এর সাথে দক্ষিণের ভাটিয়ালি মেলে না,আবার মধ্যবঙ্গের গম্ভীরার সাথে পশ্চিমবঙ্গের ঝুমুর গান মেলে না।ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গানে এক ধরনের একাকিত্বের সুর পাওয়া যায়।গরুর গাড়ির চালক ও নৌকার মাঝি তাদের একাকীত্ব দূর করতেই এই ধরনের গান গেয়ে থাকেন।ভাটিয়ালি গানে নদীর বিস্তারের সাথে মিল রেখে তার প্রবহমানতার মত একটানা বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।ফলে এখানে কোন তাল সৃষ্টি হয় না শুধু একটানা আর্তনাদ ভেসে উঠে। ভাওয়াইয়া গানের ক্ষেত্রে গাড়ির চালক একাকীত্ব বোধ করলেও পথের উঁচু-নিচু ও গাড়ির নিয়ন্ত্রণ তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখে।ফলে সে একটানা সুরে মত্ত হতে পারে না।উপরন্তু পথের উঁচু-নিচু,উঠানামা তার স্বরকে প্রায়ই ধাক্কা দেয়।গবেষকগণ বলেছেন এ কারণেই ভাওয়াইয়া গানে স্থানে স্থানে 'হ' ধ্বনির সৃষ্টি হয়েছে ।পথের আকস্মিক এই উত্থান-পতনের জন্যই  ভাওয়াইয়া গানের সুর হঠাৎ করে উপরে উঠে আবার হঠাৎ করেই নিচে নেমে যায়।


লোক ছড়াগুলো মূলত শিশুদের জন্য রচিত হলেও তা বড়দেরও মনোরঞ্জন করে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশকিছু লোকছাড়া সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করে গেছেন,যা এখনও খুব জনপ্রিয়।লোকসংস্কৃতির প্রতি তিনি খুব অনুরাগী ছিলেন। লোকশিল্পী লালনকে তিনিই সর্বপ্রথম সভ্য সমাজে প্রকাশ করেন।লোকছড়ায় ভাবের কোন ধারাবাহিকতা থাকে না,তাতে শুধু শিশুমনের অবাধ কল্পনায় উৎসারিত কল্পনাচিত্র থাকে।তাই তা এত হৃদয়গ্রাহী হয়।প্রবাদ,প্রবচন,গীতিকা ইত্যাদি প্রত্যেকটি শাখা লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ শাখা।এসবের বৈশিষ্ট্য ও বিকাশ নিয়ে গবেষকগণ বিস্তারিত আলোচনা করে গেছেন।তা নিয়ে আর নতুন করে বলার কিছু নেই।আমাদের বর্তমান জীবনের উপর লোকসাহিত্যের কি প্রভাব ও লোকসংস্কৃতি কী কারনে আজ ধ্বংসের প্রান্তে তাই আমার আলোচনার বিষয়।


লোকসংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মধ্যযুগের সাহিত্যে।মধ্যযুগের আদি নিদর্শন 'শ্রীকৃষ্ণকর্তীন' এ রাধাকৃষ্ণ বিষয়ে শাস্ত্রীয় মতামতকে অনুসরণ করা হয়নি।হিন্দুশাস্ত্র যেখানে রাধাকৃষ্ণের অপঙ্কিল প্রেমকাহিনীর কথা বলছে এই কাব্যে সেখানে কৃষ্ণকে মানবীয় পঙ্কিল গুণসম্পন্ন করে উপস্থাপিত করা হয়েছে।শাস্ত্রমতে রাধার বয়স যখন দশ অথবা এগার তখন কৃষ্ণ মথুরায় চলে যান এবং রাধার সাথে তার আর কোনদিন দেখা হয়নি।তাহলে সাহিত্যে তাদের পরিণত বয়সের প্রেমানুভূতি কোথায় থেকে এল?এটা এসেছে মূলত কাব্যের প্রয়োজনে কবিকল্পনা ও লোকধারণার উপর ভিত্তি করে।শাস্ত্র অনুযায়ী যেখানে রাধাকৃষ্ণের বস্তুগত মিলন হয়নি সেখানে বৈষ্ণব কবিগণ কৃষ্ণকে মথুরা থেকে ফিরিয়ে আবার রাধার কাছে এনেছেন,কারণ সে যুগে বিরহ দিয়ে কাব্য শেষ হওয়ার রীতি ছিল না।লোককাহিনীর শেষ লাইনে "অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো" এই কথার যে প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায় সেই মনোভাবের প্রভাবই রাধাকৃষ্ণের মিলনে কবিদের উৎসাহী করে তোলেছে।বলা যায় লোকআশাকে এখানে নিরাশ করা হয়নি,তাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আধ্যাত্মিক ও উচ্চমার্গীয়ভাবে উপস্থাপন করা হলেও সেখানেও মিলনাত্মক এই ধারাকে উপেক্ষা করা হয়নি।মঙ্গলকাব্যেও যেভাবে লৌকিক দেবদেবীকে আর্যদেবদেবীর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা  হয়েছে,তাদের উপর হিংসা-প্রতিশোধ ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবেই লৌকিক সংস্কৃতি প্রভাবিত।তাদের আসন,বসন সবক্ষেত্রেই লৌকিক আচারের প্রভাব পড়েছে।দেবত্বকেও তারা লৌকিকতা দ্বারা অলংকৃত করেছেন।আরাকান রাজসভার কবিদের অনুবাদ সাহিত্যেও একইভাবে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে লৌকিক চরিত্র ঢুকে গেছে এবং মূলের কাহিনী হুবুহু গ্রহণ না করে তারা সেই ঘটনার লৌকিক রূপ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।


আধুনিক সাহিত্য একান্তভাবে ইউরোপীয় প্রভাবিত হওয়ায় মোটাদাগে সেখানে লোকসংস্কৃতির উপাদান ব্যবহৃত হয়নি।তবে লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানকে সাহিত্যে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।ব্যক্তিমনের আত্মঅনুসন্ধানই আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য।সেখানে সমাজ এসেছে ব্যক্তির সাথে তার সম্পর্কের ভিত্তিতে,সমাজের সার্বজনীন অনুভূতি নিয়ে নয়।রবীন্দ্রনাথ লোকসংস্কৃতির চর্চা করলেও তার পরিশীলিত শিল্পে সরাসরি তার প্রয়োগ ঘটাননি।যদিও লালনের তত্ত্ব তাকে আকর্ষণ করেছিল এবং তার কিছু গানে বাউল আদর্শের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।নজরুল আরবি-ফারসি শব্দের যতটা চর্চা করেছেন সেই তুলনায় লোকশব্দ কবিতায় ব্যবহার করেননি।তবে তিনি তার বেশকিছু গানে ভাটিয়ালি সুর ব্যবহার করেছেন।লোকসুর তাকে আকর্ষণ করেছিল।বাংলা কবিতায় লোকজ শব্দের সার্থক ব্যবহার ঘটান সর্বপ্রথম জীবনানন্দ দাশ।তার 'রূপসী বাংলা' লোকচিত্র ও লোকশব্দে ভরপুর।তার অন্যান্য কবিতাতেও এর বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতায় লোকজ উপাদানের সার্থক প্রয়োগ ঘটান আল মাহমুদ।অবশ্য তিনি জীবনানন্দের মত প্রাকৃতিক চিত্র আঁকেননি।তার কবিতায় লোকজ উপাদান এসেছে অনুষঙ্গ হিসেবে,বিষয় হিসেবে নয়।এছাড়া সৈয়দ শামসুল হকের 'পরাণের গহীন ভিতর' কবিতায় লোকজ উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে অত্যন্ত সার্থকভাবে।উত্তরাধুনিক কবিতায় মানুষের সার্বিক জীবনই যখন উপেক্ষিত তখন লোকসংস্কৃতি যে সেখানে স্থান পাবে না এটা স্বাভাবিক।কেউ কেউ তার সামান্য চর্চা করে থাকলেও মোটাদাগে তা ধরা পড়েনি।


লোকজীবন দ্বারা মানুষের সবকিছুই প্রভাবিত।একই ধর্মের একই বিষয় সমাজের বিভিন্নস্থানে লোকাচারে পার্থক্যের জন্য সামান্য হলেও পরিবর্তীত হয়ে অনুষ্ঠিত হয়।একই প্রমিত বাংলা রিডিং পড়ার সময় রাজশাহীর মানুষ এক টানে পড়েন,সিলেটের মানুষ আরেক টানে পড়েন।একই খাদ্য একেক অঞ্চলের মানুষ একেক প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত করেন।তাদের খাদ্যগ্রহণের প্রক্রিয়াও বিভিন্ন।কোন অঞ্চলে মাদুরে বসে খাওয়ার রীতি,কোন অঞ্চলে পিড়ীতে বসে খাওয়ার রীতি।আজকাল অবশ্য কী গ্রামে,কী শহরে সম্পন্ন পরিবারে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার রীতিই দেখা যায়।খাদ্যগ্রহণের পার্থক্যটা আমি নিজের চোখেই দেখেছি।অফিসের একই ডাইনিংটেবিলে বসে খাবার সময় রংপুরের লোককে দেখেছি শুরুতেই মাছ-মাংস,সবজি ও ডাল একসাথে মিশিয়ে নিতে।ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষকে দেখেছি বেশি বেশি মরিচ খেতে।অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রেও এরকম সূক্ষ্ণ অনেক পার্থক্য আছে উপযুক্ত গবেষণায় যা বেরিয়ে আসবে।এখানে অবশ্য লৌকিকতার সাথে আঞ্চলিকতার বিষয় এসে পড়ে।লৌকিক আর আঞ্চলিকের মধ্যে বড় বিরোধ নেই।আঞ্চলিক শব্দটি লৌকিক শব্দের চেয়ে আরও বিস্তীর্ণ বিষয়কে ধারণ করে।বহুল বিখ্যাত ঢঙে তাই বলা যায়,যা কিছু লোকজ তার সবই আঞ্চলিক আবার যা কিছু আঞ্চলিক তার সব লোকজ নয়।


আমরা জানি সংহত সমাজ বলতে বিশ্লেষকগণ যে আত্মনির্ভরশীল সমাজকে বুঝিয়েছেন তা আর  এখন অবশিষ্ট নেই।তার বিনোদন এখন অন্য কারও দখলে।তার ওপর বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিদেশী সংস্কৃতি প্রান্তিক জনগণকেও স্পর্শ করেছে।ফলে লোকসংস্কৃতি তার কদর ও সৃষ্টির প্রেরণা হারিয়েছে।এখন গরুর গাড়ির চালক বা মাঝির গান গেয়ে আর তার একাকীত্ব দূর করার প্রয়োজন হয় না।তার সাথে প্রায়শই একটি মোবাইল ফোন থাকে যেটা তার গানের এই খোড়াককে পূর্ণ করে ফলে।যদি সে মোবাইলে তার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া বা ভাটিয়ালি গানও শুনতে থাকে তবু সে নতুন সৃষ্টতে আগ্রহী হয় না।ফলে লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির সৃষ্টিমুখ এভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।আচার,আচরণ,খাদ্যাভ্যাস,আসবাবপত্র,গৃহ নির্মাণ সকল ক্ষেত্রে এখন গ্রামীণ সমাজে নগর সভ্যতার অনুকরণ লক্ষ্য করা যায়।ফলে বস্তুগত লোকসংস্কৃতিও একইভাবে আর বিকশিত হচ্ছে না।এভাবে সাধক বাউলের পরিবর্তে একধরণের গায়ক বাউলরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।সভা সেমিনার,বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশে,গবেষণায় লোকসাহিত্যকে ব্যবহার করে নানাজনের জীবনচর্যার ব্যবস্থা হলেও লোকসংস্কৃতির তা বিশেষ উপকার করছে না।বর্তমানে একমাত্র আদিবাসী সমাজই তাদের নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি ধরে রাখতে পারছে কিন্তু যেহেতু বৃহত্তর সমাজে তা অনুপ্রবেশের যোগ্য নয় তাই গবেষকগণ তাকে মূল লোকসংস্কৃতি থেকে পৃথক করে লোক সংস্কৃতির এক বিশেষ শাখা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।


মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ,খাদ্যাভ্যাস,কথা বলার ভঙ্গি সবক্ষেত্রেই পাশ্চাত্যকরণ হচ্ছে।ফলে জাতীয় সংস্কৃতিই যেখানে ধ্বংসের মুখে তখন লোকসংস্কৃতির অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।বাঙালীর হাজার বছরের একধরনের লোকচিকিৎসা ছিল।আধুনিক চিকিৎসার সাথে তা পারঙ্গম নয় সত্য,কিন্তু অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসায় তা উপকারি।ওরিয়েন্টাল মনোভাবের ফলে তাকেও  আমরা অবজ্ঞা করেছি।লোকসংস্কৃতির সাথে সাথে লোকসংস্কৃতির চর্চাও এখন বিলুপ্তির পথে।তার জন্য যে নিবিষ্ট সাধনা, অবসর ও নিষ্ঠা চাই তা আর এখন মানুষের নেই।


//লোকসংস্কৃতির প্রভাব ও আধুনিক যুগে বিকাশ ধারায় প্রতিবন্ধকতা//


********


আধুনিক সমাজের অর্থনীতি ব্যাপক শিল্পায়ন ও বাণিজ্যের উপর নির্ভর করলেও মধ্যযুগে কৃষিই ছিল রাষ্ট্রের অর্থ প্রাপ্তির প্রধান উপকরণ।ফলে যে কোন রাষ্ট্র কাঠামোই চাইতো সর্বোচ্চ ফলন এবং তা থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে।মুঘল আমলে যেসব ব্যবসা বাণিজ্য হত তার প্রধান উপকরণও ছিল মূলত কৃষি পণ্যজাত।প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা কাপড় বোনার জন্য বিখ্যাত ছিল।তবে বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে এখানে কাপড় বোনা হত না।কৃষিতে যেমন দাদন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল কুটির শিল্পে তা ছিল না।ফলে খুব বড় মূলধন প্রয়োগ করা তাঁতিদের পক্ষে সম্ভব হত না এবং অনেক তাঁতি এক জায়গায় একত্র হয়ে ব্যাপক শিল্পায়নের সুযোগ কম ছিল।সাধারণত কয়েক ঘরের বংশানুক্রমিক তাঁতি মিলে ৫-১০ টি তাঁত চালাত।তাতে যে উৎপাদন হত তা দিয়ে সবসময় তাদের সংসার চলতো না।তাই মাঝে মাঝে তারা কৃষিকাজেও শ্রম বিক্রি করতো।এই সব উৎপন্ন কাপড় স্থানীয় বাজার সহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে জাহাজ যোগে রপ্তানি করা হত।তাঁতিদের কাপড়ের মান উন্নয়নে তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না কারণ সব রকমের ক্রেতা বাজারে ছিল এবং কোন না কোন ক্রেতার কাছে পণ্যটি বিক্রি হয়ে যেত।তাছাড়া উচ্চ মানের জন্য যে পরিমান দামি তুলা ও সুতা ক্রয় করা প্রয়োজন সেটা ছিল তাদের সাধ্যের বাইরে।এ ব্যাপারে রাষ্ট্রও তাদের সাহায্য করেছে বলে তেমন নজির পাওয়া যায় না।তাঁতিরা যে মোটা কাপড় বুনতো সেটাও তারা সারা বছর বুনার রসদ জোগার করতে পারত না।যে কয়েকটি কাপড় বুনতো সেটা বিক্রি করে নিজের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটিয়ে যেটুকু অর্থ হাতে থাকত তা দিয়ে আবার রসদ সংগ্রহ করত।ইতিহাস বিখ্যাত মসলিন মানের দিক থেকে অনেক উচ্চ ছিল কিন্তু তা সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে প্রস্তুত হত না।কতিপয় অপেক্ষাকৃত ধনী সম্প্রদায় তা উৎপাদন করতো এবং বেশিরভাগ সময়েই তা রাজা-রাণীদের পোশাক হিসেবে আরব দেশে রপ্তানি করা হত।ফলে মসলিনের ইতিহাস দিয়ে গ্রাম বাংলার বিস্তীর্ণ সম্প্রদায়ের তাঁতিদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা যাবে না।


এইসব কাপড় ও কুটির শিল্পের নানা উপকরণ সংগ্রহের জন্য অঞ্চলভেদে নানা লোক থাকত।তাদের কাজই ছিল উৎপাদকদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে পণ্য সংগ্রহ করা ও একসাথে করে পরবর্তী পাইকারের কাছে তা সরবরাহ করা।এভাবে নানা হাত ঘুরে এসব পণ্য পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে চলে যেত।বাণিজ্য সমুদ্র পথে ও স্থল পথে উভয় পথেই হত।তবে স্থল পথে নানা গোষ্ঠী ও রাজ্যের আরোপিত শুল্ক ও লুঠের ভয় থাকত, তাই সমুদ্রপথেই বেশি বাণিজ্য হত।প্রাচীন সিল্ক রোড পশ্চিম এশিয়া ও আরব দেশে স্থল পথে পণ্য রপ্তানির জন্য বিখ্যাত ছিল।সমুদ্র বন্ধর হিসেবে দক্ষিণ ভারতের কালিকটের বন্দর খুব বিখ্যাত ছিল।শুধু আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য নয় সূদূর দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ--সুমাত্রা,জাভা ইত্যাদি থেকে এই বন্দরে নানা রকম মসলা আনা হত।ইউরোপ ও আরবে এই মশলার ব্যাপক চাহিদা ছিল কিন্তু তারা প্রথমদিকে জানতো না যে এর উৎপাদন কোথায় হয়।ভারতীয় বণিকরা এসব মসলা আমদানি করে কালিকট বন্দরে নিয়ে আসতেন।সেখানকার রাজা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রচুর পরিমাণে শুল্ক আদায় করতেন এবং এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে সেই রাজ্যটি ছিল অনেক উন্নত।ফলে বাণিজ্য ব্যবস্থা যাতে সচল থাকে,বণিকদের যেন কোন সমস্যা না হয় সেদিকে কর্ণাটক রাজ্য সব সময় দৃষ্টি রাখতো।প্রথম দিকে এই বাণিজ্য প্রধাণত মিসরীয়দের দখলে থাকলেও পুর্তগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামার আফ্রিকা ঘুরে কালিকট বন্দরে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে তাতে বেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।এ নিয়ে আরব বণিক ও কালিকট রাজার সাথে পুর্তগীজদের বেশ কয়েকটা যুদ্ধও হয়,ইতিহাসে যা মসলার যুদ্ধ নামে বিখ্যাত।ইউরোপে এসব মসলার ব্যাপক চাহিদা ছিল।মিশরীয় বণিকরা এর একচেটিয়া বাণিজ্য করত এবং দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে তা ইউরোপে রপ্তানি করত।তখনকার দিনে সুয়েজ খাল ছিল না বলে ভূমধ্য সাগরের সাথে আরব সাগরের কোন যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল না আবার স্থলপথে পূর্ব দিকে ওসমানি (অটোম্যান) সাম্রাজ্যের সাথে ইউরোপের সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন থাকার কারণে এই পথেও তারা ভারতের সাথে বাণিজ্য করতে পারত না।তাই সরাসরি বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে আফ্রিকা মহাদেশ  ঘুরে ভারত পৌঁছানোর পথ আবিষ্কার করতে তারা বাধ্য হয়।



মুঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্যের প্রসার হলেও রাজ্যের মনোযোগ ছিল মূলত কৃষিকে কেন্দ্র করে।বার্ষিক রাজস্বের শতকরা ৮৫ ভাগ আয় হত কৃষি থেকে।তাই কৃষিকে ঘিরে এখানে জমিদার,জুতদার,মহাজন,জায়গিরদার ইত্যাদি নানা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে।রাজস্বকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও ব্যাপক হারে বিদ্রোহও ছড়িয়ে পড়ে।মুঘল আমলে কৃষকদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ ছিল।প্রথম দিকে কৃষকরা ইচ্ছেমত জমি গ্রহণ করতে পারত।জমিদারকে নির্দিষ্ট হারে খাজনা দিতে পারলেই জমির মালিকানা নিশ্চিত হয়ে যেত।আবার অনেক সম্পন্ন কৃষক জঙ্গল কেটে চাষের জন্য নতুন জমি প্রস্তুত করত।কৃষকদের নতুন জমি তৈরিতে উৎসাহিত করার জন্য জমিদাররা এসব জমির উপর প্রথম দিকে অল্প হারে কর আরোপ করত।তবে ক্রমে ক্রমে কৃষকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও শোষণ বঞ্চনার ফলে নানা স্তর সৃষ্টি হয়।অপেক্ষাকৃত অবস্থা সম্পন্ন কৃষকেরা নিজেদের জমি নিম্ন আয়ের কৃষকদের দিয়ে চাষ করাত।যেসব কৃষকদের সামান্য জমি ছিল,নিজের চাষে যাদের সংসার চলত না তারা অন্যের জমিতেও বাড়তি অর্থের আশায় শ্রম দিত।


বেশিরভাগ কৃষকদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।তাদের মহাজনদের কাছে দাদন অর্থ্যাৎ ফসল চাষের বীজ ও অন্যান্য উপকরণ কেনার জন্য সুদের উপর অর্থ ধার নিয়ে চাষ করতে হত।একদিকে দাদন ও তার সুদের টাকা অন্যদিকে জমিদারের আরোপিত কর,সব মিলিয়ে উৎপাদিত শস্যের অর্ধেকের বেশি চলে যেত।ফলে কৃষক সারা বছর চাষ করে পরিবারের জন্য তিন মাসেরও খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত না।উপরন্তু খাজনা ধরা হত জমিতে সর্বোচ্চ ফসল উৎপাদনের ভিত্তিতে এবং তার সর্বোচ্চ দাম ধরে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফসল কখনও তার সমান উৎপন্ন হত না।আবার যখন ফসল কাটা হত তখন খাজনা নির্ধারণের সময় যে দাম ধরা হয়েছিল তার চেয়ে ফসলের বাজারদর অনেক কম হত।ফলে প্রচুর ফসল শস্তা দামে বিক্রি করে কৃষকদের টাকায় খাজনা দিতে হত।অনেক সময় চাষীরা ফসল দিয়ে খাজনা পরিশোধের জন্য অনুরোধ করত।কোথাও কোথাও ফসলের বিনিময়ে খাজনা পরিশোধের বিধান থাকত আবার সময়ে সময়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী তা অর্থের বিনিময়ে আদায় করতে বলা হত।তার উপর মুঘল কর্মচারী,নানা কর্তাব্যক্তি ও জমিদার রাষ্ট্র আরোপিত করের বাইরে বাড়তি কর দাবি করত ও কৃষকদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাত।অত্যাচারে ক্ষুব্ধ ও দিশেহারা হয়ে কৃষকরা রাতের অন্ধকারে অনেক সময় এক জমিদারের এলাকা থেকে আরেক জমিদারের এলাকায় পালিয়ে যেত।চাষের জমি ছেড়ে এভাবে পালিয়ে যাওয়া তখন ছিল আইনত দণ্ডনীয়।সর্বোচ্চ রাজস্বের জন্য জমিদারদের উপর কেন্দ্র থেকে সব সময় চাপ দেয়া হত এবং কৃষকদের এ ব্যাপারে নিয়মিত তদারকি করা হত।যাই হোক স্থান পরিবর্তন করে কৃষকেরা কদাচিৎ সুখের সন্ধান পেত।


অনেক জমিদারিতে আবার বেগার খাটার নিয়ম প্রচলিত ছিল।জমিদারের দেওয়া কোন একটা কর মওকুফের বিনিময়ে জমিদারের নিজস্ব জমিতে বছরের একটা সময় কৃষকদের বেগার খাটতে হত।বেগার খাটা শব্দটা সেখান থেকেই মনে হয় আমাদের সমাজে বহুল প্রচারিত হয়েছে।এছাড়া ফসল ঘরে তোলার সময় নিয়োগকৃত পেয়াদা,আমলাতান্ত্রিক কর্মচারী এদের বেতনও কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হত।কোন নতুন জমিদার কেন্দ্রকে ঘুষ দিয়ে জমিদারি গ্রহণ করলে বা পুরনো জমিদারকে বিদ্রোহের মাধ্যমে উৎখাত করলে তার খরচ হওয়া অর্থ ফিরে পেতে কৃষকদের উপর বাড়তি হারে কর আরোপ করত।আবার অতিবৃষ্টি,অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল না হলে তাতে কেন্দ্রের কিছুই আসতো যেত না,সকল দায় যেন হতভাগ্য কৃষকেরই।কৃষককে পূর্ব নির্ধারিত খাজনা দিতে বাধ্য করা হত।অনেক কৃষককে মহাজনদের কাছে ধার করে এই কর পরিশোধ করতে হত।সুদের এই চক্র থেকে বের হওয়া তাদের পক্ষে আর কোনদিনও সম্ভব হত না।ফলে ভিটেমাটি ছেড়ে হয় পালাতে হত নয়তো ভূমিহীন কৃষক হয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হত।


এসল কারণে সুযোগ পেলেই কৃষকেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠত।কখনও বুভুক্ষু কৃষক সমাজ একত্র হয়ে রাজস্ব আদায়কারীদের ধরে মারতো,জমিদার বাড়িতে আক্রমণ করত।আবার কখনও জমিদার বা জায়গিরদারদের পক্ষ নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হত।জমিদাররাও অনেক সময় এভাবে কৃষকদের নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিত,বিশেষ করে যখন কেন্দ্র থেকে জমিদারদের উচ্ছেদের কোন ইঙ্গিত থাকতো।কখনও কখনও মুঘল সাম্রাজ্য জমিদারদের শর্ত মেনে নিতেন আবার কখনও অন্য কোন সম্প্রদায়কে জমিদারি দানের লোভ দেখিয়ে বিদ্রোহী জমিদারকে দমন করতেন।কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন একই রকম থেকে যেত।অনেক সময় শত শত বিদ্রোহী কৃষককে হত্যা করা হত।তাদেরকে এমনভাবে দমন করা হত যে তা দেখে যেন আর কেউ বিদ্রোহের সাহস না পায়।


আবার এমনও দেখা গেছে কিছু এলাকায় সম্মিলিত কৃষকরা অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সম্রাটের কাছে অভিযোগ করেছে।মুঘল সাম্রাজ্যে তার রীতিও ছিল।অবস্থা অনুযায়ী কখনও কখনও সম্রাট সেই জমিদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন এবং তার স্থানে অন্য কাউকে জমিদারি দিতেন।তবে অভিযোগকারীরা প্রাণভয়ে অভিযোগের কথা গোপন রাখতে চাইতেন অথবা অত্যাচারে প্রাণের মায়া যখন চলে যেত তখন আর কোন পরিণতি না ভেবে শেষ আশ্রয় হিসেবে তারা সম্রাটের দরবারে অভিযোগ নিয়ে যেতেন।কোন কারণে জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে এইসব সাধারণ কৃষকের পরিণতি কী হত তা সহজেই অনুমেয়।



কৃষকদের বাইরে নানা উপজাতিরাও বিদ্রোহে অংশ নিত।বাণিজ্য পথে নিরাপত্তা দানের মাধ্যমে নানা কর আরোপ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত।কারণ তারা বেশিরভাগ পাহাড়ী অঞ্চলে বাস করত এবং সেখানে ফসলের উৎপাদন খুব কম হত।উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আফগান উপজাতি,ইউসুফজাই উপজাতি এ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল।মুঘল শক্তি কখনও তাদের এই আরোপিত করের অধিকারকে স্বীকার করত আবার কখনও কঠোর হস্তে দমন করত।তাছাড়া আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু ধর্মীয় বিপ্লব লক্ষ্য করা যায়।এরা খাজনা দেওয়াকে নিজেদের ধর্মের অপমান মনে করত।রাষ্ট্রের পরিবর্তে তারা নিজেদের ধর্মীয় নেতাকে একটা নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদান করত।এই সব বিপ্লবে বর্ণের পার্থক্য না থাকায় হিন্দু-মুসলমান সকল ধর্মের লোক এখানে আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেত।রোশনিয়া আন্দোলন এমন একটি ধর্মীয় বিপ্লবের নাম।এসব ধর্মে প্রায়ই স্বীকৃত রীতিনীতিকে অস্বীকার করে ভাববাদী ধর্মীয় রীতি প্রয়োগ করা হত।এমনকি তাদের প্রচারিত ধর্মের বাইরে যে কারও সম্পদ লুঠ করাকে তারা বৈধ মনে করত।সময়ের ব্যবধানে কেন্দ্রীভূত শক্তি না থাকায় এসব আন্দোলন নানা দিকে মোড় নিয়েছে এবং এক সময় থিতিয়ে পড়ে।মুঘল সাম্রাজ্য কখনও কখনও এইসব বিদ্রোহী নেতাদের সাথে আপোষ করে রাষ্ট্র কাঠামোতে তাদের স্থান দিত এবং তাকে সেই এলাকার শাসনকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিত।


আবার আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত শাসন প্রতিষ্ঠায় মারাঠা,রাজপুত,জাঠ নানা সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে সমষ্টিগতভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠতো।কখনও কোন অঞ্চলের একটা ধর্মীয় অংশ বা এক জাতের লোক নিজেদের মাঝে এভাবে পুরো এলাকা জুড়ে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিত।তখন সেই এলাকায় একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করত।তাদের দমন করার জন্য বিপুল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হত।ফলে উভয় পক্ষেই প্রচুর পরিমাণ লোক আহত ও নিহত হত।বেশিরভাগ সময় রাষ্ট্রশক্তিই জয়ী হত এবং বিদ্রোহীদের সমস্ত ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হত।এরকম বিদ্রোহ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বেশি হয়েছে।বাংলায় সেই তুলনায় কৃষক বিদ্রোহ অনেক কম দেখা যায়।সম্ভবত বাংলায় জমিদারদের সাথে কৃষকদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনেক বেশি ছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের কাঠামোতে একে অপরকে টিকে থাকতে সাহায্য করছিল।


মূলত আওরঙ্গজেবের আমলের কিছু আগে থেকে শুরু হয়ে তার সময়ে সাম্রাজ্যের সর্বত্র জাতিগত,ধর্মীয় এবং কৃষক আন্দোলন চরমভাবে  মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।এই সকল বিদ্রোহে যাদুবিদ্যা ও অতিলৌকিক বিশ্বাস একটা প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।সাধারণ কৃষকেরা মনে করতেন যে তাদের নেতাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে যার বলে বিশাল মোঘল বাহিনীকে তারা পরাস্ত করতে সক্ষম হবে।তাই তারা অসীম সাহসে মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেত।কৃষকরা সমাজের এক বিশাল অংশ হয়েও,একই ভাবে নির্যাতিত হয়েও সামগ্রিকভাবে তারা বড় কোন আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি।যেসব বিদ্রোহ হয়েছে তা ছিল আঞ্চলিক এবং বিচ্ছিন্ন।সমগ্র রাষ্ট্রের কৃষক কখনও একসাথে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেনি।কারণ জাতি ও ভাষাগত ভাবে তারা ছিল আলাদা,নিজেদের ব্যক্তিগত চাহিদার বাইরে গিয়ে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা তাদের ছিল না।ফলে রাষ্ট্র শাসনে নানা সময় বেঘাত সৃষ্টি করলেও কেন্দ্রীভূত শক্তির অভাবে এসব বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের ভিতকে কখনও নাড়িয়ে দিতে পারেনি।


ইংরেজ আমলেও কৃষি আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।শাসক পরিবর্তীত হলেও শোষণের মাত্রা একই রকম থাকে বরং কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি বেড়ে যায়।এইসব কৃষি আন্দোলন ক্রমেই ব্রিটিশ আমলে নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে শক্তি জোগাতে থাকে।



কৃষিতে যে দাদন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার অর্থ প্রথমত আসত সম্পন্ন কৃষকদের উদ্বৃত্ত ফসল থেকে।সম্পন্ন চাষীরা তাদের এই বাড়তি ফসল বিক্রি করে দাদনের জন্য সুদ হিসেবে গরীব কৃষকদের মাঝে বন্টন করত।ধীরে ধীরে এভাবে স্বতন্ত্র মহাজন শ্রেণীর উদ্ভব হয় যাদের পেশাই হল মানুষকে সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দেয়া।বেশিরভাগ সময় মহজনরা স্থানীয় প্রভাবশালী কোন ব্যক্তি অথবা জমিদারকে সাক্ষী হিসেবে রেখে চাষীদের মাঝে ঋণ দিত।অর্থ্যাৎ দাদনের এই প্রক্রিয়াটা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রণ করা হত।এই মহজনরা ক্রমেই এত প্রভাবশালী হয়ে উঠে যে জমিদাররাও জমিদারি রক্ষার জন্য কর মেটাতে গিয়ে তাদের কাছে ধার নিত।আবার যুদ্ধের সময় রসদ সরবরাহের খরচ মেটানোর জন্য রাজারাও এইসব মহজনদের কাছে অর্থ ধার নিতেন ও যুদ্ধে জয়লাভের পর তাদের নানা সুবিধাসহ সে অর্থ ফিরিয়ে দিতেন।তাছাড়া সেকালে সন্নাসীদের নিষ্কর জমি দেয়া হত।এসব জমি থেকে তারা মোটামুটি ভাল রকমের আয় করতেন ও খরচ চালানোর পর ভাল একটা অংশ তাদের হাতে থেকে যেত।জেনে অবাক হতে হয় যে তথাকথিত ইহজীবনের প্রতি বৈরাগ্যবাদী এসব সন্ন্যাসীরাও চাষীদের মাঝে উচ্চ সুদে অর্থ ধার দিতেন।এসব সন্ন্যাসীদের নিষ্কর জমি দিয়ে রাজ্যের লাভ কী সে কথা বিবেচনা করতে গেলে বলতে হয় সন্ন্যাসীরা ধর্ম পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে সুসংহত রাখতে সাহায্য করতেন।তারা মানুষের মাঝে ধর্মীয় বাণী প্রচার করে তাদের মনকে একদিকে কেন্দ্রীভূত রাখতেন ও রাজাদের রাজকীয় মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে রাজার প্রতি মানুষের মনকে অনুগত করে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন।মৌর্য,গুপ্ত,পাল ও সেন আমলে সন্ন্যাসীগণ রাজাদের দৈববংশ বলে প্রচার করতেন,অর্থ্যাৎ রাজারা ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে রাজ্য শাসন করছেন।এর ফলে কোন রকম অন্তর্গত বিদ্রোহ ছাড়া নিশ্চিন্তে রাজারা রাজ্যশাসন করার নিশ্চয়তা পেতেন।কিন্তু ত্রয়োদশ শতক থেকে সমাজে ব্যাপকভাবে ইসলাম অনুপ্রবেশ করায় এবং মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশে সকল ধর্মের রাজা থাকে সত্ত্বেও ক্ষমতার উপরের অংশে ইসলামি চিন্তাধারা প্রসার লাভ করায় রাজাদের দৈববংশ হিসেবে প্রচারের এই প্রথা কমতে থাকে।


মুঘলযুগে কর ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা সংগঠন ছিল।তারা জমিকে উচ্চ ফলনশীল,মাঝারি ফলনশীল ও অল্প ফলনশীল এই তিনভাগে ভাগ করে ফসলের হিসাব অনুযায়ী কর ধার্য করতেন।তার পরেও সেটা প্রকৃত ফলনের হিসাবের থেকে বেশি হত।কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে কোথাও কোথাও বিগত ১০ বছরের প্রকৃত ফলনের হিসাব করে কর ধার্য করা হত।এ ক্ষেত্রে করের বোঝা কৃষকদের কাছে কিছুটা হলেও সহনীয় হত।এই কর কখনও ফসলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ,এক তৃতীয়াংশ,কখনও অর্ধেক করা হত।বিশেষ করে রাজ্য ঘন ঘন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে যুদ্ধের খরচ মেটাতে কৃষকদের উপর বাড়তি করের বোঝা এসে পড়ত।কোথাও কোথাও লাঙলের উপর কর ধার্য করা হত এবং লাঙলের সংখ্যা চাষের জমির অনুপাতে জমিদারের পক্ষ থেকে প্রযুক্ত হত।তাছাড়া অনেক জায়গায় নানা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রের নজরদারির বাইরে নিজেদের মত করে কৃষকদের কাছে ফসল আদায় করত।এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় উদ্দ্বুদ্ধ হয়ে কৃষকেরা নিজেদের ইচ্ছেতেই ফসলের একটা অংশ তাদের ধর্মনেতার হাতে তুলে দিতেন।জমিতে ফসলের বা তাদের শ্রমের একটা অংশকে তারা ধর্মীয় নেতার প্রাপ্য অংশ বলে মনে করতেন।এই বিশ্বাস ধর্মীয় উপদেশের ভেতর দিয়েই ধর্মপ্রচারকগণ তাদের অনুগতদের মাঝে বদ্ধমূল করে দিতেন।বেশিরভাগ সময় এসকল ধর্ম ভাববাদী হত এবং বাইরের কাঠামোগত ধর্মকে অস্বীকার করে নিজেদের একটা আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতো।সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিলে রাষ্ট্র তাদের কঠিন হাতে দমন করতেন এ বর্ণনা আগেই দেওয়া হয়েছে।


জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরপর জমিদারি গ্রহণের জন্য নানা গোষ্ঠীর মাঝে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।নিজেদের অনুগত বাহিনী তৈরির মাধ্যমে সমাজের নিচের স্তরের অনেক ব্যক্তিত্ব জমিদারি গ্রহণ করতে চাইতেন এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চজাত হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি আদায় করতেন।অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার প্রাধান্যের উপর ভিত্তি করে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজে বর্ণপ্রথার এই স্থানান্তর লক্ষ্য করা গেছে।ইসলাম ধর্মে বর্ণপ্রথা স্বীকৃত না হলেও তখনকার সমাজে আশরাফ (উচ্চবংশ) ও আতরাফ (নিম্নবংশ) নামে দুটি শ্রেণী মেনে চলা হত।ইরান,তুরান ও আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমানেরা নিজেদের উচ্চ বংশীয় বলে প্রচার করত এবং মুঘল শাসনে এদেশীয় মুসলমানদের চেয়ে প্রাধান্য পেত।তাই কোন মুসলিম রাজা বা জমিদার হলে নিজেদের স্বভাবতই উচ্চবংশের সাথে জুড়ে দিতে চাইতেন এবং এক বা দুই প্রজন্ম পরে মানুষ স্বভাবতই তাদের শ্রেণী স্থানান্তরের কথা ভুলে গিয়ে সবদিক থেকেই তাদের উচ্চশ্রেণী হিসেবে মেনে নিতেন।
জমিদারদের মধ্যে নানা শ্রেণীবিভাগ ছিল।কোথাও জমিদারের নির্দিষ্ট এলাকায় মালিকানা স্বীকৃত হত,কোথাও জমিদার ছিলেন শুধু রাজস্ব আদায়কারী মাত্র।তাছাড়া মুঘল সাম্রাজ্য তালুকদার,চৌধুরি ইত্যাদি উপাধি দিয়ে অনেক গোষ্ঠীকে জমিদারির মত দায়িত্ব দিতেন কিন্তু তাদের এলাকা জমিদারের মত এত বিস্তীর্ণ হত না।
রাজস্ব প্রাপ্তির দিক থেকে কোন বাধা না পেলে জমিদাররা উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে জমিদারি করতে পারতেন।কখনও কোন জমিদারের একাধিক সন্তানের মাঝে জমিদারির উত্তরাধিকার নিয়ে কোন্দল দেখা গেলে মুঘল সাম্রাজ্য কেন্দ্র থেকে তার মীমাংসা করে দিত ও যে কোন একজনকে স্বীকৃতি দিত।ক্ষমতা ও শ্রেণী স্থানান্তরের এমন সুযোগ ও কোন্দল বজায় রেখে কার্যত মুঘল সাম্রাজ্য সমাজের অভ্যন্তরে কেন্দ্রের শাসন শক্তিশালী রাখার সুযোগ পেত।


জমিদার ছাড়াও সরাসরি রাষ্ট্র্ব্রের পক্ষ থেকে নানা ফৌজদার বাহিনী,কর ব্যববস্থা পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য জায়গিরদার ও নানা আমলাতান্ত্রিক ব্যক্তি থাকত।বলাই বাহুল্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তাকে কৃষক ও জমিদার উভয় পক্ষই বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করতেন ও প্রায়ই জমিদারের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীর সাথে এদের সংঘর্ষ হত।কখনও পরিস্থিতি অনুযায়ী কৃষক সমাজও এদের বিরুদ্ধে অংশ নিত।কর আদায়কারী এসব লোককে কৃষকরা কুকুরের চেয়েও বেশি ঘৃণা করত--এ কথা সেই আমলের কর আদায়কারী একজন কর্মচারীর জবানী থেকে জানা যায়।এসকল আমলাতান্ত্রিক জটিল সহাবস্থানের কারণে সমাজে সর্বদা ক্ষমতার এক প্রকার প্রতিযোগিতা ও তারল্য লক্ষ্য করা যেত।


এখন প্রশ্ন হতে পারে মুঘল সাম্রাজ্যে যে অল্প বিস্তর বাণিজ্যের প্রসার হয়েছিল তার সাথে সাম্রাজ্যের সম্পর্ক,নিয়ন্ত্রণ ও রীতিনীতি কী ছিল?কৃষক ও অন্যান্য কারিগরদের কাছে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে প্রাথমিক স্তরের বণিকদের একটা সামাজিক সম্পর্ক ছিল।আর যারা বাইরের দেশের সাথে রপ্তানিতে যুক্ত ছিল তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল রাজা ও সম্রাটের।তবে সমুন্দ্র বন্দর অবস্থিত রাজ্য ছাড়া ব্যবসা বাণিজ্যের উপর রাজশক্তির মুখ্যদৃষ্টি ছিল না।ব্যবসায়ীরা নিয়মিত একস্থান থেকে অন্যস্থানে সবসময় যাতায়াত করত বলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তাদের বিশেষ আগ্রহ বা ভূমিকা ছিল না।এর ব্যতিক্রম ছিল প্রথম সহস্রাব্দের বণিকদের ব্যাপারে অর্থ্যাৎ গুপ্ত ও পাল আমলে।তখনকার নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ও রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় বণিকদের নাম পাওয়া যায়।পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কেন বণিকদের গুরুত্ব কমতে থাকে তার সন্তোষজনক উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।তবে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য বণিকদের নিরাপত্তা,বাণিজ্যপথে বিশ্রামের জন্য পান্থশালা নির্মাণ এসব বিষয়ে সম্রাটরা সবসময় দৃষ্টি রাখতেন।বণিকরা সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায় ভূমিকা না রাখলেও ব্যবসার স্বার্থেই তারা সাম্রাজ্যের স্থিতাবস্থা কামনা করত।তাই কোন বিদ্রোহে বণিকদের উল্লেখযোগ্য সমর্থন দেখা যায় না।এভাবে বণিকরা রাজশক্তিকে সুসংহত করতে সাহায্য করত।



ইংরেজ আমলে রাষ্ট্রশক্তি আরও গভীরভাবে তার শক্তিকে সমাজের আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে দেয়।ফলে শোষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।ব্রিটিশরা সমাজের প্রতি ইঞ্চি থেকে তাদের সুবিধা আদায় করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে।এতে সমাজের নিম্ন স্তরের লোক বিশেষ করে কৃষকদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রয়োজনীয় কাচামাল জোগাতে বিশেষ করে নীল চাষে বাধ্য করায় কৃষকদের ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপান্তরিত হয়।চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত,রাইয়তওয়ারী বন্দোবস্ত ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তি কর ব্যবস্থা যত নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছে,সমাজের অন্তর্নিহিত অংশে বিদ্রোহের বীজ তত পরিপুষ্ট হয়েছে।


এক পর্যায়ে কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ও নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে কৃষকেরা 'সারা ভারত কিষান সভা' গঠন করে।বিভিন্ন স্থানে এর শাখা-প্রশাখা খোলা হয়।ফলে এই প্রথম রাজনৈতিকভাবে কৃষকেরা সুসংগঠিত হয় এবং এক শক্তির অধীনে আসে।ফলে তারা আইন অমান্য আন্দোলন,অসহযোগ আন্দোলন,ভারত ছাড়ো আন্দোলন ইত্যাদিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।তবে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বিশেষ করে জমিদারদের প্রধান ভূমিকা থাকা ও সেখানে কর মওকুফের ব্যাপারে কোন নমনীয়তা না থাকায় কৃষকদের বিস্তীর্ণ অংশ এই আন্দোলন থেকে বিরত থাকে।তাছাড়া এই আন্দোলনে হিন্দু প্রতীক ব্যবহার করা হয় বলে মুসলমান কৃষকরা তা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।আবার পূর্ববঙ্গের কৃষকেরা ধর্ম নির্বিশেষে নিজেদের স্বার্থেই, বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা কেন্দ্রিক নানা সুবিধা পাবার আশায় এই আন্দোলন থেকে বিরত থাকে।


তবে রাজনৈতিক ছায়াতলে আশার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় নানা নেতার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে।এর ফলে তা কংগ্রেস বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধীর সমর্থন হারায়।ফলে তা আবার আগের মত বিক্ষিপ্ত হয়ে থিতিয়ে পড়তে শুরু করে।ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে এদেশীয় কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলে বণিকদেরও প্রাধান্য কমে যায়।ধীরে ধীরে তারা নানা স্থানীয় ব্যবসা ও জীবিকায় অভিযোজিত হয়।আর এই সুযোগে নিজেদের শিল্পের জন্য কাচামাল সংগ্রহ,তার বাজারজাতকরণ ইত্যাদির প্রসারে ইংরেজগণ তাদের অনুগত একশ্রেণীর ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি করতে সক্ষম হয়।এই শ্রেণী তাদের বিপদে আপদে পরামর্শদাতা,অর্থদাতা ও দাবার ঘুটি হয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে ও ক্ষমতার বিস্তারে সাহায্য করে।


//মুঘলযুগে কৃষক আন্দোলন,রাজস্ব ব্যবস্থা ও বণিকদের ভূমিকা//


*******


আমাদের শিল্প-সাহিত্যের এত নিপুণভাবে সমাজ বিচ্ছিন্নতার কারণ কী?ব্যাপারটা ইদানীং অনেককেই খুব ভাবিয়ে তোলছে।শিল্পের সমাজ বিচ্ছিন্নতা মূলত শিল্পীর সমাজ বিচ্ছিন্নতার সাথে জড়িত।সমাজের নানা অংশ শিল্পীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুষ্টি না জোগালে অথবা সমাজের প্রতি কোন দায় বা মমতা অনুভব না করলেই একমাত্র এমনটা হতে পারে।কিন্তু চিরকালের উত্তাল বাঙালী সমাজের কোথায় কী এমন পরিবর্তন ঘটলো যা তার শিল্পদৃষ্টিকে প্রেরণা দিতে পারছে না।এটা একটা ভাবনার বিষয় বটে।আমার মনে হয় শিল্পী বর্তমান সমাজের কোথাও না কোথাও তার একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে গেছেন।তাই বলে যে তার জীবনে সংকট নেই,সংগ্রাম নেই তা কিন্তু বলছি না।এইসব সংকট সমাধানের মধ্যেও সে তার প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ কোথাও না কোথাও থেকে পেয়ে যাচ্ছেন এবং একটি সামান্য রোদ-বৃষ্টি মুখর মিহি ভবিষ্যত তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে।ফলে সীমিত সংকটে আবদ্ধ থাকলেও সমাজের প্রতি,চারপাশের প্রতি তার একটি ভোগবাদী নির্ভরশীলতা জন্মে গেছে।এই নির্ভরশীলতা ও প্রাপ্তি তাকে সমাজের প্রতি সন্তুষ্ট রাখছে,বহুমাত্রিক পথে হাঁটা থেকে সে ভেতর থেকে কোন তাগিদ অনুভব করছে না।যেহেতু সাহিত্যের প্রতি তার একটা অপার মুগ্ধতা আছে,নিজেকে সাহিত্যের মঞ্চে কোথাও না কোথাও তিনি দেখতে আগ্রহী--এই আত্মগত প্রেরণা তাকে জনবিচ্ছিন্ন এবং স্বভাবতই 'গুনগুন সাহিত্য' সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করছে।তাই শিল্পের বিষয়ের চেয়ে উপকরণ এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে,শরীরের চেয়ে অলংকার,ঘটনার চেয়ে রেখাপাত,চলার চেয়ে অঙ্গভঙ্গিই প্রাধান্য পাচ্ছে।


এসময় যেসব তরুণ লিখছেন তাদের বেশিরভাগেরই মানস নব্বইয়ের দশক পরবর্তী জীবনাভিজ্ঞতা থেকে গড়ে উঠেছে।বস্তুত এই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের চারপাশে নানা সূক্ষ্ণ সংকট থাকলেও মোটা দাগের সর্বব্যাপী কোন সংকট উপস্থিত হয়নি।আবার এসব সূক্ষ্ম  সংকটকে উপলব্ধি করার মত যে ইতিহাসজ্ঞান প্রয়োজন তা তাদের অল্পেরই আছে।তাদের সামনে শুধু সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতা,ইংরেজ শাসন,ভাষা আন্দোলন-দেশভাগ,মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির কিছু মাংসহীন ইতিহাসের তথ্য উপস্থিত কিন্তু এসবের মধ্যে তারা বাস করেননি বা বিস্তৃত ধারাবাহিক ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে নিজেদের বোধকে সেই সমাজচিত্র জীবন ঘনিষ্ঠ করে দেখাতে সক্ষম হননি।শিল্পীর মানস বয়স তার শারীরিক বয়স এবং অভিজ্ঞতা থেকে বেশি হয়ে থাকে।কেননা তিনি অতীতের সমাজ অভিজ্ঞতা ও তার পূর্বপুরুষের সংগ্রামকে নিজের ভেতরে লালন করে প্রতিনিয়ত ভবিষ্যতের দিকে শ্বাস ফেলেন।নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আমাদের বর্তমানকালের তরুণ শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এখানে কোথাও পার্থক্য গড়ে উঠেছে।এই সময়ের বেশিরভাগ শিল্পীর শিল্পদৃষ্টির মানস বয়স তার জীবনের এক তৃতীয়াংশের বেশি হবে না বলেই মনে হয়।ফলে এত অল্প পুঁজি দিয়ে চারপাশে উপস্থিত মিহি অথচ প্রাণঘাতী সংকটকে অনুভব করে,পরিপুষ্ট করে শিল্পে রূপান্তরিত করতে তাদের বেশিরভাগই ব্যর্থ হচ্ছেন।যে পেছনের বিশ কদম হেঁটে এসেছে,সামনের পাঁচ কদমে কী কী ঘাত-প্রতিঘাত আছে এবং কীভাবে তা অতিক্রম করতে হবে সেই তা ভাল অনুভব করতে পারে।তেমনি বর্তমান সময়কে বুঝতে হলে অতীত থেকে কিছু হেঁটে আসা চাই।


বাংলার শিল্প সাধনা এককালে প্রধানত মধ্যবিত্ত সমাজের কেন্দ্রে ছিল।জীবনের নানা টানাপোড়েন তার সৃষ্ট শিল্প-সাহিত্যে স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসতো।এই মধ্যবিত্ত সমাজ গত শতকের শেষ থেকেই নিরুত্তাপ হয়ে আছে।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটি মাঝারি মানের জীবিকা তাকে মধ্যমানের একটি সন্তুষ্ট অথচ বিস্তারহীন,চিন্তাহীন জীবনে আবদ্ধ করে রেখেছে।পরবর্তী প্রজন্মকেও তারা একই ধরনের জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত করে তোলার জন্য  তৈরী করছেন।ফলে জীবিকা সংগ্রামে তারা নিপুণ কিন্তু মানসিকভাবে সীমাবদ্ধ ও সীমিত গণ্ডির হয়ে বেড়ে উঠছে।তার উপর তথ্যপ্রযুক্তির নানা সমৃদ্ধি তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের দিকে অধিক হারে ঠেলে দিচ্ছে।


অনেকেই বলতে পারেন এই বিচ্ছিন্নতা সচেতনভাবে গড়ে ওঠা।এটাই এই সময়ের সাহিত্যের ট্র‍্যান্ড।তাদের এই খুঁড়া যুক্তিতে আমাদের ভরসা নেই।নেহাত রঙ তুলির অর্থহীন আঁচর কাটতে কেউ শিল্প করতে আসে না,প্রকাশ মোটা বা সূক্ষ্ম যাই হোক ভেতরে সারবস্তু থাকলে কোন উপায়ে তা প্রকাশ পাবেই।আলোকে ঢেকে রাখলেও তার দীপ্তির সৌন্দর্য প্রকাশিত হবেই।অন্যদিকে অন্ধকারকে রঙিন পর্দা দিয়ে জমকালো করে,সীমিতকে নান্দনিকের মোড়কে অসীম করে উপস্থিত করলেও দর্শককে খুব বেশিদিন ধোকা দেয়া যাবে না।দর্শককে,পাঠককে কূপমন্ডুক বা অনগ্রসর বলে গালি দিয়েও নিজেদের বেশিদিন সান্ত্বনা দেয়া যাবে না।সময়ের ব্যবধানে নিজেই তা খসে পড়বে।


এই সময়ের শিল্প-সাধনা সংগ্রামী মধ্যবিত্ত থেকে ফুলে-ফেঁপে বেরিয়ে আসা একটি আপোষকামী বাবু মধ্যবিত্তের  অবসর যাপন ও বিলাসবহুল সাধনার বিষয় হয়ে উঠেছে।ফলে তা রূপের চেয়ে রূপকের দিকে,সার্থকতার চেয়ে সফলতার দিকে,সৃষ্টির চেয়ে প্রচারের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে।যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের বিস্তীর্ণ জীবনাভিজ্ঞতা সম্পন্ন,সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ কোন শিল্পীগোষ্ঠী বিলাসী বাবু সমাজকে ধাক্কা দিয়ে শিল্পের মঞ্চটি দখল না করছেন ততদিন পর্যন্ত এই একঘেয়ে ও অনুরণহীন গুনগুন শিল্পসৃষ্টি আমাদের সহ্য করতে হবে।


(শিল্পের সমাজ বিচ্ছিন্নতা ও তার কারণ)


.....


সমকালীন বাংলাদেশের শিক্ষা,সমাজবাস্তবতা ও বৈশ্বিক সংকট


বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র।আয়তনে ছোট হয়েও ভৌগোলোকি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থানের জন্য কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।ভারতীয় উপমহাদেশের এক জটিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম।সাতচল্লিশের দেশভাগের মধ্য দিয়ে হাজার মাইল দূরের একটি দেশের সাথে এই ভূখণ্ডকে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে জুড়ে দিয়ে যে ভুল করা হয়েছিল,বাংলাদেশের অভ্যুদয় সেই ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন।সেই হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দুটি।প্রথমটি সাতচল্লিশে ব্রিটিশদের কাছে অর্জিত, দ্বিতীয়টি একাত্তরে রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে নেওয়া।তাই বাংলাদেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য,সমকাল ও ভবিষ্যত আলোচনায় শুধু একাত্তর পরবর্তী উপাদান নিয়ে আলোচনা করলে তার ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।


ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে আর্যদের আগমন ঘটলেও বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক পরে।সেজন্য প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলকে অনার্যদের দেশ বলা হত,তাকানো হত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে।এমনকি এদেশে ভ্রমণ করলে মানুষের আত্মিক পবিত্রতা নষ্ট হয় এমনও বলা হত।মূলত প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও নদীবিধৌত ভূমি হওয়ার জন্য ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে এটি ছিল কিছুটা বিচ্ছিন্ন।তাই খ্রীষ্টপূর্ব সময় থেকে নানা সাম্রাজ্যের ভেতর থেকেও বাংলা নিজস্ব রাজা দ্বারা আঞ্চলিকভাবে শাসিত হতে থাকে।সুযোগ পেলে প্রায়ই এখানকার রাজাগণ কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন।সেই হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মুঘল আমল পর্যন্ত বিশেষ করে পূর্ব বাংলার বিস্তৃত অংশ মাত্র এক তৃতীয়াংশ সময় কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ছিল।তাই বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাঙালীর মজ্জাগত।


তবে ঐতিহাসিক নানা বিবর্তন ঘটলেও বাংলার সামাজিক বিবর্তন খুব অগ্রগামী নয়।এক রাজা গিয়ে আরেক রাজা এসেছে কিন্তু সামাজিক মানুষের জীবনযাত্রার কোন পরিবর্তন হয়নি।মূলত উর্বর ভূমি ও নদ-নদী,খাল বিলের প্রাচুর্য থাকায় প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের সমাজ ছিল আত্মনির্ভর।তাই বৃহৎ সামাজিক শক্তির বিকাশ এখানে সম্ভব হয়নি।একই কারণে বাঙালীর ঐতিহাসিক বিবর্তন সাময়িকতা দ্বারা আক্রান্ত,ইতিহাসের সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তার আবির্ভাব নয়।সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এই টলটলয়মান অবস্থা আরও গাঢ় হয় যখন তা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একরাষ্ট্র হিসেবে যোগ দেয়।দেশভাগের মাত্র এক দশক আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা জন্ম নেয়ায় যেমন পাকিস্তান নিজেই ছিল দূরকল্পনাহীন তেমনি স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর আগে ছয় দফা দাবির মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ ধারণাও এত অল্প সময়ের মধ্যেই যে পরিণতি লাভ করবে এটাও ছিল ঐতিহাসিকভাবে অপ্রত্যাশিত।বাঙালী যখন ভারত থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তান চেয়েছিল তখন সে মূলত তার অধিকারই চেয়েছিল।ভারতের কোন কোন অঞ্চল নিয়ে কীভাবে পাকিস্তান হবে তার স্পষ্ট ধারণা সাধারণ বাঙালীর ছিল না।একই বাঙালী পাকিস্তান পাওয়ার পর নিজের অধিকার পাওয়ার পরিবর্তে যখন আরও বেশি করে বঞ্চিত ও শোষিত হচ্ছিল তখন সে এ থেকে মুক্তির জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।বাংলাদেশ হলে কী হবে,রাষ্ট্রগতভাবে তা কতটা শক্তিশালী বা দুর্বল হবে,বিশাল ভারতের উদরের ভেতর তার অবস্থান কতটা সদৃঢ় হবে--এতকিছু ভাবার অবকাশ সে পায়নি।মূলত বাঙালী চিরকাল লড়েছে তার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারের জন্য।তাই অল্পেই সে অনেক বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছে,বৃহৎ রূপরেখা তার সামনে উপস্থাপন করতে হয়নি।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে স্বাধীন দেশেও সেই বাঙালী আজও তার ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস যেমন স্থবিরতা,বঞ্চনার ইতিহাস;স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসও তেমনি এক সূক্ষ্ণ প্রতারণা,উৎপীড়ন ও দমনের ইতিহাস।


বাংলাদেশের সংবিধানের  অনুচ্ছেদ ৮ এ জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে  কথা বলা হয়েছে তা থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে।বাংলাদেশ মূলত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে সে তার সংবিধান রচনা করেছে তা বলা যায় না।সমাজতন্ত্র বিষয়টির উল্লেখ তৎকালীন পরাশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে সাহায্যকারী সোভিয়েত ইউনিয়নকে সন্তুষ্ট করার মানসেই যদি রাখা না হত তবে অন্তত তার কিছু আদর্শ বাস্তবায়নের সামান্য চেষ্টা দেখা যেত।বর্তমানে সমাজে সম্পদের সুষম বন্টন তো দূরের কথা দেশের বেশিরভাগ সম্পদ অল্প সংখ্যাক পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে।বাংলাদেশে আসলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে কিছু নেই।এখানে আছে হয় একেবারে উচ্চবিত্ত নয় একদমই নিম্নবিত্ত।এদেশে তার চারপাশ থেকে শিক্ষা বা মূল্যবোধে সামান্য অগ্রগামী  নিম্নবিত্ত কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যবিত্ত বলে প্রচার করতে প্রেরণা পায় অথবা কোথাও মধ্যবিত্ত হিসেবে নিজেদের উল্লেখ দেখলে উচ্ছ্বসিত হয়।এটাই বাঙালীর মধ্যবিত্তের ইতিহাস।স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ও আশির দশকে প্রচুর রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্টদের নিয়ম নীতিহীনভাবে শিল্পঋণ দেওয়া হয়।তাদের বেশির ভাগই সে ঋণ সুদসমেত ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়।একটি দরিদ্র দেশে খেলাপি  ঋণের পরিমাণ দেখে তাই আমাদের বিস্মিত হতে হয়।যেখানে একজন সাধারাণ মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে,একটি শিশু স্বাভাবিক খাদ্য পাচ্ছে না--সেদেশে এইসব খেলাপী ঋণকারীরা দামী দামী গাড়ি হাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।বিদেশে বাড়ি কিনছে। উপহার হিসেবে হয়তো ঋণ পরিশোধের উপায় হিসেবে আবার নতুন একটি ঋণের সুযোগ পাচ্ছে।এভাবে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আমরা রাঘব বোয়ালদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছি।সেদিক থেকে দেখলে বাঙালীর পাকিস্তান আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির সুফল ভোগ করছে সমাজের এই ক্ষুদ্র অংশ।বিল্পব জনগণের জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তনই আনেনি।এজন্য বুদ্ধিজীবীগণ এ ধরণের বিপ্লবকে বেহাত বিপ্লব বলে থাকেন অর্থ্যাৎ যে বিপ্লব বেহাত হয়ে গেছে।শুধু তাই নয় চিরকালের বিদ্রোহী বাঙালীর সমাজ কাঠামো এমন ফ্রেমবন্দী করে ফেলা হয়েছে যে তার পক্ষে এখন আর নতুন কোন বিপ্লব করা সম্ভব নয়,নীরবে সব সয়ে যাওয়াই এখন তার নিয়তি।কেউ কেউ বলবেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে কী কোন পরিবর্তনই হয়নি?হ্যা হয়েছে তো অবশ্যই।অর্থনৈতিক ও মানবিক সূচকে নানা অগ্রগতি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে।বিশ্বের প্রতিটি দেশই অগ্রসরমান।তার সাথে তাল রেখে সামাজিক অগ্রগতি হবেই,সমাজ তো একজায়গায় পড়ে থাকবে না।দেখতে হবে তার সক্ষমতার তুলনায় এসব অগ্রগতি কতদূর হয়েছে।সময়ের ব্যবধানে খড়গোশ  যদি কচ্ছপের সমান দূরত্ব অতিক্রম করে বা একদিকে এগিয়ে দশদিকে পিছিয়ে যায় তবে সেটাকে শুধু দূরত্বের পরিবর্তন দিয়ে হিসেব করলে যথার্থ চিত্র বোঝা যায় না।


রাজনৈতিক সহিংসতা ও আস্থাহীনতা বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের মূল অন্তরায়।এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা ব্রিটিশ আমলের চেয়েও বেড়েছে।এদেশের বড় দলগুলো একে অপরকে চুল পরিমাণও বিশ্বাস করে না।বরং ক্ষমতায় গেলে একে অপরের বিরুদ্ধে এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে যে তার পক্ষে আর ক্ষমতা থেকে সরে আসার পথ থাকে না।কেননা সে জানে ক্ষমতা পেয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সে যা করেছে ক্ষমতা হারানোর পর তার সাথে প্রতিহিংসাবশত আরও খারাপ কিছু হবে।তাই বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়াকে বাঘের পীঠে চড়ার সাথে তুলনা করেছেন।একবার বাঘের পীঠে চড়লে যে আধিপত্য এবং নেমে গেলে স্বয়ং বাঘের জন্যই যে সমূহ বিপদ--এটাই তার প্রধান কারণ।রাজনৈতিক এই আস্থাহীনতার জন্যই এদেশ তার ঐতিহাসিক বীরদের নির্মমভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি।যুদ্ধে পরাজিত হয়েও পাকিস্তান সরকার যে বঙ্গবন্ধুর শরীরে আচর কাটার সাহস দেখায়নি সেই বাঙালীই স্বাধীন দেশে তাকে সপরিবারে হত্যা করে স্বশরীরের রক্তখেকো হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যে চারনেতা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন,স্বাধীনতার পর নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করতেও আমাদের হাত কাঁপেনি।শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধে যথেষ্ট স্বাক্ষর রাখা আরেক সমর নায়ক ও রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেও বিশ্বদরবারে আমরা নিজেদের রক্তপিপাসু হিসেবে প্রমাণ করেছি।এরপর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে সাময়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সংবিধান সংশোধন,প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি আমরা দেখেছি। জাতিসংঘ কর্তৃক দূত প্রেরণ করেও এ বিষয়ে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায়নি।সকল দলের অংশগ্রহণে পারস্পরিক আস্থাপূর্ণ নির্বাচন এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট।এই আস্থাহীনতা আমাদের ঠেলে দিতে পারে আরও বড় কোন ষড়যন্ত্রে এবং এই সংকটের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব ব্যবহার করতে পারে তাদের কলকাঠি নাড়ার কাজে।তাই দোষারোপ ও দমনমূলক নীতি বাদ দিয়ে পারস্পরিক আস্থা অর্জন এখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।


একথা সবাই জানেন যে,জনসংখ্যা সমস্যা বাংলাদেশের একটি বিরাট সমস্যা।এত ক্ষুদ্রায়তনের ভেতর এত অধিক জনসংখ্যা পৃথিবীতে বিরল।বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বড় রাশিয়ার জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ১৪ কোটি ৫০ লাখ বাংলাদেশের জনসংখ্যা সেখানে ২০২২ এর সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী ১৬ কোটি ৫১ লাখ।বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।সীমিত সম্পদ নিয়ে এত অধিক সংখ্যক মানুষের খাদ্য,শিক্ষা,চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেওয়া যে কোন সরকারের পক্ষেই কঠিন।ফলে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উপায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।কিন্তু আমরা জানি আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দেশের বাইরে গিয়ে খুব নিম্নমানের কাজ করে।বিদেশে যাওয়ার আগে তারা যদি প্রয়োজনীয় কারিগরী শিক্ষা নিয়ে যেতে পারতো তবে তারা ক্যারিয়ার জগতে আরও ভাল অবস্থানে থাকতে পারতো এবং বাংলাদেশের রেমিটেন্স থেকে আয় আরও বেড়ে যেত।আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে।মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের দেশসমূহে প্রকৌশল,ব্যবস্থাপনা,স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের প্রচুর উচ্চপদস্থ ও দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছে।একই সাথে যা বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে এবং আর্থিকভাবেও ভারতকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।দেশের অভ্যন্তরে জনসংখ্যার বাড়তি চাপ ও কৃষিতে প্রযুক্তিগত ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অসংখ্য লোক পাড়ি জমিয়েছে শহরে,বিশেষ করে ঢাকার চারপাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা কলকারখানা গুলোতে।এখানে তারা পরিবেশগতভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।দেশের নাগরিক সুবিধা,জীবিকা সমস্তকিছু একজায়গায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে ঢাকা শহরে জনস্রোত একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার।এ শহরের প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মানুষের লোভ তাই জঘন্যভাবে দানা বেঁধেছে।উপরন্তু যানজট,খাদ্যে বিষক্রিয়া,শব্দ দূষণ,বায়ু দূষণ,নিরাপদ পানির অভাব ইত্যাদি বিষয় ঢাকা শহরকে এক আধুনিক বস্তিতে রূপ দিয়েছে।মানুষ তো দূরের কথা একটা কুকুরেরও এ শহরে আর স্বাভাবিক জীবন-যাপনের উপায় নেই।বাঙালীর রাষ্ট্র গঠনের অভিজ্ঞতা অল্প দিনের,তাই কিছুই সে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারেনি।নগর গঠনের অপরিকল্পনা,নাগরিক সুবিধার বিকেন্দ্রিকরণে ব্যর্থতা ইত্যাদি তার শহর ও নগরগুলোকে দিনে দিনে আরও বেশি কোণঠাসা করে ফেলছে।


পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতিহাসে যে নজির স্থাপন করেছিল খতিয়ে দেখতে হবে তার ধারাবাহিক অর্জন কতটুকু।বাংলাকে আমরা মূলত রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলাম,শুধুমাত্র মাতৃভাষা নয়।বাংলা এমনিতেই সকল কালে আমাদের মাতৃভাষা ছিল,আমাদের সংগ্রাম ছিল মূলত শিক্ষা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা।আজ বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের উচ্চশিক্ষার বাহনকে আমরা বাংলা করতে পারিনি।এখনও উচ্চ আদালতে রায় দেওয়া হয় ইংরেজিতে।ফলে গ্রামের একজন আব্দুল গফুরের যখন আদালতে গুরুতরো সাজা হয় তখন সে বিষয়ে পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণ বের হলেও তার মর্ম উদ্ধার তার পক্ষে সম্ভব হয় না।বাংলায় রায় দিতে গিয়ে বিচারকগণের প্রধান সমস্যা হল যে বেশিরভাগ আইনের বই রচিত ইংরেজি ভাষায়।তাই আইনের রেফারেন্স দিতে গিয়ে তাদের ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হয়।একটি স্বাধীন দেশে আমরা যদি সকল বিষয়ের প্রয়োজনীয় বইসমূহ বাংলায় অনুবাদ করতে না পারি--এ ব্যর্থতা ঢাকবো কী দিয়ে?একই কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি।আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে কিন্তু একমাত্র ইংরেজিই যদি আমাদের উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হয়,সেটা যদি আবার বাংলায় যথাযথ বই না থাকার কারণে হয়,তবে তা আমাদের জাতীয় লজ্জার বিষয়।প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত ১০০ বছরে মাত্র ৬১ টি মৌলিক বই প্রকাশ করেছে।অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ভাষ্যমতে যার ২৬ টিই এখন বিলুপ্ত।এই যদি হয় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যাপীঠের অবস্থা তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কত করুণ তা সহজেই অনুমেয়।বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বিভিন্ন ডিগ্রীর জন্য গবেষকগণ যে থিসিস করে থাকেন দুঃখের বিষয় যে তার কোন বাংলা অনুবাদও আমরা পাই না।বেশির ভাগ সময় এসব থিসিসে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের এত প্রভাব থাকে যে তা অনুবাদের সাহস হয়তো আমাদের নেই।ফলে থিসিসকারী ব্যক্তি জনগণের টাকায় বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে পদোন্নতি লাভ করলেও তাতে সমাজ ও জাতির কোন উপকার হয় না।এ কারণে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বে আমাদের অবদান শূন্যের কোঠায়।যেখানে আন্তর্জাতিক নানা বই ও গবেষণা বাংলায় অনুবাদের ইচ্ছে বা ক্ষমতাই আমাদের নেই সেখানে নতুন নতুন বিষয়ে গবেষণা আশা করা আত্মপ্রবঞ্চনার সামিল।দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ।বলাই বাহুল্য প্রকৌশল বিদ্যার টার্মগুলো শুধু মুখস্তের বিষয় নয়,তার চিত্রটি সম্যকভাবে উপলব্ধির জন্য প্রতিটি বিষয়কে আমাদের বুঝতে হবে।যেহেতু এ বিষয়ের সমস্ত বই ইংরেজির অপ্রচলিত প্রতিশব্দে লেখা,তাই পূর্ব শিক্ষার অভিজ্ঞতাপ্রসূত আমাদের শিক্ষকগণ যেমন তা পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝাতে অক্ষম আমাদের ছাত্রগণও তা পূর্ণাঙ্গ বুঝতে অনাগ্রহী।দেশে ডাক্তারি শিক্ষারও একই অবস্থা।বলতে গেলে একজন ইঞ্জিনিয়ার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যেমন নতুন করে ইঞ্জিনিয়ার হয় একজন ডাক্তারও কর্মজীবনে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা,পর্যবেক্ষণ,ট্রেনিং ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃত ডাক্তার হন।এক্ষেত্রে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের জন্য বিএসসি বা এমবিবিএস কোর্সটি শুধুমাত্র তার পূর্বস্মৃতির কারণ হয় যার জন্য সে তার পরবর্তী বাস্তব ধাপগুলোকে বুঝতে পারে।এজন্য সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যেমন আমরা সামান্য ফ্লোর লেভেলের কিছু কাজ ছাড়া বড় দায়িত্ব দিতে সাহস পাই না তেমনি সদ্য এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারের কাছেও সামান্য সর্দি-কাশি ও পেটের অসুখের চিকিৎসা ছাড়া যাই না।একই কারণে দেশের বাইরে গিয়ে আমাদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররা যথার্থ মূল্যায়ন পান না।প্রশ্ন হল দেশে প্রকৌশল ও মেডিকেলবিদ্যার জন্য এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান থাকার পরও কেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদ্যাচর্চার নিতান্ত প্রয়োজনীয় বইকে অন্তত বুঝার সুবিধার জন্যও আমরা বাংলায়  অনুবাদ করতে পারছি না?বলা বাহুল্য উপযুক্ত শিক্ষার জন্য ব্যবহারিক বিষয়াদিরও যথেষ্ট অভাব আছে আমাদের।উপযুক্ত গবেষণা না থাকার কারণে প্রযুক্তিগত বিশ্বে আমাদের অবদান সত্যিই লজ্জাজনক।আমরা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে না পারি অন্তত নতুন কিছু ধারণা যদিও বিশ্বকে দিতে পারি তবু বাঙালী,বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ তার নয়া ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি পায়।দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর পরিবর্তে বরং একদম নিম্নস্তর পর্যন্ত ইংরেজিকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো এককালে আমাদের দেশের শিল্পপতিদের বাতিক ছিল,এখন উচ্চ মধ্যবিত্ত,মধ্যবিত্তের মাঝেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।ইংরেজি শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন আছে কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকেই যে ভালভাবে আত্মস্থ করেনি একটি বেদেশি সভ্যতাকে কল্পনায় লালন করলেও বাস্তবে সে তার সমকক্ষ হতে পারে না।ফলে এধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শারীরিকভাবে দেশীয় কিন্তু মানসিকভাবে পাশ্চাত্যে বসবাসকারী একদল সংকর বুদ্ধিমত্তাই আমরা কেবল তৈরি করছি।আশঙ্কার কথা এই যে এ ধরনের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এখন মফস্বল শহরেও ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং অচিরেই ব্যাঙের ছাতার মতো রূপ পরিগ্রহণ করবে বলে মনে হচ্ছে।দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া গেলেও মফস্বল শহরগুলোতে ইংরেজি মিডিয়ামের জন্য যে মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া যাবে না তা বলাই বাহুল্য।সুতরাং মেধার নামে তা মুখের কথায় টিয়েপাখি সর্বস্ব সামান্য ইংরেজি শব্দ উচ্চারণকারী কিছু প্রজন্ম সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।


প্রযুক্তিগত উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের পশ্চাদপদতার আরেকটি লক্ষণ।আশির দশকের পর বাংলাদেশে যে পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছে তার বিস্তৃতির উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সক্ষমতা।পোশাকশিল্পের একচ্ছত্র বিকাশ অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটি ভাল দিক।তবে এর সাথে সাথে অন্যান্য শিল্পের বিকাশেও যে পরিমাণ মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ তা দেয়নি।ফলে আরও বিপুল সম্ভাবনা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি।বাংলাদেশে পোশাকশিল্প এখনও পরনির্ভর বাণিজ্য।যেহেতু আমরা বিশ্ববাজারে নিজেদের কোন বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি তাই ক্রেতারা চাইলে যেকোন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারেন।যেহেতু পোশাকশিল্পের উপরই বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের ৮৫ শতাংশ নির্ভর করে সেহেতু এর উপর অতি নির্ভরশীলতার জন্য বৈশ্বিক নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও জিম্মি হয়ে যেতে পারে।বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ।তাই ইলেকট্রনিক নানা আইটেম ও তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবশ্যই বাংলাদেশকে বিনিয়োগ করতে হবে।প্রযুক্তিগত সকল শাখায় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র না থাকায় দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জনগণের টাকায় পড়ালেখা করা প্রচুর মেধাবী ছাত্র বাইরের দেশে চলে যাচ্ছে।এভাবে মেধা পাচারের ফলে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে।একইভাবে প্রাইভেট সেক্টরের কোন উন্নয়ন না করে গত কয়েকবছর যাবত সরকারী চাকরির অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধি তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করছে তাদের সাবজেক্টিভ কর্মক্ষেত্র ছেড়ে সরকারী নানা প্রশাসনিক চাকরির প্রতি আগ্রহী হতে।মানুষের ব্যক্তিত্ব ও রুচি অনুযায়ী কিছু পরিমানে এটা হতে পারে কিন্তু সমাজের বিপুল অংশ যদি নিজেদের বিশেষায়িত অঞ্চল ছেড়ে এভাবে একদিকে ঝুঁকে পড়ে তখন বুঝতে হবে কোথাও গভীর কোন ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে।এটাও একধরনের মেধার অপচয়।বাংলাদেশের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি কারণ ছাত্ররাজনীতি।রাজনীতির যে ধণাত্মক দিকটির দিকে খেয়াল রেখে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয় সেটা হয়তো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব।কিন্তু আমাদের মত মৌখিক গণতান্ত্রিক দেশে ছাত্ররাজনীতি শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে জিম্মি করে দেশকে পিছিয়েই দিচ্ছে না,একইসাথে ছাত্রাবস্থায়ই নানা প্রলোভনে পড়ে ছাত্ররা চাদাবাজি,টেন্ডারবাজি,ভোটডাকাতি ইত্যাদি গর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়ছে।ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটা চর্চা এখান থেকেই শুরু হচ্ছে।কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সামান্য অংশ ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বাকি ছাত্রদের তারা জিম্মি করে রাখছে।ছাত্ররাজনীতির এই অবক্ষয়ের কাছে শিক্ষকরাও অসহায়।নানা সময় ক্ষমতার ছায়ায় আশ্রয়পুষ্ট শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।দুর্নীতি বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে আরেকটি শত্রু।এ নিয়ে আর নতুন কিছু বলার নেই।দেশের উন্নয়নে সরকারীভাবে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে বিভিন্ন নেতা ও আমলাতান্ত্রিক কর্মচারীদের হাতে।ফলে রাস্তাঘাট,স্কুল-কলেজ,ব্রীজ নির্মাণ,প্রযুক্তিগত যন্ত্রাংশ আমদানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথার্থ উপযোগিতা জনগণ পাচ্ছে না।দেশের প্রতিটি স্তরে এভাবে দুর্নীতি প্রবেশ করায় শুধু শিক্ষায়তন বা বইপত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলে,আইন করে কোন লাভ হচ্ছে না।কেননা সমাজ থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ দুর্নীতির শিক্ষা ও প্রেরণা পাচ্ছে।


নানা কারণে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেনি।অথচ সমভাষী ও সমসংস্কৃতির মানুষের এত আধিক্য পৃথিবীর আর খুব বেশি দেশে নেই।আমাদের সমাজে মানুষের মন ও মস্তিস্ক কোন একটি সাধারণ বিষয়ে এখনও সমতা লাভ করতে পারেনি।ফলে যে কোন ঘটনাকেই আমরা যার যার ব্যক্তিগত আদর্শ দ্বারা ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসি।তাই যে বিষয়টি দলমত নির্বিশেষে সবার জন্যই জরুরি সে বিষয়েও আমরা একমত হতে পারিনা।নাগরিক সমাজের ঐক্যহীনতার এই সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।সমাজে যেকোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে তারা দ্বিধা করছে না।সমাজের বিচ্ছিন্ন কয়েকজন শুধু নাগরিক হিসেবে দ্বিমত করতে এলেও তার গায়ে রাজনৈতিক সিল লাগিয়ে নির্মমভাবে তাকে দমন করা হচ্ছে।ফলে উপযুক্ত কারণ ছাড়াই কোন একটি দেশীয় দ্রব্যের মূল্য একলাফে তিনগুণ হয়ে গেলেও নিশ্চুপ নাগরিক সামান্য প্রতিবাদ করতে পারছেন না,তার ব্যাখ্যা চাইতে পারছেন না।এমনকি দলীয় স্বার্থে এক বা একাধিক দলের কোন্দলে দেশ অচল হয়ে গেলেও চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কারও কিছু করার থাকছে না।আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক দলই এই নাগরিক সমাজের উত্থানকে ভয়ের চোখে দেখে,তার কারণ আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেনি এটা একটা সত্য,তার সাথে আরেকটা ভয়াবহ সত্য এই যে বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক অনাস্থা।শহুরে দেয়ালবদ্ধ জীবনে শুধু নয় এদেশের গ্রামের মানুষের মাঝেও আস্থা কম।কিছুদিন আগেও গ্রামে একজনের ইটের বাড়ি হলে আশেপাশের মানুষের তা সহ্য হত না।এখনও বিষ ছিটিয়ে পুকুরের সমস্ত মাছ মেরে ফেলা,বাগানের কচি গাছ কেটে ফেলা পত্রিকায় নিত্য দেখা যায়।এর মূলে রয়েছে অত্যন্ত নীচু মানসিকতা ও প্রতিহিংসা।পৃথিবীর অসভ্যতম দেশেও এরকম নজির আছে কিনা জানিনা।এককালে গ্রামে গ্রামে যে গৃহস্থের ধানের গোলা ও পালের পশু পোড়ে উজার হয়ে যেত তার পেছনেও এই প্রতিহিংসা কতটা দায়ী ছিল তা গবেষণার বিষয়।১৯৮০ এর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল গ্রামে ৪.৫ শতাংশ এবং শহরে  ২.৫ শতাংশ মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করে।১৯৯৯-২০০১ সালে তা বেড়ে ২৩.৫ হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে তা যে আবার নিম্নমুখী হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।


বর্তমানে বিশ্বায়নের চাপে সকল দেশের স্বাধীনতাই পরোক্ষভাবে খর্ব হয়েছে।বলতে গেলে গুটি কয়েক দেশ বৈশ্বিক নানা প্রতিষ্ঠানের জালে ফেলে অন্যান্য দেশকে কব্জা করে রেখেছে।বিশ্বের মানচিত্রে একটি ছোট ও অনুন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থা সেখানে খুবই নাজুক।তবে বাংলাদেশ চাইছে ভারত,আমেরিকা ও চীনের সাথে একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে।সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে গিয়ে তাই তাকে চলতে হচ্ছে অত্যন্ত সাবধানে।ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও একটি বড় রাষ্ট্র তাই ভারতের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি তার আধিপত্যও আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টনে অসাম্য,সীমান্তহত্যা,পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কলকাঠি নাড়া এসবের প্রতিবাদ বলিষ্ঠভাবে করতে হবে আমাদের।
ভারতকে ইতোমধ্যেই সেভেন সিস্টারে যাওয়ার জন্য আমরা ট্রানজিট দিয়েছি কিন্তু তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার এখনও আদায় করতে পারিনি।এভাবে বিভিন্ন বিষয়কে কুক্ষিগত করে ভারত আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়কেই প্রভাবিত করছে যা তার কূটনীতির এক বিশেষ অংশ।সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ আরেক ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে।বলতে গেলে বাংলাদেশ এখানে একটি বন্ধুহীন অবস্থানে রয়েছে।চীন,ভারত,আমেরিকা,ওআইসি ইত্যাদি দেশ ও প্রতিষ্ঠান মৌখিক সাহায্যের কথা বললেও কার্যত তাদের বাস্তবসম্মত কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে নানা সংস্কৃতির উপজাতি বাস করায় সেখানে পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি পটভূমি বিরাজ করছিল,এখন রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্ত হওয়ায় তা নতুন মাত্রা পেয়েছে।সম্প্রতি মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরু হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া একটি ঘোলাটে ও অনিশ্চিত দিকে মোড় নিয়েছে।রোহিঙ্গা ইস্যুকে কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক উত্তোরোত্তর খারাপ অবস্থানে যাবে এবং অভ্যন্তরীনভাবেও বাংলাদেশ নানা জটিলতায় পড়বে।এসবের পাশাপাশি বিশ্বে একদিকে চীন-রাশিয়া অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার  আধিপত্যবাদী বিরোধে সৃষ্ট রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সমস্ত পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সংকটের সম্মুখীন।করোনা মহামারি থেকে আপাত মুক্তি দেখা গেলেও বৈশ্বিক এই অচলাবস্থা মোকাবেলা করা বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ ও দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ।সম্প্রতি রিজার্ভ সংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলছে।রিজার্ভ সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় আমরা যে অরাজকতা লক্ষ্য করেছি যেকোন উপায়ে সেরকম পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় এগোতে হবে।তার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি নাগরিকের যথাযথ নাগরিক দায়িত্বপালন,রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট নিরসন এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে তার যথাযথ বিকাশ।বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ তরুণ সমাজ।এদেশে নারীরাও এখন সর্বক্ষেত্রে অগ্রগামী।সর্বোপরি বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল এবং যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেদের সঠিক পথকে চিহ্নিত করতে সক্ষম।তাই নানা সংকট ও আবর্তনের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে উদ্ভূত যেকোন পরিস্থিতিতে  স্বকীয়তা বজায় রাখবে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে তার অবস্থান দিনে দিনে আরও সুদৃঢ় করবে।এটা এখন আর শুধু আশাবাদ নয়,এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার উপরই তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

...........
অস্তিত্ব


পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই সত্য মিথ্যার বিষয়ে সচেতন।যা সে চোখে দেখছে তাকেই সে একমাত্র সত্য মনে করে না।নিজের ইন্দ্রিয় ও পর্যবেক্ষণের সর্বোচ্চ নিরীক্ষণের মাধ্যমে সে আরও সত্যের হাতছানি পেতে চায়।সে হিসেবে একমাত্র মানুষই জানে জানার চেয়ে তার চারপাশে অজানাই বড়।এই অজানা,রহস্যময়তার উপর ভর করেই সে কল্পনার অবকাশ পেয়েছে।সৃষ্টি করেছে শিল্প-সাহিত্য।মূলত মানুষ যদি মহাবিশ্বের সবকিছুই প্রত্যক্ষ জানতো এবং মানুষের যদি কোন সীমাবদ্ধতাই না থাকতো তবে সে বস্তুগতভাবে যত উন্নতই হোক কল্পনার ধার খুইয়ে মানসিকভাবে অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে পড়তো।তার শিল্পসাধনাও এত ব্যাপ্তি পেত কিনা সন্দেহ।সেই দিক থেকে হালের আধুনিক সভ্যতা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে নানাদিক সমৃদ্ধ করলেও মানুষের জীবন থেকে রহস্যময়তার স্তর একে একে দূর হচ্ছে।তবু যিনি কবি,যিনি শিল্পী তার রহস্য থেকেই যায় মৃত্যুচেতনার মত অন্তর্গত রক্তের ভেতর।আর সভ্যতার এত উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও তাই তাকে ক্লান্ত করে,সৃষ্টির প্রেরণা জোগায়।


মানুষ তার পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে, তার নির্মিত প্রযুক্তি দিয়ে সবসময় বুঝতে চেয়েছে তার চারপাশকে।আসতে চেয়েছে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে।তবু মানুষ কি পেরেছে কোন পরম সত্যে পৌঁছতে?নাকি একটি আপাত ফলাফলদায়ী সত্যের উপর নির্ভর করে মৃত্যুর মত অজানার কাছে নিজেকে সমর্পনের আগে মৃদু অভিনয় করে যাচ্ছে।পঞ্চইন্দিয়ের মাঝে সহজেই একটি বস্তুর দর্শন,শ্রবণ,স্বাদ,গন্ধ ও তাপের অনুভূতি  আমরা পেতে পারি।মানুষের কাছে এ সহজাত সত্য।যদি মানুষের পঞ্চইন্দিয়ের স্বাদ ইন্দ্রিয়টি না থাকতো তবে এটি ছাড়াই মানুষ দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পারতো।বিবর্তনগতভাবে তখন সে সেভাবেই গড়ে উঠতো।স্বাদ সম্পর্কে কোন অভাব সে বোধ করতো না।তখন তাকে কোনভাবেই বস্তুর স্বাদ সম্পর্কীয় সত্য বুঝানো সম্ভব হত না।বস্তুর তাপ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।তার মানে সত্য নির্ভর করছে আমাদের এই সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ের উপর।এখন যদি এই দর্শন,শ্রবণ,স্বাদ,গন্ধ,তাপ ইত্যাদির বাইরে বস্তুর আরও কোন সত্য থাকে যা ইন্দ্রিয়ের অভাবে আমরা বুঝতে পারছি না,এমনকি অতীন্দ্রিয়ের সাহায্যেও হয়তো তাকে কল্পনা করতে পারছি না--তার সুরাহা কে করবে?কেউ কেউ মনে করতে পারেন এসব পুরনো দার্শনিক প্রশ্নের মাধ্যমে আমি হয়তো বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আধ্যাত্মিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছি।মূলত সে ধরনের কোন ইচ্ছে বা সাধনা আমার নেই।আমি শুধু প্রশ্নগুলো রাখছি সময়ের পীঠে।


মানুষ আসলে কোন বস্তু সম্পর্কেই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে না।তার সামনে থাকা একটি কাঠের খণ্ড সম্পর্কেও সে শতভাগ তথ্য পেতে সক্ষম নয়।এই একখণ্ড কাঠ সম্পর্কে সকল বৈজ্ঞানিক তথ্য উপস্থাপন করা হলেও তার কাছে এমন প্রশ্ন থেকে যাবে যার উত্তর আমাদের জানা নেই।অথবা এমন বিষয় অজানা থেকে যাবে যে বিষয়ে প্রশ্ন করার মত উৎসও আমাদের কাছে নেই।তার মানে আমরা যে সত্যকে প্রত্যক্ষ জানি তার বাইরেও আরও সত্য থাকতে পারে,
সত্যের হয়তো একটি ভগ্নাংশকেই আমরা অনুভব করছি।সুতরাং মানুষ এক আপাত সত্যের পর্যবেক্ষকমাত্র,পূর্ণাঙ্গ সত্যের সিদ্ধান্তকারী সে নয়।


এক ধরনের মাছ আছে যারা বস্তুকে একটি নির্দিষ্ট এ্যাঙ্গেলে বাঁকা দেখে।অর্থ্যাৎ বস্তুটি প্রকৃতপক্ষে যে জায়গায় আছে তার চেয়ে সামান্য ডানে বা বামে দেখে।কিন্তু এজন্য সেই বস্তুর সংস্পর্শে যেতে সে মাছের কোনই সমস্যা হয় না।কেননা জন্মের পর থেকেই এই ত্রুটিই তার সহজাত হয়ে গেছে,যান্ত্রিক ত্রুটির মত অবচেতনে তাকে হিসেব করেই সে প্রকৃত পাঠ নিতে সক্ষম।তার জীবনযাপনের যাবতীয় সূত্র এই ত্রুটির সাথে সমন্বয় করেই গড়ে উঠেছে।সুতরাং সেটা তার কাছে আর ত্রুটি নেই।মানুষও যদি এরকম কোন এক ত্রুটির ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠে,একইভাবে মানুষেরও তা নির্ণয়ের ক্ষমতা নেই।


মানুষের জীবনে সময়ের যে ব্যবহার সেটাও এক আপেক্ষিক ব্যাপার।পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে সময় পৃথিবীর মত নয়।সূর্যের চারপাশে বিভিন্ন গ্রহের অবস্থানের প্রেক্ষিতে সময়ের যে ধারণা তৈরি হয়েছে সৌরজগতের বাইরে তার সত্যতা কতটুকু?যদি সবকিছু স্থির হয়ে যায়,কোথাও কোন পরিবর্তন না হয় অথবা পরিবর্তনকে বিপরীত ক্রিয়ার মাধ্যমে ফলাফলহীন করা যায় তখন সময় বলে আর কিছুই থাকবে না।আইনস্টাইন তো বলেই দিয়েছেন যে আলোর বেগে ছুটতে পারলে সময় শূন্য হয়ে যায়।তার মানে সময়ের ধারণাও কোন না কোনভাবে মানুষের সীমাবদ্ধতারই ফসল।পদার্থবিজ্ঞানের নানা গবেষণায় আমরা জানি বস্তুর ধর্মও স্থির নয়।অভিকর্ষ বলের তারতম্যের জন্য পৃথিবীর বাইরে কোন গ্রহে হয়তো একজন বালকের পক্ষেও হিমালয়ের মত পাহাড় একহাতে ওজন করা সম্ভব হবে।বিজ্ঞানীরা অহর্নিশি মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছেন।যদি কোনদিন তাদের পেয়েই যান,এমনও দেখা যেতে পারে যে পৃথিবীর নানা পদার্থসমূহকে তারা ভিন্নভাবে ব্যবহার করছেন।হয়তো দেখা যাবে আগুনকে তারা পানির মতো অবলীলায় ব্যবহার করছেন আর পানিকে আগুনের মতো প্রাণঘাতী হিসেবে এড়িয়ে চলছেন।সুতরাং বস্তুর ধর্ম এবং পরিপার্শ্বের উপর তার প্রভাব--এটাও এক আপেক্ষিক ব্যাপার।


বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে আজ মানুষের অস্তিত্বকেও গাণিতিক নিয়মে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।সেই হিসেবে তার সমস্ত আচরণকেই প্রকাশ করা হচ্ছে জিনগত বিবর্তন দিয়ে।প্রাণীর বস্তুগত পরিবর্তন বা আচরণগত নানা বৈশিষ্ট্যকে জিনগত বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বর্ণনা করা গেলেও তার আমিত্বের ধারণার সাথে তা কতটা সংযুক্ত?নির্দিষ্ট ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনে রহিমের স্থানে সত্তাগতভাবে করিম এলে বিজ্ঞানের কী সত্যিই তা নিরুপণের ক্ষমতা আছে?জিনগত পরিবর্তন দিয়ে নিশ্চয় মানুষের শিল্পসত্তাকেও ব্যখ্যা করা যাবে না।যমজ সন্তানদের বেলায় জিনগত মিল সবচেয়ে বেশি থাকে।সেজন্য বাইরের আকৃতিতে তারা হুবুহু একরকম বা কাছাকাছি থেকেও মানসিকভাবে হতে পারেন দুজন দুই মেরুর মানুষ।সুতরাং জিনগত বিবর্তন আচরণে প্রভাব ফেললেও তা মানুষের সত্তাগত বিবর্তন নয়।


অস্তিত্বের ধারাণা তাই এখনও একটা অমীমাংসিত বিষয়।বিজ্ঞান শুধু প্রাণের বিচার করতে পারে,ধর্ম শুধু উপসংহার টানতে পারে,তবে কেউই এর সুনির্দিষ্ট পরিধি দেখাতে পারে না।সম্ভবত মানুষের চেয়ে এত গাঢ় আমিত্বের অনুভূতিসম্পন্ন আর কোন প্রাণী নেই।সবকিছুর চেয়ে এটাই তার বড় সম্পদ।একই কারণে অস্তিত্বের এই বিনাশই তার সবচেয়ে বড় দুঃখের কারণ।এজন্য একজন সূক্ষ্ণানুভূতি সম্পন্ন মানুষের অন্য কোন দুঃখ না থাকলেও মৃত্যুজনিত চিন্তা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে।তবু নিঃশ্বাস নিতে নিতে প্রত্যেক মানুষই অস্তিত্বের আনন্দে মশগুল হয়,মহাবিশ্বকে তার আমিত্বের কেন্দ্রে স্থাপন করে।


আমার অস্তিত্বই সবচেয়ে বড় অলৌকিকতা।


....


ভারত একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র।অতি প্রাচীনকাল থেকে নানা বর্ণ,নানা জাতি,নানা ধর্মের লোক এখানে এসে নিজেদের বাসস্থান তৈরি করেছে এবং এদেশের ঐতিহ্যের সাথে তারা মিশে গেছে। তাই বৈচিত্র‍্যের মাঝে ঐক্যকে ভারত গর্বের সাথে গ্রহণ করেছে এবং এটাকে ভারতীয় রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের প্রধান আশ্রয় হিসেবে তারা মনে করে। কিন্তু ইদানিং ভারতের সেই বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক চরিত্র বিশেষ একটি শাসক গোষ্ঠীর জন্য কলঙ্কিত হচ্ছে। এর আগে সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্যাতন ও বঞ্চনা হতো সেটা ছিল আঞ্চলিক কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকার উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে সাধারণ জনগণের মাঝে উসকে দিচ্ছে এবং এটাকেই তাদের রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছে।এক কথায় বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন করছে ও তার চর্চার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছে।এর ফলে ভারতের চিন্তাশীল শিক্ষিত শ্রেণীও এই উগ্রবাদিতা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।


ভারতে প্রায় বিশ কোটি মুসলমান আছে।এছাড়া শিখ,জৈন,বুদ্ধ,খ্রিষ্টান ইত্যাদি ধর্মের এক উল্লেখযোগ্য অংশ বাস করে।ভারত বড় দেশ হিসেবে তুলনামূলক বিচারে তারা সংখ্যালঘু হলেও তাদের এই সংখ্যাটা একেবারেই কম নয়।ভারত চাইলেও এই ভিন্ন ধর্মের লোকদের রাতারাতি বিদায় করতে পারবে না,রাতের আঁধারে তাদের গুম করে দেয়াও সম্ভব নয়।মোদি সরকারের জন্য মেনে নেয়া কষ্টকর হলেও সব ধর্মের সব জাতির লোককে নিয়েই ভারতকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।অন্যথা করতে চাইলে  সমস্যা বরং বাড়বে,আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সম্মান নষ্ট হবে।কংগ্রেস ও তৃণমূল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ইমেজ নষ্ট করার জন্য বিজেপিকে দায়ী করেছে।


বিজেপি সরকার কোন রাখঢাক বা চক্ষুলজ্জা না রেখেই সরাসরিভাবে মুসলমানদের তার হিংসাত্মক রাজনীতির প্রধাণ লক্ষ্য করেছে।দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভেঙে দুইভাগ হওয়ার পরও তার দেশে কেন এত মুসলমান রয়ে গেছে--এই প্রশ্ন মোদী সরকারের নিদারুণ যন্ত্রণার কারণ হয়েছে।করোনার সময় নানা উপায়ে বিশ্বে এই প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে গেলেও মোদী সরকার সেই সময় তাবলিগ জামাতের একটি দলকে বিশেষভাবে তার জন্য দায়ী করে,প্রায় হাজার খানেক মুসলমানের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিদ্বেষকে তখন মিডিয়াতে তীব্রভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় যে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদের জন্যই ভারত চিরকাল সংকটে  পড়ে।করোনার সময় তাবলিগ জামাতের সেই অপরাধ আইন লঙ্ঘনীয় হতে পারে কিন্তু মুসলমান হওয়ার জন্যই যেন তাদের অপরাধকে অনেক বড় হয়ে ধরা পড়ে!


সম্প্রতি ভারতে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব আইন বিশ্বের মননশীল মানুষকে তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছে।এটি ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বরে ভারতের সংসদে পাস হওয়া একটি আইন। এ বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আগত নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিষ্ঠান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরকিত্ব পাওয়ার সুযোগ হয়েছে এই বিলের মাধ্যমে।মুসলিমদের জন্য এজাতীয় কোনো সুযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।ভারতীয় আইনের আধারে প্রথমবারের মতো ধর্মীয় পরিচয়কে নাগরিকত্ব লাভের শর্ত হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে যা চরমভাবে নিন্দনীয়।মুসলমানদের প্রতি বিজেপি কী ধরনের ঘৃণা পোষণ করে তা এই আইনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।তাছাড়া এই আইন দ্বারা তার আশেপাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে।পরোক্ষভাবে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে সেসব দেশে অন্যধর্মের লোকেরা নিরাপদ নয়,তাই ভারত তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে মহান ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছে।


সম্প্রতি ভারত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে বাতিল করেছে এবং তাকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে।তাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাকে কারাবন্দী করেছে,যুবকদের হত্যা করেছে।সেনাবাহিনী নামিয়ে, ইন্টারনেট ও সব ধরনের তথ্য সেবা থেকে বঞ্চিত করে তাদের পুরো বিশ্ব থেকে আলাদা করে রেখেছে।এ নিয়ে ভারতের সচেতন গোষ্ঠী নানাভাবে বিজেপির সমালোচনা করেছে।কাশ্মীর এখন ভারতের এক শীতল বরফময় রাজ্যে পরিণত হয়েছে।এখানেও মুসলমান বিদ্বেষ কতটা কাজ করেছে সেটাও বিস্তর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।কিছুদিন আগে বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতীয় আদালত যে বিতর্কিত রায় দিয়েছে তা প্রকাশ্যভাবেই এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে গেছে।প্রায় ৫০০ বছর আগের নির্মিত একটি মসজিদকে এভাবে দিনে-দুপুরে ঘোষণা দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হল তার কোন বিচারই হল না!যে পুরাতাত্ত্বিক কমিটিকে বাবরি মসজিদের নিচে অন্যকোন ধর্মীয় স্থাপনা ছিল কিনা তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয় তারা তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।তারা নিজেরাও রিপোর্টে সে কথা স্পষ্ট করে জানিয়েছে।তবু আদালত বলেছে তারা মানুষের ধর্মীয় আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে এই রায় দিয়েছে এবং মুসলমানদের জন্য অন্যত্র মসজিদের জন্য জমি বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছে।বলা বাহুল্য মহান আদালত এখানে শুধু এক চোখার মতো এক ধর্মের মানুষের আবেগকেই দেখলেন!ক এর প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে যুক্তি প্রমাণ ছাড়া খ কে বিতারিত করা আধুনিক কালের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদালতের কী ধরনের সাম্যবাদী আচরণ তা আমাদের অবাক করেছে।শুধু তাই নয় সম্প্রতি জ্ঞানব্যাপী মসজিদকেও একই ধরনের লক্ষ্যে পরিণত করা হচ্ছে।এখানেই শেষ নয়,তাজমহলের মতো ঐতিহাসিক স্থানকেও তারা সন্দেহের চোখে দেখছেন।ধারণা করা হচ্ছে তার রুদ্ধ কক্ষে নিশ্চয় এমন কিছু আছে যা ভারতের প্রধাণ ধর্মগোষ্ঠীর ধর্মীয় উপাদানকে বহন করে।এই ধারণা ভুল প্রমাণিত করতে ইতোমধ্যেই সেইসব রুদ্ধ কক্ষের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে।তাতেও শেষ রক্ষা হয়তো হবে না কারণ তাজমহলের নাম ও প্রতিষ্ঠার সাথে মুসলিম ইতিহাস জড়িয়ে আছে।তাই তার কোথাও না কোথাও অন্যধর্মের পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস জড়িয়ে দিয়ে,মানুষের সরল ধর্ম বোধকে উসকে দিয়ে তাজমহলকে ধ্বসিয়ে দিতে না পারলে একশ্রেণীর উগ্রবাদী ধার্মিকদের রাতের ঘুম স্বস্তিদায়ক হবে না।বলাবাহুল্য যা কিছু মুসলিম ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত তাকেই এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে,এমনকি প্রায় ৮০০ বছর আগের নির্মিত কুতুব মিনার নিয়েও প্রশ্ন উঠছে!


গত নির্বাচনের আগে আগে হঠাৎ করে পাকিস্তানের সীমান্তে বিমান হামলা--এটাও বিজেপি সরকারের এক রাজনৈতিক চাল।উন্নয়ন দিয়ে জনসমর্থন ধরে রাখতে না পেরে প্রতিবেশী দেশের প্রতি ঘৃণাকে উসকে দিয়ে জনসমর্থন ধরে রাখার এ এক দারুণ কৌশল।শুধু তাই নয় অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির নানা এমপি মন্ত্রীরা প্রকাশ্য ভাষণেই বাংলাদেশকে উল্লেখ করে অপমান সূচক বক্তব্য পেশ করে থাকেন।সুতরাং বিশেষ এক শ্রেণীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণই এখন বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক ট্রাম কার্ডে পরিণত হয়েছে।


কিছুদিন আগে বিজেপির দুই নেতা হযরত মুহাম্মদ (স) কে নিয়ে প্রকাশ্যে যে কটুক্তি করেছে তা বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে।মুখে সব ধর্মকে সম্মান করার কথা বললেও বিশেষ একটা ধর্মের প্রতি যে তাদের বিশেষ ঘৃণা রয়েছে এবং দীর্ঘ দিনের চর্চায় তা ফুলে-ফেঁপে বিশাল আকার নিয়েছে তা তাদের বক্তব্যের নমুনা দেখেই বুঝা যায়।কেন্দ্র থেকে বহুদিন ধরে পুষ্টি না পেলে এ ধরনের উচ্চারণের সুযোগ তারা হঠাৎ করে পেত না।এই দুই কর্মীকে বরখাস্ত করে বিজেপি তাদের অবস্থানকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে চাইলেও সবাই জানে বিজেপি সরকার মূলত অর্থনৈতিক কারণে বাধ্য হয়ে এটা করেছে।তারা ভাবতে পারেনি বিশ্বের এতগুলো দেশ থেকে একসাথে তার উপর কূটনৈতিক চাপ আসবে,মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় আশি লক্ষ ভারতীয় অভিবাসী নাগরিকের ভবিষ্যত প্রশ্নবিদ্ধ হবে,ইরাক-ইরানের সাথে তেল গ্যাসের বাণিজ্য সংকোচিত হওয়ার উপক্রম হবে,সর্বোপরি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ইমেজের অবনমন হবে।সকল ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো শুধু যে মুখের কথা নয় তা প্রমাণ করতে গেলে বিজেপি সরকারকে তাদের বিদ্বেষী নীতি থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে এবং নাগরিক অধিকারের সর্বত্র সাম্যের দৃষ্টান্ত দেখাতে হবে।এ কাজটি সহজ নয় কঠিন।কিন্তু এই কঠিনকে সহজ করতে না পারলে বিশেষ এক গোষ্ঠীকে বড় করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তারা নিজেদের ক্ষতিই করবে।কাউকে পিছিয়ে রেখে,কাউকে খারাপ রেখে নিজে ভাল থাকার দিন বিশ্বে শেষ হয়ে গেছে।ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে তা আমরা টের পাচ্ছি।


//বিঃদ্রঃ আমার এই লেখাটি কোন বিশেষ দেশ বা ধর্মকে লক্ষ্য করে নয় বরং একটি উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে//


১১.০৬.২২