একজন পাঠকের কাছে আধুনিক কবিতা কতটা অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য এই নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই ক্ষেত্রে  আধুনিক না বলে সমকালীন শব্দটিও  প্রয়োগ করা যায়। আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতা কিংবা অস্পষ্টতার অভিযোগ সব সময়ই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই দুর্বোধ্যতার মাপকাঠি কিভাবে নির্ধারিত হয় ? কবিদের লেখা কবিতা না বোঝার ব্যর্থতার দায় কি শুধু কবিদের একার, নাকি পাঠকেরও রয়েছে ?


কেউ কেউ বলে থাকেন কবিতা না বুঝে উঠার ব্যর্থতা সম্পূর্ণ পাঠকের, এতে কবির কিছু করার নেই। আবার অনেকেই এই মতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কবিতার দুর্বোধ্যতাকেই দায়ী করে দায়ভার কবির উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং বিশ্লেষণও কম হয়নি। ভবিষ্যতে হতেও থাকবে।


একটা সময় ছিল যখন কবিদের সাথে পাঠকের সংযোগ হওয়াটা ছিল দুরূহ এবং অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ সেই সময় কবিরা পাঠকের হাতের নাগালে ছিল না। সেই সময় কবিতার সমালোচনা পড়ার জন্যে নির্ভর করতে হতো কাব্য সমালোচকদের লেখা প্রকাশিত প্রবন্ধ কিংবা বোদ্ধাদের সভা-সেমিনারে গুরুগম্ভীর আলোচনা শোনার জন্যে ঠায় বসে থাকা।বলা যায় ব্লগকেন্দ্রিক বাংলা কবিতার প্রসারতা  এবং ইন্টারনেট ব্যাবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে কবি ও পাঠকের মধ্যে ভাব বিনিময়ের প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ও যোগাযোগের একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ স্থাপিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। আর এই লাগসই প্রযুক্তির কল্যাণে পাঠক হিসাবে ব্লগে প্রকাশিত কবিতা বোঝা গেল কি বোঝা গেলনা এই অভিযোগের ব্যক্তিগত কৈফিয়তটি এখন সরাসরি কবির দরবারে উপস্থাপন করা সহজ হয়ে পড়েছে। ফলে কবিতার  দুর্বোধ্যতা নিয়ে কবি ও পাঠকের মধ্যে প্রত্যক্ষ লড়াই এখন জলন্ত ইস্যু। যেটি আগে কল্পনাও করা যেত না।    


আসলে এই দুর্বোধ্য শব্দটির মাপকাঠি কিভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে এই প্রশ্নটি একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছেও মূখ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন যখন দেখি ব্লগে প্রকাশিত কবিতায় পাঠকের মন্তব্যে 'কিচ্ছু হয়নি', 'বুঝিলাম না', কিংবা 'কিছুই বুঝিলাম না' এমন সব মন্তব্যে ভরপুর থাকে।এইখানে আমি কোনো নির্দিষ্ট ব্লগের কথা উল্লেখ না করে সামগ্রিক কবিতাকেন্দ্রিক বাংলা ব্লগের কথা বলছি। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং একজন কাব্যপাঠক হিসেবে অনুভূতিটুকু বলার প্রয়াসে এই লেখাটির অবতারণা।


দুর্বোধ্য মানে কি উচ্চারণে কঠিন শব্দ ? নাকি শব্দের সঠিক অর্থ পাঠকের জানা না থাকা। বাংলা ভাষায় অনেক অপ্রচলিত শব্দ রয়েছে যার অর্থ একজন পাঠক হিসেবে আমি নাও জানতে পারি। আমার এই না জানার দৈন্যতাকে আমি শব্দের দুর্বোধ্যতা ভেবে  এর দায় কবির উপর চাপিয়ে দিতে পারি কি? আমার না বোঝার দায় কবির উপর বর্তাবে কেন ? এইটি হলো একটি দিক।


অন্যদিকে সহজভাবে লেখা কবিতাও কী খুব সহজে বোঝা যায়? অনেক আধুনিক কবির সহজ ভাষায় লেখা অনেক কবিতা আছে যা সহজে উপলব্ধিতে আনা দুরূহ হয়ে পড়ে। এই সহজ এবং জটিল বিষয়টি আপেক্ষিক। সহজ শব্দের গাথুনিতে বিমূর্ত ভাবধারার কারণেও পাঠক কবিতার অর্থোদ্ধারে তাঁর ইচ্ছাশক্তি  হারিয়ে ফেলে।এই ধরনের কবিতার অনেক উদাহরণও দেয়া যেতে পারে এখানে। লেখাটির কলেবর না বাড়ানোর তাগিদ থেকে উদাহরণ দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। আসলে নান্দনিক এবং শৈল্পিক মনের ভাবনায় নিজকে নিবেদিত করতে না পারলে কবির কবিতায় যে শৈল্পিক আঁচর থাকে পাঠক কিভাবে তাঁর মর্মোদ্ধার করবে? এর দায়ভারও কি কবিকে বহন করতে হবে?

কবিতার চরণ থেকে শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থ বের করে কবিতা বোঝার চেষ্টা সবসময় সার্থক নাও হতে পারে। এই বিষয়টি পাঠককে কবিতা পঠনের সময় মনে রাখতে হবে। কবিতা পাঠে পাঠককের মননশীলতা এবং কবিতার রহস্যময়তা বিবেচনায় আনতে না পারলে একজন সার্থক কবিতা পাঠক হওয়া দুরূহ বটে। অনেকেই মনে করে থাকেন রহস্যময়তা কবিতার প্রাণ।আর এই রহস্যময়তার সৌন্দর্য ও শক্তির কারণেই কবিতা আলাদা হয়ে যায় গদ্যসাহিত্য থেকে।এখানেই গদ্যসাহিত্য থেকে কাব্যের স্বাতন্ত্রতা।


কবিতার দুর্বোধ্যতা কিংবা অস্পষ্টতার অভিযোগের কারণেই কোনটি কবিতা আর কোনটি অকবিতা এই প্রশ্নটি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে বেশ জোরালো হয়ে দেখা দেয়। কোনটি কবিতা এবং কোনটি নয়, এর সীমারেখা আদৌ টানা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত ?এই নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে।এই ক্ষেত্রে কেউ কেউ কবিদের স্বেচ্ছাচারিতার কথাও বলে থাকেন। তবে আমার সহজ একটি উপলব্ধি হলো কবিতা তো সভা-সেমিনারের পঠিত কারো ফরমায়েশি 'কী-নোটস' নয় যে, চার দেয়ালের কক্ষে উপবিষ্ট নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রোতা-দর্শকদের জন্যেই রচিত হবে? কবি যা অনুভব করেন তাঁর আত্মদহনের চিত্রকল্প নিজের মত করে সাজিয়ে তোলেন স্বাধীনভাবে। কবির ভাবনা কখনো পাঠকের ভাবনার সাথে মিলে যেতেও পারে আবার নাও মিলতে পারে।পাঠকের না বোঝার দায় কবির উপর ছেড়ে দিলে সংবেদনশীল লেখক তাঁর অপার সম্ভাবনাময় জগৎ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।


বাঙালি মাত্রই কবিতার প্রতি যেমন রয়েছে গভীর ভালবাসা তেমনি কবি ও কবিতার প্রতি বিদ্রুপ করাও ততটাই আবেগী বিষয়। কবি অথবা কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গ উক্তি যতটা তাচ্ছিলের সাথে সহজে করা যায় কিংবা হয়ে থাকে সাহিত্য চর্চার  ক্ষেত্রে অন্য কোনো  শাখায় ব্যঙ্গ চর্চা ততটা জনপ্রিয় নয় বলেই আমার বিশ্বাস। এর কারণটা অনুধাবন করতে হলে বুঝতে হবে বিদ্যমান সমাজ কবিদের কোন চোখে দেখে থাকে। অথবা একটু ঘুরিয়ে বললে সমাজে কবিদের সামাজিক মর্যাদা কতটুকু। জনশ্রুত আছে কবি পত্নীরাও নাকি কবিদের সামাজিক মর্যাদাকে খাটো করেই দেখেন। আর কান পাতলে এও তো শোনা যায় কবিতার পাঠক অপেক্ষা কবির সংখ্যাই নাকি বেশি। প্রচলিত এই কথাটি দিয়ে মূলত কবি ও কবিতার প্রতি কথকদের বিদ্রুপ চেতনাই প্রকাশ পায়।


আমার কাছে মনে হয় কবিতা পাঠ উপলব্ধির ব্যাপার। শিল্পকে উপলব্ধিতে এনে বোঝার কাজটা প্রথমে সেরে নিতে পারলে কবিতার অর্থোদ্ধারে মনোনিবেশ করা সহজ হয়।কবিতার পাঠোদ্ধার নির্ভর করে পাঠকের মননশীলতা,শিক্ষা এবং রুচি বোধের উপর। 'সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’- জীবনানন্দ দাশের এই বাণীকে যখন আমরা আলোচনায় নিয়ে আসি তখন আমরা এই  কথাটি বললে অত্যুক্তি হবে কি (?) 'সকলেই কবিতার পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক’ !! আমার কাছে পুরো বিষয়টি মনে হয় আপেক্ষিক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। একজনে যা পারেন বা বোঝেন অন্যজন তা নাও বোঝতে পারেন।কবিতার দুর্বোধ্যতা এবং অস্পষ্টতা পাঠকের অভিযোগ হলেও এই দায় শুধুই কবির নয়, কিছুটা পাঠকেরও বটে।