প্রশ্নটা হল পাঠকনামা আমি কেন লিখি। উত্তরটা খুব সোজা, নিজের জন্য। আমার মোদ্দা কথা হল আমি অন্য কারোর জন্য কিছু লিখতে পারিনা। কিন্তু অনেকে লেখা পাই যখন মনে হয় এ শুধু আমার জন্য লেখা। আজ এমনি এক কবি আর তার কবিতা।


কবি ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৫ - ২০০৫)। কবির কথায়


"সারাজীবন একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে, আজ দেখি, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমি প্রায় কিছুই করিনি, শুধু কবিতা লেখা ছাড়া। বাংলা কবিতা নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করব, আমার এরকম একটা ইচ্ছে ছিল কমবয়স থেকেই। সেটা বোধহয় স্বপ্নই থেকে গেল। এই সংকলনের জন্যে আমার কবিতার বইগুলো থেকে পছন্দসই কিছু কবিতা বাছতে বাছতে শেষপর্যন্ত বুড়োই হয়ে গেলাম। তথাকথিত ছন্দ ছাড়া আমার কবিতাকে আমি হাঁটতে শিখিয়েছিলাম। আমার নিজের কাছে আমার একটাই দায় ছিল, জ্যান্ত আর নতুন কবিতা লেখার দায়... ( অগস্ট ১৯৯৯ / ভাস্কর চক্রবর্তী)"


আমি কবি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলব না সুধু এই টুকু বলব, এমন কবিতায় যেন আমি প্রতিদিন বাঁচতে পারি।


কাব্যগ্রন্থ: শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, এসো সুসংবাদ এসো, রাস্তায় আবার, প্রিয় সুব্রত, দেবতার সঙ্গে, আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে, ইত্যাদি।


১) শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা


শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব – প্রতি সন্ধ্যায় কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে – আমি চুপ করে বসে থাকি – অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা – তারপর হঠাত
সব মোমবাতি ভোজবাজির মতো নিবে যায় একসঙ্গে – উত্সবের দিনহাওয়ার মতো অন্যদিকে ছুটে যায়, বাঁশির শব্দ
আর কানে আসে না – তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয় – জলের ভেতর – শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিশ্বাস নিই সারাক্ষণ – ভালো লাগে না সুপর্ণা, আমি
মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না – পায়ের পাতা
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ – ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা
আঙ্গুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন – আমার ভালো লাগে না – শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব


একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার কাছে – চারিদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যচ্ছিল না সেদিন – সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম – চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার -
এখন আমি মানুষের মতো না – রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাত্ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার – ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না – আমি
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি এখন – যে-দিক দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব



২) মৃতসঞ্জীবনী


যদি ভালোবাসা, প্রিয়, আমাকে বাঁচাতে পারে বাঁচবো তাহলে-
খসে পড়া তারাগুলো নাহলে আমাকে নিয়ে
মৃত তারাদের দেশে চলে যাবে-
সেখানে সমাধি হবে আমারও বা
লেখা হবে, আজব বিচিত্র এক নীল তারা, চশমাধারী প্রজাপতি,
এখানে ঘুমোচ্ছে সারা জীবনের ঘুমে,
যে তারাটি একা একা ছাতে বসে বুঝতে চেয়েছিল
ভালোবাসা আজো কেন বিক্রি হবে চড়া দামে
ভালোবাসা, রাজারহাটের তিন বেডরুমের মোলায়েম ফ্ল্যাট নাকি কোনো?
শাদা কোনো টাটা সুমো?
হলুদ বালিতে যায় ভরে যায় দেশ-বিদেশ, যাকে তোমরা
মরুভূমি বলো
সে মরুবালিও পথ শুঁকে শুঁকে এসে গেছে আমাদের ঘরে
এসো তুমি ধবধবে বিছানায় দুঘন্টায় ধন্য হও পথের কুটীরে
তিন গ্লাস স্বাধীনতা সঙ্গে পাবে
শুধু তুমি, এখনো কেন যে ভাবো, ভালোবাসা
ভালোবাসা মৃতসঞ্জীবনী


৩) কাটাকুটি


কালো কালির ওপর
লাল কালির মর্মান্তিক কাটাকুটি।
ব্যাপারটা কিছুই নয়।
ব্যাপারটা সত্যি তেমন কিছুই নয়
যদি না মনে পড়ে
কালো একটা ছেলে
রক্তাক্ত
ধানক্ষেতে শেষঘুমে ঘুমিয়ে আছে।


৪) আঁধার বিষয়ে


যে বিকেলে জ্বর আসে সেই বিকেলের মতো তুমি এসে দাঁড়িয়ে রয়েছো। ঘড়ির ভেতর দিয়ে রক্তের রেখার মতো সময় চলেছে। -আমি কি অসুখ থেকে কোনোদিন উঠে দাঁড়াব না?আজো রাত জাগাজাগি হয়। শরীর মিলিয়ে যায় নরম শরীরে।-আমি শুধু আমার প্ থিবী দেখে যাই...। চারপাশে কেমন হাজারো আলো জ্বলে আছে,তবু এমন আঁধার আমি জীবনে দেখিনি।


৫) বিশাল এই মহাদেশের ছায়ায়


আমি যে কী করব নিজেকে নিয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সুদুর কোনো গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে পড়ব?
কান্নাকাটি করব কোনো মেয়ের কাছে গিয়ে?
জীবনটা নিয়ে, সত্যি, একটা ছেলেখেলা করেছি-
পুরোনো প্রেমিকার শোকে আপাতত একটা সিগারেট ধরানো যাক।


কিন্তু বিছানায় এভাবে চিত হয়ে আর কতদিন চলতে পারে?
শীতকাল, আমার আর ভালো লাগে না-
বিছানা থেকে ছোটো বোনকে ডাকি-‘আলোটা জ্বালিয়ে দে’
বিছানা থেকে ছোটো বোনকে ডাকি-‘আলোটা নিভিয়ে দে’
বিষাক্ত একটা জীবন আমি গিলে চলেছি প্রতিদিন
ঐ এসে পড়েছেন হেডলি চেজ
তিনি আজ জানাচেছন আমাদের-অপরাধের পরিণাম কী!


আমার যে হয়েছে কী মুশকিল দিনগুলো আর কাটতেই চায় না।
বন্ধুদের হাতগুলোও এমনই কৃপণ যে কাঁধে পড়ে না
গলাগুলোও এমনই শুকনো যে ঘুম পাড়ায় না আমাকে।
তবে কি ঔষধপত্রই সারাজীবন ছড়িয়ে থাকবে আমার ঘরে?
তবে কি শান্তা সর্ম্পকে আমি আর জানতে পারবো না কিছুই?
‘শাশ্বত’ শব্দটাকে আমি আলমারিতে চাবি-বন্ধ করেছি গতকাল
অশ্তিত্ববাদ নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই
বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকা হয়তো এখন প্রেম করছে শালবনে
সন্ধেবেলায় শুয়ে-শুয়ে আমি একটা মোমবাতির মৃত্যুদৃশ্য দেখছি এখন।


৬) এপিটাফ


দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে, মৃত্যু, আমি তোমাকে
জন্মাতে দেখেছি


৭) প্রেম


আমার স্মৃতি ছিল জটিল ফলে ডাক্তারবাবু কিছুটা ছেঁটে দিয়েছিলেন।
কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিন
হাঁটু পর্যন্ত মোজা, আর সকালবেলা চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে!
অথবা, কিছুই ঘটেনি হয়তো কোনোদিন-
আমিই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিলাম পুরো ব্যাপারটা


একটা কাঠবেড়ালী আমার জন্যে একটা বাদাম নিয়ে ছুটে আসছে।


৮) উৎস


কেউ-কেউ হারিয়ে যেতে চায়, চিঠি লেখে দুটো-একটা, হারিয়ে যায়।
নৌকাগুলো দুলতে-দুলতে ফিরে আসে---
গাছের নিচে আমরা বসে থাকি--- তবু নিভতে চায় না আগুন।


কতোরঙের ফুল সকালবেলা বিকেলবেলা ছাদের টবে ফুটে ওঠে।
কথাটা, কথাটা তো সত্যি
ওদের নিয়ে আমাদের আর তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।


দু-চারজন মানুষ, বলা-কওয়া নেই, কীরকম সটকে পড়ে হঠাৎ।
এলিজি লিখতে বসে আমরা চেয়ে দেখিঃ
কিছু নতুন মুখ
আমাদের জামার হাতা ধরে টানে--- আর, কী মনখুশ হাসি ফোটায়।


৯) যে কবিতাটা আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম


সন্ধেবেলার ডানায় এখন সাদা তিনফোঁটা বৃষ্টিবিন্দু।
সুর নেই, তবু দু-একটা গানে গলা মেলাচ্ছে ছেলেরা মেয়েরা।
নভেম্বরের রাত্রিতে এক মাতাল ভিজছে
চোদ্দ বছর কাটিয়ে দিলাম আত্মহত্যা করিনি।


তোমার বাড়ির রাস্তা আমাকে খুঁজে পেতে হবে। ভেবেছি কতই।
আজ চেয়ে দেখি, ছোট্ট পাখির ঠোঁট ছুঁয়ে সেই রাস্তা গিয়েছে।
বই-খাতা সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে
স্বপ্নে দেখেছি গতকাল, তুমি আমাকেই ভালোবাসছ।


রেডিয়ো এখন খেলনাবাক্স প্রচারগাড়ির সামনে আসুন।
উড়তে থাকুন দূর মহাকাশে ভাসতে থাকুন মেঘে মেঘে একা।
দিদিরা ভায়েরা, এ সপ্তাহের নতুন ঘোষণাঃ
নগদ অথবা সহজ কিস্তি ভালোবাসা এক মিনিটে।


বেরিয়ে পড়েছি সকালবেলায় কলকাতাটাকে কিনে নেবো আমি।
কিনে নেব দিন রাত্রি কিনবো চিন্তাভাবনা পাঠাব দিল্লি।
সামান্য এক ইঞ্চিতে সব ধূলিসাৎ হয়
বাবা ভোলানাথ মারুক। কাটুক। বাড়ি আর ফিরে যাব না।


১০) চৌ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা চারজন


'এদিকে স্বর্গের পথ' --- বলে একচক্ষু নারী হঠাৎ হারিয়ে গেল---
চৌ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা চারজন হেসে উঠলাম--- এ-ওর মুখের
দিকে, তাকিয়ে আমরা হেসে উঠলাম
যেন স্বর্গে যাবো বলে
সেই ভোরবেলা--- অদ্ভুত ছাতা হাতে আমরা বেরিয়েছি, পায়ে
আশ্চর্য চপ্পল


এ-ওর শরীর নিয়ে গন্ধ শুঁকছি সন্ধেবেলা--- সন্ধেবেলা
এ-ওর বুকের মধ্যে উঁকি মেরে কোথায় দুঃখ পাপ
লুকোনো টাকার মতো রয়ে গেছে, কোথায় ঈশ্বর
টুপি খুলে হাঁটু মুড়ে
বসে আছেন, চেয়ে দেখছি---
পোস্ট-মাস্টারের মেয়ে শুধুমাত্র জুতোজোড়া নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে
তার সঙ্গে গোলাপি যুবক --- তারা স্বর্গে যাবে


আমাদের স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে


১১) অনুপস্থিতি


তীব্র কোনো শব্দ হবে না
গড়িয়ে পরবে না কোথাও এক ফোঁটা চোখের জল
'যাক ঝামেলা চুকলো' কেউ হয়ত বলবে
কেউ হয়ত চিঠি লিখবেঃ ঢ্যাঙাটা গেছে
নতুন একটা জিরাফের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে আমার
প্লাতেরোর ভাইপোর সঙ্গে আলাপ হবে
যখন দূর থেকে আমরা দেখবো আমাদের পৃথিবীটাকে
হয়তো তুমি তখন
দু-একটা কমলালেবু অথবা নাসপাতি কিনে ঘরে ফিরছো
চারপাশে কীরকম একটা রাত্রি-রাত্রি ভাব
রাস্তার ধারে তখন হয়তো জোরসে বক্তৃতা চলছেঃ
মশাইরা, একটু ভাবুন।


১২)  প্রেমিকেরা প্রেমিকারা


প্রেমিকেরা একদিন স্বামী হয়। স্বামীরা তারপর আর
প্রেমিক থাকে না।
অথচ ওমলেট খায়। ফিশফ্রাই খায়।
দু-তিন চারপাক রাস্তায় ঘুরে এসে
বিড়ি খায়।
আরো একটু রাত হলে ন্যাংটো ছবি দেখে।
প্রেমিকারা? তারা বা কোথায় যায়? --তারা তো স্ত্রী হয়, আর
পেটে বাচ্চা ধরে।
কথাগুলো, কোথায় হারিয়ে যায়। রান্নাঘরে আলো জ্বলে ওঠে।



( কবিতা পড়ুন, কবিতার বই কিনুন)
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, ফেসবুক, বিভিন্ন ওয়েব সাইট, ব্লগ, কবির লেখা কবিতার বই, ম্যগাজিন
(তথ্যে কোন ভুল থাকলে অবস্যই ধরিয়ে দেবেন)