কবিদের জীবন যাপনই কবিতা এই কথা যদি সত্যি হয় তা হলে কবি পিনাকী ঠাকুর এর কবিতা যেন জীবনের ছবি। কবি পিনাকী ঠাকুরের কবিতার সাথে আমার প্রথম আলাপ দেশ পত্রিকার একটি কবিতার মাধ্যমে, যদিও কবিতার নাম মনে নেই তবুও সে দিন সে সময় আমার অনুভব আজও আমাকে বিস্মিত করে তোলে। বিশেষ কিছু কবির কবিতা পড়ার সময় আমি নিজে কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকি। তার প্রধান কারণ তাদের লেখা এতটাই শক্তিশালী যে আপনার লেখা কে প্রভাবিত করবেই। কবি পিনাকী ঠাকুর তেমনি এক কবি। সাধারণ থেকেও যে অসাধারণ হওয়া যায়, খুব সামান্য জিনিস দিয়ে যে বিশ্বের তাবড় ভাবনা দের প্রকাশ করা যায় তা কবির কবিতা প্রমাণ। গতানুগতিক লেখার বাইরে এসেও কবির শব্দ চয়ন থেকে ভাব বা ভাষা, প্রকাশ খুব কাছের খুব পরিচিত অথচ বিস্তার মুগ্ধ করবেই। কবির কবিতায় বিরাট অংশ জুড়ে থাকে মফঃস্বল এর জীবন যাত্রা, চলন বলন, চিত্রতা ও সাধারণ মানুষের রোজনামচা। কোথাও গিয়ে বার বার কবির কবিতার সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলি।


https://www.facebook.com/Pinaki-Thakurer-kobitara-141093652657574/ (কবির কবিতার ফেসবুক পাতা)
আনন্দ সম্মান ১৪১৮` পুরস্কার (২০১২) কবি পিনাকী ঠাকুর।-`চুম্বনের ক্ষত` কাব্যগ্রন্থের জন্য।
কাব্যগ্রন্থ:
চুম্বনের ক্ষত , জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়, অকালবসন্ত, পিনাকী ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতা, একদিন অশরীরী, আমরা রইলাম, অঙ্কে যত শূন্য পেলে, হ্যাঁ রে শাশ্বত, সাত মিনিট ঝড়, বিপদজনক, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে।  
কবির জন্ম ১৯৫৯ সালে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র স্নাতক স্তরে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বাবা অমল ঠাকুর মা শ্রীযুক্তা মীরা ঠাকুর।
কবির বসবাস কোলকাতা থাকে একটু দূরে হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়া, কবিতা কে ভালোবাসা ছোট থেকেই কিন্তু বিপর্যয়, ঘাতকের দল খুন করছে তাঁর বাবাকে। সচ্ছল ছিল না পারিবারিক অবস্থা, তীব্র জীবন সংগ্রামের মাঝেও সেই কিশোরের ভুলে যায়নি কবিতা। যৌবনের প্রারম্ভে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্র হাতে এলো, তখন পিনাকী ঠাকুরের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেলে কবিতার আকাশ। প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল উশীনর পত্রিকায়, ১৯৭৪-এ। মাঝে বেশ কিছু বছর কবিতা থেকে সরে ছিলেন। ফিরে এলেন, নব্বইয়ের দশকে, মনের টানেই। ডানলপ-এ চাকরি করতে করতে কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটি উচ্চতর কোর্স করার সুযোগ এসেছিল। প্রচুর পড়াশোনা করে তার প্রথম ধাপটি পেরলেন। আর মাত্র একটিই ধাপ ছিল, কর্পোরেট-এর হাতছানি ছিল, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন কবিতা। দেশ’ পত্রিকায় কবিতা , উনিশশো উনআশি।
প্রয়োজনে প্রতিদিনই নিয়মিতই কোলকাতাতে আগমন । ফিরে যাওয়া রাতের নিঝুম ট্রেনে। সেই আসা-যাওয়ার পথের ধারেই তাঁর জেগে  কবিতা নিয়ে।  কবি ভালবাসেন আড়াল, চূড়ান্ত মৃদুভাষী, এই কবির লেখা এ প্রজন্মের কাছে অমূল্য সম্পদ।

আবৃতির লিংক


https://www.youtube.com/watch?v=-wDc2bh9l28



চাঁদ পুড়িয়ে খাচ্ছি ---পিনাকী ঠাকুর


এই বাড়িটা ডিপ্রেশনের বাড়ি
ওই বাড়িটায় বাজতো গ্রামোফোন !
কাব্য উধাও, পাঞ্জাবি আর দাড়ি
রয়েই গেল ! চাকরি খুঁজব ?ক্ষুদ্রশিল্পে লোণ ?
`রানু ভিলা'য় বাজতো গ্রামোফোন
এখন বাজছে পিংক ফ্লয়েডের সিডি
ব্যালকনিতে তাকাসনে ভাই মন
কে দাঁড়িয়ে ? হিমাংশুদের কী-যেন তুতো দিদি ?
এই বাড়িটার রোজ সকালে বাজার
এই বাড়িটায় ব্রতই উপবাস !
ওই বাড়িটায় অনেক বাঁদর, ড্রয়িংরুমে একটা মুক্তাহার
এই বাড়িটা ধুঁকতে ধুঁকতে শ্বাস !
আমাদের ছাদ-জানলা ভাঙাচোরা !
ওদের বাড়ি সুর ছুড়েছে বলেই
চাঁদ পুড়িয়ে খাচ্ছি কপাল পোড়া
সুচিত্রার কণ্ঠে বেজে উঠল: `কৃষ্ণকলি'....
না খেয়ে কেউ মরে না, শোন্ মিডিয়াবালা, খুব কুচুটে তোরা !


মধুচন্দ্রিমা -- পিনাকী ঠাকুর


সুখাদ্য? পিঁপড়ের ডিম। উৎসব? ভাত। সাদা ভাত।
দশ বছর আগের একটা রাত। হাত পেতে সেই
জ্যোৎস্না ধরবার পর টুরিস্টরা যা করে।
জঙ্গলে পশুর ডাক। সারারাত রবীন্দ্রসঙ্গীত।


আজকেও টিভিতে দেখা রক্ত আর বুলেটের ফাঁকে
করুণ দু'চোখ তুলল মধুচন্দ্রিমার কাঁকড়াঝোড়...


শীত আসছে -- পিনাকী ঠাকুর


পার্লারের মেয়েটা ছিল লেস্‌বিয়ান । সে তোমার উত্তাপ চেয়েছে ।
সমুদ্র পুরুষ । সে-ও চায় ।
যে হাওয়া ঝাপট মারছে আমি তার জেন্ডার জানিনা ।
কতদূর ? এক ঘণ্টা আরও ।
পুরুষতন্ত্রকে নিয়ে সেমিনার তুমি যত পারো
আমি তত স্পর্শ পাই তোমার আদর মাখি শীত- আসছে
হাওয়ায় হাওয়ায় ...  


অন্তর্জাল -- পিনাকী ঠাকুর


মেয়ের পর মেয়ের পর দেশবিদেশের
গ্ল্যামারগার্ল
তাদের স্তন বরফ দিয়ে ঢাকা
তাদের যোনি ভার্চুয়াল
লাস্য হাসি আমন্ত্রণ তাদের নাচ
তৈরি করেন ডিরেক্টার-


তার চেয়ে চল্ হাড়কাটায় টিকিট কেটে
পাহাড় নদী দেখতে যাই


হিংসে -- পিনাকী ঠাকুর


ওর কথা বলিস না প্লিজ! না! না! শুনলেই আমার
খাওয়া ঘুম নষ্ট হয়। ওর গল্প বন্ধই থাকুক।
একটু বোকাবোকা, মানে ইন্নোসেন্ট, সেই ছেলেটাকে
না-দেখতে পেলেই তোর মাইগ্রেন শুরু হয়ে যেত!


না, ওকে চিনি না আমি। বন্ধু-টন্ধু কেউ নই।
ঝড়ে বা বন্যায় মারী কিংবা মড়কে গেছে। যাক!
হিংসে? তা হিংসেই হবে! ও আমার (রোজ ভুলতে চাই)
সতেরো, আঠারো-প্লাস, ও আমারই চটিছেঁড়া


                          ফার্স্ট ইয়ার? না! না!


শিশুনাটিকা -- পিনাকী ঠাকুর


যখন মা-বাবারা যে যার কাজে যান :


ভোর ভোর খেলি আয়।  বাজার বাজার খেলি।  'ট্যাংরামাছ, দই-
তোর অফিস।  চান কর।  আমার সেলাই।  রান্না।  চ্যানেল ঘোরানো।
তুই বেশ 'টা টা' বল।  আমি বলি, 'তাড়াতাড়ি ফিরো আজ ওগো'।
এই ফাঁকে দুপুর যাচ্ছে।  পর্দা টেনে বিকেল করে দি'।


ডিং ডং।  ডিং ডং।  দরোজা খুললাম।  এই ভালুকপুতুল
আমাদের দুষ্টু সোনা।  হামি খাই।  ওর নাম? এক্স ওয়াই রায়।
-'চিঠি আছে?' -  'নেই।' - 'কেউ এসেছিল?' - 'না মশাই।'
- 'তাহলে অ্যাসট্রেতে কার মরা সিগারেট?'
- 'সিগারেট? কই? ওহো।  কার? তাই তো সিগারেট...'
আয় এবার ঝগড়া ঝগড়া খেলাটা জমাবো।
উঁহু।  মারামারি নয়।  ছাড়।  'চ্ছাড়ো ছোটলোক'...


বেশ বাবা।  ঝগড়া থাক।  সূর্য অফ ক'রে
রাতের খাবার খাওয়া।  ঘুম ঘুম খেলা করলে হয়।
কী রে দ্যাখা।  দ্যাখাবি না? লজ্জা পাস? আরে বোকুরাম
আমরা বড় বড় খেলছি।  বড়রা মোটেই
লজ্জা করে না তো।  আমি নিজে কাল দেখলাম
রাত দুপুরে-
    হি হি।  না, না।  সে কথা বলতে নেই।
        বড়দের মতো তুই
            আয়...  


পুত্রার্থে -- পিনাকী ঠাকুর


ভোর ৬ টা : শ্রীশ্রীদুর্গামাতা সহায়।  পাঁজিটা? এই তো। ২৫ ভাদ্র, ১১ সেপ্টেম্বর, রবিবার, অষ্টমী রাত্রি ১১/১৫/৫৭ পর্যন্ত। হুঁ। রোহিণী নক্ষত্র। বেশ। কালরাত্রি ১/০০ থেকে ২/২৮। কালরাত্রি বাদ। অমৃতযোগ দিবা ৬/১৩ থেকে। দিবা থাক। এই যে আবার অমৃতযোগ রয়েছে রাত্রি ৭/১৪ থেকে ৮/১২। ওঃ জ্বালালে, এই সময়টা প্রশস্ত নয়, ঘরভর্তি বাজে লোকজন। পুনঃ- জয় গুরু, পুনঃ রাত্রি ১১/১৬ মিনিট থেকে ১২/৫০। মায়া, আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। কেন? আরে বাপু, গুরুর আদেশ, জ্যোতিষশাস্ত্রের নির্দেশ। কেন? কিছুই বোঝো না তুমি মুখ্যু মেয়েমানুষ। যাক গে যাক, চায়ে একটু আদা দাও দিকিনি।


রাত ১১ টা : মায়ারানি গো, এসো। আহা, লাগুক, গায়ে পা লাগুক, পরে প্রণাম করে নিয়ো। ভাদ্র মাস। রবি তাঁর স্বক্ষেত্র সিংহরাশিতে। দেশবরেণ্য হবার যোগ। আর ৪ মিনিট, ৩ মিনিট...। অষ্টমী তিথি। অমৃতযোগ। এহে, এরই মধ্যে ঘুমুলে নাকি, মায়া?


এক জীবনে -- পিনাকী ঠাকুর


ফিরিয়ে দাও ট্রেনের ভারা, ফিরিয়ে দাও
মেলাপথের
আস্ত সিকি, বরফ খেয়ে ধন্য আশা!
' মীরাদিদির মন্টু খোকা' ঃ রঙতামাশা
' আদর বেশি দিলেই শিশু আশকারা পায়' ...


ফিরিয়ে দাও প্রাইজ-পাওয়া রাজকাহিনী
টিফিনবেলা লড়াই, মাথা ফাটিয়ে আসা,
ভক্তস্যার ক্লাসে ঢুকেইঃ 'আমরা জানি ...'
লোভে পড়ার রাইকিশোরী সর্বনাশা!


হটাত পাওয়া ছুটির মতো খরচাপাতি
ফুরিয়ে ফেলে
জীবন, আমি তোমার কাছে হাত পেতেছি,
ভরদুপুরে পাত পেতেছি, ফিরয়ে দাও
ফিরিয়ে দাও এক জীবনে অঙ্কে যত শূন্য পেলে!


পুরানো জানিয়া -- পিনাকী ঠাকুর ( কিছু লাইন)


এখনও তার চুলে কাঁচা রাবারের গন্ধ। নিঃশ্বাসে
গন্ধকের বিষ
যে শরীর কেরানিগিরি করতে পারে না, যে শরীর স্কুলমাস্টারি
করতে পারেনা, যার পৌরুষ শ্যাওলাধরা কলঘরে ছিটকে পড়েছিল
তুমি জানো না তার পেটের অন্ধকারে চিপ ক্যান্টিনের পাউরুটি
জমে পাথর
.
.
.
যে শরীর, বেঁচে থাকলে, তোমাকে ভালবাসতে পারত।


বাংলার বউ বলে চিঠি -- পিনাকী ঠাকুর ( কিছু লাইন)


তুই রাগ করিস না চুল্লি। ছুটি করেই আমি আসছি।
পাথরে পাথর ফাটিয়ে যখন সোনা খুঁজি
.
.
.
রাগ করিস না রে, আমাকে ভুলে মেরে দিস না, চুল্লি।


স্কুল সার্ভিস পাবার পর দেবষি -- পিনাকী ঠাকুর ( কিছু লাইন)


জলন্ধরে তৈরি সেন্ট। 'সেক্স অ্যাপিল' (মেড ইন ফ্রান্স)।
স্টাফরুমে ক্যানভাসার। কিনব? থাক। অনেক দাম।
.
.
.
ফানশানের সন্ধে যায়। মাল্যদান। পুরষ্কার।
বাড়ি ফিরেই ব্যাগ খুলে ভুল বানান, দুষ্টুমি--
'মাই দিয়ার নতুম স্যার'-- ছোট্ট এক চিরকুতেঃ
'আপনাকেই চাই আমার, আপনাকেই,


অন্য কেউ পুরুষ নয়!'


বাৎস্যায়ন যা বলেননি -- পিনাকী ঠাকুর (কিছু লাইন)


যার নাম নদী কিংবা লতার নামে, উঁহু, সেই নায়িকার দিকে কদাচ আর এগিয়ো না। পুরুষের যে প্রধান সমস্যা মেয়েরা বুঝতেই চায় না তার জন্য চিন্তা নেই-- অশ্বগন্ধা, গব্য ঘৃত প্রভিতি জোগাড় করো। গ্রন্থে সব পদ্ধতি দেওয়া আছে।
.
.
.
কিন্তু স্যার, সেই জিনিসটা তো বললেন না? মানে হৃদয়। বাংলায় যাকে বলে, মহব্বত?


------------------------------------