কিছু কবি আছেন যাদের লেখা শুধু আপনাকে ভাবায় না ঝাঁকিয়ে দেয়; আজ তেমনি এক কবির কবিতা পরবো। শূন্য দশক শুরুর মুহূর্ত আমি সবে কবিতার সাথে পরিচিত হতে শুরু করেছি। হাতে এলো এক কবির লেখা, প্রতি পাতা উল্টে যা পাই তা চরম বিস্ময়। অবাক আমার সে সব ঘোর লাগা কবিতা যাপন। তারপর যত বার পেয়েছি কবি মন্দাক্রান্তা সেনের কবিতা ততবারই চেটেপুটে নিই। আমি ব্যক্তিগত ভাবে নারী কবি বা পুরুষ কবিতে বিশ্বাসী নই। তবুও মহিলারা যখন কবিতা লেখেন, তাদের প্রতিদিনের ছোট বড় সুখ দুঃখ ভালোলাগা মন্দলাগা বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে মুহূর্তে তৈরি হয় এক নিজস্ব অন্তর্জগত। যা  চলমান পুরুষশাসিত কবিতা থেকে অনেকটাই আলাদা অনেক স্বতন্ত্র। আর নারীর বিষয়ে কবিতার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে ভেসে ওঠে নারীর সেই প্রতিমা যা পুরুষভাবনায় কবিতা দিয়ে যার প্রকাশ। সে ভাবনা পুরুষেরই ভাবনা তাই কবিতার পরম্পরায় নারীর দের রূপ যেন একই রকম। বলা যেতে পারে নয় প্রেমিকা নয় ভোগ্যা না হয় পূজিতা। পুরুষভাবনার সেই পরম্পরার মধ্যে থেকেই মেয়েরা লেখেন। কিন্তু একটা সময় আসে যখন নারীদের কলম আলাদা ভাবে ভাস্বর হয়ে উঠতে শুরু করে। আর সেই সব কবি দের প্রবাহ ও ভাষা দীপ্ত রূপে প্রকাশিত হয় আজকের নারী কবিদের লেখাতে। সেই সময় যে কয়েক জন বর্তমান ভারতীয় নারী কবি আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেছে তাদের এক জন মন্দাক্রান্তা সেন।


এই মুহূর্তের বাঙালি কবি দের মধ্যে অন্যতমা মন্দাক্রান্তা সেন জন্ম ১৫.০৯.১৯৭২ কোলকাতার টালিগঞ্জে। কবি পাঁচ বছর ডাক্তারি পড়ে (  Nilratan Sirkar Medical College) পড়া ছেড়ে দেন শেষ বছরে ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে। প্রথম বই হৃদয় অবাধ্য মেয়ে (১৯৯৯), এই বইটির জন্যেই মন্দাক্রান্তা ওইবছরেই পান আনন্দ পুরষ্কার। এত কম বয়সে (সাতাশ বছর) ওই পুরষ্কার আর কেউই পান নি। এরপর বেরোয় বলো অন্যভাবে (২০০০)। তার পরে গদ্যের স্বাদ পাই দেশ পূজাবার্ষিকী তে বের হয় উপন্যাস ঝাঁপতাল। এখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন।


মন্দাক্রান্তা সেনের শ্রেষ্ঠ কবিতা, হৃদয় অবাধ্য মেয়ে (আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত) , কলকব্জা, একটি গল্পের বই, অন্ত্যাক্ষরী, ঝাঁপতাল, দলছুট, ছদ্মপুরাণ, বলো অন্য ভাবে, আত্মহত্যা রেখেছি মুলতুবি, এখন বিকেল, ঋতুচক্র এবং আরও অনেক বই।


https://www.facebook.com/mandakranta.sen (কবির facebook পাতা)।


ফেরা -- মন্দাক্রান্তা সেন


একজন কাজে যায়
কাজ থেকে ফিরে
আসে ফের অলিখিত কবিতার তীরে
আগে যা-যা লিখেছিল
ভুলে যায় সব
মনে করে রাখা অসম্ভব
অথচ ওগরানোও যায় না,
গিলে ফেলতে হয় ধীরে ধীরে
সাপের জিভের মতো
সত্তাখানি গেছে তার চিরে


নিমন্ত্রণ -- মন্দাক্রান্তা সেন


আমার ছোবল আছে
এবং ফণাও
সবসুদ্ধ, হ্যাঁ, আমাকে নাও
চুষে খাও বিষ
আমি এক একাকী খরিশ
তুমিও তো একা, তাই বলে
ছোঁব না কি, ছোবলে ছোবলে!
আমার এ দীর্ঘ শরীরও
তোমারই অপেক্ষা করে…
ফিরো বন্ধু, মরণ থেকেও আজ ফিরো…


সমবয়েসি -- মন্দাক্রান্তা সেন


ওত পেতে বসে থাকি কখন বিশ্রাম থেকে উঠবে মা
আর দু’জনে মুখোমুখি বসে ফ্লাস্ক গড়িয়ে চা খাব
সাড়ে তিনটের দিকে ঘড়ির কাঁটা আর হাঁটতেই চায় না
বরং সে যাতে পিছু না হাঁটে
আমি থাবা পেতে পাহারা দিই তার সামনে
সে এগোতে চায় না, অথচ হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে চলে
আমাদের বয়েস
সাড়ে তিনটে বাজলে
আমি আর মা
সমবয়েসি হয়ে উঠি


পবিত্র -- মন্দাক্রান্তা সেন


এমন পবিত্র আমি আগে কি ছিলাম কোনওদিন !


আসলে, দেখিনি আগে এই গুটিশুটি শুয়ে থাকা ।
গলা অবধি ঢাকা দেওয়া। ফুটে আছে ঘুমে ভাসা মুখ।
হাতদুটি জড়ো করা চিবুকের কাছে।


সযত্নে শিয়রে বসি। কপালে আঙুল রাখি ধীরে।
একটু একটু করে ঠিক স’রে যায় ঘুমের ঝালর।
এমন আশ্চর্য হাসো,
ঐ হাসি হেসে গেছে আদিতম মানবশিশুরা ;
আজও যে হাসিটি হাসলে তবে পৃথিবীতে ভোর হয়।
আমি সে ভোরের সামনে শান্তহাতে পেতে রাখি
                               ছোটখাটাে সহজ প্রার্থনা…..


এমন পবিত্র আমি ছিলাম না বহু বহু দিন।


সাড়া --  মন্দাক্রান্তা সেন


যে গান গাইছি খাতার পাতাতে পাতাতে
তুমি কি শুনতে তুমি কি পড়তে পাচ্ছ ?
এসেছিলে তুমি তাই বন্ধুতা পাতাতে
আমাকে উদাস দেখে ফিরে চলে যাচ্ছ ?

যেও না বন্ধু, আমি তো তেমন পটু নই
ব্যর্থ হয়েছি সুরে সুরে ডাক পাঠাতে
স্বভাব-উদাস, অথচ আমি তো কটু নই
প্রেমের গানই তো গাইছি খাতার পাতাতে

সে প্রেম নেবে কি ? আমি কিছু সন্দিগ্ধ
অভ্যাস নেই তেমন চকিত সাড়াতে
নিজেকে বলেছি কেন নোস তুই স্নিগ্ধ
পারিস না কেন সেভাবে দু'হাত বাড়াতে

তবু যদি তুমি ফিরে আস সখা আবারও
হ্যাঁ, রাহাখরচ দেব গো, আসার… যাবারও


হৃদয় অবাধ্যমেয়ে -- মন্দাক্রান্তা সেন


হৃদয় অবাধ্যমেয়ে
ওকে কোনও পড়া বুঝিও না
বইখাতা ছিঁড়ে একশা, থুথু দিয়ে ঘ'ষে
মুছে ফেলেছে গাঢ় বিধিলিপি।
নীল ব্যাকরণের পাতায়
লিখে রেখেছে ছেলেদের নাম...
এমন কী, ছবিও!


হৃদয় অবাধ্যমেয়ে
তাকে কী শাস্তি দেবে, দিও।


মাঝবয়সের প্রেমের কবিতা --মন্দাক্রান্তা সেন


রাতবিরেতে নীল ছবি দেখি,
কী বলব, হাসিই পায়


একসময় দিনের মধ্যে হাজারবার
চানঘরে গিয়ে শরীর খুলে দেখতাম
নীল কালশিটে


আয়নার সামনে যত হিংস্র আত্নরতিই সারো
মরে গেলেও নিজের স্তন নিজে কামড়াতে পারবে না।


কবিতার সাথে প্রেম -- মন্দাক্রান্তা সেন


জিন্স পরা ছেড়ে দিতে পারি
তুমি যদি বল, অন্য নারী
হয়ে যাবো অতি অনায়াসে
যে মেয়ে তোমাকে ভালবাসে
তার ছোট চুল,বিনা তেলে
(তুমি যেন কাকে বলেছিলে)
সে কখনো হতেই পারে না।
বেশ,হব নিজের অচেনা
কাল থেকে,তুমি বল যদি
তোমার পায়ের কাছে নদী
খুলে রাখবে নীল ধনেখালি
আমার সমস্ত পুরুষালী
মুদ্রাদোষ ওড়াবো হাওয়ায়।
জিন্স পরা ছেড়ে দেওয়া যায়
সহজেই, নদী হতে পেলে
সাঁতার জান তো তুমি,ছেলে?


আদুরে -- মন্দাক্রান্তা সেন ( কয়েক লাইন)


তুই না, ভীষণ আদুরে
শুয়েই তো ছিলি মাদুরে
হটাত যে তোর হলো কী
হাত ধরে তুই টানলি
বুকের উপর আনলি
চোখে না ফেলতে পলকই


.
.
.
তা হোক, পাশে কি শুবি না
খুলে বলি তোকে, খুবই না
আদর করতে ইচ্ছে --
আর কাছে নয়, যা দূরে
তুই না, ভীষণ আদুরে
তোকে কে পাত্তা দিচ্ছে!


আদর -- মন্দাক্রান্তা সেন ( কয়েক লাইন)


তোর পরিপাটি পোশাকে
যেন পেঁয়াজের খোসাকে
ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছে --
ইচ্ছে, আমার ইচ্ছে
.
.
.
তছনছ এই চাদরে
মেতেছি হিংস্র আদরে
কামড়া, আমাকে কামড়া ...


শেষ কবিতা -- মন্দাক্রান্তা সেন


তার সাথে কথা হয় ফোনে
গোপনে গোপনে


কত কথা পড়ে থাকে বাকি
তবু বলি; আজ তবে রাখি?


ইচ্ছের রাতগুলো আকাশে তাকিয়ে তারা গোনে


গোপনে গোপনে


চাঁদ উঠে করে ডাকাডাকি


আমি শুধু বলি; আজ রাখি?


তথ্যসুত্রঃ ফেসবুক, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট, কবির লেখা কবিতা ও গল্পের বই।