“বাবা, বিয়েটা এবার করে ফেল
আর কার জন্য অপেক্ষায় করছিস”
মা প্রতিদিন একই কথা বলে
আর আমি “আসি মা”
বলে অফিসের দিকে পা বাড়াই।
আমি আসলে নিজেকে
টেনে নিয়ে যাই অফিসের দিকে
প্রতি মূহুর্তে আমি নিজেই টানছি নিজেকে,
আমি নয়শো তিন দিন ধরে নিজেকে টানছি
আর অপেক্ষায় আছি একটা ফোন কলের।


তুমি খুবই ঘুম কাতুরে ছিলে
কতোদিন যে আমাকে রাস্তায়
অপেক্ষায় রেখে রুমে ঘুমিয়ে থাকতে,
তারপর তোমার হলে গিয়ে যখন
তোমাকে ডেকে পাঠাতাম,
ঘুম ঘুম চোখে তোমাকে ঠিক
ঘুমের রাজকন্যার মতো লাগতো।
আমার বার বার তোমার
ঘুম ঘুম চোখ দেখতে ইচ্ছে করতো,
খুব আদর করে তাই তোমার
নাম দিয়ে ছিলাম তন্দ্রাবতী,
আমার মাঝে মাঝে মনে হতো,
তুমি আমার গোপন ভালো লাগাটা
হয়তো বুঝে ফেলেছিলে,
তাই আমাকে অপেক্ষায় রেখে
ইচ্ছে করে ঘুমিয়ে থাকতে।


তোমার খুব বেশী ভালোবাসা ছিলো
সরকারী চাকুরীতে,
বড় অফিসার হওয়ার জন্য আমাকে
তাই কয়েকবার বসতে হলো পরীক্ষায়,
তুমি ও বসলে আমার সাথে,
সংসারের খুব দায় ছিলো আমার,
বাবা মা ভাই বোন সবাই
আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো,
তারপর তোমাকেও দিতে হতো অনেকটুকু,
হলের সব খরচ,
তোমার সরকারী চাকুরীর
প্রস্তুতি কোচিং খরচ,
সব, একেবারে সব খরচ,
তোমাকে কখনো বুজতেই দেইনি,
আমার পকেটের টানাটানি  গল্প।


সারাদিন অফিস করে,
দুটো টিউশনির শেষে বাসায় ফিরে
ক্লান্ত শরীরে আর পড়তে ইচ্ছে করতো না,
কিন্তু ক্লান্ত হতো না এই মন,
আমি যে ভালোবেসেছিলাম
সত্যিই ভালোবেসে ছিলাম
তন্দ্রাবতী তোমায়,
বড় আশা ছিলো তুমিই একদিন
বড় সরকারী অফিসার হবেই।


তুমি ঠিকই তোমার ভালোবাসার চাকুরী পেয়ে
একদিনেই উঁচু বংশে উঠে গেলে,
আর আমি অস্পৃশ্য জাতে নেমে গেলাম সেদিনই।


আমি এমনই অস্পৃশ্য হয়েছিলাম
তুমি আমার ফোনই ধরতে না,
আমি কেনো বড় সরকারী
অফিসার হতে পারলাম না?
আমি কেনো নীচু জাতেই পরে রইলাম ?
আমার সাথে সংসার করলে
আমাকে কিভাবে পরিচয় করিয়ে দিবে?
এই লজ্জা থেকে বাঁচতে অনায়েসে তুমি
উঁচু বংশেরই একজনকে বিয়ে করলে ,
সেদিন থেকেই আমি নিজেকে টানছি।


তারপর আমি মন খারাপ  করে
অনেক কেঁদেছি,
কাঁদতে, কাঁদতে, দেখতে চেয়েছি ,
কত জল জমেছে বুকে,
কত অপমান জমেছে বুকে,
আর কতো কাঁদলে
অভিমানে বুক ফেটে যায়,
তাও দেখতে চেয়েছি।
কাঁদতে কাঁদতে আমি এক সময়
বুকের জলের মধ্যেই ডুবে মরে গেছি
তারপর থেকে আমি বুকের মধ্য
আমার লাশ টেনে যাচ্ছি।


তল্দ্রাবতী .আজ অনেক দিন পর
আমার অপেক্ষার ফোন কলটা এলো,
তোমার নামটা ভেসে উঠলো
আমার মতো নিচু জাতের
একটা মানুষের ফোনে,
আমি হ্যালো বলতেই,
তুমি শুধু নিজের কথাই বললে,
একবারও আমার অপমানিত জীবনের কথা
জানতেই চাইলে না,
আমি কিন্ত্তু এতোটুকু আশ্চর্য হয়নি,
আমার কানে শুধু বাজছিলো,
তোমার দুটি কথা
তুমি ভালো নেই,তুমি সুখে নেই।
আমার বুকের লাশটা
অনেকদিন পর নড়ে উঠলো
আমার বুকের জল নিমিষেই
তোমাকে দিয়ে দিলাম,
তারপর হাসতে হাসতে
চিৎকার করে বলে উঠলাম,
আমাকে অভিমানী করে,
আমাকে অপমানিত করে,
আমাকে কাঁদিয়ে তুমি
কখনোই ভালো থাকতে পারোনা।


তন্দ্রাবতী,
আমার ভালোবাসা প্রতিনিয়ত
তোমাকে অভিশাপ দিয়েছে
সুখের ঘুম যেনো তোমাকে ছেড়ে যায়
নিঁচু জাতের মানুষতো ,
তাই অভিষাপ দিয়ে দেই অনায়াসে।


আজ সকালে অফিসে যাবার সময়
মা’র দরজার সামনে দাড়িয়ে বললাম
“ মা বিয়েটা এবার করে ফেলবো,
একটা ঘুমকাতুরে মেয়ে দেখবে”
বলেই হেসে ফেললাম,
মা’ও হেসে ফেললো।


অনেকদিন পর নিজেই অফিসে যাচ্ছি
বুকের মধ্যে এখন আর কিছুই টানছি না।
—————————


রশিদ হারন
০৬/০২/২০১৮