‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব  
মৃত্যু-অমৃত করে দান’।  
                        [মরণ: কড়ি ও কোমল]


মৃত্যু, সর্বজনবিদিত সত্য। সব মিথ্যা হলেও, এর থেকে চরম আর কোনো সত্য থাকতে পারে না। কিন্তু এ-কথার ভার বহন করা অত্যন্ত জটিল। মানুষ যেমন জন্মগ্রহণ করেছে; ঠিক তদ্রুপ তাকে আবার বিদায় নিতে হবে। মৃত্যুর রূপ তারপরও মানুষের চিত্রে এসে ফু’টে উ’ঠে; সৌন্দর্য বিকাশ যেন তার মননে গেঁথে থাকে আপন সুরে। মানুষ যে জীবন নিয়ে মগ্ন থেকেছে তা কিন্তু নয়। মৃত্যু যে তার ভাবনাতে কখনও ছায়া ফেলেনি; তা কিন্তু বলা যাবে না। আলো ও রৌদ্র ছায়ার মতো তার সাথে মিশে ছিল ভাবনার জগতে। জন্মগ্রহণের পর থেকে সেও নিরন্তর এগোতে  থাকে সেই কোমল ছায়ার দিকে; যা একদিন তাকে ছুঁয়ে যাবে উজ্জ্বল দিন বা মাঘের হিমশীতলে বা নির্জন দুপুরে। আমাদের মানবজীবনের মৃত্যুচিন্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) যে, খুব বেশী দূরে ছিলেন তা কিন্তু নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায়, কল্পনায়, চিন্তায় মৃত্যু যে বিলাসিতার রূপ হ’য়ে এসেছে তা কিন্তু নয়। বাস্তবতার আলোকে, আরও বলা যেতে পারে, বরং মৃতুকে তিনি মানব জীবনের অভিজ্ঞাতার আলোকে অনুভব করেছেন সম্পূর্ণ জীবন ভ’রে।
রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনায়, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সকল দিক দিয়ে মৃত্যু সম্বন্ধে এক গভীর উপলব্ধির চিত্র আমরা দেখতে পাই তার শৈশবকাল থেকেই।


পরিণত বয়সের মধ্যেও, একাকার হ’য়ে মিশে থাকে মৃত্যুচিন্তা। বলতে গেলে শৈশব থেকেই, রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে শান্ত সমাহিত রূপে দর্শন করার সামর্থ্য অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুতে মানবজীবনের সবকিছুর বিনাশ ঘটতে পারে না। মৃত্যু ও দুঃখের মাধ্যমে তিনি মুক্তি লাভ ক’রে, পরিপূর্ণ সত্যেয় উপনীত হ’তে চেয়ে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে দুঃখবোধ ও মৃত্যুচিন্তা কতটা নিবিড় হ’য়ে দেখা দিয়েছিল, তা আমরা দেখতে পাই তার রচিত সমস্ত জীবনব্যাপী শিল্প ও সাহিত্যেয়। এও যেন দেখা দেয়, তার কাছে শিল্পের ছায়া হ’য়ে। তার কবিতায় যেমন আমরা শুনতে পাই ‘ওরে মৃত্যু, জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে/বেঁধেছিস বাসা/যেখানে নির্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর/স্নেহ-ভালোবাসা,/গোপন মনের আশা, জীবনের দুঃখ সুখ,/মর্মের বেদনা,/চিরদিবসের যত হাসি-অশ্রু-চিহ্ন-আঁকা/ বাসনা-সাধনা;/যেখানে নন্দন-ছায়ে নিশঙ্কে করিছে খেলা্‌,। রবীন্দ্রনাথের শৈশবকালের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, তিনি অন্যান্য শিশুদের মত মায়ের ভালোবাসা পাননি খুব বেশী। মা সারদাসুন্দরী দেবী পারিবারিক কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। শিশু রবীন্দ্রনাথ, পরিবারের দাসদাসীদের দ্বারা প্রতিপালিত হোন। শৈশবকে পিছে ফেলে, কৈশোরেও পিতা-মাতাকে অনায়াস ও সাবলীল ভাবে খুব বেশী তাদেরকে কাছে পাননি কিশোর রবীন্দ্রনাথ। সেই কিশোর বয়স থেকেই এক প্রকার নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়েই তিনি বেড়ে উঠেন। যার ফলে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের এক প্রকার ছায়া দেখা যায় তার মনোভাবের চিত্রে। এ-চিত্র শুধু যে, শৈশব ও কৈশোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়; বরং সারাজীবনব্যাপী তা দেখা দেয়। এর ফলে যা দেখা দেয় তা হল, শৈশব থেকেই  রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একপ্রকার নিঃসঙ্গতার প্রভাব পরিলক্ষিত হ’তে থাকে। এই বোধ বা ভাবধারা তার পরবর্তী জীবনের পর্যায়গুলিতে, তাকে আরও বেশী চিন্তা ও মননশীল ক’রে তুলেছিল। আপন মনে, নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের ভাবনা, যেগুলি সাধারণ ব্যক্তির মনে ভীতি ও বিরক্তি সঞ্চার ক’রে, সেগুলিই রবীন্দ্রনাথের মননে একটি বিচিত্র দার্শনিক ভাবের সূচনা করেছিল। তার বড় একটি রূপ আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রসাহিত্যেয় । যে সাহিত্যেয় পাওয়া যায়, গভীর এক দুঃখের চিহ্ন।


তাই পরিত্যক্ত গোলাবাড়ি, নির্জন দুপুর, বাড়ির ছাদ সব কিছুই যেন বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করতো। তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি’তে আমরা দেখতে পাই- ‘আমাদের বাড়ির উত্তর- অংশে আর-একখণ্ড ভূমি পড়িয়া আছে, আজ পর্যন্ত ইহাকে আমরা গোলাবাড়ি বলিয়া থাকি। এই নামের দ্বারা প্রমাণ  হয়, কোনো-এক পুরাতন সময়ে ওখানে গোলা করিয়া সংবৎসরের শস্য রাখা হইত-তখন শহর এবং পল্লী   অল্পবয়সের ভাইভগিনীর মতো অনেকটা একরকম চেহারা লইয়া প্রকাশ পাইত, এখন দিদির সঙ্গে ভাইয়ের মিল খুঁজিয়া পাওয়াই শক্ত। ছুটির দিনে সুযোগ পাইলে এই গোলাবাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইতাম। খেলিবার জন্য যাইতাম বলিলে ঠিক বলা হয় না। খেলাটার চেয়ে এই জায়গাটারই প্রতি আমার তান বেশী ছিল। তাহার কারণ কী বলা শক্ত। বোধ হয় বাড়ির কোণের একটা নিভৃত পোড়ো জায়গা বলিয়াই আমার কাছে তাহার কী একটা রহস্য ছিল। সে আমাদের বাসের স্থান নহে, ব্যবহারের ঘর নহে; সেটা কাজের জন্যও নহে; সেটা বাড়িঘরের বাহির, তাহাতে নিত্য প্রয়োজনের কোনো ছাপ নাই; তাহা শোভাহীন অনাবশ্যক পতিত জমি, কেহ সেখানে ফুলের গাছও বসায় নাই; এই জন্য সেই উজাড় জায়গাটায় বালকের মন আপন ইচ্ছামত কল্পনায় কোনো বাধা পাইত না। রক্ষকদের শাসনের একটুমাত্র রন্ধ্র দিয়া যেদিন কোনোমতে এইখানে আসিতে পারিতাম সেদিন ছুটির দিন বলিয়াই বোধ হইত।’ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আবার বলা যায়, ‘জন্মকাল থেকে আমাকে একখানা নির্জন ভেলার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ বাস্তবিক অর্থে, রবীন্দ্রনাথ এই নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের বিচিত্র রস উপলব্ধি করতে ভালবাসতেন। রবীন্দ্রচরিত্রের আরও একটি দিক স্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয়, তা হল- ‘তিনি সকলের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ ও একক হ’য়ে থেকেছেন।’ জীবন সম্পর্কে এরূপ উদাসীন ও নির্লিপ্ত মনোভাবের জন্য তিনি সম্ভবত বহুবার দুঃখের আঘাত, এমনকি মৃত্যুর আঘাতেও বিচলিত হননি, এগুলিকে তিনি সযত্নে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে মানসিক চাপগুলো, তার দার্শনিক ভাবনার অনুপ্রেরণা হিশেবে কাজ করলেও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে মিলন; খণ্ডের মধ্যে অখণ্ডতা, আংশিক থেকে সমগ্রতা, অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়াই হল রবীন্দ্র দর্শনের মূল কথা। রবীন্দ্রমননে সীমা এবং অসীম; উভয়ই হল একপাক্ষিক সত্য, উভয়ের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ সত্য উপনীত হওয়া যায়। যিনি সীমার মধ্যে অসীমকে উপলব্ধি করতে পারেন, কিংবা আরও বলা যেতে পারে, যিনি সীমার মধ্যে অসীমের মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হন, তিনিতো মৃত্যুকে জয় ক’রে অমরত্ব লাভে সক্ষম হবেন। এইভাবে আধ্যাত্মিক ভাবপ্রবণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে দার্শনিক ভাবধারার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। প্রাত্যহিক জীবনে নানাদিক থেকে আমরা দুঃখের মুখোমুখি হ’য়ে থাকি। তা যে কোনো ভাবে ঘটুক না কেন, তার চরম পরিণতি ঘটে মৃত্যুর মধ্যে।


রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ এক জীবনে এতো বিপুল বিচিত্র বেদনা, মৃত্যুশোক তার দৃষ্টান্ত আসলেই বিরল। মনোভাবনার এই দুঃখ, বেদনার অনুভূতির প্রতিক্রিয়া বিশেষ ভাবে তাৎপর্য ও বিষাদময়। রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিক অর্থে; বিভিন্নমুখী দুঃখের দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত ছিলেন। একটিকে বলা যেতে পারে মৃত্যুশোক জনিত; যা এসেছিল সর্বজনবিদিত মৃত্যুর ধারণার মধ্যে দিয়ে। যা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে নিঃসঙ্গ ও একাকী ক’রে তোলে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও নিকট আপনজনের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ অনেকটা একাকী মানুষে পরিণত হোন। পারিপার্শ্বিকতার দুঃখ যে রবীন্দ্রনাথের জীবনে ছিল না; তা কিন্তু বলা যাবে না। এই প্রকার বেদনা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে কাতর ও মর্মাহত ক’রে তোলে। কতকগুলি অপরিণত, অপরিশীলিত, অপরিণামদর্শী প্রিয়জনদের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ এই প্রকার দুঃখ পেয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃস্মৃতিতে – এ সম্পর্কে বলেন, ‘বহুকাল পর্যন্ত বাবাকে এবং মা যতদিন বেঁচেছিলেন তাদের বাড়ির লোকজনদের কাছ থেকে বিদ্যালয় সম্পর্কে (শান্তিনিকেতন) বিরূপতা ও বিরুদ্ধতা সহ্য করতে হয়েছিল। এইভাবে জীবিত ও মৃত; উভয়ের কাছ থেকে শোক পেয়েছিলেন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ। যদিও রবীন্দ্রনাথ এই সব ব্যাপার নিয়ে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির  সাথে আলাপচারিত মেতে উঠেননি। রবীন্দ্রনাথের অপার সৃষ্টির বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তার দুঃখ ভাবনা। কি গল্পে, কি কবিতায়, কি উপন্যাসে-সর্বত্রে তার পদচারনা আমরা দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথের স্মরণ পর্বের কবিতার দিকে একটু দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব সেই মৃত্যুচিন্তা যেন ফিরে আসছে বার-বার। মৃত্যু কবিতাটি একটু পড়া যাক- ‘মৃত্যু ও অজ্ঞাত মোর/ আজি তার তরে/ ক্ষণে ক্ষণে  শিহরিয়া  কাপিতেছি ডরে/ সংসার বিদায় দিতে,/ আঁখি ছলছলি/ জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি/ দুই ভুজে’। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির নানা ধারায় ছড়িয়ে রয়েছে মৃত্যুভাবনা। দুঃখবোধের সাথেও রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। দুঃখ হল মানুষের জীবনের একটি অকৃত্রিম অনুভূতি। যা সবার জীবনে সমান ভাবে আঘাত ক’রে; কেউ সহ্য করতে পারে কেউবা পারে না। এই আঘাত দ্বারা যে দুঃখিত হয়, শোকার্ত হয় সেই একমাত্র এই অনুভূতি বোঝে। রবীন্দ্রনাথ, তার জীবনে দুঃখকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তার ভাবনায় দুঃখ হল বিচিত্র, গভীর এবং বহুমুখী। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে একমত হ’য়ে তিনি স্বীকার করেন যে, দুঃখের মধ্য দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্বের প্রকৃত বিকাশ ঘটে থাকে।


মানুষের জীবনের জন্য যেমন বায়ু আবশ্যক, তেমনি মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্যও দুঃখের প্রয়োজন। জ্ঞানের চোখে  যাকে আমরা দুঃখ বলি, অনেক সময় তা থেকেও সুখের উৎপত্তি ঘটে।’ কিন্তু দেখা যায়, সাধারণ ব্যক্তি দুঃখকে পরিহার ক’রে সুখ উপভোগ করতে চায়। রবীন্দ্রনাথ দুঃখকে নৈরাশ্যর সমার্থক হিসাবে গ্রহণ না ক’রে, তাকে বিশেষভাবে গ্রহণ ক’রে নিয়েছেন। ব্যক্তিগত শোক-দুঃখ একদিকে যেমন তাকে গভীর শূন্যতায় পর্যবসিত করেছিল, তেমনি শূন্যতার মধ্যে পূর্ণতার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করেছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠেই শোনা যায়- ‘পৃথিবীতে এসে যে ব্যক্তি দুঃখ পেল না, সে লোক ঈশ্বরের কাছ থেকে সব পাওয়া পেল না।’ এইভাবে অসীম দুঃখকে সকল সুখের সারে পরিণত ক’রে তিনি আপন জীবন ও সেই জীবনে দুঃখের দানকে প্রত্যাশিত অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আবার যখন শুনতে পাই- ‘রক্তের অক্ষরে লিখিলাম/ আপনার রূপ/ চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়/ সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালবাসিলাম/ সে কখনও করে না বঞ্চনা/ আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন/ সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে/ মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে’। এইভাবে দুঃখ ও মৃত্যুভাবনার মধ্যে নিহিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্টতা। জীবনে, দুঃখ ও মৃত্যুকে অস্বীকার ক’রে নয়, বরং এগুলিকে অপরিহার্য মনে ক’রে জয় করার কথা বলা হয়েছে রবীন্দ্রদর্শনে।  


রবীন্দ্রনাথের এই বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি অনুপ্রেরণা হিশেবে তার বৈচিত্র্যময় জীবনে ক্রিয়াশীল রয়েছে। প্রায় সকল ভারতীয় দর্শনে মানবজীবনে দুঃখবোধ ও জন্ম-মৃত্যু রূপের কথা স্বীকার করা হয়েছে। বন্ধনকেই তার মূল কারণ ব’লে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুঃখের বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও; দুঃখকে বাদ দিয়ে জীবন পথে চলা সম্ভাব নয়। জীবন-মৃত্যুর এই নিয়ত ক্রমের মধ্য দিয়ে জীব তার কর্ম অনুযায়ী সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ ক’রে পূর্ণতার পথে অগ্রসর হ’য়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের চেতনায়; মানুষ তার ভাবনার জগতে একাকী নীরব মানুষ রূপে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। যে প্রেরণায়, মানুষের চেতনার প্রসারণে দুঃখ ও মৃত্যুর আঘাতে তা তুচ্ছ হ’য়ে যায়। যে মানুষ সত্যের নিকট জীবন উৎসর্গ করেছে, দেশের জন্য, লোকহিতের জন্য যে বৃহৎ ভূমিকায় নিজেকে উৎসর্গ করেছে। ব্যক্তিগত শোক-দুঃখ তার ভাবনায় পরিবর্তিত হ’য়ে দেখা দেয়। যে মানুষ সহজেই সুখ ত্যাগ করতে পারে; সে-ই দুঃখকে স্বীকার ক’রে তাকে অতিক্রম করতে পারে।


রবীন্দ্রনাথ, মানুষের ক্ষেত্রে দু’টি পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার ক’রে নেন। মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ অহং আর সীমা অতিক্রমী ভুমাবোধ। এই দুই প্রকার সত্তার বিরোধের মধ্যে মানব স্বভাবের বেদনাবোধের উপাদান বিদ্যমান। মানুষ তার ব্যক্তিগত সত্ত্বায় দুঃখহীন জীবন কল্পনা করতে পারে না। মানুষ অনেক সময় তার জীবনে শোকে-দুঃখে কাতরতা প্রকাশ ক’রে। রবীন্দ্রনাথ আবার যখন প্রকাশ করেন, ‘দুঃখের যত প্রকার ব্যাখ্যা করি না কেন দুঃখতো দুঃখই থাকিয়া যায়, না থাকিয়া যো নাই।’ জীবন দুঃখময় হওয়ায় জীবনের প্রতি মমতা বা তৃষ্ণাই হল সকল দুঃখের কারণ। কিন্তু একটি দিক আমাদের অবাক ক’রে দেয়, তা হল-রবীন্দ্রনাথ জীবন ও জগতকে দুঃখময় ব’লে অভিহিত করেননি।


তিনি সর্বদা বিশ্বাস করতেন, দুঃখের কারণ হল জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা। দুঃখ ও মৃত্যু বিষয়ে তার ধারণা, হৃদয়ে দুঃখবোধের প্রতিফলন, এবং তার প্রতিক্রিয়া এই অভিমতের দ্বারা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে দুঃখের অভিজ্ঞতা নানাভাবে আবির্ভূত হয়েছে। তার দুঃখচেতনার প্রধান  দৃষ্টিভঙ্গি হল ব্যক্তিগত। তার মানসিকতা অহংবোধের সীমা অতিক্রম ক’রে বিশ্বপ্রকৃতিতে, আত্মিক সীমাহীনতার অনুভূতিতে প্রসারিত হয়েছে এ-কথা সত্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই বিশ্বপ্রকৃতি, অসীম অনুভূতি একান্তভাবেই তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণার আলোকে আলকিত। দুঃখকে তিনি সর্বদাই ব্যক্তিচিত্তে তার প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে বিচার করেছেন। সেই প্রতিক্রিয়ার মধ্য দুঃখের কোন স্বরূপ ফু’টে ওঠে সেই বেদনাকে কীভাবে রমণীয়, বরণীয় করা যায় তাই রবীন্দ্রনাথের অন্বিষ্ট।


          রবীন্দ্রজীবনে প্রাপ্ত অসংখ্য দুঃখের মধ্যে মৃত্যুর বিয়োগজনিত ব্যথা, বেদনা, তার চিত্তকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা ও অপরাপর প্রিয়জনের মৃত্যু তাকে এই প্রকার দুঃখ দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন ধ’রে একপ্রকার মৃত্যুশোকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ছোটভাই বুধেন্দ্রনাথ যখন মারা যান, রবীন্দ্রনাথ এতোটাই ছোট ছিলেন যে, সেই মৃত্যুর ঘটনা তার স্মৃতিতে বিশেষ কোনো দাগ কাটেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সু-দীর্ঘ জীবনে যে সব মৃত্যুর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা একটু দেখা যাক-কাছের মানুষের মধ্যে মা সারদা দেবীকে, রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছিলেন তের বছর দশ মাস বয়সে ১৮৭৫-এ। এর পর শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর গান। ১৮৮১-তে তিনি হারান গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৮৮৩-তে, সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জামাইবাবু (যিনি রবীন্দ্রনাথের বিয়ের রাতেই মারা যান), ১৮৮৪-তে, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (সেজদাদা), ১৮৮৪-তে, সেই একই বছরে মারা যান কাদম্বরী দেবী, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান (যিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন), ১৮৯৪-তে, বিহারীলাল চক্রবর্তী, আধুনিক কবি, যিনি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বেয়াই হোন। ১৮৯৫-তে, অভিজ্ঞা চট্টোপাধ্যায় (ভ্রাতুষ্পুত্রী), ১৮৯৭-তে, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভগ্নীপতি, যিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হ’য়ে মারা যান। ১৮৯৯-তে, ঊষাবতী চট্টোপাধ্যায় (ভ্রাতুষ্পুত্রী), ১৮৯৯-তে, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র, যক্ষায় মৃত্যু), দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ সন্তান, বীরেন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লময়ীর একমাত্র সন্তান। ১৯০১-এ, নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯০২-এ, মৃণালিনী দেবী, স্ত্রী (২৯ বছরে মারা যান), ১৯০৩-এ, বিমানেন্দ্রনাথ রায় (বাবার শ্যালকের ছেলে), ১৯০৩-এ, রেণুকা (রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর মধ্যম কন্যা, যক্ষায় মৃত্যু), ১৯০৫-এ, পিতা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৭-এ, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ সন্তান, কলেরায় মৃত্যু হয়। ১৯০৮-এ, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯০৮-এ, সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (রেণুকার স্বামী), ১৯১০-এ, নৃপময়ী ঠাকুর (বৌদি-মৃণালিনী দেবীর শিক্ষিকা), ১৯১৩-তে, ভগ্নিপতি- জানকীনাথ ঘোষাল (স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী), ১৯১৫-তে, বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর-দাদা, ১৯১৬-তে, শান্তা বন্দ্যোপাধ্যায় (ভাগ্নের ছেলে), ১৯১৮-তে, ইরাবতী মুখোপাধ্যায় (ভাগ্নি), ১৯১৮-তে, কন্যা মাধুরী লতা, রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান, ১৯১৯-এ, জ্যোতিপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, দাদার মেয়ের ছেলে, ১৯১৯-এ, সুকেশী ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্রের স্ত্রী, ১৯২০-এ, শরৎকুমারী মুখোপাধ্যায় (দিদি), ১৯২০-এ, সৌদামিনী গঙ্গোপাধ্যায় (দিদি), ১৯২২-এ, তিভাসুন্দরী চৌধুরী (ভাগ্নি), ১৯২২-এ,  সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতা ), ১৯২২-এ, প্রতিভাসুন্দরী দেবী (ভ্রাতুষ্পুত্রী- হেমেন্দ্রনাথের কন্যা), ১৯২২-এ, দ্বিপেন্দ্রনাথ  ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯২৩-এ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতা), ১৯২৪-এ, আশুতোষ চৌধুরী (ভাগ্নির স্বামী), ১৯২৪-এ, বিনয়িনী চট্টোপাধ্যায় (বেয়াই-রথীন্দ্রনাথের শাশুড়ি), ১৯২৫-এ, হিরণ্ময়ী মুখোপাধ্যায় (ভ্রাতুষ্পুত্রী), ১৯২৫-এ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতা), ১৯২৬-এ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতা), ১৯২৯-এ, অরুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯২৯-এ, মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (অবনীন্দ্রনাথের জামাতা), ১৯২৯-এ, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯৩২-এ, নীতিন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (দৌহিত্র), ১৯৩২-এ, স্বর্ণকুমারী দেবী (দিদি), ১৯৩৩-এ, সত্যগোপাল গঙ্গোপাধ্যায় (ভাগ্নে), ১৯৩৫-এ, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯৩৭-এ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), ১৯৩৮- এ, গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (কাকার ছেলে), ১৯৪০-এ, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভ্রাতুষ্পুত্র), এ-ছাড়াও আরও অনেক নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু তিনি অনেক কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন।


           একই বছরে, একাধিক মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে। তার জীবনে; প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মায়ের মৃত্যুতে। সারদা দেবী কোনদিনই কোলে পিঠে ক’রে মানুষ করেননি তার সন্তানদের। শিশুরা দাস-দাসীদের দ্বারাই প্রতিপালিত হতেন। মাকে কাছে চাইলেও পাওয়ার সুযোগ বেশী ঘটেনি বালক রবীন্দ্রনাথের। তার উপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে, মৃত্যুর আগে প্রায় একবছর বালক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ আরও ক্ষীণ হ’য়ে এসেছিল। এই প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতি’তে বলেন, ‘ইতিমধ্যে বাড়িতে পরে পরে কয়েকটি মৃত্যুঘটনা ঘটিল। ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনো দিন প্রত্যক্ষ করি নাই। মা’র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন অল্প বয়স। অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাহাঁর জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরের স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাহাঁর রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়-তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাহাঁর মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।’ তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ভৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন-পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কায় তাহাঁর ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতে পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না।


বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাহাঁর সু-সজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না-সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনানান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাহাঁর দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজা বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাহাঁর পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাহাঁর নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’                      


কাদম্বরী দেবীর মমতা, মাধুর্য, স্নেহ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক অনাস্বাদিত জগতের দ্বার খুলে দেয়। মানসিক বিপর্যয়ের অভিঘাত সামলাতে না পেরে, পরবর্তীকালে, আত্মহননের পথ বেছে নেন কাদম্বরী দেবী। এই মৃত্যুর যন্তনা রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞাতায় সঞ্চিত হয়েছিল। এর পূর্বে, মা ও অনন্যা আত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছিল দৃষ্টির অগোচরে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের, চব্বিশ বছর বয়সে মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় ঘটল কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কারণে তা অনেকটা চোখের সামনে স্পষ্ট হ’য়ে উঠলো। রবীন্দ্রনাথ, জীবনস্মৃতি’তে লিখলেন, ‘বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠা বধূ ছিলেন তিনিই মাতৃহীন বালকদের ভার লইলেন। তিনিই আমাদিগকে খাওয়াইয়া পড়াইয়া সর্বদা কাছে টানিয়া আমাদের যে কোনো অভাব ঘটিয়াছে তাহা ভুলাইয়া রাখিবার জন্য দিনরাত্রি চেষ্টা করিলেন। যে-ক্ষতি পুরন হইবে না, যে- বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটা প্রধান অঙ্গ- শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে, তখন সে কোনো আঘাতকে গভীরভাবে গ্রহণ করে না, স্থায়ী রেখায় আঁকিয়া রাখে না। এইজন্য জীবনে প্রথম যে-মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দপদে চলিয়া গেল।’ যেই মৃত্যুকে একদিন শ্যামের সঙ্গে তুলনীয় বলে মনে হয়েছিল, সেই মৃত্যুর করাল রূপ প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। কবির জীবনে নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত। দীর্ঘায়ু কবি  চোখের সামনে দেখেছেন মৃত্যুর গভীর নীরবতা। শান্ত সমাহিত চিত্তে গ্রহণ করতে চেষ্টা করেছেন মৃত্যুর অভিঘাতকে। সেই দারুণ দহন সহজ কথা নয়। পরবর্তীকালে, স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুতে, তিনি মৃত্যুর সাথে নতুন ক’রে সম্পর্ক তৈরি করেন। এ-যেন চোখের সামনে মৃত্যুর আবার নতুন রূপ। যে রূপ ভুলবার নয়; আকর্ষণ থেকে আঘাতটাই যেন বুকে বাধে বেশী। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে তিনি গভীরভাবে শোকাহত হয়েছিলেন। এই মৃত্যুর ঘটনা তাকে, তার দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তিনি বলেন- ‘তুমি মোর জীবনের মাঝে/ মিলায়েছ মৃত্যুর মাধুরী’। মৃণালিনী দেবী প্রায় দু’মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। নার্স থাকা সত্ত্বেও কবি নিজের হাতেই তাঁর সেবা করেছেন। এ-সম্পর্কে হেমলতা দেবী বলেন, ‘মৃত্যুশয্যায় কবি নিজের হাতেই তাঁর শুশ্রূষা করেছিলেন তার ছাপটি মুদ্রিত হয়ে রয়েছে পরিবারের সকলের মনে আজও। প্রায় দু’মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে স্ত্রীর শুশ্রূষার ভার কবি একদিনের জন্যেও দেননি। রবীন্দ্রনাথের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে ২৩ নভেম্বর, ১৯০২ সালে মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে বিদায় নিলেন কবি স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। মৃত্যুর আগের দিন; রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে, মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের বিছানার পাশে বসতে বলেন। রথীন্দ্রনাথ এ-সম্পর্কে বলেন, ‘তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগলো। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। আমাদের ভাই বোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরানো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারারাত কেটে জাগল। ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, কোন প্রকার সারা শব্দ নেই। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ [পিতৃস্মৃতি-রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর]  


          মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর সাড়ে ন’মাস পরে মৃত্যু হয় রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনী দেবীর দ্বিতীয় কন্যা রেণুকার। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর আগেই রেণুকার অসুস্থতার সুত্রপাত। রবীন্দ্রনাথ তাকে সুস্থ করার বহু চেষ্টা করলেও তিনি সুস্থ হ’য়ে উঠেননি। রবীন্দ্রনাথ, রেণুকাকে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার জন্য কীভাবে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলেন, তার বিবরণ পাই রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘বাবা রোজ সকাল বেলায় ওকে নিয়ে বারান্দার এককোণে বসে উপনিষদ থেকে মন্ত্র পাঠ করে তার মানে বুঝিয়ে দিতেন। এমনি করে ধীরে ধীরে তার মনকে সংসারের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করবার পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ছেড়ে যেতে বেশী কষ্ট না পান। এই সময় বাবা যেন রানীদিকে বেশী কাছে টেনে নিয়েছিলেন।’


         রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম মর্মান্তিক শোক কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু। কবির রূপ-গুণের উত্তরাধিকার সবচেয়ে বেশী পেয়েছিলেন শমীন্দ্রনাথই। দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগেই, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দিনেই, মৃত্যু হয়  শমীন্দ্রনাথের। বন্ধুর বাড়ি মুঙ্গেরে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হ’য়ে এই অকাল মৃত্যু। প্রিয়পুত্রের মৃত্যুশোকও রবীন্দ্রনাথ সহ্য করেছিলেন অদ্ভুতভাবে। হেমলতা দেবী, সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে লিখেছেন, ‘শমীর মৃত্যুর পর একদিন দেখি তার জামা কাপড় নিয়ে বসে আছেন। আমায় বললেন, ছোটবৌ শমীর জন্য মখমলের সুট করিয়েছিল আমি পরাতে দিইনি, ছেলে বাবুগিরি শিখবে। ছেলে আমার কোলে থাকতে ভালোবাসতো আমি কোলে নিইনি আদুরে হয়ে যাবে। আমার কাছে শুতে ভালোবাসতো আমি শুতে দিইনি আদুরে হয়ে যাবে। শক্ত করে স্বাধীন করে মানুষ করব।’ রবীন্দ্রনাথ শমীর শোক কীভাবে বহন করেছিলেন সেই প্রসঙ্গে হেমলতা দেবী লিখেছেন, ‘কাকামশায়ের সে শোক দেখা যায় না। কি কষ্ট ! মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল। শোক থামিয়ে রাখতেন কিন্তু ব্যথা লাগলে শরীর যেমন নীল হয় তেমনি মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতেন না। যে সব পুরুষ রবীন্দ্রনাথের শোকস্তব্ধ মূর্তি কাছ থেকে দেখেছেন এবং সেই অভিজ্ঞতা লিখেছেন তাদের বর্ণনায় বিশ্বকবির ধ্যানগম্ভীর প্রতিচ্ছবিই স্পষ্ট হয়েছে।


         মৃত্যুর করাল পথে যাওয়ার পালা এরপর এসেছে মাধুরীলতার। রবীন্দ্রনাথের বড় কন্যা। ডাকনাম বেলা বা বেলি। কবির অত্যন্ত আদরের মেয়ে। মেজ মেয়ে রেণুকার মত কবির বড় মেয়েও আক্রান্ত হয়েছিল ক্ষয়রোগে। নিরন্তর চেষ্টা করেও কবি তাকে বাঁচাতে পারেননি। অকাল মৃত্যুর হাত থেকে কবি যেন কোনো ভাবেই নিস্তার পাচ্ছেন না।        


          রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতা বীরেন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লময়ীর একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথ ছিলেন সুদর্শন, সুসাহিত্যিক, সংগঠক ও আলাপী প্রকৃতির। এই ভ্রাতুষ্পুত্রটি অত্যন্ত প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর কাছে। সে যখন মৃত্যুশয্যায়, কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি ঠাকুরবাড়ি থেকে। তবুও অনেক চেষ্টাকে ব্যর্থ ক’রে বিদায় নিলেন বলেন্দ্রনাথ। মা  প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, ‘যেদিন সে জন্মের মত আমাকে তাহার বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া চলিয়া গেল, সেইদিন রবি (আমার ছোট দেবর) আসিয়া আমাকে বলিলেন যে, তুমি একবার তার কাছে যাও, সে তোমাকে মা মা করিয়া ডাকিতেছে।’ রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে প্রফুল্লময়ী বলেন্দ্রনাথের পাশে বসতেই ধীরে-ধীরে জীবনপ্রদীপ নিভে গেল বলেন্দ্রনাথের। প্রফুল্লময়ী আবার বলেন, ‘রবি বলুকে খুবই ভালবাসিত। আমার এই অবস্থার ভিতর এই সময় তিনি একদিন গীতা হইতে একটি উপযোগী সুন্দর শ্লোক পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন। সেই শ্লোক কি, এখন আমার ঠিক মনে নাই, তবে তাহার কথাগুলি আমার প্রাণে আসিয়া বাজিয়াছিল।’ বলেন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিক অর্থে স্নেহ করতেন, ফলে তার মৃত্যুতে কবিকে মৃত্যুশোক পেতে হয়েছিল। তবু তার মধ্যেই তিনি চেষ্টা করেছেন বলেন্দ্রনাথের মা’কে সান্তনা দিতে। বলেন্দ্রনাথের পর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথের আরেক ভ্রাতুষ্পুত্র নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনেও। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সর্বসুন্দরী দেবীর পাঁচ পুত্রের  তৃতীয় এই পুত্রটিও অনেক প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের। জোড়াসাঁকোর যে কোন অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার ভার সর্বদাই  নীতীন্দ্রনাথের পরামর্শেই হত। তাকে সুস্থ করে তোলার অনেক চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। পরবর্তীকালে, এই নীতীন্দ্রনাথের স্মৃতিতেই রবীন্দ্রনাথ তার কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর পুত্র সন্তানের নাম রেখেছিলেন নীতীন্দ্রনাথ।


        এইভাবে ঈশ্বর যেন রবীন্দ্রনাথের মাথায়, ধারাবাহিক ভাবে দুঃখের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এমনই ব্যক্তি ছিলেন যিনি আমৃত্যুকাল মৃত্যুর ছায়া সামনে রেখে বড় হয়েছিলেন। রবীন্দ্রজীবনে এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পৌনঃপুনিকতা কখনই তাকে অন্য সাধারণ মানুষের মত বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী, তার গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন  প্রবন্ধে লিখিছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস অন্য যেকোন সাধারণজন এ রকম আঘাতের পর আঘাত পেলে কিছুতেই আর সুস্থ জীবন যাপন করতে পারত না। অথচ রবীন্দ্রনাথকে দেখলে কিছুতেই মনে হত না কতখানি শোক তিনি বুকের মধ্যে বহন করে বেড়াচ্ছেন।’    


        রবীন্দ্রনাথের মনে জীবন, মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, প্রকাশ পেয়েছে শোক, হতাশা ও নৈরাশ্যবোধ। এইভাবে জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে পারস্পারিক সম্পর্কের উপলব্ধি ঘটে। জীবনের শেষ পর্বের রচনায় মৃত্যু সম্পর্কে এরূপ মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ্য করা গেলেও মূলত প্রাক-নৈবেদ্য পর্বের রচনায় খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যু বিষয়ে যদি খণ্ডদৃষ্টি পরিত্যাগ করে সামগ্রিক দৃষ্টি গ্রহণ করা যায়, তবে উক্ত বিসয়গুলির আপাত বিরোধ দূরীভূত হয়। পরবর্তীকালে, উপনিষদীয় ভাবধারায় রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি নানাবিধ কাব্যিক উপমা ব্যবহার ক’রে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, জীবন-মৃত্যুকে একে অপরের পরিপূরক বলে অভিহিত করেছেন। এইভাবে জীবন ও জগত সম্পর্কে আংশিক দৃষ্টি পরিত্যাগ ক’রে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপক অর্থে সমগ্র বিশ্বজগতকে পরমসত্তার লীলাময় প্রকাশ রূপে উপলব্ধি করেছেন।


          রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন ও মৃত্যু তাৎপর্যময়। মৃত্যুই জীবনের একমাত্র সত্য, এবং তা অবধারিত। এ-কথা তিনি, তার সমগ্র সাহিত্যে জুড়ে প্রকাশ করেছেন। গভীর উপলব্ধি দ্বারা তার বিশ্লেষণও ক’রে আমাদের দেখিয়েছেন। তিনি আমাদের এও দেখিয়েছেন, মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়, রূপান্তর মাত্র। মৃত্যুই জীবনকে তাৎপর্যময় ক’রে তোলে, জীবন পরস্পরার মধ্যে দিয়ে সার্থক ও পরিপূর্ণ লক্ষ্যেয় পৌঁছে দেয়। জীবনের পরিপূর্ণময় বিকাশের জন্য মৃত্যুও প্রয়োজন। এ-যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ, একটি ছাড়া অপরটিকে কল্পনাও করা যায় না।