কবি, যা রচনা করেন তা-ই কি কবিতা ? ইন্দ্রিয়ের একগুচ্ছ অপার সৌন্দর্য প্রকাশ পায় কবিতায়। কবিতা হ’য়ে  ঊ’ঠে ইন্দ্রিয়য়ের এক বহিঃপ্রকাশ। কি-কি জিনিস থাকতে হয় কবিতায় ? বা কোন কোন উপাদান থাক’লে  তাঁকে আমরা একটি ভালো বা উৎকৃষ্ট কবিতা বলতে পারি ? আমি একটি কাঠামো  তৈরি করবো, তাঁর জন্য মৌলিক কিছু উপাদান প্রয়োজন। যে সব উপাদান না থাকলে কোনো ভাবেই  কাঠামোর  একটি স্থাপত্য  দাড় করানো সম্ভাবপর হ’য়ে  উ’ঠে না। যদিও, স্থাপত্যটির  জন্য প্রস্তুতকারির  রয়েছে  পূর্বপরিকল্পনা । তাহ’লে কি কবিতা রচনা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা রয়েছে একজন কবির ? না, ভাব-ভাবনা আর ভাষার নিটোল বহিঃপ্রকাশ হল কবিতা, যার কোনও কাঠামো নেই। একটি সুন্দর ভাবনা আর একগুচ্ছ জ্যোতির্ময় শব্দের প্রকাশ হ’ল কবিতা। কখনও তা প্রকাশ পেতে পারে স্থিরভাবে; আবার তা হ’তে পারে  ইন্দ্রিয়ের গলিত সুখ হ’য়ে । কবে লেখা হ’য়ে ছিল বাঙলায় প্রথম কবিতাটি ? একশো-দুশো-তিনশো বছর পূর্বে ? না, তাঁর ও পূর্বে ? যা পড়া বা দেখা মাত্র মানুষের ইন্দ্রিয়ে সুখ জাগিয়েছিল,  দ্রুতি খেলা করেছিল মন ও মগজে। অনুভব করলো এটা গদ্য বা পদ্য নয়, অন্য কিছু। যার নামকরণ তখনো স্থির হয় নি, যা ইন্দ্রিয়ে সুখকর হ’য়ে দেখা দিবে, তাঁর নাম হবে কবিতা, শুধুই কবিতা। কে রচনা করবে কবিতা বা যিনি কবিতা রচনা করবেন তাঁকে কি নামে আখ্যায়িত করবো আমরা ? যিনি কবিতা রচনা করবেন তিনি-ই কবি । আবার, কবি’র অন্যতম কাজ কি  কবিতা রচনা করা ? কবি, কবিতা রচনা করবেন। কবিতা-ই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। কবি কবিতার রাজা, এক আদিম দেবতা, যিনি; যে আধার আলোর অধিক-এর মাঝে খুঁজে নিবেন ঝ’রে পড়া তীব্র সৌন্দর্যবোধকে। কবিতার জন্ম নিয়ে তিরিশি অন্যতম কবি সুধীদ্রনাথ দত্ত  বলেনঃ  


“কাব্যের জন্ম বৃতান্তে আমাদের প্রয়োজন নেই, সে-সন্ধান নৃতত্ত্ব বিদদের। আমরা শুধু  এইটুকু জানলেই সন্তুষ্ট যে কাব্য কবির পূর্বপুরুষ , কবি কাব্যের জন্মদাতা নয়। প্রথম কবিতার আবির্ভাব হয়েছিল  কোনও ব্যক্তি বিশেষের মনে নয়, একটা মানব সমষ্টির মনে, প্রথম কবিতার প্রসার শুধু  একটি  মানুষের উপরে নয়, সমগ্র জীবনের উপরে,  প্রাথমিক কবিতার উদ্দেশ্য বিকলন নয়, সঙ্কলন। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত কাব্যের বিশ্বম্ভর  মূর্তি কেবল ক্ষয়ে গেছে,  তাঁর  সেই  নীহারিকার মতো আয়তন সৃষ্টির রীতিতে আজ  কবি-রুপ উল্কা খণ্ডের মধ্য  আবদ্ধ । আমার তাই বিশ্বাস। আমি মনে করি এই ধরনের একটা অধ্যায় পুর্নচ্ছেদ  পরেছে। এর পরেও আবার যদি কাব্যের মধ্য একটা  তীব্র জ্যোতি দেখা যায়, তবে বুজবো সে জ্যোতি পথ চ্যুত উল্কার চিতাগ্নি।“ [স্বগতঃ ১৩৪৫,পৃঃ ১৩]


সুধীদ্রনাথ দত্ত মনে করেন  ‘ভাব’, ‘ভাষা’ আর ‘ছন্দ’- এই তিনে গ’ড়ে  উঠে কাব্য। আমি কাব্য বলতে চাই না, বলতে চাই গ’ড়ে উঠে কবিতা । কবিতা নিয়ে কালে কালে বিভিন্ন জন, বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। আসলে কবিতা কি ? বা কবিতা কি নয়। চীনা কবি গাউজঙ, কবিতা নিয়ে চমৎকার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। সাহিত্যর অনেক গুলো শাখা রয়েছে, কবিতা তাঁর মধ্য অন্যতম, এবং কবিতা হল তাঁর আদিমতম শাখা। এক কথায় বলতে চেয়েছেন, কবি ভাবনার ছন্দবদ্ধ ও শিল্পিত ভাব প্রকাশ হল কবিতা । যে ছন্দের কথা আমরা সুধীদ্রনাথে-ও পাই। তাহ’লে কি বলতে পারি, কবিতায় থাকতে হবে “ ছন্দ” এবং তা-প্রকাশ হ’তে হবে শিল্প মণ্ডিত ভাবে। কবিতার কি রয়েছে একক কোনও সর্বজনীন সংজ্ঞা ? যে ভাবে বা সংজ্ঞায় স্থির করা যাবে কবিতাকে। বলতে পারবো কোনটা কবিতা বা বলতে পারবো কবিতা নয় কোনটা?  মহা কাব্যের রচনাকারী বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর –তাঁদের একক কোনও মানদণ্ড রয়েছে কবিতা নির্ধারণের ? এলিয়ট, ইয়েটস, অডেন, কামিংস, লারকিন, গিন্সবার্গ বা এজরা পাউন্ড  কেউ কি দেখিয়েছেন  কবিতা নির্ধারণের পথ গুলো? যে পথে গেলে ও গুলো শুধুই কবিতা হ’বে বা হবে না অন্য কিছু । জীবনানন্দ দাস-যখন ব’লে উঠেন “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। মানব মনের ভাবনা না বলে, কবি মনের শিল্প মণ্ডিত ভাবনা যখন ভাষা- ছন্দ এবং দ্রুতিময় কিছু শব্দের সংমিশ্রণ রয়েছে সেটা-ই কবিতা, এরকম বলেছেন অনেকে।
ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিন [১৮৮০-১৯১৮]-কবি সম্পর্কে বলেছেনঃ


“সেই ব্যক্তি কবি বা সাহিত্যিক যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। কবি তাঁর মৌলিক সৃষ্টকে লিখিত বা অলিখিত উভয় ভাবেই প্রকাশ করতে পারেন। কবিতা রচিত হতে পারে  প্রেক্ষাপট, ঘটনার রূপকধর্মী এবং নান্দনিকতার সহযোগে। কবিতায় বিভাজন থাকতে পারে বিভিন্ন ভাবে”।


গিয়োম আপোলিন এখানে কবি এবং সাহিত্যিককে এক ক’রে ফেলেছেন। আমি বলতে প্রস্তুত নই,কবি এবং সাহিত্যিক এক। আমরা সকল কবি কে সাহিত্যিক বলতে পারি এই অর্থে, তাঁরা কোন না কোন সময়  গদ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং রচনা করেন কোন না কোন গদ্যধর্মী রচনা। পুরো জীবনে একটি বাক্য হ’লেও তিনি স্পর্শ করেন। কোন ক্ষতি নেই,  যদিও তিনি রচনা না করেন  একটি গদ্যও। কবি হ’য়ে উঠেন কবি। সাহিত্যিক কখনও কবি হয়ে উঠেন না, যদি না তিনি রচনা করেন একটি অপার সুশোভিত পঙক্তি। সাহিত্যিককে  কবি হ’তে হ’লে রচনা করতে হবে  অন্তত পক্ষে একটি উৎকৃষ্ট মানের কবিতা, যা হবে শুধুই কবিতা, অন্য কিছু নয়।
ফরাসি আরেক কবি আর্থার রিমবোঁদ [১৮৫৪-১৮৯১]...কবি’ শব্দের অর্থ ব্যাখা করেনঃ


“একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিশেবে নিজেকে অন্যর চোখে  ফুটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ,সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিন্ত্রিত অবস্থায় সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্যর বাইরে অবতীর্ন  হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালোবাসা,দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা–উম্মাদনার  মাঝে  নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরনের বিষবাস্পকে  নিঃশেষ করতে পারেন। সেই সাথে পারেন এগুলোর  সারাংশকে  কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অকথ্য দৈহিক অমানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করে  যখন,যেমন,যেখানে খুশী অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষের মধ্য সর্বশ্রেষ্ঠ হিশেবে বিবেচিত হন। একজন বড় ধরনের অকর্মণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিসম্পাতগ্রস্থ ব্যক্তিও, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসেবেও তিনি অভিহিত হতে পারেন । যদি তিনি অজানা ,অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা যদি  তিনি বিকৃত, উন্মাত্ত, বিকারগ্রস্ত  হয়ে পড়েন- তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। তাই, কি হয়েছে  যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অ-শ্রুত , নাম বিহীন অজানা বিষায়াদি ধ্বংস করেন, অন্যান্য আদি ভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা পুনরায় সমান্তরাল রচনা শুরু করবে যা পূর্বেই নিপতিত হয়েছিল”।


কবি গ’ড়ে তুলেছেন আপন ভুবন, ভাব-ভাষা আর তাঁর ছন্দ দিয়ে। কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, এবং তাঁর সম-সাময়িক পর্যন্ত যে সকল কাব্য বা মহাকাব্য রচিত হয়েছিল ,তাঁর সব কিছুই ছিল এই ভাব আর ভাষার  মধ্য। কখনো কখনো এই সব ভাব আর ভাষা হ’য়ে উঠে নিজস্ব একটি পথ, যে পথে কবি এগিয়ে যান তাঁর নিজস্ব গন্তব্যয়। এই জন্য এটা হ’য়ে উঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা,ওটা জীবনানন্দ দাসের কবিতা, সুধীদ্রনাথের কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা। প্রত্যকের তো ছন্দ রয়েছে, কিন্তু ভাষা ? এই ভাষা–ই পৃথক ক’রে কবিকে। সব কবিতাই রচিত হয় বাঙলায়, কিন্তু প্রবাহিত হ’তে থাকে স্ব-স্ব ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ যখন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ-তে বলেনঃ
        
                                          “ আজি এ প্রভাতে রবির কর
                                           কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
                                           কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান!
                                          না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ”।
                                                                   [প্রভাত সংগীতঃ ১৮৮৩]


রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা, তাঁর কবিতা ক’রে তোলে তাঁর প্রকাশ ও ভাষার জন্য। আমরা দেখলেই বলতে পারি বা শূনেও বলতে পারি এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, আমরা বলি না এটা জীবনানন্দ বা  সুধীদ্রনাথের কবিতা। তাঁরা সকলেই কবিতা লিখেছেন।    


সুধীদ্রনাথ যখন প্রকাশ করেনঃ
                                         “ জনমে জনমে, মরণে মরণে,
                                           মনে হয় যেন তোমারে চিনি।
                                           ও-শরমার্ত অরূপ আনন
                                           দেখেছি কোথায়, হে বিদেশিনী” ?
                                                            [অর্কেস্ট্রাঃ ১৯৩৫,‘চপলা’]


এই কবিতাটা পড়া মাত্রই আমরা বলি না এটা জীবনানন্দ বা বুদ্ধদেবের বা রবীন্দ্রনাথের  কবিতা। আমরা জানি, এটা সুধীদ্রনাথের কবিতা। এই জানাটা কিসের? বলতে পারি,তাঁদের কবিতা পড়তে পড়তে আমরা চিনে গেছি কার কবিতা কোনটা ? আমরা আরও জেনে গেছি, রবীন্দ্রনাথের কবিতা কোনগুলো বা তাঁর কবিতার ভাষা কি রকম হয়। একই ভাবে আমরা বলতে পারি, জীবনানন্দ দাসের ভাষা কি রকম,বুদ্ধদেব বসুর ভাষা কি রকম বা সুধীদ্রনাথের ভাষা কি রকম বা বিষ্ণু দে’র ভাষা কি রকম।  অক্ষর বিন্যাস কবিতাকে এক করে না, বরং ভিন্নতা প্রকাশ ক’রে। পূর্বেই বলেছি, কবিদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা বা তাঁর প্রকাশ ভঙ্গি, তাই বিভিন্ন জনের কবিতা হ’য়ে উঠে ভিন্ন-ভিন্ন কবিতা। আর প্রয়োগ করেন সর্ব প্রিয় উজ্জ্বল শব্দগুলো, যে সব শব্দগুলো কখনও হ’য়ে উ’ঠে রবীন্দ্রনাথের শব্দ আবার কখনও বা সুধীদ্রনাথের শব্দ। অনেক ক্ষেত্রে কবিতার শব্দ দেখেও আমরা বলে দিতে পারি, কোনটা কার কবিতা বা এ কবিতার রচয়িতা কে? সুধীদ্রনাথ দত্ত যখন বলেনঃ

“মহাকবিরা নিজেদের ভাষা নিজেরা বানিয়ে যান বটে,কিন্তু সে – ভাষা যখন চূড়ান্তে পৌঁছয়, তখন তাঁর মধ্য শোনা যায় নিত্ত-নৈমিত্তিক উক্তি-প্রত্যুক্তির প্রতিধ্বনি, প্রাক্কিত ভাষার সবল, সরল ও সজীব পদক্ষেপ, তখন আর শেক্সপিওর –এর  ভাষা ব’লে কিছু থাকে না, ধরা পরে যে শেক্সপিওর জনসাধারনের সাবলীল ভাষা ধার নিয়েছেন। অথচ এতখানি আত্মত্যাগ স্বতঃও শেক্সপিওর–এর পৃথক পরিচয়  হারায় না, বরং উজ্জলতর রূপে দেখা দেয়, দুটো- চারটে অসংলগ্ন  ছত্র পড়লেই বুঝি , সে রচনা শেক্সপিওর –এর কিনা। এই অঘটনসংঘটনে যে দৈব প্রসাদ নেই , এমন মত পোষণের মতো তথ্য আজও আমাদের আয়ত্তে  আসেনি, কিন্তু এটা নিঃ সন্দেহ যে  মহা শিল্পীরা কোনও  অলৌকিক  শক্তির প্রসাদ  পান বা না পান, অন্তত লৌকিক বুদ্ধিতে ও তাঁরা  নিতান্ত নগণ্য নন”।
                                                             [স্বগতঃ ১৩৪৫, পৃঃ ১৪৫]


মহাকবিরা তৈরি করেন তাঁদের নিজেদের ভাষা, যে ভাষায় তাঁদের কবিতা, কবিতা হ’য়ে রয়। সে সব উচ্চ মানের ভাষা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না কোন কবি কোনটা রচনা করেছেন। একদা এই সব কবিতা হ’য়ে ঊঠে মহাকাব্য বা কালের কবিতা, যার প্রাণ থাকে কয়েকশো বছর যাবৎ। কবি, কবিতাকে ক’রে তোলে শুধুই কবিতা, যা অন্য কিছু নয়, প্রাণ পায় কবিতা ব’লে। তিনি শেষ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বলতে পারেন না, তিনি যা লিখছেন তা-কি রূপ পাচ্ছে কবিতা বলে, না হচ্ছে অন্য কিছু।  


মানুষের চাহিদা রয়েছে অনেক কিছুর, তাঁর বেঁচে থাকার জন্য। মানুষ কখন,প্রথম উপলব্ধি করলো কবিতা-ও প্রয়োজন তাঁর বেঁচে থাকার জন্য? যার প্রয়োজনীয়তা থেকে কবিরা রচনা করলেন কবিতা। কবিতা, কতটা সুখী ক’রে তো’লে সেই সব মানুষদের, যাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন কবিতা! না, কবির প্রয়োজন কবিতার ? কবি কে? তিনি কেন কবিতা লিখবেন ? কবিতা কি তাঁকে অন্য মানুষে পরিণত করবে ? আমরা যা ভাবি, তিনি কি তা ভাব্বেন না! না-কি, তিনি অন্য কিছু ভাববেন, যা আমরা ভাবনা বা কল্পনায়  নিতে পারি না, আর এর জন্য তিনি কবি।
বুদ্ধদেব বসু এ- সম্পর্কে  বলেনঃ


“যদি মানুষ তাঁর স্থলমান মুহূর্ত গুলির অব্যবহিত  প্রভাবের  মধ্যই  আবদ্ধ  থাকতো , তাহ’লেও  ভ্রুনাবস্তায়  রুপকথা  সম্ভাব হ’তো না তা নয়, কিন্তু বিজ্ঞান  হ’তো না। তাঁর ই নাম কবি, যিনি  আবেগের  দৈহিক অভিঘাত থেকে যাএা   করে  সেই দৈহিক অভিঘাত থেকে  মুক্তি দেন মানুষকে, ইন্দ্রিয় গত  সংবেদনকে রুপান্তরিত  করেন সেই আধ্যাত্মিক সামগ্রীতে , যা কে আমরা অভিজ্ঞতা ব’লে থাকি। আমাদের এই আদি কবি একাধারে কাব্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের জনকঃ তাঁর চিত্তে আবেগ থেকে জ্ঞান নিষ্কাশিত হ’য়ে জ্ঞান আবার সঞ্জীবিত  হয়েছে  আবেগ; বিশ্বপুরাণ থেকে মানবেতিহাস বিশ্লিষ্ট হবার পর ইতিহাস আবার পুরাণের স্রোতে মিশ্রিত হ’য়ে নতুন ক’রে প্রাণ পেয়েছে। এবং তাঁর ও ভাষার জন্ম একই লগ্নে ; তাঁর সত্তা একান্ত রূপে ভাষানির্ভর। মানুষের ভাষা আছে, এতেই প্রমাণ হয় যে সারাৎসার কবির,মানুষ যদি কবি না হ’তো তাহ’লে তাঁর ভাষার প্রয়োজন হতো না। এই জন্য জার্মান দার্শনিক হামান্‌ বলেছিলেন যে, ‘কবিতাই মানবজাতির মাতৃভাষা’।“


[বুদ্ধদেব বসু প্রবন্ধ সঙ্কলনঃ মাঘ ১৩৮৮;“ভাষা,কবিতা ও মনুষ্যত্ব”,পৃঃ ২১০-২১১]


কালে কালে মানুষের মুখের ভাষার যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেখানেও বড় রকম ভূমিকা রেখেছে কবিতা। ভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটেছে কবিতার; ভাষা প্রাণ দিয়েছে কবিতাকে আর ছন্দ তাঁকে ক’রে তু’লেছে গতিময়। ভাষার যেমন রয়েছে পরিবর্তনশীলতা, একই ভাবে তাঁর সহযোগী হ’য়ে আছে কবিতা। তাই, ভাষা আর কবিতা গেঁথে আছে একই সূত্রে, তাঁর সহোদর হ’য়ে। বাঙলা ভাষার কবিরা শুধু ভাব আর ছন্দ নিয়ে মেতে উঠেননি, বরং, চমৎকার খেলেছেন ভাষা নিয়ে; দেখিয়েছেন বাঙলা ভাষার রূপ আর তাঁর বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যগুলি। যে সৌন্দর্যর প্রথম শিকারি হলেন কবি। কবিরাই প্রথম আবিষ্কার করেন ভাষার সৌন্দর্যবোধের দিকটি, এবং মেতে উঠেন সেই সৌন্দর্য নিয়ে যা তাঁদের কাছে পরবর্তীতে হ’য়ে উ’ঠে কবিতা। কবিরা-ই প্রথম ভাষার স্তুবকারি। কারো কাছে ভালো লাগা বা না লাগা থেকে কবিতা রচিত হয় না, কবিতা রচিত হয় কবির ভালো লাগা থেকে। এই ভালো লাগা যদি অন্য কারো সাথে মিশে থাকে, তাহ’লে তা কবির প্রাপ্তি।


কি পরিমাণ লেখা লিখবেন একজন কবি ? বা, কত পরিমাণ লিখলে কবি হওয়া যায়, এ রকম অনেক প্রচলিত ধারণা রয়েছে কবির মাঝে। আমরা জানি না, একজন কবিকে কত পরিমাণ লিখতে হয়। তাঁর জীবনে কয়টি কাব্য লিখতে হবে তাঁকে? দুটি, চারটি, ছয়টি, দশটি, পনেরটি, বিশটি, তিরিশটি,পঞ্চাশটি,একশোটি না তাঁরও অধিক! কবির কয়টি কাব্য থাকলে  তাঁকে আমরা কবি বলবো ? তাঁর কি থাকতে হ’বে  হাজার-হাজার কবিতা ? হাজার হাজার কবিতা কি কবি হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান ক’রে ? না, কবিদের থাকতে হয় কয়েক হাজার কবিতা ! একজন কবি যে পরিমাণ কবিতা রচনা করেন, অপর পক্ষে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে তাঁর সমকক্ষ কবিতা কখনও রচনা করতে পারেন না; তাহ’লে তাঁরা কি কবি নন ? একটি অনুমান নির্ভর ভাবনা থেকে কি বলা যায়, এদের মাঝে কে বড় বা প্রধান কবি? তাহ’লে কি রয়েছে বড় বা প্রধান কবি নির্ধারণের একটি  সু-নিদিষ্ট মাপকাঠি ? না, কাল আর সময় কবিকে বড় বা প্রধান করে তোলে ? এ সম্পর্কে  বুদ্ধদেব বসু প্রকাশ করেনঃ


“পৃথিবীর প্রধান লেখকেরা অনেকেই অজস্র লিখেছেন; আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কেননা সাধারণ নিয়ম হিশেবে বলা যায় যে  রচনা পরিমাণে বেশি না  হ’লে সমসাময়িক সাহিত্য ও  সমাজে তার প্রভাব ব্যাপক কিংবা গভীর হ’তে পারে না। কোনো  কোনো ‘বাজে’ লেখকও যে বেশি লেখেন তাতেও অবাক হবার কিছু নেই; লেখা যার খারাপ, তিনি যতবারই একটি বই লিখবেন ততবারই খারাপ বই লিখবেন, এ তো সোজা কথা। বাংলাদেশে ও, উচ্ছৃঙ্খল  জীবনের  ফাঁকে- ফাঁকে মধুসূদন কিছু কম লেখেননি–রবীন্দ্রনাথের কথা কিছু না-ই বললাম। বেশি লেখা খারাপ, এই ধারণার তাহলে ভিত্তি কোথায়?”  
                                                                 [কালের পুতুলঃ ১৯৯৭,পৃঃ ৫]


কবিতা লেখা হয়েছে কালে কালে। অনেক সময় তা লেখা হয়েছে দলবদ্ধভাবে আবার কখনও তা একক ভাবে। যেভাবেই হোক, রচিত  হয়েছে কবিতা। কবিতা হ’য়ে উঠেছে কবির মনভাবনা ও চেতনার  সর্বচ্ছ  প্রকাশ। একদা কবিতা হ’য়ে উঠে, কবির  সহযোগী। সকাল, বিকাল, সন্ধা আর বিনিদ্র রজনী এক হ’য়ে আসে কবির কাছে ; তাঁর কবিতার মতো, যেখান থেকে রচিত হ’বে একটি উৎকৃষ্ট কবিতা। কবি, কতটা নিজস্ব ক’রে  নিয়েছেন কবিতাকে ? অন্য সব কিছুর মতো তিনি কি প্রস্তুত একটি অপার সু-সজ্জিত কবিতার জন্য ? যে কবিতা তাঁর হ’য়ে আসবে; তাঁরই হৃদয়ে। তিনি কি অপেক্ষা করে আছেন একটি কবিতার জন্য, যা দেখা দিতে পারে যেকোন মুহূর্তে ! কবিতা কতটা কবিতা হ’য়ে উঠেছে তা কে স্থির ক’রে দিবেন ? না , কবি যা রচনা করবেন তা-ই কবিতা হ’য়ে দেখা দিবে মানসচিত্রে ! একক; অভিভাবক শূন্য কবি হ’য়ে উঠেন কবিতার আপনপিতা। তিনি-ই কবিতাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান জ্যোতির্ময় গন্তব্যর দিকে, যেখানে কবিতা রূপান্তরিত হয় কবিতায়, অন্য কিছুতে নয়। আলো যে ভাবে দেখা দেয় আলো হ’য়ে, তদ্রুপ কবিতা ও দেখা দেয় কবিতা হ’য়ে। আলো যেভাবে দূর ক’রে অন্ধকারকে, অকবিতা কে সরিয়ে কবিতাই জাগ্রত হোক কবিতা হ’য়ে।
`
কবিদের কবিতা রচনায় একটি দিক খুব স্পষ্ট হ’য়ে উঠে, আর তা হ’লো তাঁরা যখনই কবিতা রচনা করেছেন; শিরোনাম হিশেবে বেছে নিয়েছেন ‘কবি’ নামটি। এ শিরোনামে কবিতা লিখেননি এ-রকম কবির সংখ্যা খুবই কম।
জীবনানন্দ দাস যখন বলেনঃ
‘আমি কবি,- সেই কবি,-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙ্গুল- মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন কামনা জাগিছে প্রানে!’
                             [ঝরা পালকঃ ১৩৩৪(১৯২৭); ‘আমি কবি,-সেই কবি’]
কিংবা আবার যখন বলেনঃ  
                
                  ‘ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
                   আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন!
                   নিরালায় সুর সাধি,- বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
                   মানুষ দেখিনি মোরে কনদিন,-আমারে চেনেনি!’


                                            [ঝরা পালকঃ ১৩৩৪(১৯২৭); ‘কবি’]
জীবনানন্দ দাস ‘অগ্রন্থিত কবিতায়’’ লিখেন “কবি” শিরোনামে আরও একটি কবিতাঃ
              
                  ‘কবিকে দেখে এলাম
                  দেখে এলাম কবিকে
                  আনন্দের কবিতা একাদিক্রমে লিখে চলেছে
                  তবুও পয়সা  রোজগার করবার দরকার আছে তার
                  কেউ উইল ক’রে কিছু রেখে যায়নি।‘


তাহ’লে কি কবি ও বাঁচতে চান অন্যদের মতো ক’রে ? যারা সমাজ,রাষ্ট্র আর সভ্যতায় বেঁচে আছেন মানুষ বলে ! তাঁরা মানুষ, কিন্তু কবি ব‘লে পরিচিত নয়। মানুষের মাঝে কবিদের বসবাস, যারা আছেন তাঁদের মতো ক’রে, কবি হ’য়ে। মানুষ থেকে হ’য়ে পড়লেন এক অজানা মানুষে, যাদের কবি ছাড়া অন্য কিছু আখ্য্য িয়ত করা যায় না।
সুধীদ্রনাথ; কবিতা লিখেছেন শতকের ও কিছু বেশি। তাঁর-ও রয়েছে ‘কবি’ শিরনামের চমৎকার একটি কবিতা।‘কবি’ শিরনামের কবিতা রচনা কি কবির একপ্রকার দায়বদ্ধতা  না তাঁর ভালো লাগার প্রকাশ, আমার তা জানা নেই। কবিতাটা আমি একটু পড়তে চাইঃ
              
                 ‘কেন আমি কাব্য লিখি, জানতে চাহো  সেই কথাটাই
                  অত কিছু বলা–কওয়ার  আজকে, সখা, সময় যে নাই।
                  তবু যদি নেহাৎ শুধায়, এইটুকু নয় ব’লে রাখিঃ    
                  জীবনে যে কাব্য লেখে , জীবন তারে দিল ফাঁকি।‘  
                                                               [তন্বীঃ ১৩৩৭; ‘কবি’’]


ফিরে আসা যাক সুধীদ্রনাথের শেষ পংত্তিটিতে; যেখানে তিনি প্রকাশ করেন ‘জীবনে যে কাব্য লেখে, জীবন তারে দিল    ফাঁকি’। তাহ’লে কি সম্পর্ক রয়েছে জীবন আর কবিতার মাঝে ? কাব্য লিখে যদি জীবন নিরথর্ক হ’য়ে উঠে তাহ’লে কবি কেন বেছে নেন কবিতা নামক ওই  পংত্তিগুলোকে ? তিনি কি অবগত নন জীবন আর কবিতা সম্পর্কদ্বয়ের ?জীবনটাকে ফাঁকি দিতে পারে যে কেউ, যে কোনো ভাবে;  আর সেটাই যদি হয় তাহ’লে সব দোষ কেন কবিতার উপর বর্তাবে ! নিরথর্ক জীবন নিরথর্কতাঁর জন্য দায়ী,কবিতা তাঁর উপলক্ষ মাত্র । যে কেউ, যে কারো জীবন, যে কোনো ভাবে বিষাক্ত ক’রে তুলতে পারে, কবিতা তাঁর জন্য দায়ী নয়। জীবনকে ফাঁকি দিয়ে কোনো কাব্য যদি রচিত হয়, তাহ’লে কি থাকে সেই কাব্যয়ে ? জীবন বহির্ভূত কাব্য কতটা প্রয়োজন হ’য়ে প’রে জীবনের জন্য ? কাব্যর সাথে জীবনের যদি কোনো সংমিশ্রণ  না থাকে তাহ’লে সেটা কি কবিতা হবে ? কতটুকু প্রাধান্য পাবে তা মানুষ বা কবিতার কাছে ? আর সেটা যদি না-ই হয় , তাহ’লে কবিরা কেনো রচনা করবেন কবিতা ! কবিতাকে হ’য়ে উঠতে হ’বে কবিতা রূপে, অন্য কিছু নয়। জীবনের অন্য নাম অন্য কিছু না হ’য়ে যদি কবিতা হয়, তাহ’লে কবিতাই সেখানে স্তব গাবে তাঁর হ’য়ে। জীবনকে বাদ দিয়ে কবিতা কখনও কবিতা হবে না, হ’তে পারে অন্য কিছু, কিন্তু কবিত নয়। কবিতাকে, কবিতা হ’তে হ’লে তার সাথে জীবনের থাকতে হবে নিবিড় সম্পর্ক, যে সম্পর্ক অটুট থাকবে কাল থেকে কালান্তর পর্যন্ত। কবিতায় জীবন কিভাবে আসবে তা আমাদের ভাবার বিষয় নয়, তা কবিই নির্ধারণ ক’রে নিবেন। তিনি কিভাবে জীবনকে উপাস্থাপন করবেন কবিতার মাঝে,  থেমে থেমে নয়, নিবিড় ভাবে।  
  রবীন্দ্রনাথ, কবি ও কবিতা নিয়ে লিখেছেন প্রচুর। তাঁর ব্যাপক-বিস্তৃত এ-সম্পর্কে লেখাগুলো রয়েছে কবিতা ও প্রবন্ধগুলোতে। তাঁর মতো ক’রে এ-সম্পর্কে এতো পরিমাণ লেখা কেউ লিখেছেন কি-না আমার জানা নেই। কবি ও কবিতা নিয়ে লিখেছেন বিরামহীন ভাবে; কখনও তা-কবিতায় আবার কখন তা সাহিত্যর নানা স্থানে, রয়েছে উজ্জ্বল হ’য়ে।    
রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কবিতায় “কবি “সম্পর্কে যখন বলেনঃ
            
            
             ‘কবি, তবে উঠে এসো- যদি থাকে প্রাণ
              তবে তাই লহো সাথে, তবে তাই করো আজি দান।
              বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা- সম্মুখেতে কষ্টের সংসার  
              বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
              অন্য চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
              চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল  পরমায়ু,
              সাহসবিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্য মাঝারে, কবি,
              একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।‘  
                          
                                                      [চিত্রাঃ ১৩০২ ‘এবার ফিরাও মোরে ]


রবীন্দ্রনাথ, কবিকে সাথে আসার জন্য আহ্বান করেছেন, যদি তিনি প্রাণবাণ হোন। কবির থাকতে হয় বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা আর সংসার-এ পাহাড় সমান কষ্ট। এসব যেন কবির ভাগ্যর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এসব উপাদান না থাকলে যেন কবি হওয়া যায় না। দুঃখ, ব্যথা, দারিদ্র্য , শূন্যতা, ক্ষুদ্র, অন্ধকার এসব- ই যেন কবির আপনজন। একজন কবির জীবনে যেমন থাকে এ সব উপাদানের উপস্থিতি , আবার বলা যায় কোনো ব্যাত্তির জীবনে এ-সব থাকলেই তাঁকে কবি ব’লে আখ্যায়িত করা যাবে, তাঁর কোন কারণ নেই। কবির জীবনে ব’য়ে যাবে সে সব ঘটনা, যা ইতি পূর্বে ঘটেনি অন্যর জীবনে। জীবনের যত সব ঘটনা তাঁর প্রাক-পরীক্ষা যেন ঘটাতে হবে কবির জীবনে কারণ; এ জীবনটা এতো মূল্যবান নয় তাঁর কাছে, যা রয়েছে অন্যর কাছে। কবির জীবন হচ্ছে দুঃখ, কষ্ট পর্যবেক্ষণ করার স্বাধীন বিচরণভূমি, যেখানে- যে কেউ অনায়াসে পারে তাঁর পরীক্ষা মূলক পর্যবেক্ষণ কর্মটি সু-সম্পন্ন ক’রে নিতে। যেমন আমরা পারি মুক্ত একখণ্ড ভুমিতে ইচ্ছা মতো ফসল বুনতে। কাব্যেয় আসলে কি থাকে? যা আমাদের জানা নেই। যার জন্য কবি নিরন্তর সাধনা আর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।


রবীন্দ্রনাথ এ- সম্পর্কে বলেনঃ


‘কাব্যেয় আমরা আমাদের বিকাশ উপলব্ধি করি। তাহার সহিত নূতন তত্ত্বয়ের কোনো যোগ নাই। বাল্মাকি যাহা ব্যক্ত করিয়াছেন তাহা  বাল্মাকির সময়েও একান্ত পুরাতন ছিল। রামের গুন বর্ণনা  করিয়া তিনি বলিয়াছেন ভালো লোককে আমরা ভালোবাসি। কেবল মাত্র  এই মান্দাতার আমলের তত্ত্ব  প্রচার  করিবার  জন্য সাতকাণ্ড রামায়ণ  লিখিবার  কোনো আবশ্যক ছিল না। কিন্তু ভালো যে কত ভালো, অর্থাৎ ভালোকে  যে কত ভালো লাগে তাহা  সাতকাণ্ড রামায়ণেই প্রকাশ করা যায়; দর্শনে বিজ্ঞানে কিংবা সুচতুর সমালোচনায় প্রকাশ করা যায় না।‘

                                                                                                                      [সাহিত্য ১৩৯৪ঃ‘কাব্য’পৃঃ ৬৯৩]
রবীন্দ্রনাথ, কবিতা সম্পর্কে সবচে ভালো মত প্রকাশ করেছেন “জীবনস্মৃতি” গ্রন্থেঃ


‘কিছু একটা বুঝাইবার জন্য কেহ তো কবিতা লেখে না। হৃদয়ের অনুভূতি কবিতার ভিতর দিয়া আকার ধারন করিতে চেষ্টা করে। এই জন্য কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে ‘বুঝিলাম না’ তখন বিষম মুশকিলে পড়িতে হয়। কেহ যদি ফুলের গন্ধ শুঁকিয়া বলে ‘কিছু বুঝিলাম না’ তাহাকে  এই কথা বলিতে হয়, ইহাতে বুঝিবার কিছু নাই, এ যে কেবল গন্ধ। উত্তর শুনি, ‘সে তো জানি,কিন্তু খামকা গন্ধই বা কেন, ইহার মানেটা কী।‘ হয় ইহার জবাব বন্ধ করিতে হয়, নয় খুব একটা ঘোরালো করিয়া বলিতে হয়, প্রকৃতির ভিতরকার আনন্দ এমনি করিয়া গন্ধ হইয়া প্রকাশ পায়। কিন্তু মুশকিল এই যে, মানুষকে যে কথা দিয়া কবিতা লিখিতে হয় সে কথার যে মানে আছে। এই জন্য তো ছন্দবন্ধ প্রভৃতি নানা উপায়ে কথা কহিবার স্বাভাবিক পদ্ধতি উলটপালট করিয়া দিয়া কবিকে অনেক কৌশল করিতে হইয়াছে, যাহাতে কথার ভাবটা বড়ো হইয়া কথার অর্থটাকে যথাসম্ভাব ঢাকিয়া ফেলিতে পারে। এই ভাবটা তত্ত্বও নহে, বিজ্ঞানও নহে, কোনো প্রকার কাজের জিনিস নহে, তাহা চোখের  জল ও মুখের হাসির মতো অন্তরের চেহারা মাত্র। তাহার সঙ্গে তত্ত্বজ্ঞান, বিজ্ঞান কিংবা আর কোনো বুদ্ধিসাধ্য  জিনিস মিলাইয়া দিতে পার তো  দাও কিন্তু সেটা গৌণ। খেয়ানৌকায় পার হইবার সময় যদি মাছ ধরিয়া লইতে পার তো সে তোমার বাহাদুরি কিন্তু তাই বলিয়া  খেয়ানৌকা জেলে ডিঙ্গি নয়- খেয়ানৌকায় মাছ রপ্তানি হইতেছে না বলিয়া পাটুনিকে  গালি দিলে অবিচার করা হয়।‘
                                                                                
[জীবনস্মৃতিঃ ১৩১৯,পৃঃ ৪৯৩-৪৯৪,রর,পাঠক সমাবেশ]


রবীন্দ্রনাথ, তাঁর এই লেখাটিতে স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছেন, কবিরা কেন কবিতা লেখে? তাঁর মানসলোকে জমানো গাঢ় দুখগুলো যেন আরও অনেক বেশি হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির হ’য়ে  প্রকাশ পায়। কবিতা সব সময় বোঝার ব্যাপার হ’য়ে আসে না, অনেক সময় তা আবার আসে মনের উপলব্ধি এবং ইন্দ্রিয়ের সুখকর হ’য়ে, একটু হলেও নাড়া দেয় মনকে, কিছুক্ষণ সময় মনকে রাখে আধার থেকে আলোকিত ক’রে। সব–সময় সব কবিতা ইন্দ্রিয়ে সুখ জাগায় না, সব কবিতা সুখ জাগাতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ, এখানে কবিতা ভালো লাগার  বিষয়টিকে নিয়ে আসেন ফুলের গন্ধের সাথে। যার সাথে কোনো যুক্তিতর্ক  মিলে না। তাহ’লে কি বলবো কবিতা সব সময় ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধির বিষয়, বুঝার বিষয় না ? কবিতার পংতিতে পংতিতে রয়েছে তাঁর নিজস্ব কিছু অর্থ, যা সহজেই প্রবেশ ক’রে মনে। কবিতা কখন ও অব্যক্ত  প্রলাপ নয়, তা  সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কবির মনের ভাব ও ভাবনার সর্বচ্ছ প্রকাশ  হল কবিতা। সেই সাথে জুড়ে বসে কিছু জ্যোতির্ময় শব্দ ও ছন্দের দোলা। যার অতপ্রত সংমিশ্রণে প্রকাশ পায় অভূতপূর্ব একটি কবিতা। এই শব্দ ও ছন্দের খেলায় মেতে উঠেন কবিরা, আর এর থেকে প্রকাশ পায় কবিতার পর কবিতা। সেই ফুলের সুঘ্রাণ এর মতো কবিতা–ও আসে এক হ’য়ে। কবি তাঁর হৃদয়ের ব্যাপক প্রসারিত মনভাবনা প্রকাশ করেছেন কবিতার মাধ্যমে। হৃদয়ের অনুভূতি বহিঃপ্রকাশের জন্য যদি কবিতা লিখা হয়, তাহ’লে ওই সকল কবিতার সাথে রয়েছে কবির অন্তঃভাবনা, যে ভাবনা বা তাঁর অনুভূতিগুলো এক হ’য়ে আসে কবিতার  সাথে। কবিতার সাথে অনেক কিছুর সংমিশ্রণ থাকতে পারে, তাঁতে কবিতা কখনও ম্লান হ’য়ে পরে না, বরং কবিতা স্থির থাকে তার নির্ভরযোগ্য আসনটিতে। যেখানে কবিতা শুধু কবিতা হ’য়ে উঠে।  


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সমালোচনা’’ গ্রন্থে [২৬ মার্চ, ১৮৮৮]...“নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি” শিরোনামের লেখাটিতে প্রকাশ করেন কবির অন্তঃভাবনার বিস্তৃতরূপটি। রবীন্দ্রনাথ বলেনঃ  
                      
                        (ক)...“একটা কথা উঠিয়াছে, মানুষ মাত্রেই কবি। যাহার মনে ভাব আছে, যে দুঃখে কাঁদে, সুখে হাছে, সেই কবি। কথাটা খুব নূতনতর। সচরাচর লোকে কবি বলিতে এমন বুঝে না। সচরাচর লোকে  যাহা বলে তাহার বিপরীত একটা কথা শুনিলে অনেক সময় আমাদিকের ভারি ভালো লাগিয়া যায়। যাহার মনোবৃত্তি আছে সেই কবি, এ কথাটা এখনকার  যুবকদের মধ্য অনেকেরই মুখে শুনা যায়। কবি শব্দের ঐরূপ অতিবিস্তৃত অর্থ এখন একটা ফ্যাশন  হইয়াছে বলিলে অধিক বলা হয় না। এমন- কি নীরব–কবি বলিয়া একটি কথা বাহির  হইয়া গিয়াছে ও সে কথা দিনে দিনে খুব চলিত হইয়া আসিতেছে।এতো দূর পর্যন্ত  চলিত হইয়াছে যে, আজ যদি আমি এমন একটা পুরাতন কথা বলি যে, নিরব-কবি বলিয়া একটা কোনো পদার্থই নাই তাহা হইলে আমার কথাই লোকের নূতন বলিয়া ঠেকে। আমি বলি কি, যে নীরব সেই কবি নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমার যা মত অধিকাংশ লোকেরই আন্তরিক তাহাই মত।“  


রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ব্যক্তিগত মতের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখেননি কবি নামের মানুষটিকে। মানুষ নামের মানুষটি কখন কবিহয়  তা- তিনি আমাদের দেখিয়েছেন। কবি নামের নতুন সংজ্ঞাটি রবীন্দ্রনাথকে আরও বেশি আবেগ-আপ্লুত ক’রেতোলে। কবি শিরোনামের নতুন নামটি রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়ে দেয়, কে কবি বা কবি নয়। প্রচলিত সংজ্ঞাকে তিনি কতটা মেনে নেন তা আমাদের জ্ঞাত নয়। ভাব, দুঃখ, সুখ- এসব যার মধ্য রয়েছে তাঁকে কবি ব’লে মেনে নেয়া যেতে পারে। টেনে আনেন নতুনদের, কবি নামের নতুন শিরোনামটি। মনোবৃত্তি, যার আছে সেই কবি। পূর্বেই বলেছি, এই মনোবৃত্তি অন্য কিছু নয়, ভাব-ভাবনা আর চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশই কবির সূচনা। মেনে নেননি ‘নীরব কবি’ নামের কবিদের। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, কবি হবেন কবি, মনোলোকের চেতনায় জন্ম নেয়া কোনো ধারণা থেকে তিনি জেগে উঠবেন না। তিনি জেগে উঠবেন মানুষের মধ্য থেকে, যাকে আমরা সহজেই ‘কবি’ নামে আখ্যায়িত করবো।
            
একই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেনঃ
                                      
       (খ)... “যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে  বিভিন্ন লোকে কবি বলিয়া থাকে, তখন কি করিয়া বলা যাইতে পারে যে    কবি বলিতে সকলেই এক অর্থ বুঝে? আমি বলি কি, একই অর্থ বুঝে! যখন পদ্যপুণ্ডরীকের  গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত রামবাবুকে তুমি কবি বলিতেছ, আমি কবি বলিতেছি না ও কবিতাচন্দ্রিকার গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত শ্যামবাবুকে আমি কবি বলিতেছি তুমি বলিতেছ না, তখন  তোমাতে আমাতে এই তর্ক যে, “রামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে  কবি বলা যাইতে পারে?” বা, “শ্যামবাবু কি  এমন কবি যে  তাঁহাকে  কবি বলা যাইতে পারে?” রামবাবু ও শ্যামবাবু এক স্কুলে  পড়েন, তবে তাঁহাদের মধ্য  কে ফাস্ট  ক্লাসে পড়েন কে লাস্ট ক্লাসে পড়েন তাহা লইয়া কথা। রামবাবু ও শ্যামবাবু যে এক স্কুলে পড়েন, সে স্কুলটি কি ? না, প্রকাশ করা। তাঁহাদের মধ্য সাদৃশ্য কোথায় ? না, প্রকাশ করা লইয়া। বৈসাদৃশ্য কোথায় ? কিরূপে প্রকাশ করা হয় তাহা লইয়া। তবে, ভালো কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে  তাঁহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা  হইতে আরও দূরে গেলে তাঁহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে পারি, যাহা ইচ্ছা। পৃথিবীর মধ্য সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জীবকে আমরা মানুষ বলি, তাহার কাছাকাছি  যে আসে তাঁহাকে বনমানুষ বলি, মানুষ হইতে আরও তফাতে গেলে তাহাকে মানুষ ও বলি না , বনমানুষ ও বলি না, তাহাকে বানর বলি, এমন তর্ক কখনো  শুনিয়াস  যে, Wordsworth শ্রেষ্ঠ কবি না ভজহরি ( যে ব্যত্তি লেখনীর আকার কিরুপ জানে না) শ্রেষ্ঠ কবি ?  অতএব এটা দেখিতেছ, কবিতা প্রকাশ না করিলে কাহাকে ও কবি বলা যাই না। তোমার মতে তো বিশ্ব -সুদ্ধ লোককে চিত্রকর বলা যাইতে পারে। এমন ব্য িত নাই, যাহার মনে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত না রহিয়াছে , তবে কেন মনুষ্যজাতির আর এক নাম রাখ না চিত্রকর ? আমার কথাটি অতি সহজ কথা। আমি বলি যে, যে ভাব বিশেষ ভাষায় প্রকাশ হয় নাই তাহা কবিতা নহে ও যে ব্যত্তি ভাব বিশেষ ভাষায় প্রকাশ করে না সেও কবি নহে। যাঁহারা ‘নীরব কবি’  কথার সৃষ্টি করিয়াছেন  তাঁহারা বিশ্বচরাচরকে কবিতা বলেন।  এ সকল কথা কবিতাতেই শোভা পায়। কিন্তু অলঙ্কারশূন্য  গদ্য অথবা তর্কস্থলে বলিলে কি ভালো শুনায়? একটা নামকে এরূপ নানা অর্থে ব্যবহার  করিলে দোষ হয় এই যে, তাহার দুইটা ডানা বাহির হয়, এক স্থানে ধরিয়া  রাখা যায় না ও ক্রমে ক্রমে  হাতছাড়া  এবং সকল কাজের বাহির  হইয়া বুনো হইয়া  দাঁড়ায়।“


রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কবি ভাবনায় শুধু যে কবিকে নিয়ে ভেবেছেন তা নয়, কবি কি শিক্ষিত হবেন, না অ-শিক্ষিত হবেন তা নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। যদিও শিক্ষা কবি হওয়ার নিচ্ছয়তা  প্রদান ক’রে না, কিন্তু কবি হবেন শিক্ষিত। শিক্ষা বা অ-শিক্ষা  কবিতা নিধাররনের  মাপ কাঠি নয়, কবিতা কতটা কবিতা হ’য়ে উঠলো তা কবির একান্ত চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যে চেতনার ভাব বিশ্লেষণ থেকে রচিত হ’তে পারে কবিতার পর কবিতা। যে সকল কবিতা টিকে থাকতে পারে শতাপদ্দির পর শতাপদি। কবিতায় কতটা সত্য বা মিথ্যা থাকবে তা নিয়ে-ও ভেবেছেন। কবিতা হ’তে পারে সত্য আবার একই সাথে আবার তা হ’তে পারে মিথ্যা। আবার একই সাথে তা কখনো  দেখা দিতে পারে সত্য-মিথ্যা রূপে।

রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ‘সমালোচনা’’ গ্রন্থে [২৬ মার্চ, ১৮৮৮] কবিতার সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে বলেনঃ
                      
“সত্য যত কবিতা আছে , মিথ্যায়  তেমন নাই। শত সহস্র  মিথ্যার দ্বারে দ্বারে কল্পনা বিচরণ  করিতে পারে, কিন্তু এক মুষ্টি কবিতা সঞ্চয়  করিতে পারে কি না সন্ধেহ ; কিন্তু একটি সত্যর কাছে যাও , তাহার দশগুণ  অধিক কবিতা পাও কি না দেখো দেখি। কেনই বা তাহার ব্যতিকক্রম হইবে বলো ? আমরা তো প্রকৃতির  কাছেই কবিতা  শিক্ষা করিয়াছি, প্রকৃতি কখনো মিথ্যা কহেন না । আমরা কি  কখনো কল্পনা করতে পারি যে, লোহিতবর্ন ঘাসে  আমাদের চক্ষু  জুড়াইয়া যাইতেছে ? বলো দেখি, পৃথিবি নিশ্চল রহিয়াছে  ও  আকাশে অগণ্য তারকারাজি নিশ্চলভাবে  খচিত রহিয়াছে , ইহাতে অধিক কবিত্ব, কি সমস্ত তারকা নিজের পরিবার  লইয়া ভ্রমণ করিতেছে, তাহাতে অধিক কবিত্ব; এমনি তাহাদের তালে তালে পদক্ষেপ যে, একজন জ্যোতির্বিদ বলিয়া দিতে পারে-  কাল যে গ্রহ অমুক স্থানে  ছিল আজ সে কোথায় আসিবে। প্রথম কথা এই যে, আমাদের কল্পনা প্রকৃতি  অপেক্ষা কবিত্বপূর্ণ বস্তু সৃজন  করিতে অসমর্থ; দ্বিতীয় কথা এই যে, আমরা যে অবস্থার মধ্য  জন্ম  গ্রহণ করিয়াছি  তাহার বহির্ভূত সৌন্দর্য  অনুভব করিতে পারি না। অনেক মিথ্যা, কবিতায়  আমাদের মিষ্ট লাগে।  তাহার কারণ এই যে,  যখন সেগুলি প্রথম লিখিত হয়  তখন  তাহা সত্য  মনে করিয়া লিখিত হয়, ও সেই অবধি বরাবর সত্য বলিয়া চলিয়া আসিতেছে।আজ তাহা আমি মিথ্যা বলিয়া জানিয়াছি, অর্থাৎ জ্ঞান  হইতে তাহাকে দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি; কিন্তু হৃদয়ে সে এমনি শিকর বসাইয়াছে যে, সেখান হইতে তাহাকে উৎপাটন করিবার জো নাই। কবি যে ভূত বিশ্বাস না করিয়াও  ভূতের বর্ণনা করেন, তাহার তাৎপর্য কী ? তাহার অর্থ এই যে, ভূত বুস্তত সত্য না হইলেও আমাদের  হৃদয় সে সত্য। ভূত আছে বলিয়া কল্পনা করিলে যে আমাদের মনের কোন খানে আঘাত লাগে, কত কথা জাগিয়া উঠে, অন্ধকার, বিজনতা, শ্মশান, এক অলৌকিক পদার্থের নিঃশব্দ অনুসরণ, ছেলেবেলাকার  কত কথা মনে উঠে- এ সকল সত্য যদি কবি না দেখেন  তো কে দেখিবে ? সত্য এক হইলেও যে দশ জন কবি সেই এক সত্যর মধ্য দশ প্রকার বিভিন্ন কবিতা দেখিতে পাইবেন না তাহা তো নহে। এক সূর্যকিরণে পৃথিবি  কত  বিভিন্ন বর্ণ ধারণ  করিয়াছে দেখো দেখি ! নদী যে বহিতেছে, এই  সত্যটুকুই কবিতা নহে। কিন্তু এই বহমানা নদী দেখিয়া  আমাদের হৃদয়ে যে ভাব বিশেষের জন্ম হয়, সেই সত্যই যথার্থ  কবিতা। এখন বলো দেখি, এক নদী দেখিয়া সময়ভেদে কত বিভিন্ন ভাবের উদ্রেক হয়! কখনো নদীর কণ্ঠ হইতে বিষণ্ণ গীতি শুনিতে পাই; কখনো বা  তাহার উল্লাসের কলস্বর, তাহার শত তরঙ্গের নৃত্য আমাদের মনকে মাতাইয়া তোলে। জউস্না  কখনো  সত্য- সত্যই  ঘুমায় না, অর্থাৎ সে দুটি চক্ষু মুদিয়া পড়িয়া থাকে না ও জসস্নার  নাসিকাধবনিও কেহ  কখনো শুনে নাই। কিন্তু নিস্তব্দধ রাত্রে জস্না দেখিলে মনে হয় যে জস্না ঘুমাইতেছে, ইহা সত্য। জস্নার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তন্ন তন্ন রূপে আবিষ্কৃত হউক, এমনও প্রমাণ হউক যে জস্না একটা পদার্থই নহে, তথাপি লোকে বলিবে জস্না ঘুমাইতেছে। তাহাকে কোন বৈজ্ঞানিক-চূড়ামণি মিথ্যা কথা বলিতে সাহস করিবে ? “  


রবীন্দ্রনাথ; অনুবাদ করেছেন অনেক কবিতা। বেঁছে নিয়েছেন Victor Hugo, Shelley, Browning, Ernes Myers, Moore, Marston, Christina Rossetti, Swinburne, Hood- ইত্যাদি কবিদের। Victor Hugo- এর রয়েছে “The Poet” কবিতা, যা রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন “কবি”  শিরোনামেঃ


“ওই যেতেছেন  কবি কাননের পথ দিয়া,
কভু বা অবাক, কভু ভকতি – বিহ্বল হিয়া।
নিজের প্রাণের মাঝে
একটি যে বিনা বাজে,
সে বীণা শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া।
বনে যত গুলি ফুল আলো করি ছিল শাখা,
কারো কচি তনুখানি নীল বসনেতে ঢাকা,
কারো বা সোনার মুখ,
কেহ রাঙা টুকটুক,
কারো বা শতেক রঙ যেন ময়ূরের পাখা,
কবিরে আসিতে দেখি হরষেতে হেলি দুলি
হাব ভাব করে কত রূপসী সে মেয়েগুলি।
বলাবলি করে, আর ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,
“প্রণয়ী মোদের ওই দেখ লো চলিয়া যায়।“


কবিতার ব্যবহারিক  অর্থ বিভিন্ন জন, বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন স্থানে দিয়েছেন। যার একক কোনো  অর্থ বিরাজ ক’রে  না সর্বত।“সাহিত্যর শব্দার্থকোশ” [১৯৯৯], সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গ্রন্থে  ‘কবিতা’  শব্দের ব্যাখ্যা করা হয় এভাবেঃ
“ইংরেজিতে ‘পোয়েম’ (Poem); মূল গ্রিক ‘পোয়েইমা’(Poiema)-এর আক্ষরিক অর্থ  হল ‘সৃষ্টি করা  কোনও বস্তুু। ছন্দে বা অমিত্রাক্ষর ছন্দে  লেখা কোনও রচনা। যেটি  গদ্য সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভাব নয় এমন এক নান্দনিক  অনুভূতি ব্যক্ত করার  উদ্দেশ্য আবেগসমৃদ্ধ ও  অলংকিত ভাষায় সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম।“ এই সংজ্ঞা থেকে বুঝা যায় ; তাকেই কবিতা বলা যাবে যার মধ্য থাকবেঃ ১. লেখাটা হ’তে হ’বে ছন্দ নির্ভর বা  অমিত্রাক্ষর ছন্দে ; ২. গদ্যয় যার ভাব প্রকাশ করা যাবে না; ৩. ভাব প্রকাশের ধরণ হ’বে  নান্দনিক বা শিল্পনির্ভর; ৪. রচনাটিতে থাকতে হ’বে আবেগের সংমিশ্রণ; ৫. এবং আবেগের ভাষা হ’বে সৌন্দর্যময়। এ গুলো থাকলেই তাকে আমরা একটা উৎকৃষ্ট রচনা বা কবিতা বলবো! না, উৎকৃষ্ট রচনার মধ্য থাকবে ভাষা-সৌন্দর্য- অলংকার আর ছন্দের খেলা।


“কবি ও কবিতা”-সম্পর্কে বোদলেয়ারের রয়েছে ব্যাপক রচনা। যেখানে তিনি পৃথকভাবে ব্যাখা করেছেন কবি ও কবিতা নিয়ে। বোদলেয়ার মনে করেন কবিতা একটি মাধ্যম বা যন্ত্র নয়, এর একটি নিদিষ্ট বিষয় ও রয়েছে। কবি একজন স্বপ্নদাতা, যিনি স্বপ্নের রাজ্যয় আমাদের বিচরণ করান, তাঁর মতো ক’রে। কখনো আবার হ’য়ে উঠেন একজন জ্ঞানবান ধ্যানী একাকী মানুষ। যে মানুষ তাঁর সৌন্দর্যগুলো ছড়িয়ে দিতে চান সকলের মাঝে; যেখানে আলো-অন্ধকার এক হ’য়ে রয়।


সমকালীন কবি ও সমালোচক ‘Jules Janin’- এর উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে “বোদলেয়ার” বলেনঃ        
“Pourquoi le poete ne serait-il pas un broyeur depoisons aussi
  bien qu’un confiseur, un eleveur de serpents pour miracles et spectacles, un psylle amoreux de ses reptiles...”


অর্থাৎ, “কবি একজন বিষমন্থনকারী, ৈধয্যবান  শিক্ষক হতে পারেন, হতে পারেন একজন দক্ষ সাপুড়ে অথবা একজন ‘Confessor’(পাপীদের পাপ-এর কথা শোনেন যে পুরোহিত)।“  
[দ্রঃশার্ল বোদলেয়ারঃ অনন্য দ্রষ্টা (১৯৯২),সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়;পৃঃ ৮১]


বিভিন্ন পেশাদার মানুষের সঙ্গে বোদলেয়ার তুলনা করেছেন  কবিদের। তিনি মনে করেন কবি হ’তে পারেন ঠিক একজন যাদুকরের মতো, আবার কখনো তিনি হ’তে পারেন গণিতবিদ, একজন ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ, অসিক্রিয়াবিদের মতো  অথবা, একজন ধ্যানী সঙ্গীতবিদ বা হ’তে পারেন রন্ধন শিল্পী। মানুষের চতুর দিকে যা রয়েছে তিনি  তাঁর সাথেই তুলনা করেছেন কবিকে। কবি যেন আমাদের মাঝেই বসবাস কারী একজন, তা ব্যতিত  অন্য কেউ নয়। হয়তো তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সকাল- বিকাল আর সন্ধ্যায়, কফি পান করছি এক সাথে  বা পথ চলছি  একত্রে। কবি কতটা বিচিত্র হ’তে পারেন  আমাদের থেকে ? তিনি কি একাকী ! তিনি কি আছেন আমাদের মাঝে; না, তিনি দেখা দেন ভাবনা আর মনোবিশ্ব লোকে, যেখানে জ’মে  থাকে একগুচ্ছ স্বপ্ন আর তাঁর অলৌকিক বিশ্ব, যেখানে  নাগরিক হ’য়ে তিনি–ই  বেঁচে আছেন অধরার মতো। তিনি কবি; তিনি কি কথা বলেন আমাদের মতো ? স্বপ্ন দেখেন আমাদের হ’য়ে, তিনি কি সফল অন্য সকলের মতো ! যারা হয়তো পৌঁছে গেছে চূড়ান্ত শিখরে। যেখানে হয়তো তিনি কোনো দিন  পৌঁছেবেন না বা চেষ্টা করবেন না সামান্য মাত্র। তিনি থাকবেন হয়তো আলো- অন্ধকার থেকে অনেক দূরে। যেখানে অন্য কেউ না, তিনি থাকবেন কবি হ’য়ে। যার নিত্য কর্ম স্বপ্ন বুনে যাওয়া, স্বপ্নের ভিতরে বেঁচে থাকা।


কবিতা এক প্রকার আবেগ মণ্ডিত রচনা; স্বতস্ফুততম চিত্তাবেগচালিত কবির রচনাও হ’য়ে–ওঠা ৈনসর্গিক  সামগ্রী নয়, তা রচিত শিল্পকলা। তবে অনেকের এবং অনেক কবিতা শরীর থেকে রচনাচিহ্ন সম্পূর্ণ মুছে ফেলে বোধ জাগায় যেনো তা প্রাকৃতিক পুষ্প পল্লবের মতো জন্মেছে। কোনো কোনো কবিতা স্থাপত্যধর্মী, তা রচনাচিহ্ন লোপ ক’রে  দিয়ে স্থাপত্যমহিমা প্রচার করে স্বপ্ন- কল্পনা-চ চেতনায়, এবং প্রচুর কবিতায় নির্মাণচেষ্টা স্পষ্ট দেখা যায়।  রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নঢ্য  গীতিকবিতারাশি রচনা বা নির্মাণের কোনো  ছাপ শব্দ-পংত্তি- স্তবকে ধ’রে  রাখে না, জীবনানন্দের আদি পরযাের  কবিতাপুঞ্জ  গোপন ক’রে   রাখে  নির্মাণকৌশল, আর অন্ত্য পরযাএর কবিতা প্রদর্শন করে নির্মাণ দউবল্ল। সুধীদ্রনাথের  কবিতা নির্মাণপ্রণালি লুকিয়ে রাখে  স্থাপত্যমহিমা  রটায়।  যে- কবিতা বারংবার  সংশোধিত ও পূর্ণলিখিত, তা-ই শুধু নির্মিত বা রচিত, এমন নয়। কবি সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন তাঁর মনে; কাগজের শাদা পৃষ্ঠায় স্থান  পাওয়ার অনেক আগেই কবিতা বারংবার  নির্মিত, পুননির্মিত ও রচিত হয়। বিভিন্ন কলা প্রকৌশলের সুখী সম্মিলনে গ’ড়ে ওঠে কবিতা। তাঁতে আছে শব্দসজ্জ, বাক্যনির্মাণ, ছন্দঅনুপ্রাস- মধ্যমিলের মতো শারীরিক প্রকৌশল,এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রুপক-চিত্রকল্পের মতো অ-শারীরিক কলা। কবিতা রচিত হওয়ার পরে জৈব ও অবিভাজ্য  রূপ গ্রহণ করে। কিন্তু বিভাজন সম্ভাব সবকিছু; অণু, মানব-শরীর, জটিল যন্ত্র ও কবিতা সবকিছুকে ক্ষুদ্রংসে ভাঙা সম্ভাব। ব্যবছেঁদে  কবিতা কষ্ট পায়; যখন কোনো  উপমাকে কেটে আনা হয় কবিতা- শরীর থেকে, উপমাটি মলিন হয়।  কিন্তু কবিতা থেকে লুণ্ঠন ক’রে  না- এনে দেখানোর কোনো উপায় নেই কিভাবে উপমাটি গঠিত হয়ে কবিতাটি আলো জ্বেলে দিয়েছে। কবিতার কলা প্রকৌশলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্লেশন, কমপক্ষে, দুটি কাজ করতে পারেঃ  তা দেখিয়ে দেয় কবিতার রচনাপ্রক্রিয়া এবং চিনিয়ে দেয়  কবিকে। কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া  জানলে বোঝা যায় কবিতা কোনো   অলৌকিক মত্ত প্ররোচনার ফল নয়, আর কবিতার কলাপ্রকৌশল উতঘাথিত হওয়ার সঙ্গে উদঘাটিত হয় কবির অভ্যন্তর,- তাঁর মানসভুবন িস্থ মায়াবী কারখানা, যা সৃষ্টি করে কবিতা।[দ্রঃ হুমায়ুন আজাদঃ শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা( ১৯৯৬/১৪০২); পৃঃ ১৪৫-১৪৬]    


হুমায়ুন আজাদ, তাঁর “প্রবচনগুচ্ছ”[২০০৪ : ১৪১১]...গ্রন্থে  ‘কবিতা’ সম্পর্কে বলেন... “মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে; কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।“ আজাদ, তাঁর এই বক্তব্যর মধ্য দিয়ে মানুষ ও কবিতাকে এক ক’রে রেখেছেন। আবার কবিতা ও মানুষকে করেছেন একই দণ্ডে দণ্ডিত, যারা সমান ভাবে অপরাধী। যারা সৌন্দর্য খোঁজেন কবিতায়, চিত্তে দোলা জাগাতে চান, অপার সুখ অনুভব করেন ইন্দ্রিয়ে; তাঁরা অন্য কেউ নয়, তাঁরা কবির সহোদর। মানুষের ইতিহাস কত বছরের তা আমার বিবেচ্য বা ভাবনার বিষয় নয়। কিন্তু, এখন বলতে পারি, কবিতার ইতিহাস ও কম নয়। যেহেতু তা জড়িয়ে রয়েছে মানুষের সাথে। যদি বলি, মানুষের ইতিহাস গত চারশো-পাঁচশো বা হাজার বছরের মতো, তাহ’লে অন্তত পক্ষে বলতে পারবো কবিতার ইতিহাস-ও কম নয়। যেহেতু তা রয়েছে মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কবিতা কি মানুষের সমান বয়সী ? মানুষ যদি বেঁচে থাকে  আরও কয়েক লক্ষ বছর, তাহ’লে  কি কবিতা ও বেঁচে থাকবে লক্ষ  বছর ? না, হারিয়ে যাবে সন্ধ্যাতাঁরার মতো !  


তিরিশি–উত্তর বাঙলা কবিতার প্রাণপুরুষ শামসুর রাহমান। কবিতা রচনা-ই যার আরাধ্য। কবিতা নিয়ে “কবে শেষ হবে কৃষ্ণপক্ষ”[২০০৬]....এ ‘আমার অভিবাদন গ্রহণ করো হে একবিংশ শতাব্দী’  শিরোনামের লেখাটিতে বলেন : “একবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে একজন প্রতিভাবান নতুন কবি টেবিলে ঝুঁকে কোন ধরনের কবিতা লিখবেন সেই  ভবিষ্যদ্বাণী  আমার পক্ষে  বলা ভারি মুশকিল। তবে হ্যাঁ, এটুকু  বলতে পারি, কবিতার ধরন যতই পালটাক, কবিতা হয়ে-ওঠার গুনটুকু আগামীর বাক্যকেও ধারণ করতে হবে। নইলে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারবে না।“


ভাষা এক হ’লেও, একজন প্রধান কবি অন্য  কোনো কবিকে  দিয়ে তাঁর নিজের কথাই বলিয়ে নিতে চান; তাঁর মতো ক’রে। ভাবনার কোনো স্তরে তাদের মিল দেখলে; অ-মিলগুলো সরিয়ে তাঁর কল্পনায় জায়গা ক’রে নেন নিজের-ই সৃষ্টি বিশুদ্ধশিল্পকলায়। যেখানে অন্য কেউ নয়,  তিনি-ই বিস্তৃতি ঘটান তাঁর নিজের-ই আপনসত্ত্বায়। কবি ও কবিতায়  যিনি হ’য়ে  উঠেন একক ত্রাতা।  অন্য কেউ নয়;  কবি হ’য়ে  উঠেন জ্যোতির্ময় পদাবলীর নক্ষএময় উজ্জ্বল স্পন্দন, তাঁর বিধ্বস্ত হৃদয় আজ আর চন্দনের প্রলাপ নয়। সেখানে দিন- রাত্রি নেমে আসে  মোহনীয়  শ্রুতি হ’য়ে। সার্থক তাঁর সৃষ্টি, সার্থক ইন্দ্রিয়ের অনন্ত আলোড়ন, রুপক-প্রতীক আর চিত্রকল্পের উপলব্ধি। কামনা, বাসনা আর সৌন্দর্যবোধের মধ্য মৃত্যুর সুর যেনো প্রতিশ্রুতিশীল  ভাষায় বেড়ে উ’ঠে। পূর্বপুরুষেরা যে পথে গিয়েছে সে পথ নয়, কবির পথ হ’য়ে উঠুক  কবি ও কবিতার বিরামহীন বসন্ত সঙ্গীত, যার সুর গেঁথে রয়েছে কবির মানস চেতনালোকে।