হুমায়ুন আজাদ, তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লিখেছিলেনঃ ’কবিতা তাঁর কাছে সৌন্দর্যের বিরামহীন বিস্তার, ইন্দ্রিয়ের অনন্ত আলোড়ন, জীবাশ্মের মতো নির্মোহ মহর্ষির প্রাজ্ঞতা, ধ্যানের অবিচল উৎসরণ, জীবনের আদিম উচ্ছল উৎসব, রূপক প্রতীক চিত্রকল্পের নির্বাণহীন অঙ্গার’। কবিতা সৃষ্টিতে থেকেছেন সৌন্দর্যের এক বিরামহীন স্তরে। নিজেকে এবং বাঙলা কবিতাকে করেছেন সমৃদ্ধ। কবিতায় খুঁজেছেন অমল অপার সৌন্দর্য; এবং তা দু’মুঠে নিয়েছেন আপন মনে। শুধু কবিতা নয়; লিখেছেন সাহিত্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শাখাগুলোতে। চরম ভাবে হলেও সত্য যে, সমৃদ্ধ করেছেন বাঙলা সাহিত্যকে । যে সাহিত্যকে  তিনি নিয়ে যেতে চেয়েছেন সৌন্দর্যের উচ্চতম স্থানে। কেন লিখলেন কবিতা ? সৌন্দর্যের এক অপার শোভা ধারণ ক’রে আছে ঐ চোখে; এবং তার বহিঃপ্রকাশের জন্য ? আবদ্ধ থাকেননি বাঙলার প্রথাগত সাহিত্য নিয়ে। দেখিয়েছেন সাহিত্য কি এবং কিভাবে তাকে নিয়ে যেতে হয় সৃষ্টিশীলতার উচ্চতম  পর্যায়ে। এ যেন এক অদম্য পথিকের নিরন্তন পথচলা। হুমায়ুন আজাদ; চারদশকের চেয়েও বেশি সময় অবস্থান করেছেন বাঙলা কবিতায়। এই দীর্ঘ বিরামহীন পথে সাতটি কাব্যগ্রন্থে উপহার দিয়েছেন প্রায় তিনশতক কবিতা। সর্বদা লক্ষ্য রেখেছেন কবিতার মান এবং সৌন্দর্যবোধের দিকে। সংখ্যাগত দিক থেকে নয়; কবিতার মান এবং বিরামহীন সৌন্দর্য দিয়ে ধারণ ক’রে আছেন বাঙলা কবিতায়। এই দীর্ঘ সময়ে অন্য কেউ হয়তো লিখে উঠতেন সত্তরটির মতো কাব্য। তিনি স্থির থেকেছেন; কবিতার দিকে এগিয়েছেন স্বপ্ন ও  সৌন্দর্যে। বিশ্বাস করতেন; কবিতা উৎপাদিত কোনো জিনিস নয়। যেন ইচ্ছা করলেই তা বেড়িয়ে আসবে গড় গড় ক’রে। হুমায়ুন আজাদ, কবিতাকে প্রাণ দিয়েছেন, বেঁচে ছিলেন কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে। আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে বেড়িয়ে আসতে হয় প্রথাগত সাহিত্য থেকে সৃষ্টি ও মননশীল সাহিত্যের দিকে। নিজের কবিতা নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করেননি; স্থির থেকেছেন অবিচল আস্থায়। নিজের কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় তাই প্রকাশ করেনঃ’ নিজের কবিতা সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই না; শুধু বলি আমি কবিতা লিখেছিলাম, লিখছি এবং লিখবো।’
                             হুমায়ুন আজাদ; লিখেছিলেন সাতটি কাব্যগ্রন্থ। ১.’অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩); ২.‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০); ৩.‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫); ৪.‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ (১৯৮৭); ৫.‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ (১৯৯০); ৬.‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ (১৯৯৮) এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ৭. ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪)-এ। হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)-এর সাথে সেই একই বছর মহাদেব সাহার ‘মানব এসেছি কাছে’ (১৯৭৩) এবং নির্মলেন্দু গুনের ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’ (১৯৭৩)- প্রকাশিত হয়। আধুনিক বাঙলা কবিতায় দেখা দেয় আরো চমৎকার কিছু কাব্যগ্রন্থ।  
      
                             পঞ্চাশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)-এ। এর ঠিক সাত বছর পর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ ; যেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় উনপঞ্চাশটি কবিতা। কবিতার সংখ্যার দিক থেকে তেমন কোনো ব্যবধান থাকে না প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যের মাঝে। এর পাঁচ বছর পর (১৯৮৫)- এ প্রকাশিত হয় তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ ; যেখানে পাওয়া যাবে চল্লিশটি কবিতা। এর ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ, ১৯৮৭- তে প্রকাশিত হয় চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ ; যাতে পাওয়া যাবে আঠাশটি কবিতা। ১৯৯০-এ প্রকাশিত হয় পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ ; যাতে পাওয়া যাবে  সাতাশটি কবিতা। প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের ন্যায় খুব বেশি ব্যবধান থাকে না চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রন্থের মাঝে। একটি কবিতা কম বা বেশি দিয়ে ব্যবধান তৈরি করা হয়েছে কাব্যগুলোকে। এর আট বছর পর (১৯৯৮)-এ চুয়াল্লিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থটি। সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’ প্রকাশিত হয় (২০০৪)-এ। যেখানে পাওয়া যাবে বায়ান্নোটি কবিতা। কবিতা সংখ্যার দিক থেকে বড় কাব্যটি ‘পেরোনোর কিছু নেই’ এবং ক্ষুদ্রটি ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’। সাত বছর ব্যবধানে যেমন রচনা করেছেন কোনো কাব্য; ঠিক দু’বছর ব্যবধানেও রয়েছে অন্য কোনো কাব্য।                          


                             হুমায়ুন আজাদের কবিতার সূচনা বছর যদি নির্ধারণ করা হয় ১৯৭৩; এবং সমাপ্তি বছর যদি হয় ২০০৪-এ; তাহ’লে এই তিনদশকেরও কিছু বেশি সময়ে তিনি নিরন্তন সৃষ্টি ক’রে চলেছেন বাঙলা কবিতা। এখানে উল্লেখ্য যে, যে সময় কবিতা প্রকাশ পেয়েছে সেই সময় তার রচনা কাল নয়। তবুও প্রকাশিত কালকে ধ’রে তা নির্ধারণ করা হ’লো। এর বাইরেও থেকে গেলো কিশোর ও অনুবাদ কবিতা। একটি বিষয় বেশ আশ্চর্য লাগে যে, হুমায়ুন আজাদের এক কাব্য থেকে অপর কাব্যের কবিতার সংখ্যাগত ব্যবধান খুব বেশি নয়। যা একটি বা দুটি কবিতার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কোনো কাব্যেয় যেমন আমরা কবিতা দেখতে পাই চব্বিশটি, কোথাও সাতাশটি, আবার কোথাও আঠাশটি। কবিতার সংখ্যাগত দিকটি তো আবার এ রকম হ’তে পারতো কোনোটি আঠাশটি বা কোনোটি বিরাশিটি। তা কিন্তু হ’য়ে উঠেনি। তিনি কি সতর্ক ছিলেন কবিতার সংখ্যাগত দিকটি নিয়ে ? বাঙলা কবিতায় তাঁর সাথে অন্য অনেকে এটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কয়েক শতক পর্যন্ত। তিনি সর্বদা সজাগ ছিলেন কবিতার মান ও সৃষ্টিশীল ব্যাপারটি নিয়ে। তাই আমরা পাই না তিনদশক সময়ে তাঁর রচিত সহস্রাধিক কবিতা। হুমায়ুন আজাদের সমপরিমাণ কবিতা রয়েছে তিরিশি আরেক আধুনিক কবি সুধীদ্রনাথ দত্তের। সুধীদ্রনাথ দত্তের সাতটি কাব্যেয় পাওয়া যাবে প্রায় দুইশতক কবিতা।
                              হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩); যখন প্রকাশ করেন আধুনিক বাঙলা তিরিশি কবিদের বিগত হয়েছেন দু’জন কবি। জীবনানন্দ দাশ ( ১৮৯৯-১৯৫৪) এবং সুধীদ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০)। বেঁচে ছিলেন অপর তিনজন। বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী এবং বিষ্ণু দে।  


                              ‘১৯৭৩’ এবং একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ। সময়টা আমাদের বেশ ভাবিয়ে তোলে। সবে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ডে একটি দেশ; যার নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বাঙলাদেশ’। যার বহন করার মতো রয়েছে একটি নিজস্ব পরিচয়। যে পরিচয়ে সে পরিচিতি পাবে আরও অনেক ক্ষেত্রে। পুরনো জরাজীর্ণ চেতনায় ধুয়ে- মুছে সৃষ্টি হ’বে  নতুন একটি ভূখণ্ডের ; যা গেঁথে থাকবে মন ও মননে। এর পর থেকে আমরা ধারণ করব নতুন কিছু শব্দ। যা দেখা দিবে ‘স্বাধীনতা পূর্ব’ এবং ‘স্বাধীনতা পরবর্তী’ নামে। যে শব্দ দু’টির সাথে পরিচিত ছিলাম না আমরা। ‘দশক’ শব্দটি বার বার এবং বহুবার ফিরে এসেছে বাঙলা কবিতায়; ব্যাপক-বিস্তৃতভাবে। বিশ শতকের সবচেয়ে উচ্চারিত শব্দটি ছিল ‘আধুনিক বাঙলা কবিতার তৃতীয় দশক’; এর মতো আর কোনো শব্দ এতো পরিমাণ উচ্চারিত হয়নি বাঙলা কবিতায়। এই শতকের পরবর্তী সময়কে আর তেমন কোনো দশক দিয়ে শক্ত ক’রে বাধিনি আমরা। চার, পাঁচ, ছয় ব’লে  কাটিয়ে দেই আমরা। সাত দশকের কবিতা পর্যন্ত উচ্চারিত হয় এই নামে; পূর্বের ন্যায়। এর পর থেকে বাঙলা কবিতায় আমরা উচ্চারণ করি ‘স্বাধীনতা পূর্ব’ বা ‘স্বাধীনতা উত্তর’ নামে আধুনিক বাঙলা কবিতাকে। তাই হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হ’য়ে উ’ঠে স্বাধীনতা উত্তর কাব্যগ্রন্থের অন্যতম; যে কাব্যকে বলা যেতে পারে নিঃসঙ্গ বেহালার একাকী সুরের কম্পন। ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয় পরাধীনতার গ্লানি থেকে কতোটা হিমশীতল হ’য়ে দেখা দেয় আমাদের স্বাধীনতা। যা আলো-আধাদের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন ক’রে বাঙলা কবিতায়। যে কবিতা আর নির্দিষ্ট থাকে না ব্যক্তিগত কবিতা হ’য়ে; তা দেখা দেয় আধুনিক বাঙলা কবিতারূপে। এ কাব্যগ্রন্থে আমরা পাই ‘প্রেম’, ‘স্বপ্নকাতরতা’ , ‘সৌন্দর্য’ , ‘রূপক’, ‘প্রতীক’ এবং চিত্রকল্পের এক অনন্য সমন্বয়; যা আবেগ এবং সৌন্দর্যে ভরিয়ে দেয় আমাদের ইন্দ্রিয়কে। যে কবিতাগুলো কোনো প্রথাগত কবিতা নয়; তা দেখা দেয় ইন্দ্রিয়ের গলিত সুখ হ’য়ে। পর্যায়ক্রমে আলোচনা করবো হুমায়ুন আজাদের এ  কাব্যের কবিতাগুলো।  


‘অলৌকিক ইস্টিমার’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘স্নানের জন্য’ । যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়ঃ


‘মরুভূমির মতো নদী বয়ে যায় দিকচিহ্নহীন
আমি কি ক’রে  ভাসাই নৌকো জ্বলে নামি স্নান করি
স্নানের যোগ্য জল নেই কো নো নদী সরোবরে
পেছনে স্বভাব কবির কণ্ঠনিসৃত পদ্যের  মতোন  ধুয়োওঠে কারখানার চিমনি চিরে
তার স্তবে মগ্ন হ’লে  বুঝতে পারি ড্রেনে ড্রেনে পদ্ম ফোটেডাস্টবিনে জন্ম নেয় সূর্যমুখী।’


কবিতাটির মধ্যে আমরা পাই না নতুন কোনো স্বপ্ন; যে স্বপ্ন আমাদেরকে নিয়ে যাবে তার কোনো এক অজানাভূমিতে । কবিতাটির মাঝে আবার আমরা শুনতে পাইঃ ‘আমার শরীর খানি তুলে ধরো হে মরমা হৃদয়মন্দির’। এ যেন কোনো এক আকুল আবেদন অন্য কারো নিকট। যোগ্য জল থেকে তিনি রয়েছেন অনেক দূরে; যা হয়তো হাত দিলেই আর তাকে পাওয়া যাবে না। ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ কাব্যগ্রন্থের  নামের ‘অলৌকিক’ শব্দটির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই প্রথম কবিতাটিতেই।‘নেমে এসো পূর্ণ বেগে ভরা স্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী’। এ নদী প্রবাহিত ধারা কোনো নদী নয়; তা রয়েছে আমাদের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। যা স্বপ্নে গেঁথে থাকে অলৌকিক হ’য়ে। আত্মস্মৃতি নির্ভর দ্বিতীয় কবিতা ‘আত্মজৈবনিক, একুশ বছর বয়সে’। এ কবিতাটির নাম নেওয়া মাত্র আমার মনে পড়ে শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)-এর ‘ বিধ্বস্ত নীলিমা’( ১৯৬৭) কাব্যের ‘আত্মজৈবনিক’ কবিতাটির কথা। যার শুরুটা এ রকমঃ’ যুদ্ধবাজ সাইরেনে উচ্চকিত কৈশোর আমার/গলির বিধ্বস্ত ঘরে। গুলির শব্দের প্রতীক্ষায়/ কেটেছে ভুতুড়ে রাত্রি অন্ধকারে এবং তামার/ মতো দিন খাকির প্রতাপে কাঁপে শান্তির ভিক্ষায়’। আর হুমায়ুন আজাদের কবিতাটির শুরু এ রকমঃ
‘বাগানে বিশ্বস্ত আজো, মধ্যরাতে অন্ধকারে কান পেতে শুনিপাখিদের প্রেমালাপঃ অবলুপ্ত তারকার অনন্ত ফাল্গুনি।প্রেমিকা বিমুখ হয় ভালবাসে ঘৃণা করে, তবু বারে বারে কিছু মধু রেখে যায় বিকলাঙ্গ শরীরের বিমর্ষ কিনারে।’
      
কবি এখানে ‘মধ্যরাতে অন্ধকারে কান পেতে শুনি’ পঙক্তিটিতে ব্যবহার করেন ‘মধ্যরাতে অন্ধকারে; ‘মধ্যরাত’তো এমনি অন্ধকার, এর ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত। তাহ’লে কি ঐ মধ্যরাত অন্ধকারময় নয় ? না, যেখানে প্রেমিকা বিমুখ হ’য়ে ফিরে আসে। পূর্বের কবিতার নদীর ন্যায় এ কবিতাটিতে আমরা পাই সেই নদী ও জাহাজকে। এক বিশ্বাসহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে কবিতাটি। যেখানে কবি আর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই কবিতার মধ্যে আবার ব’লে  উঠেনঃ


‘আমার বিশ্বাস মৃত, সে কখনও  মদস্রাবী  পিপাসা আনে না,শোক ছাড়া এ হৃদয় আর কো নো বান্ধবীর ঠিকানা জানে না;
কেবল ধ্বংসের স্মৃতি, ভগ্ন গৃহে তীব্র ফনি মনসার চারা
সাড়া দেয় আহবানেঃ স্মৃতি আর রাখে নাই চ’লে গেছে যারা’।


কবিতাটির শেষের দিকে আবার পাইঃ


‘সুখের প্রত্যাশী নই, নিদ্রাহীন সারারাত, বিনিদ্র এসেছি
বিপুল বিভ্রান্তি ভরা পৃথিবীতে, নিদ্রাহীন চলে যাবো জানি;আকাশ ওরে না আর ভেঙে ভেঙে ঝ’রে পড়ে মস্তকে শরীরে।’

‘পৃথিবী ছেঁড়ে’, ‘নিদ্রাহীন’, ‘আকাশ’ এই রকম শব্দের সাথে আমরা নতুন পরিচিত নয়। এ রকম অজস্র শব্দের সাথে আমরা পূর্বেই পরিচিত ছিলাম জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। তাই এই শব্দ আমাদের মাঝে আর আলোড়ন জাগায় না। যা জাগাতে পারে নতুন কোনো শব্দ। নঞ ভাবধারায় পরিবেষ্টিত হ’য়ে আছে কবিতাটি। পাই না একুশ বছরের সেই উদ্দাম আর তার উচ্ছ্বাস সাহসিকতাকে। ‘মধ্যরাত’, ‘অন্ধকার’, ‘বিমুখ’, ‘ঘৃণা’, ‘বিকলাঙ্গ’, ‘ বিমর্ষ’, ‘মাতাল’, ‘আপদ’, ’ক্লান্তি’, ‘কুৎসিত’, ‘নেই’, ‘অন্বিষ্ট’, ‘তিক্তশ্বাস’, ‘পদতলে’, ‘নীতিহীন’, ‘ঘোলাটে’, ‘মৃত’, ‘শোক’, ‘ধ্বংস’, ‘ভগ্নগৃহে’, ‘নির্মম’, ‘বিভ্রান্তিভরা’, ‘ভেঙে ভেঙে’ ইত্যাদি শব্দগুলো জড়িয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ কবিতাটিতে। তাই একুশ বা তার সেই চেতনার ভাবধারাটি বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়ে কবিতাটি। ‘বুদ্ধিতে বিশ্বাস নেই’ , ‘শান্তির শঙ্কিত বাণী’, ‘ধর্মগ্রন্থ পদতলে’, ‘রাজনীতি নীতিহীন’, ‘অগ্নিতে বিলুপ্ত হোক শত শত মনীষার রটিত দর্শন’, ‘আমার বিশ্বাস মৃত’ ‘কেবল ধ্বংসের স্মৃতি’, ‘সকল হৃদয় কানাকানি করে’ , ‘সুখের প্রত্যাশী নই’, ‘বিপুল বিভ্রান্তি ভরা’, ‘নিদ্রাহীন চলে যাবো জানি’ ইত্যাদি পঙক্তিও আমাদের জানিয়ে দেয় সেই একই অর্থ। পরের আর একটি কবিতা ‘আমার সন্তান’। যার শুরুতেই আমরা পাই সেই ‘অধঃপাতে’ শব্দটি। যা আমাদের বিচ্যুতি ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ ক’রে না। অধঃপাত থেকে আমরা আর এগিয়ে যেতে পারি না। কবিতাটির শুরু এ রকমঃ


‘আমার সন্তান যাবে অধঃপাতে, চন্দ্রালোকে নীল বন
তাকে কভু মোহিত করবে না, কেবল হোঁচট খাবে
রাস্তায় সিঁড়িতে ড্রয়িংরুমে সমভূমি মনে হবে বন্ধুর পাহাড় উল্টে পা হড়কে পড়ে যাবে।’


এখানেও আমরা দেখতে পাই সেই ‘শক্ত অন্ধকার’, ’সে অন্ধকার’ , ‘বল্লম’, ‘বন্দুক’ , ‘বোমা’, ‘হিংস্র’ ইত্যাদি শব্দগুলো; যা আমাদের কে নিয়ে যায় কবিতাটির গভীর ভাবনার দিকে। তাই আমার সন্তান হ’য়ে উ’ঠে  হিংস্র পরবাসে আগত কোনোএক নতুন অতিথি। ‘আমার সন্তান’ থেকে বেড়িয়ে আবার পাই নতুন এক কবিতা ‘আমার কন্যার জন্য প্রার্থনা’। আমার ভালোলাগা অসম্ভাব একটি কবিতা। আমি তার কয়েকটি পঙক্তি পড়তে চাইঃ

‘ক্রমশ সে বেড়ে উঠছে পার্কের গাঢ়তম গাছটির মতোন
ডাল মেলছে চতুর্দিকে, যেনো তার সংখ্যাতীত ডাল উপডালে ভ’রে দিবে  সৌরলোক – জোনাকিরা জ্ব’লে  যাবে পাখি এসে বসবে ডালে, অখণ্ডিত  নীলাকাশ
বাতাসে পা ভর দিয়ে আসবে যাবে সন্ধ্যায় সকালে।
শিকড় বাড়াচ্ছে নিচে জল চাই তার
মালির পরিমিত জলে গাছ বাঁচে কখনো আবার !’


কন্যার জন্য সব রকম প্রার্থনা করেন তিনি। তার পরও কোনো এক অজানায় সে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। যেখানে কোনো ভয় নেই; নেই কোনো রোদনের স্মৃতি। কন্যা কেমন জীবন বেঁচে নিবে, কেমন হ’বে তাঁর দিন যাপন, কিভাবে সে এগিয়ে যাবে কোনো প্রকার ভয় বা  নির্মম অজানা ভবিষ্যতের দিকে ! যার পদে পদে রয়েছে সভ্যতার করুন চিহ্নগুলো। ‘বৃষ্টি নামে’ কবিতায় ফু’টে উঠেছে বৃষ্টির অসম্ভব রকম এক সৌন্দর্য। যা থেকে বাদ পড়েনি কোনো কিছুই। গাছ, পাতা, টাওয়ার, পাখি, পাথর, রেশম, লৌহ, চুল, পাতাবাহার, নীল আলপিন, ঠোঁট, বাড়িঘর, হাসপাতাল, যানবাহন ইত্যাদি। শেষের দিকে আমারা দেখতে পাই কারা বৃষ্টির চরম প্রত্যাশী; যাঁদের হৃদয়ের গভীরে ভ’রে যাবে বৃষ্টির নিটোল ফোঁটায়; কেঁপে যাবে সমস্ত শরীর। যতো বার পড়েছি এ কবিতাটি ততো বার-ই মনে হয়েছে অমিয় চক্রবর্তী’র ‘বৃষ্টি’ কবিতার কথা। ‘নতুন সঙ্গিনীকে’ কবিতাটি রচিত হয় তাঁর কোনো একপ্রকার দ্রুতিময় সৌন্দর্য নিয়ে। সে যেনো কোনো এক আগন্তুক; যার স্পর্শে সব কিছুর এক পরিবর্তন ঘ’টে  যাবে মুহূর্তে। তাই কবি প্রকাশ করেন এ ভাবেঃ ‘পরম সত্যের মতো জ্বলে ওঠে সবগুলো ভুল/ গীতবিতানের গান গ’লে হয় সোনালী দুপুর’। এ কবিতাটির মধ্যে চমৎকার একটি জিনিস লক্ষ্য করি, আর তা হ’লো একটি দাঁড়ি বা কমা ব্যবহার না ক’রে তিনি শেষ করেন কবিতাটি। এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উ’ঠে কবিতার অভ্যন্তরে, যা থেকে বাদ পড়ে না আমাদের চোখও। এ রকম অভ্যাসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিন (১৮৮০-১৯১৮)-এর কবিতার কথা; যার কবিতা রচিত হয় এ রকম দাঁড়ি-কমা ছাড়া। তিনি মনে করতেন এটা কবিতার নতুন এক বৈচিত্ত্য। ‘বঙ্গউন্নয়ন ট্রাস্ট’ কবিতাটিতে প্রকাশ পায় পশ্চিমা বিশ্বের কিছু নাম। যেখানে ফুটে উ’ঠে  মার্কিন, রাশিয়া, চীন-এর নাম; প্রকাশ করেন গভীর ভাবে যারা বাঙলার শত্রু নয়। দু’জনের নাম প্রকাশ পায়  এ কবিতাটিতে ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘রেহানা আখন্দ’; প্রথম জনকে চিনতে পারলেও পারি না দ্বিতীয়জনকে। আমার দেশের সকল সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধতা যেনো চ’লে যায় অন্যের দিকে; যার নাম ধারণ ক’রে ‘বঙ্গউন্নয়ন’ নামে। দেশকে ক’রে নেন নিজের মধ্যে; তাই তা আর বাহ্যিক থাকে না। তাই আপন মনে ব’লে উঠেনঃ ‘আমার বাঙলাদেশে কোনো গ্রাম আর গাছ থাকবে না/কোনো কবি আর ডাকতে পারবে না নিসর্গের ডাকনাম ধ’রে’। যেনো সকল সৌন্দর্যের বিনাশ ঘটছে অন্যর হাতে; বিনাশ ঘটছে বাঙলাদেশের। ‘অম্লান জল’ কবিতায় ফু’টে উ’ঠে এক গভীর সৌন্দর্যবোধ; যা বধির ক’রে তোলে আমাদেরকে। তার অমলতা রয়েছে কবিতাটির পঙক্তিতে পঙক্তিতে। ‘ব্লাডব্যাংক’ কবিতাটি হ’য়ে উ’ঠে রচিত প্রথম দেশাত্মবোধক কবিতা; যা দেখা দেয় বাঙলার কবিতা হ’য়ে। কবিতাটির প্রথম পঙক্তিই আমাদের মনে করিয়ে দেয় কি প্রকাশ পাবে কবিতাটিতে। তিনি বলেনঃ


‘বাঙলার মাটিতে কেমন রক্তপাত হচ্ছে প্রতিদিন
প্রতিটি পথিক কিছু রক্ত রেখে যায় ব্লাডব্যাংকেঃ বাঙলার মাটিতে জমা রাখে ভবিষ্যৎ ভেবে।’
  
আবার একই কবিতায় প্রকাশ করেনঃ
‘কে আর রক্ত রাখে ব্লাড ব্যাংকে হাসপাতালে
সেই খানে লাল রক্ত ঘোলা হয়ে যায়
কাচ শিশি ওষুধের বিষাক্তছোঁয়ায়।’................চলবে