ধীরশান্তভাবে প’ড়ে উঠছিলাম তার পাঁচ হাজারের মতো চিঠি; আর মুগ্ধ হ’য়ে তাকিয়েছিলাম সেই মুখের দিকে;  তিনি কি নীরবে শুধু চিঠিই লিখছিলেন; সকাল বিকাল আর সন্ধ্যায়? যা কেউ জানতো না, বা কেউ জানতো ! তিনি কি মগ্ন ছিলেন সেই চিঠির গভীরে। তিনি কি লেখেননি নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, রাহুর প্রেম, বাহু, অনন্ত প্রেম, সোনার তরী, চিত্রা, মানসী, আগমন বা যদি তোমার দেখা না পাই-এর মতো কবিতা! তিনি কি লেখেননি গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং বৈচিত্র্যময় বাঙলা সাহিত্যে; যেখানে প্রকাশ পেয়েছে তার সৃষ্টিশীলতার নানাদিকগুলো। রবীন্দ্রনাথ, তার জীবনদর্শায় কতোগুলো চিঠি লিখেছিল ? সেই সব চিঠি কি তিনি লিখেছিলেন একক কোনো ব্যক্তির নিকট ! যা নাড়া দিতে পারে রবীন্দ্রনাথ বা সেই ব্যক্তিকে। রবীন্দ্রনাথের লিখিত চিঠিতে কোন কোন বিষয়বস্তু প্রকাশ পেত ? তিনি কি সব কিছু বলে জাননি তার সমস্ত সাহিত্যজুড়ে! এরপরও কি অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে তার সম্পর্কে; যা আমরা পাবো না তার রচিত সাহিত্যেয়! যা দেখা দিবে রবীন্দ্রলিখিত চিঠির মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন; তার লিখিত চিঠিগুলো প্রকাশ পাবে অন্যের কাছে এভাবে। তিনি যেমন লিখেছেন এক লাইনের চিঠি; আবার তেমনি লিখেছেন হাজার লাইনের চিঠি। চিঠি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের মত হলো, ‘যদি কোনো লেখকের সবচেয়ে ভালো লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয় তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে। আমি তো আরও অনেক লোককে চিঠি লিখেছি, কিন্তু কেউ আমার সমস্ত লেখাটা আকর্ষণ করে নিতে পারেনি। তার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, নানান লোকের নানান ধরণ, নানান রকম-সকম, সেইরকম-সকমগুলোকে বাঁচিয়ে চলতে হয়।’


একক কোনো ব্যক্তির কাছে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লেখেননি; এ-ক্ষেত্রে তিনি বেঁছে নিয়েছেন তিনশোজনেরও বেশি ব্যক্তিকে; যারা কোনো না কোনো ভাবে পেয়েছেন তার চিঠি। এর মধ্যে যেমন পাওয়া যাবে পরিবারের খুব আপনজন; ঠিক তেমনি পাওয়া যাবে অনেক অজানা ব্যক্তিকে, যে শুধু পরিচিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নিকট। যারা কোনো না কোনো সময় এসেছেন রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যেয়; এবং সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন তার সাথে। রবীন্দ্রনাথ; তার লিখিত চিঠিতে কোন কোন নির্বাচিত বিষয়গুলো তু’লে নিতেন, তার একক কোনো উত্তর পাওয়া যায় না কোনো চিঠিতেই। সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা, ধর্ম, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জমিদারি, প্রকৃতি, ভ্রমণ, সাহিত্যে, নারী, পুরুষ, প্রেম ইত্যাদি ব্যাপারগুলো জায়গা ক’রে নিয়েছে তার লিখিত চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথের লিখিত এমন অনেক চিঠি আছে; তার শিরোনাম যদি চিঠি না হতো, তাহ’লে তা জায়গা ক’রে নিতো উৎকৃষ্ট প্রবন্ধে। অই শিরোনামই নিদিষ্ট ক’রে দেয় ওগুলো চিঠি; অন্যকিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের লিখিত চিঠিগুলোর মর্মে-মর্মে প্রকাশ পেয়েছে, তার রচিত সাহিত্যের চিত্রকল্প। ওগুলো পড়ে আমাদের আর বুঝে নিতে বাকী থাকে না; তিনি যে একজন বড় মাপের সাহিত্যিক।


রবীন্দ্রনাথ; তার লিখিত চিঠিতে প্রাপক ব্যক্তি থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান ক’রে তুলেছেন তার ভাবনাবোধকে; এবং তার বিস্তার ঘটিয়েছেন রচিত চিঠিতে। এমন অনেক চিঠি প্রকাশ পেয়েছে; যা তিনি বেঁচে থাকলে প্রকাশ করার অনুমতি হয়তো দিতেন না, বা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ কি চিন্তা করতেন চিঠি লেখার পূর্বে ? যেমন তিনি চিন্তা করেছেন অন্যসাহিত্যেগুলো রচনার পূর্বে। তার লিখিত চিঠিগুলো পড়ে বুঝা যায়; তিনি চিন্তা ছাড়া কোনো কিছুই রচনা করেননি। যখনই কিছু লিখেছেন; তার সাথে সমন্বয় ক’রে নিয়েছেন চিন্তা ও গভীর ভাবনাবোধকে। রবীন্দ্রনাথ কতোগুলো চিঠি লিখেছিলেন তার সম্পূর্ণ  জীবনব্যাপী ? তার একক কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের লিখিত চিঠির সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। কারো-কারো মতে; তিনি ২৭০০ চিঠি লিখেছেন, কেউবা বলেন ৩৬০০ চিঠি। কিন্তু বর্তমান সময় পর্যন্ত জানা যায়; তার লিখিত চিঠির সংখ্যা প্রায় সাত হাজার; যার মধ্যে শুধুই বাঙলায় রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার চিঠি। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ পায় ১৯৪২-এ। এর অনেক পরে, প্রায় ৬২ বছর, শ্রীমতী সাগর মিত্রের সংকলন ও সম্পাদনায় (২৫ বৈশাখ, ১৪১১/২০০৪), রবীন্দ্রনাথের চিঠির ১৯তম খণ্ডটি প্রকাশ পায়। ১৯তম খণ্ডটিতে, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রায় একুশশো চিঠি। যা রবীন্দ্রচিঠির সামান্য অংশই। বিশ্বভারতী থেকেও অনেক বেশি সংখ্যক চিঠি প্রকাশ পেয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। তার মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ, প্রতিক্ষণ, পরিবর্তন, বর্তমান, বসুমতী, মহানগরের নাম। রবীন্দ্রচিঠির প্রকাশিত ধারার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে ‘দেশ’ পত্রিকা।তারা, তাদের নানা সংখ্যায় সযতেœ প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি। পরবর্তী সময়ে; তা থেকে দেখা দেয় চিঠির গ্রন্থ।

সম্প্রতি সময়ে, প্রকাশিত একটি রবীন্দ্রপত্রাভিধানের ভূমিকায় দাবি করা হয় হয়েছে; রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত চিঠির সংখ্যা রয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। ঐ পরিসংখ্যানে উল্লেখ্য করা হয়; বিশ্বভারতীর চিঠিপত্র সিরিজের ১৯তম খণ্ড, ভানুসিংহের পদাবলী ও ছিন্নপত্রাবলী মিলিয়ে ৭০জন প্রাপকের ২,৭৮০টি চিঠি রয়েছে; যা রবীন্দ্রলিখিত চিঠির সামান্য অংশই বলা যেতে পারে। এর থেকেও অনেক বেশি সংখ্যক চিঠি প্রকাশ পেয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। প্রায় তিরিশ বছর পূর্বে (আষাঢ় ১, ১৩৯১/ ১৬ জুন, ১৯৮৪)-এ, প্রকাশিত গৌরচন্দ্র সাহা সংকলিত রবীন্দ্রপত্রাবলী তথ্যপঞ্জী শিরোনামের গ্রন্থে চার হাজার সাতানব্বইটি চিঠির উল্লেখ রয়েছে। এটা শুধুই একটি তালিকা মাত্র; চিঠির বিষয়-বস্তু এখানে নেই। প্রকৃত পক্ষে, নিদিষ্ট ক’রে বলা সম্ভাব নয়, রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা আসলেও কতো ? রবীন্দ্রনাথ, কোনো এক চিঠিতে ক্ষিতিমোহন সেনকে লিখেছিলেন, ‘আমার লেখার চেয়ে কম হবে না আমার চিঠি।’


আশি বছরের জীবনে; বাঙলা ও ইংরেজি ভাষায়, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে সহস্র প্রাপকের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে; রবীন্দ্রনাথ ছত্রিশটি চিঠি লেখেন। চিঠির সম্ভাষণে স্ত্রীকে তিনি ‘ভাই ছোটো বউ’, ‘ভাই ছুটি’ শিরোনামেই বেশি লিখেছেন। কোনো এক চিঠিতে, স্ত্রীকে উদ্দেশ্য ক’রে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যতটুকু অসাধ্য তা ঈশ্বরের মঙ্গল ইচ্ছা স্মরণ করে অপরাজিত চিত্তে বহন করবার চেষ্টা করব। পৃথিবীতে এ ছাড়া যথার্থ সুখী হবার আর কোন উপায় নেই।’ অপর কোনো এক চিঠিতে আবার লিখলেন, ‘আমি তাই মনে স্থির করেছি তোমার বুদ্ধিতে আর চলবো না, ‘আমাদের হিন্দুশাস্ত্রেও লিখছে স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ংকারি। বোধ হয় শাস্ত্রকারদের স্ত্রীরা স্বামীদের জোর করে ঢাকাই ধুতি পরাত।’ রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র;  রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, রবীন্দ্রনাথ ১৭৩টি চিঠি লেখেন। সন্তানকে লিখিত চিঠির শিরোনাম হিশেবে ‘রথী’ নামটি তিনি বেঁছে নেন। রবীন্দ্রনাথ, পুত্রকে প্রথম চিঠিটি লেখেন ১৭ই মে, ১৯০৩ সালে। পুত্রকে যেমন তিনি স্বল্প লাইনের চিঠি লিখেছেন; তেমনটি লিখেছেন দীর্ঘ লাইনের চিঠি।চিঠির শেষে ‘বাবা’ থেকেও অনেক বেশি লিখেছেন ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’; কিংবা কোনো কোনো চিঠিতে তিনি কিছুই লিখেননি। রবীন্দ্রনাথ প্রথম এবং শেষ চিঠিটি কাকে লিখেছিলেন ? তা নিয়ে রয়েছে বিভিন্নমত। এ-সম্পর্কে স্পষ্ট ক’রে কিছু না বলা গেলেও; এতটুকু বলা যায়, তার নয় বছর তিন মাস বয়সে (৮ ভাদ্র, ১২৭৭/২৩ অগাস্ট ১৮৭০) জীবনের প্রথম চিঠিটি; বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন বলে জানা যায়। আর আশি বছর তিন মাস বয়সে রবীন্দ্রনাথ শেষ চিঠিটি লেখেন মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে (১৪ই শ্রাবণ, ১৩৪৮/৩০ জুলাই ১৯৪১) পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে। যাকে রবীন্দ্রনাথ, তার জীবনদর্শায় লিখেছিলেন একশো পনেরটি চিঠি। পুত্রবধুকে, লিখিত চিঠিতে উ’ঠে এসেছে অর্থসংকট, কৃষিকাজ, ইতিহাস-চেতনা, জমিদারি, অভিনয়য়, কবিতা, গল্প, চিত্রকলা, নাটক, সমালোচনা, পরিবার, প্রকৃতি, শিক্ষা ও শিল্পভাবনার মতো বিষয়গুলো।


রবীন্দ্রনাথ, তার পুত্রবধু প্রতিমা দেবীকে, প্রথম চিঠিটি লেখেন ৭জুলাই, ১৯১০ সালে শিলাইদা থেকে। পুত্রবধুকে তিনি কল্যানীয়াসু বা বৌমা  ব’লে সম্বোধন করেছেন; এবং চিঠির শেষে লিখতেন ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। পুত্রবধুকে লিখিত কোনো এক চিঠিতে, রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেন, ‘সংসারকেই বড় আশ্রয় বলে জেনো না এবং কঠিন দুঃখ বিপদেও ভক্তির সঙ্গে তাঁকে প্রণাম করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে শেখ, প্রতিদিনের সুখ-দুঃখে তাকে প্রণাম করার অভ্যাস রেখো, প্রত্যহই যদি তাঁর কাছে যাবার পথ সহজ করে না রাখো তাহলে প্রয়োজনের সময়ে সেখানে যেতে পারবে না।’ প্রতিমা দেবীকে তিনি যেমন ছোট চিঠি লিখেছেন; ঠিক তেমনি দীর্ঘ চিঠিও লিখেছেন। নিজের জীবনের অনেক কথাই তিনি প্রকাশ করেছেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে; যা প্রকাশ করেননি অন্য কারো কাছে। কোনো এক চিঠিতে পুত্রবধুকে বলেন, ’আমার বয়স সত্তর হয়ে এলো। আজ ত্রিশ বছর দূরে যে দুঃসাধ্য চেষ্টা করেছি আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে যেন ভীত পাকা হবে। ছবি কোনো দিন আঁকিনি, আঁকব বলে স্বপ্নেও বিশ্বাস করিনি। হঠাৎ বছর দুই তিনের মধ্যে হু-হু করে একে ফেললুম আর এখানকার ওস্তাদরা বাহবা দিলো। বিক্রিও যে হবে তাতে সন্ধেহ নেই। এর মানে কি ? জীবনগ্রন্থের সব অধ্যায় যখন শেষ হয়ে এলো তখন অভূতপূর্ব উপায়ে আমার জীবন দেবতা এর পরিশিষ্ট রচনার উপকরণ জুগিয়ে দিলেন। আমার জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ-এ সেই পরিশিষ্টেরই অঙ্গ। জীবনে যা কিছু শুরু করেছি তা সারা করে যেতে হবে। কোনোটা বাকী থাকবে না।’ ’রবীন্দ্রনাথ, তার নিজের সম্পর্কে, চমৎকার একটি উক্তি করেন প্রতিমা দেবীকে, লিখিত ঠিক পরের চিঠিতে।


এখানে তিনি প্রকাশ করেন,  ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মস্ত বড়ো প্রফেট, ফিলজফার এই বাজে কথাটা সম্পূর্ণ লোপ করা আর সম্ভাব নয়।’ রবীন্দ্রনাথের চতুর্থ সন্তান; ছোটো কন্যা মীরা দেবী (১৮৯৪-১৯৬৯), ‘অতসীলতা’ নামেও তিনি পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ  তাকে লিখেছেন একশো বিরাশিটি চিঠি। কন্যাকে লিখিত চিঠির বিষয় হিশেবে প্রাধান্য পেয়েছে পারিবারিক সুখ-দুঃখ, আনান্দ-বেদনা এবং একপ্রকার গভীর মর্মস্পর্শী বেদনা। ১৫ই মে, ১৯২০-এর দিকে কোনো এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কন্যাকে লিখেন, ‘সুখ-দুঃখ আমাদের আয়ত্তের মধ্যে নেই। কিন্তু ভাগ্যে যাই-ই ঘটুক সেইটেই অন্তরের তেজে কল্যাণে পরিণত করবার সাধনা আমাদের নিজেদের হাতে। তোরা সুখী হবি এই কামনা করি। কিন্তু এই প্রাথর্না পূর্ণ হওয়া সকলের ভাগ্যে কঠিন। আমি কেবল আশীর্বাদ করি দুঃখকে মহত্ত্বের সঙ্গে বহন এবং দুঃখকে আত্মার শক্তিতে অতিক্রম করবার সাধনা তোর প্রতি মুহূর্তে সফল হতে থাক।’ শান্তিনিকেতনের জন্য রবীন্দ্রনাথের ছিল পরম ভালোবাসা। তাই কন্যাকে লিখিত চিঠিতে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে বলেন, ‘আমেরিকায় গিয়ে চেয়ে-চিন্তে ভিক্ষে করে যেমন করে হোক শান্তিনিকেতনের জন্য কিছু টাকা সংগ্রহ করতেই হবে। সে জন্য কোমর বেঁধে চলেছি, নইলে কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না।’ কন্যাকে আশীর্বাদ করে নভেম্বর, ১৯০৯-এর কোনো এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ঈশ্বর তোর হৃদয়কে পবিত্র করুক মধুর করুক, নম্র করুক, তোর চিত্তকে মঙ্গলে পরিপূর্ণ করুক এবং তোর জীবনকে তাঁর দিকে প্রতিদিন আকর্ষণ করে নিন এই আমার একান্ত মনের কামনা।’


মীরা দেবীকে (৮ই ফাল্গুন ১৩১৭/২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯১১) চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আবারও লেখেন, ‘তোর প্রতি আমার একটি উপদেশ এই যে স্বামীকে ভক্তি করতে শিখবি, এ কথা নিশ্চয় জানিস মেয়েরা যদি পূজা করতে না পারে তাহলে কখনোই সুখী হয় না, পূজা জিনিসটা হৃদয় বৃত্তির একেবারে  চরমে। সাম্য জিনিসটা অত্যন্ত শুষ্ক, সেটা হচ্ছে কেনাবেচার সম্বন্ধ। যতখানি পেলুম ততখানি দিলুম, কিন্তু যথার্থ ভালোবাসা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি, সে বিনামূল্যে আপনাকে উৎসর্গ করতে চায়। হৃদয়বৃত্তির উৎকর্ষই হচ্ছে মেয়েদের প্রধান জিনিস এবং এই হৃদয়বৃত্তির চরমই হচ্ছে ভক্তি পূজা, আত্মনিবেদন। যে দেশে যে অবস্থায় মেয়েদের এই পূজার ভাব ঘুচে গেছে, ভক্তির ভাব শুকিয়ে গেছে সেই দেশে সেই অবস্থায় মেয়েরা তাদের রাজত্ব থেকে পথে বেরিয়েছে। ভক্তি করতে পারার দ্বারাই মেয়েরা ভক্তির যোগ্য হয়, এই জন্যেই পতিভক্তিমতী সতী স্ত্রীরাই ভক্তির যোগ্য হয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথ; কন্যাকে পারিবারিক আর্থিক অবস্থার কথা উল্লেখ করেও চিঠি লিখেছেন। যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সংসারের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ব্যাপারগুলো। নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৯-১৯৫৪), মীরা দেবীর স্বামী; কবির কনিষ্ঠ কন্যা। মীরার যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স সাড়ে তের বছর, আর নগেন্দ্রনাথের সতের বছর। কনিষ্ঠ  জামাতাকে রবীন্দ্রনাথ একশো সাতাশটি চিঠি লেখেন। নগেন্দ্রনাথ ও মীরা দেবীর দাম্পত্য জীবন কখনো সুখের ছিল না। নগেন্দ্রনাথকে; রবীন্দ্রনাথ প্রথম চিঠিটি লেখেন  শিলাইদহ থেকে, ১৩১৪-শ্রাবণে। চিঠির বিষয় হিশেবে প্রাধান্য পায় পারিবারিক ব্যাপার, ভ্রমণ, পরিবেশ, ধর্ম বিশ্বাস এবং আদেশ-অনুরোধ ইত্যাদি।


নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১১-১৯৩২), নগেন্দ্রনাথ ও মীরা দেবীর সন্তান; রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্র। মাত্র একুশ বছর বয়সে যার মৃত্যু হয়। এতে রবীন্দ্রনাথ মানসিক ভাবে অনেক ভেঙে পড়েন; এবং এরপর থেকে নিজের নামের পূর্বে শ্রী লেখা বর্জন করেন তিনি। প্রিয় দৌহিত্রকে, রবীন্দ্রনাথ আঠারোটি চিঠি লেখেন । প্রথম চিঠিটি লেখেন মে, ১৯২১ সালে। রবীন্দ্রনাথ; প্রিয় দৌহিত্রকে ‘নীতু’ নামেই চিঠিগুলো লিখেছেন। নগেন্দ্রনাথ ও মীরা দেবীর অপর সন্তান নন্দিতা দেবী (১৯১৬-১৯৬৭); স্বামী কৃষ্ণ কৃপালনী। নন্দিতার জন্ম জোড়াসাঁকোতে। রবীন্দ্রনাথ; তার এই প্রিয় দৌহিত্রীকে বিশটি চিঠি লেখেন; এবং বেশির ভাগ চিঠি লেখা হয় শান্তিনিকেতন থেকে। চিঠিতে কখনো বুড়ি, বৃদ্ধা, মেমসাহেব ইত্যাদি নামে রবীন্দ্রনাথ সম্বোধন করতেন। কৃষ্ণ কৃপালনীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় ২৫ এপ্রিল, ১৯৩৬। এই বিবাহ; অসবর্ণ বিবাহ বিধায় সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে তাদের বিবাহ রেজিস্ট্রি হয় সিউরিতে। কন্যার বিয়ের সময়; বাবা নগেন্দ্রনাথের সাথে পারিবারিকভাবে কোনো সম্পর্ক ছিল না। ক্যান্সারে আক্রান্ত হ’য়ে; একান্ন বছর বয়সে, নিঃসন্তান অবস্থায় নন্দিতা দেবী (১৯৬৭) সালে মারা যান।


রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতা, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৪২-১৯২৩), ১৯২২ সালের ১১জানুয়ারি, শান্তিনিকেতন থেকে একটি মাত্রই চিঠি লেখেন  রবীন্দ্রনাথ। চিঠির বিষয় হিশেবে উ’ঠে আসে পরিবার, বিশ্বভারতীর অবস্থা এবং বিশ্বভারতীতে আগত অতিথিদের সম্পর্কে জ্ঞাত বিষয়বস্তু। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর; ১৮৬২ সালে আইসিএস পরীক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান, এবং ১৮৬৪ সালে ফিরে আসেন। নতুন দায়িত্ব পেলেন বোম্বাই প্রদেশে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর; ১৮৬৫ সালে আহমেদাবাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদান করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন চার বছরের শিশু। পিতার একান্ত  প্রেরণায় তিনি ব্রাহ্ম হোন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর; নারীমুক্তি ও নারীস্বাধীনতার জন্য আজীবন কাজ ক’রে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, এই একটি মাত্র চিঠির শেষে ‘স্নেহের রবি’ ব’লে শেষ করেন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী; সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী; দু’কারণে পরিচিতি পেয়েছেন; ছিন্নপত্রাবলীর পরিবর্ধিত অংশের চিঠিগুলোর তিনিই প্রেরণা দাত্রী; এবং রবীন্দ্রনাথের গানের তাত্ত্বিক বিশ্লেষক হিশেবে তার নাম আসে সবার আগে। রূপে এবং গুনে অনন্যা ছিলেন ইন্দিরা দেবী। একই সাথে তিনি সঙ্গীতশিল্পী ও সু-সাহিত্যিক। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে (১৮৭৮)-এ, মা জ্ঞানদাননন্দিনী দেবীর সাথে বিলেত যান; এবং ১৮৮০ সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। এরপর ১৮৯২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথমস্থান অধিকার ক’রে পদ্মবতী স্বর্ণপদক পান। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয় সাহিত্যে ও সঙ্গীত ছিল তার আয়ত্ত্যেয়। ইন্দিরা দেবী, রবীন্দ্রনাথের অনেক প্রিয়পাত্রী ছিলেন; যার কারণে রবীন্দ্রনাথ তার প্রভাত সঙ্গীত কাব্যগ্রন্থটি তাকে উৎসর্গ করেন।


অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন ইন্দিরা দেবী; সেই সাথে সম্পদনা করেছেন পত্রিকা। সেই সময়ে, সবুজপত্র সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী (১৮৮৬-১৯৪৬)-এর সঙ্গে ইন্দিরা দেবীর বিয়ে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ইন্দিরা দেবীকে তিনশো ছত্রিশটি চিঠি লেখেন। কবির জীবনদর্শায়; তারই সম্পাদনা ও নামকরণে ছিন্নপত্র প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে (১৩১৯ বঙ্গাব্দে)। সেখানে ইন্দিরা দেবীকে লিখিত,  রবীন্দ্রনাথের একশো পঁয়তাল্লিশটি চিঠি এবং শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত আটটি চিঠি ছিল। পরবর্তী সময়ে; ‘রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ’ উপলক্ষে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের চিঠিগুলো বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘ইন্দিরা দেবীকে’ লিখিত দুইশো বায়ান্নোটি পরিপূর্ণ চিঠি নিয়ে বিশ্বভারতী প্রকাশ করে ছিন্নপত্রাবলী (১৯৬০) গ্রন্থটি। ‘ছিন্নপত্রাবলী’; দেখা দেয় পরিপূর্ণ একটি গ্রন্থরূপে। ‘ছিন্নপত্র’ নিয়ে অনেকজন; একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন; কারণ তা দেখা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্প রূপে। ডঃ নিমাইচন্দ্র পাল দেখিয়েছেন, ‘জমিদারি কাজের দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথে যখন কোলকাতা থেকে শিলাইদহ গেলেন তখনই তিনি প্রকৃত পারিবারিক গণ্ডি থেকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছলেন; একেবারে মানুষের দ্বারে এসে দাঁড়ালেন; অবারিত বিশ্ব প্রকৃতির মাঝখানে এসে পড়লেন। শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসরে এসে সঞ্চিত হলো কবির জীবনের অসামান্য উপার্জন।’


এ-সম্পর্কে ডঃ সুকুমার সেন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মধ্যেযৌবনের অনেক কবিতার ও অনেক গল্পের ধাত্রীধামের জন্মভূমির নির্দেশ এবং শেষ জীবনে আঁকা কোনো কোনো চিত্রভাবনার ইঙ্গিত এই ছিন্নপত্রাবলীর মধ্যে ছড়ানো আছে।’ ছিন্নপত্রাবলী’তে চিঠি রয়েছে দুশো বায়ান্নোটি; তার মধ্যে বেশির ভাগ চিঠি তিনি শিলাইদহ থেকে লিখেছেন। শিলাইদহ থেকে ৯৩টি, সাজাদপুর থেকে ৩১টি, পতিসর থেকে ১৯টি চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। শুরুতেই পাওয়া যাবে দার্জিলিং থেকে লেখা দুটো চিঠি। এছাড়াও  কোলকাতা থেকে ৪০টি, বোলপুর বা শান্তিনিকেতন থেকে ২২টি, কটক থেকে ১১টি, বোয়ালিয়া থেকে ৮টি, কুষ্টিয়া থেকে ৩টি চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। অল্পসংখ্যক চিঠি পাওয়া যাবে লন্ডন, তিরন, চুহালি, কর্মাঠার, গোয়ালন্দ, দিঘাপতিয়া ও তীরতল থেকে।


বিশ্বভারতীর চিঠিপত্রের পঞ্চমখণ্ডের ৮৪টি চিঠির মধ্যে ৬২টি চিঠিই লেখা হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে; ১০টি চিঠি লেখা হয় কোলকাতা থেকে। অন্যান্য চিঠিগুলো লেখা হয় বিভিন্ন স্থান থেকে। ইন্দিরা দেবীকে; রবীন্দ্রনাথ চিঠির শুরুতে ‘কল্যাণীয়াসূ’ বলে সম্বোধন করেছেন; এবং চিঠির শেষের দিকে ‘রবিকাকু’ লিখে শেষ করতেন; যেটা আমরা দেখতে পাবো ‘বিশ্বভারতীর’ রবীন্দ্রসমগ্রের পঞ্চমখণ্ডে। ইন্দিরা দেবীকে; রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র চিঠি; ঠিক তেমনি লিখেছেন দীর্ঘ চিঠিও। ইন্দিরা দেবীকে; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৩ অক্টোবর, ১৮৯০ (লন্ডন) থেকে কোনো এক চিঠিতে বলেন, ‘এ দেশে এসে আমাদের সেই হতভাগ্য বেচারা ভারতভূমিকে সত্যি সত্যি আমার মা বলে মনে হয়। এ দেশের মতো তার এত ক্ষমতা নেই, এত ঐশ্বর্য নেই, কিন্তু আমাদের ভালোবাসে। আমার আজন্ম কালের যা-কিছু ভালোবাসা, যা-কিছু সুখ, সমস্তই তার কোলের উপর আছে। এখানকার আকর্ষণ চাকচিক্য আমাকে কখনোই ভোলাতে পারবে না-আমি তার কাছে যেতে পারলে বাঁচি।


সমস্ত সভ্য সমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তাঁরই এক কোণে বসে মৌমাছির মত আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাইনে।’ ইন্দিরা দেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো যেন প্রকৃতি, প্রেম, সৌন্দর্য আর তার ব্যাপক-বিস্তৃত বর্ণনা ফুটে উঠে আমাদের চোখের সামনে। শিরোনামহীন ভাবে যদি তা বিন্যাস করা হতো; তাহলে তা পেত উৎকৃষ্ট প্রবন্ধের রূপ। ইন্দিরা দেবীকে লিখিত কোনো এক চিঠিতে প্রকৃতির বর্ণনা যেভাবে ধরা দেয় রবীন্দ্রনাথের নিকট তা অনেকটা এরকম, ‘বালিয়ার ঘাটটি বেশ দেখতে। দুই ধারে বেশ বড়ো বড়ো গাছ, সব সুদ্ধ খালটা দেখে সেই পুনার ছোটো নদীটি মনে পড়ে। আমি ভালো করে ভেবে দেখলুম এই খালটাকে যদি নদী বলে জানতুম তা হলে ঢের বেশি ভালো লাগতো। দুই তীরে বড়ো বড়ো নারকেল গাছ, আম গাছ এবং নানাজাতীয় ছায়া তরু, ঢালু  পরিষ্কার তট সুন্দর সবুজ ঘাস এবং অসংখ্য নীল পুষ্পিত লজ্জাবতী লতায় আচ্ছন্নও; কোথাও বা কেয়াবন; যেখানে গাছগুলি একটু বিরল সেইখান থেকে দেখা যায় খালের উঁচু পাড়ের নীচে একটা অপার মাঠ ধু-ধু করছে, বর্ষাকালে শস্যক্ষেত্র এমনি গাঢ় সবুজ হয়েছে যে দুটি চোখ যেন একেবারে ডুবে যায়, মাঝে-মাঝে খেজুর এবং নারকেল গাছের মণ্ডলীর মধ্যে ছোটো ছোটো গ্রাম; এবং এই সমস্ত দৃশ্য বর্ষাকালের স্নিগ্ধ মেঘাচ্ছন্ন আনত আকাশের নীচে শ্যামচ্ছায়াময় হয়ে আছে। খালটি তার দুই পরিষ্কার সবুজ সম্পতটের মাঝখান দিয়ে সুন্দর ভঙ্গিতে বেঁকে বেঁকে চলে গেছে। মৃদু-মৃদু স্রোত; যেখানে খুব সংকীর্ণ হয়ে এসেছে সেখানে জলের কিনারার কাছে কাছে কুমুদবন এবং বড়ো বড়ো ঘাস দেখা দিয়েছে; সবসুদ্ধ অনেকটা একটা ইংরাজি ংঃৎবধস-এর মতো। কিন্তু তবু মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ থেকে যায় এটা একটা কাটা খাল বৈ নয়-এর জলকলধ্বনির মধ্যে অনাদি প্রাচীনত্ব নেই, এ কোনো দূর দুর্গম জনহীন পর্বতগুহার রহস্য জানে না-কোনো একটি প্রাচীন স্ত্রীনাম ধারণ করে অতি অজ্ঞাকাল থেকে দুই তীরের গ্রামগুলিকে স্তন্য দান করে আসেনি-এ কখনো কুল কুল করে বলতে পারে না’।


ইন্দিরা দেবীকে লিখিত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন এমন দুটি গ্রন্থের নাম জানা যায়; একটি হ’লো ‘এলিমেণ্টস অফ পলিটিক্স’ এবং অপরটি ‘প্রবলেমস অফ দি ফিউচার’। সংসার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল বেশ স্পষ্ট; তাই তো তিনি আবার বলেন, ‘জগৎ সংসারে অনেকগুলো প্যারাডক্স আছে, তার মধ্যে এও একটি যে, যেখানে বৃহৎ দৃশ্য, অসীম আকাশ, নিবিড় মেঘ, গভীর ভাব, অর্থাৎ যেখানে অনন্তের আবির্ভাব সেখানে তার উপযুক্ত সঙ্গী একজন মানুষ, অনেকগুলো মানুষ ভারী ক্ষুদ্র এবং খিজিবিজি।’ প্রকৃতির এমন বর্ণনা ইন্দিরা দেবীকে লিখিত চিঠির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলেছেন যা অন্যত্র বিরল। রবীন্দ্রনাথের নিকট বার-বার যেন প্রকৃতি ফিরে আসে তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে; যা তিনি দেখতে পান সর্বত্র। পূর্বেই বলেছি; ইন্দিরা দেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের চিঠিগুলো প্রকৃতি আর সৌন্দর্য নিয়েই এগিয়েছে অনেক বেশি। ইন্দিরা দেবীকে লিখিত কোনো এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজ সকাল বেলায় অল্প অল্প রৌদ্রের আভাস দিচ্ছে। কাল বিকেল থেকে বৃষ্টি ধরে গেছে, কিন্তু আকাশের ধারে ধারে স্তরে স্তরে এত মেঘ জমে আছে যে বড় আশা নেই-ঠিক যেন মেঘের কালো কার্পেটটা সমস্ত আকাশ থেকে গুটিয়ে নিয়ে এক প্রান্তে পাকিয়ে জড়ো করেছে। এখনি একটা ব্যস্ত বাগীশ বাতাস এসে আবার সমস্ত আকাশময়  বিছিয়ে দিয়ে যাবে, তখন নীলাকাশ এবং সোনালী রৌদ্রের কোনো চিহ্ন মাত্র দেখা যাবে না। এ বারে এত জলও আকাশে ছিল ! আমাদের চরের মধ্যে নদীর জল প্রবেশ করেছে। চাষারা নৌকা বোঝাই করে কাঁচা ধান কেটে নিয়ে আসছে, আমার বোটের পাশ দিয়ে তাদের নৌকা যাচ্ছে আর ক্রমাগত হাহাকার শুনতে পাচ্ছি।’ ইন্দিরা দেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের এক-একটি চিঠি যেন প্রকৃতির এক বৈচিত্র্যময় বর্ণনা; যা প্রকাশ পেয়েছে চিঠির ভাজে ভাজে। রবীন্দ্রনাথ; তার ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটা সাজাদপুরে কোনো এক দুপুরে লিখেছিলেন তা প্রকাশ করেন ইন্দিরা দেবীকে। রবীন্দ্রনাথে এখানে এসে বলেন, ‘আমার এই সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুরবেলা-মনে আছে ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলাম।