ধর্মকে রক্ষা এবং তার প্রচার কার্য কতটা স্থিতিবোধগম্য হ’লে তা প্রচার স্বীকার্য হ’বে তা আলোচ্য হ’য়ে উঠে। চেতনাও মানস লোকের স্থির ধর্ম, এখন আর নির্দিষ্ট কোন স্থানে আর স্থির নেই, ধর্ম হ’য়ে উঠে প্রচারযোগ্য। ধর্ম চেতনালোকের একক কোন স্থান থেকে, তাঁর বিচরণ ঘটে বহুরূপে। যেখানে তা প্রকাশ বা প্রচারযোগ্য হয়ে ওঠে। নিজস্ব চেতনায় ধারণ করেই স্থির হয়ে থাকেননি রবীন্দ্রনাথ বরং তাঁর উপলব্ধি এবং প্রচার অনস্বীকার্য নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন দিবস-রজনী।


তাই রবীন্দ্রনাথ আবার বলেন: ‘ধর্মকে যাহারা সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়া প্রচার করিতে চেষ্টা করে, তাহারা ক্রমশই ধর্মকে জীবন হইতে দূরে ঠেলিয়া দিতে থাকে। ইহারা ধর্মকে বিশেষ গন্ডি আঁকিয়া একটা বিশেষ সীমানার মধ্যে বন্ধ করে। ধর্ম বিশেষ দিনের বিশেষ স্থানের বিশেষ প্রণালীর ধর্ম হইয়া উঠে। তাহার কোথাও কিছু ব্যতায় হইলেই সম্পদ্রায়ের মধ্যে হুলস্থুল পড়িয়া যায়।’


সত্য, সুন্দর, প্রেম, সৃষ্টি, কামনা-এবং সর্বোপরি অপারসৗন্দর্য আরো কমল এবং মসৃন হ’য়ে উঠে যার স্পর্শে, তিনি রবীন্দ্রনাথ। নিজের জীবনকে চালিত করেছেন সত্য সুন্দর- সুন্দরই সত্য। এবং এরই ক্ষণিক প’রে সেই সত্যকে আরো প্রচন্ডরূপে রূপান্তর ঘটান ধর্মের মাধ্যমে। যে ধর্মে বাক্যের পর বাক্যেয় ফিরে আসে সত্য, সত্য, সত্য, । এ ‘সত্য’ একক কোন সত্য নয়। এটা চেতনার বিচ্ছুরণ, যে বিচ্ছুরণ থেকে উজ্জ্বল আলো ঝ’রে পড়ে চেতনা থেকে চেতনায়। যে চেতনার জ্যোর্তিময় সৌন্দর্যে নিজেই স্থির থাকেননি, বরং তাঁর বহুমুখী প্রকাশ ঘটিয়েছেন বহিঃ ভাবনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ মনও মননে যে ধর্মকে তিনি পোষণ করেছেন, তাঁতে আবার যদি বলা হয় ধর্ম কী? যা আপনি লালন বা ধ্যান করেছেন জীবনময়।


রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ধর্ম’ হল: ‘সংসারে একমাত্র যাহা সমস্ত বৈষম্যের মধ্যে ঐক্য, সমস্ত বিরোধের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে, সমস্ত বিচ্ছেদের মধ্যে একমাত্র যাহা মিলনের সেতু, তাহাকেই ধর্ম বলা যায়। তাহা মনুষ্যত্বের এক অংশে অবস্থিত হইয়া অপর অংশের সহিত অহরহ কলহ করে না। সমস্ত মনুষ্যত্ব তাহার অন্তর্ভুক্ত তাহাই যথার্থভাবে মনুষ্যত্বের ছোটো বড়ো, অন্তর বাহির সর্বাংশে পূর্ণ সামঞ্জস্য। সেই সুবৃহৎ’ সামঞ্জস্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে মনুষ্যত্ব সত্য হইতে স্খলিত হয়, সৌন্দর্য হইতে ভ্রষ্ট হইয়া পড়ে। সেই অমোঘ ধর্মের আদর্শকে গির্জার গণ্ডির মধ্যে নির্বাসিত করিয়া দিয়া অন্য যে কোনো উপস্থিত প্রয়োজনের আদর্শ দ্বারা সংসারের ব্যবহার চালাইতে যাই। তাহাতে সর্বনাশী অমঙ্গলের সৃষ্টি হইতে থাকে।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জীবনের ধর্ম-কে নিয়ে আসেন গভীর করে। যে ‘ধর্ম’ শুধু রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্ম’ হয়ে-ই থাকেনি, বরং তা- হয়ে ওঠে সমগ্র ভারতবর্ষের ধর্ম হয়ে। যা পোষণ করে একটি সমগ্র জাতিসত্তা। শুধু নিজস্ব ভু-মন্ডল বা তাঁর সীমা নয়- বরং গভীর হ’য়ে ওঠে ওই জাতিসত্তার মানসলোকে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজস্ব ‘ধর্ম’-সম্পর্কে বলেন: ‘আমাদের ধর্ম রিলিজন নহে, তাহা মনুষ্যত্বের একাংশ নহে-তাহা পলিটিকস্ হইতে তিরস্কৃত, যুদ্ধ হইতে বহিস্কৃত ব্যবসা হইতে নির্বাসিত, প্রাত্যহিক ব্যবহার হইতে দূরবর্তী নহে। সমাজের কোনো বিশেষ অংশে তাহাকে প্রাচীর বন্ধ করিয়া মানুষের আরাম আমোদ হইতে, কাব্য-কলা হইতে, জ্ঞান- বিজ্ঞান হইতে তাহার সীমানা রক্ষার জন্য সর্বদা পাহারা  দাঁড়াইয়া নাই। ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বান প্রস্থ প্রভৃতি আশ্রমগুলি এই ধর্মকেই জীবনের মধ্যে, সংসারে মধ্যে সর্বতোভাবে সার্থক করিবার সোপান। ধর্ম সংসারের আংশিক প্রয়োজন সাধনার জন্য নহে, সমগ্র সংসারই ধর্ম সাধনের জন্য এই রূপে ধর্ম গৃহের মধ্যে গৃহধর্ম রাজত্বে মধ্যে রাজধর্ম হইয়া ভারতবর্ষের সমগ্র সমাজকে একটি অখন্ড তাৎপর্য দান করিয়াছিল। সেই জন্য ভারতবর্ষ, যাহা অধম, তাহাই অনুপযোগী ছিল-ধর্মের দ্বারাই সফলতা বিচার করা হইত। অন্য সফলতা দ্বারা ধর্মের বিচার চলিত না।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ’য়ে উঠেন ধর্মের অগ্রপথিক। যে পথে শুধু নিজেকে নয়, মানবচেতনার প্রতিটি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দিকটিও তু’লে আনেন নিজের দিকেই। ভাবও ভাবনাকে একত্রে সংমিশ্রণ ঘটান সংসার নামক জায়গাটিতে। ব্যক্তি এবং তাঁর প্রাত্যহিক কর্মগুলোকে স্থান করে দেন ধর্মীয়ভাবাপন্নতায়। ধর্মীয় ভাবনা এবং তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ উপাসনা নামক ক্রিয়াগুলো ও হ’য়ে উঠে প্রাত্যহিক কর্মে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো বলেন: ‘এই জন্য মানব সংসারের মধ্যেই প্রতিদিনের ছোটো বড়ো সমস্ত কর্মের মধ্যেই ব্রহ্মের উপাসনা মানুষের পক্ষে একমাত্র সত্য উপাসনা। অন্য উপাসনা আংশিক, কেবল জ্ঞানের উপাসনা, কেবল ভাবের, উপাসনা-সেই উপাসনা দ্বারা আমরা ক্ষণে ক্ষণে ব্রহ্মকে স্পর্শ করিতে পারি, কিন্তু ব্রহ্মকে লাভ করিতে পারি না।’
সত্য, অ-সত্য, প্রার্থনা, উপাসনা, ইত্যাদি দিকগুলো থেকে বিচ্যুতি হননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাব-ভবনাও ভাবাবেগের চেয়েও বেশি কাতরতা বোধ করেছেন ধর্মীয়নুভূতি দিকগুলোর প্রতি। যে সকল অনুভূতি চরম ও সত্যরূপে প্রবেশ করেছে রবীন্দ্রচেতনায়। রবীন্দ্রনাথ ‘সত্য’ এবং তাঁর প্রতি আকূল আবেদন ছিল রবীন্দ্র জীবন দর্শায়। সত্য কখনো প্রকাশ পেয়েছে সুন্দর হয়ে; আবার একই ভাবনায় ‘সুন্দর’ ও হ’য়ে উঠেছে ‘সত্য’ রূপে। যে ‘সত্য’ ও ‘সুন্দরের’ পূজারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ জীবনব্যাপি। সত্য ও সুন্দর-কে আহ্বান কখনোও কখনোও, রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে উঠেছে একজন বিশ্বাসী ধর্মপরায়ণরূপে। যিনি সমগ্র জীবন ধ’রে শুধুই বলেছেন- সত্য-সত্য-সত্য, সুন্দর-সুন্দর-সুন্দর। যে সত্য ও সুন্দর যেন রবীন্দ্রনাথের এক দীর্ঘ প্রতিবিম্ব হ’য়ে রয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন : ‘আমাকে অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও, প্রতিনিমেষের খণ্ডতা হইতে তোমার অনন্ত পরিপূর্ণতার মধ্যে আমাকে উপনীত করো; অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও-অহংকারের যে অন্তরাল, বিশ্বজগৎ আমার সম্মুখে যে স্বাতন্ত্র লইয়া দাঁড়ায়, আমাকে এবং জগৎকে তোমার ভিতর দিয়া না দেখিবার যে অন্ধকার তাহা হইতে আমাকে মুক্ত করো, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও-আমার প্রবৃত্তি আমাকে মৃত্যু দোলায় চড়াইয়া দোল দিতেছে, মুহূর্তকাল অবসর দিতেছে না, আমার মধ্যে আমার ইচ্ছাগুলোকে খর্ব করিয়া আমার মধ্যে তোমার আনন্দকে প্রকাশমান করো, সেই আনন্দই অমৃতলোক।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম’-গ্রন্থের বেশির ভাগ অংশগুলো রচনা করেন, যখন তাঁর বয়স চল্লিশ থেকে সাতচল্লিশ এর মধ্যেবর্তী সময়ে। এই গ্রন্থে তিনি তুলে আনেন বিভিন্ন সমাজ, রাষ্ট্র সভ্যতা, এর দিকগুলোর চেয়েও মানুষের ধমানুভূতির দিকগুলো। তাই রচনা করেন “মনুষত্ব”, “ধর্মের সরল আদর্শ,” “প্রার্থনা,” “ধর্মপ্রচার,” এবং “দুঃখ” নামক বিভিন্ন লেখাগুলো। যে রচনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের মানবীয় দিকগুলো। প্রকাশ পায় রবীন্দ্র ব্যাকুল চিত্তের উৎফুল্ল বহিঃ প্রকাশ। বিশ্বাস এবং তাঁর গভীর অস্তিত্বের প্রকাশ পায় ‘ধর্ম’-নামক গ্রন্থে। যে গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ হ’য়ে উঠেন একজন বিশ্বাসী, প্রার্থনাকারী, অনুনয়কারী, ধর্মে নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি হিশেবে। কি ভাবনা ছিল নিজের মাঝে? এবং বিশেষ ক’রে ধর্মের দিকগুলোর প্রতি, যার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ পায় এ গ্রন্থে।


ঈশ্বরের শক্তি বা তাঁর বিকাশকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেন, এবং বলেন:
‘ঈশ্বরের শক্তি বিকাশকে আমরা প্রভাতের জ্যোতিরুন্মেষের মধ্যে দেখিয়াছি, ফাল্গুনের পুষ্প পর্যাপ্তির মধ্যে দেখিয়াছি মহা সমুদ্রের নীলাম্বুনৃত্যের মধ্যে দেখিয়াচি। কিন্তু সমগ্র মানবের মধ্যে যেদিন তাহার বিরাট বিকাশ দেখিতে সমাগত হই, সেইদিন আমাদের মহামহোৎসব। মনুষ্যত্বের মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা যে শত শত অভ্রভেদী শিখর মালায় জাগ্রত-বিরাজিত সেখানে সেই উড়–ঙ্গ শৈলাশ্রমে আমরা মানবমাহাত্মের ঈশ্বরকে মানব সংঘের মধ্যে বসিয়া পূজা করিতে আসিয়াছি।’


ঈশ্বর এবং ঈশ্বর ভাবনা ও তাঁর প্রতি আকুলতা রবীন্দ্রনাথকে ক’রে তোলে একজন বিশ্বাসী এবং ধর্মপরায়ন ব্যক্তিরূপে। যে প্রার্থনা বা আকুলতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসবোধের স্থানটি। তিনি আহ্বান করেন :
“হে ঈশ্বর, তুমি আজ আমাদিগকে আহ্বান করো। বৃহৎ মনুষ্যত্বের মধ্যে আহ্বান করো। আজ উৎসবের দিন শুধুমাত্র্ ভাব ও রস সম্ভোগের দিন নহে। শুধুমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে-আজ বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শক্তি উপলব্ধির দিন, শক্তি সংগ্রহের দিন। আজ তুমি আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন জীবনের প্রাত্যহিক জড়ত্ব প্রাত্যহিক ঔদাসীন্য হইতে উদবোধিত করো, প্রতিদিনের নিবীর্য নিশ্চেষ্টতা হইতে আরাম আবেশ হইতে উদ্ধার করো। যে কঠোরতায় যে উদ্যমে যে আত্মবিসর্জনে আমাদের সার্থকতা, তাহার মধ্যে আমাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করো। আমরা এতগুলি মানুষ একত্র হইয়াছি। আজ যদি যুগে যুগে তোমার মনুষ্য সমাজের মধ্যে যে সত্যের গৌরব যে প্রেমের গৌরব যে মঙ্গলের গৌরব যে কঠিন বীর্য নির্ভীক মহত্ত্বের গৌরব উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা না দেখিতে পাই, দেখি কেবল ক্ষুদ্রদীপের আলোক, তুচ্ছ ধনের আড়ম্বর, তবে সমস্তই ব্যর্থ হইয়া গেল-যুগে যুগে মহাপুরুষের কণ্ঠ হইতে যে সকল অভয়বাণী অমৃতবাণী উৎসারিত হইয়াছে, তাহা যদি মহাকালের মঙ্গলশঙ্খ নির্ঘোষের মতো আজ না শুনিতে পাই-শুনি কেবল লৌকিকতার কলকলা এবং সাম্প্রদায়িকতার বাগ্ বিন্যাস-তবে সমস্তই ব্যর্থ হইয়া গেল।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সত্য, সুন্দর, ঈশ্বর, প্রার্থনা, পবিত্র, অপবিত্র ইত্যাদির মধ্যেই স্থির হননি, বরং কবিতা এবং তাতে নিজের ধর্মবোধের দিকটি তুলে এনেছেন সুষ্প®ষ্টভাবে। ধর্ম, প্রেম এবং তাঁর সৌন্দর্যবোধে তিনি-ই অবতীর্ণ হয়েছেন, হ’য়ে উঠেছেন একজন চরম সত্য ও সুন্দরের সাধক পুজারীরূপে। ‘চৈতালি’ (১৫ আশ্বিন ১৩০৩: ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬) গ্রন্থে ‘মানসী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে আসেন বিধাতার দ্বারা নারী সৃষ্টির ক্রিয়াটি।


‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে-সৌন্দর্য সঞ্চারি’


যে নারী আবার কখনও হ’য়ে উঠেন সৌন্দর্যের চরম বহি: প্রকাশ রূপে। একই কাব্যগ্রন্থের ঠিক পরের কবিতাটি ‘নারী’। যেখানে তিনি নারী বা তার সৌন্দর্যকে নিয়ে আসেন প্রতিমা সমপর্যায়ে। যে প্রতিমা তার নিজের ধর্মবোধের বা বিশ্বাসের একটি উপাদান বা নিয়ামক হিসেবে গণ্য হয়। তাই বলেন:
‘তুমি এ মনের সৃষ্টি, তাই মনোমাঝে
এমন সহজে তব প্রতিমা বিরাজে।’


রবীন্দ্রনাথ ভাবনা ও বোধের সাথে একত্রে নিয়ে আসেন নিজের চেতনার দিকটিও। একই সাথে একজন প্রার্থনাকারী হিসেবে উপস্থিত হন। ‘প্রার্থনা’-কবিতায় (চৈতালি: ১৪ শ্রাবণ ১৩০৩), যেখানে মনে হয়, সমস্তু কিছু শেষ হওয়ার পরও যেন চাওয়ার বাকী রয়েছে, অন্য কোন ভাবনাও ভাবাবেগময় একই সাথে প্রকাশ করেন:


‘প্রাণে দিবস রজনী উঠিতেছে ধ্বননী
তোমারি বীণার গুঞ্জনা।’


যে ধ্বনি গুঞ্জনা সম-সাময়িক কোন ব্যাপার নয়, বরং তা মননের সাথে সংম্রিশন রয়েছে তাঁর, যা রবীন্দ্রনাথের অভ্যন্তরীণ ভাবনা বোধের স্থানটি, যেখানে তিনি একাকী এবং একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি রূপে জাগ্রত হন।
‘পূরবী’ (শ্রাবণ ১৩৩২ : ১৯২৫) গ্রন্থে ‘চাবি’- কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে ওঠেন বিধাতার মনও মননের প্রতীক রূপে। যেখানে নিজের সৃষ্টিকে প্রকাশ না করলেও ‘মনকে’ সৃষ্টির ব্যাপারটি নিয়ে আসেন সুষ্পষ্ট ভাবে। তাই-ওই বোধ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটান এভাবে ঃ
‘বিধাতা যেদিন মোর মন
করিলা সৃজন
বহু কক্ষে-ভাগ করা হর্স্যরে মতন,
শুধু তার বাহিরের ঘরে
প্রস্তুত রহিল সজ্জা নানামত অতিথির তরে,
নীরব নির্জন অন্তঃপুরে
তালা তার বন্ধ করি চাবিখানি ফেলি দিলা দূরে।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরবী’ (১৯২৪) কাব্যগ্রন্থে রচনা করেছেন ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামক একটি কবিতা। যে কবিতা শুধু কবিতা নয় বরং রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ভাব-দর্শনের একটি জ্যোতির্ময় অবস্থান। ঈশ্বর, ভাবনা, প্রার্থনা সত্য, প্রতিমা, বিধাতা ইত্যাদি দিকগুলো তু’লে আনার পর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবার কবিতায় অবস্থান করান সৃষ্টিকর্তা’কে, যে সৃষ্টিকর্তা, রবীন্দ্রনাথের মনোভাবনা এবং মানসলোকের বিশ্বাসের এক আশ্চর্য সৃষ্টি।
‘সৃষ্টিকর্তা’ (পূরবী: ২৫ ডিসেম্বর ঃ ১৯২৪)-এ বলেন:


‘জানি আমি মোর কাব্য ভালোবেসেছেন মোর বিধি,
ফিরে যে পেলেন তিনি দ্বিগুণ আপন-দেওয়া নিধি।
তাঁর বসন্তের ফুল বাতাসে কেমন বলে বাণী
সে যে তিনি মোর গানে বারংবার নিয়েছেন জানি।
আমি শুনায়েছি তাঁরে শ্রাবণরাত্রির বৃষ্টিধারা
কী অনাদি বিচ্ছেদের জাগায় বেদন সঙ্গীহারা।
যেদিন পূর্ণিমা রাতে পুষ্পিত শালের বনে বনে
শরীরী ছায়ার মতো একা ফিরি আপনার মনে
গুঞ্জরিয়া অসমাপ্ত সুর, শালের মঞ্জুরী যত
কী যেন শুনিতে চাহে ব্যগ্রতায় কবি শিয় নত,
ছায়াতে তিনিও সাথে ফেরেন নিঃশব্দ পদচারে
বাঁশির উত্তর তাঁর আমার বাঁশিতে শুনিবারে।
যেদিন প্রিয়ার কালো চক্ষুর সজল করুণায়
রাত্রির প্রহর মাঝে অন্ধকারে নিবিড় ঘনায়
নিঃশব্দ বেদনা, তার দুটি হাতে মোর হাত রাখি
স্তিমিত প্রদীপালোকে মুখে তার শুদ্ধ চেয়ে থাকি,
তখন আধারে বসি আকাশের তারকার মাঝে
অপেক্ষা করেন তিনি, শুনিতে কখন বীণা বাজে
সে সুরে আপনি তিনি উম্মাদিনী অভিসারিনীরে-
ডাকিতেছেন সর্বহারা মিলনের প্রলয় তিমিরে।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তত পক্ষে এতোটুকু সান্ত্বনা পেয়েছেন এখানে এসে ‘সৃষ্টিকর্তা’ বা ঈশ্বর’ যা-ই বলি না কেন সাদরে গ্রহণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিময় কাব্যকে। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা, শ্রাবণরাত্রিময় কোন সময়-ই তিনি বাদ দেননি, যে সময় বা মুহূর্তগুলোতে তিনি স্মরণ করেননি সৃষ্টিকর্তাকে। যে সৃষ্টিকর্তা হ’য়ে উঠে তাঁর কবিতার উজ্জ্বল ভাবময় স্মৃতি।