বৎসরান্তের ডুবন্ত সূর্যটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছি,
ভাবছি আর দেখছি;
দেখছি বকের সোনালি ডানা-তোমার ভুরুর মতো সরু চাঁদ, থর মরুভুমিতে ঝরে পড়া সোনার ঝুরো। আমি চিৎকার করি-অংশুমান!তুমি দাঁড়াও,কিংবা তুমি ধীরে যাও। আমার কাঁধে এখনো আছে ধর্ষিতা নাবালিকার নিথর দেহ।আমার এককানে ভাসে নকুলমণ্ডলের কান্না-"মেয়েটাকে ইভাবে মারল ক্যানে?"আরেক কানে ভাসে-“বন্ধুগণ!আমরা এগিয়ে চলেছি’। চোখে আজ-ও ভাসছে-উচ্চমাধ্যামিক ফলপ্রকাশের রাত্রে ফ্যানের ব্লেড ধরে সৌম্যের ঝুলন্তদেহ।পাশে সুইসাইডনোট-“মা!-তোমাদের আশাপূরণ করতে পারলাম না-চলে গেলাম-তোমাদের নিষ্ফল সৌম্য”।

সারা বিশ্বের আজ বড়-ই অসুখ,
এ পোড়া দেশের আনাচেকানাচে হঠাৎ-ই অচেনা ভাইরাসের মারণ হানা -
আমি দিকভ্রান্ত, দিশেহারা।
মানুষের মৃত্যুর মহামিছিল দেখেছে আমার অসহায় চোখ।  শবের মাদুরে দাঁড়িয়ে আমি মূহ‍্যমান‌। গৃহবন্দী জীবনটা খুঁজেছে নতুন জগৎ....শিখেছে সংযম, নিয়মানুবর্তিতার সহজপাঠ আবার নতুন করে.....

আমি দেখেছিলাম-
দেখেছিলাম  হাঁঁটছে মানুষ
শত শত শ্রমিক চলেছে পদব্রজে
মাইল মাইল  
ঘরে ফেরার তাগাদায়..
পরিযায়ীর সার্টিফিকেট ধরালো অন্ধ সমাজ.... সব খুয়েই বাড়ি ফেরা..কোরেনটাইন, লকডাউন-মাস্ক- স‍্যানিটাইজার-এমন হরেক নতুন শব্দের সঙ্গে হল পরিচয় ,হল  সহবাস

তার-ই মাঝে উঠল ঝড়
ভয়াবহ তুফান... আম্ফানের তাণ্ডবনৃত‍্যে জনজীবন হল লণ্ডভণ্ড, ছিন্নবিছিন্ন হল শত শত জীবনের স্বপ্নের তানপুরা....
অসহায় দেশ,জীবকুল প্রকৃতির লীলাখেলায় যে নিরুপায় দর্শক!
ক্ষয়ক্ষতির পাহাড়ে সর্বহারা মানুষের হাহাকার, দীনের আর্তনাদ অনুরণিত হল রুদ্ধ বিবেকের আদালতে....
মাইল মাইল নয়নাশ্রুতে প্লাবিত বেদনামন্দ্রিত মাতলা নদী.... সহানুভূতিশীল সচেতন সমাজ যদিও চেষ্টা করেছিল-
আপ্রাণ  চেষ্টা করেছিল পারস্পরিক সাহায‍্যের বাঁধ দিতে.....ছন্দে এখনো ফেরিনি জনজীবন

অধিকারের লড়াই-
ভারত-চীনের সংঘাত
সীমান্তে হারালো শত শত তাজা প্রাণ....খবর কে রাখে? একদিন দুদিন হৈহৈ তারপর? নামগুলোও যেন আজ অস্পষ্ট স্মৃতির ধূসর ক‍্যানভাসে....

হায়রে
একি হল?
কোজিকোডে হঠাৎই ভেঙে পড়ল স্বপ্নের উড়োজাহাজটা
উদ্ভ্রান্ত মন হতভম্ব হল
  বিশাখাপত্তনমে গ‍্যাস লিকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়
কলম তরবারির মতো গর্জে উঠল অসহায় গর্ভবতী হস্তিনী মায়ের নির্মম হত‍্যাকাণ্ডে....
  শত শত এমন দুর্ঘটনার দুঃস্বপ্নে ভাঙলো আমার বিবেকের নিদ্রা।
জীবনটা আজ যেন আতঙ্কের মরণকূপ,
সন্ত্রস্ত মনের হানাবাড়িতে শঙ্কা-শকুনের সে কি বেপরোয়া বিজয়োল্লাস!
বিশের বিষত্রাসে আমার  নাভিশ্বাস,
মনুষ্যত্বের ক্লাসরুমে আমি করি উঠবস...।
দমবন্ধ হওয়া জীবনের জলসাঘরে তার-ই মধ্যে গৌরবের অমৃতসুধা পান......
আমার বুক ফুলল অভিজিৎ- রাজকমল, বজরং -আসরফ-দিনদয়াল-রোহিত-দীপিকা-হেমন্তের সাফল্য পুরস্কারে।

বুকফাটলো আবারো
দেশের কৃষকদের করুণাবস্থানে,
শেষ সম্বলটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার প্রাণপণ লড়াই।

প্রণব-সুশান্ত-ইরফান-পিকে-চুনী-সরোজ-সৌমিত্র -ঋষির মতো ঘনঘন অসংখ্য নক্ষত্রপতনে আজ আমার দেশ কাটায় নক্ষত্রহীন রাত।

আমেরিকা-বিহার-রাজ‍্য রাজনীতি তোলপাড়.. চায়ের কাপে ছুটছে রুদ্ধশ্বাস তুফান...মিথ‍্যা প্রতিশ্রুতির ফুল গেঁথে গেঁথে আমি স্বপ্নমাল‍্য গাঁথি
আশার রামধনুতে হতাশার রঙ পরিশেষে চলকায়।

আজ বৎসরান্তে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঝুলি কাঁধে-আমি গর্জায়োমান এ-কে-ছাপান্ন রাইফেল হাতে দণ্ডায়মান।অন্যহাতে আমার ভালোবাসার পাতামোড়া অলিভগাছের ডাল।আমার একপাঁজরে আজও বাজে ‘কোরানের  সামগান’,অন্যপাঁজরে অনুরণিত হয় গীতার মন্ত্রপূত বাণী।আমি বছরের গোধূলিবেলায় স্বপ্নমেলায় দেখছি-যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে,কাল সে সুন্দর-সুস্থ বাসযোগ্য পৃথিবীতে-মান,হুঁশ সমন্বিত মানুষ হয়ে উঠছে।আমি স্বপ্নে দেখছি-সীমান্তে দাঁড়িয়ে দুপারের সৈন্যদের একান্ত আলিঙ্গন,হাজার নিরুপমাদের পুনরুত্থান।যুদ্ধোন্মত্ত পৃথিবীটা প্রেমোন্মত্ত।হাজারো স্বপ্ন-ভিড়েও বাস্তবতার সেলফিতে দেখি-চীনের প্রাচীর ভাঙছে,হিমালয় ক্ষয়েক্ষয়ে যাচ্ছে,অতলান্তিক থেকে ভারতমহাসাগর মজে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।আমি চিৎকার করে উঠি- অংশুমান!-তুমি দাঁড়াও-কিংবা তুমি ধীরে যাও-চেয়ে দেখো ওই চেয়ে দেখো
রাস্তার ধারের ওই উলঙ্গ শিশুটা আজ-ও তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী..
তোমার উত্তাপ মেখে আমি হতে চাই এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড,
এখনো কতকিছু করা বাকি, কত পাওয়া নাপাওয়ার হিসাব মেলানো বাকি, তুমি দাঁড়াও একটিবার.....
হঠাৎ চমকে উঠি-
উদ্ভাসিত হচ্ছে নবারুণ  পুনরায় বৎসরান্তের অস্তরাগে....
নববর্ষের হাজারো নবাশার নবালোকবর্তিকা নিয়ে তুমি যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলছো-“এসো নতুন প্রাণের সঞ্চার করো।সন্ধ্যে নামতে এখনো দেরী”।