সাহিত্যের সর্বাধিক প্রাচীন ও  দুরধিগম্য  ক্ষেত্র কবিতা৷  কবি-হৃদয়ের আবেগ ও বোধ উদ্ভূত ভাববিক্ষেপের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুরণনে  সৃজিত নির্মাল্যই কবিতা । কবিতা অনুভবের সম্মোহনে সুতীব্র অন্তরানুভূতির আহ্বানে  সৃষ্ট তাই মানবিক আবেগ অনুভূতির আলেখ্যের এক জটিল ও যৌগিক সংমিশ্রণ কাব্যজগতকে আরও দুরূহ করে তোলে।  নৈঃশব্দের অতলান্তিকে নিমজ্জিত কবি হৃদয়ের উদ্ভূত ভাবকে ছাপার অক্ষরে ধারণ দুঃসাহসিক এক প্রয়াস। ভাবনার ভাববস্তু চেতনাসাধ্য,  ছাপার অক্ষরে তার প্রতীকায়ন সাধ্যাতিত। সৌভাগ্যের বিষয়,  সমালোচকদের  সুবিধার্থে কবি তার কবিতার দেহাভ্যন্তরে উপমা,  উৎপ্রেক্ষা,  রূপকাদির সাহায্যে এমন কিছু নিদর্শন অব্যক্তরূপে প্রচ্ছন্ন করে রাখেন যা থেকে কবির মনোজাগতিক প্রতিমূর্তির হৃদয়জ অনুভবের একটি আপাত স্পষ্ট ধারণা পাঠক মনে প্রতীয়মান হয়।


বাহ্যজগতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিঘাতে ব্যক্তিমন হয়ে ওঠে  সংক্ষুব্ধ,  হৃদয়ে আবির্ভূত হয় বিশেষ অনুকল্প,  সৃষ্টি হয় সাহিত্য ; সুনির্দিষ্ট অর্থে কবিতা।  কবিতায় বস্তুজগতের সমান্তরালে বিশেষ সংবেদন নিয়ে আবির্ভূত হয় ইন্দ্রিয়জগৎ,  উত্তরাধুনিক কবিদের কবিতায় এই ইন্দ্রিয়জগত পরম আস্বাদ্য৷  নাগরিক জীবনের  বস্তুগত ও ইন্দ্রিয়গত প্রত্যক্ষণ  কবি মানসে বিচিত্র রূপে চিত্রিত হয়,  কবিসত্তায় অনুভূত হয় অন্তর্গত বেদনা৷ তাই উত্তরাধুনিক যুগের কবিগণের ভাবাকাশ জুরে এক চরম অপ্রাপ্তি ও অনাস্থার মেঘ ঘনীভূত হয়ে ওঠে,  কবির গভীর অনাস্থা আত্মানুসন্ধানের আওতায় স্বীয় সত্ত্বাকেও সন্দিগ্ধ করে তোলে,  কবির নিজের উপর নিজেরই অবিশ্বাস পুঞ্জীভূত হয়। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রচারবিমুখ, উপেক্ষিত কবি নূরুল হকের(১৯৪৪—২০২১)  কবিতায় দ্যোতিত জীবন দর্শন।


কবি মানসের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গিত ভাব সমুদ্রে বিচরণের পূর্বশর্ত তার যুগ মানস সম্পর্কিত সম্যক ধারণা। কবি নূরুল হক ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নির্জনপ্রিয়, সাহিত্যানুরাগী৷ আমৃত্যু সাহিত্যের প্রতি ছিল তার সুতীব্র ঝোঁক,  ফলশ্রুতিতেই  কাব্যব্রতে সমিধস্বরূপ তার কাব্যগ্রন্থ সমুহ উত্তরাধুনিক কাব্য প্রবাহের  হোমকে করেছে প্রজ্বলিত ও পরিস্ফুট। তিনি একাধারে ছিলেন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ,  পাকিস্তান(পূর্ববঙ্গ) এবং বাংলাদেশের নাগরিক।  ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব তার মানসপটে সুদূর প্রভাব ফেলে নি যেহেতু তৎকালে নূরুল হকের বয়স অনূর্ধ্ব পাঁচ, কিন্তু পাকিস্তান শাসনামলে বিশেষত ষাট থেকে সত্তর এর দশকে পরিণত নূরুল হক সমকালীন রাজনৈতিক,  আর্থসামাজিক ঘটনাবাহুল পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন ।


মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে একজন বীরোচিত ব্যক্তিত্ব স্বাদেশিক আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেনি,  ক্রন্দনরত জননীর মর্মপীড়া, পরাধীন দেশমাতৃকার অসহায়ত্ব,  নিপীড়িত,  নিঃগৃহিত,  নির্জিত,  অবজ্ঞাত,  অনাহূত মানুষের দগ্ধীভূত জীবন, পাশবিক মানসিকতার পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম,  নির্লজ্জ,  মানবতা বহির্ভূত কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের বিপক্ষে ভালো মানুষটির মত আত্মরক্ষার উপায় সন্ধানে উদভ্রান্ত হয়ে ওঠে নি তাঁর কবিচিত্ত।  'মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প'  কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কিঞ্চিৎ বিবরণ পরিদৃশ্যমান। যুদ্ধঘন একাত্তরে কবিমানস ঘটনার নাটকীয়তায় আতংকিত,  আশংকিত হয়ে ওঠে,  অভ্যস্ত গন্ডিতে অনভ্যস্তার আগমন কবি নূরুল হকের অন্তরে সৃষ্টি করে আক্ষেপ — কবির ভাষায়:


                            তারমানে একটু আগেও যারা জগতে ছিল
                            ছিল রাস্তা-ঘাটের মানুষ
                            দরাদরির মানুষ
                            এখন তারা পারি দিয়েছে
                                   পরলোকে
                            সারিবদ্ধভাবে।


মানুষের স্বাভাবিক জীবন মুহূর্তেই বিষিয়ে ওঠে পাক-হানাদারের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে,  সংবেদনশীল কবি হৃদয়ে ঘনীভূত হয় এক সুতীব্র বিদ্রোহী সত্ত্বা  পাকিস্তানের ক্রুর শাসকনামী শোসকদের বিরুদ্ধে।  স্বদেশির এই মর্মান্তিক  
পরিণতির পশ্চাতে যে কালোশক্তি দায়ী কবি হৃদয় সেই শক্তির টুটি চেপে ধরতে চায়,  অরক্ষিত দেশের রক্ষক রূপে নিজেকে যখন কবি আবিস্কার করলেন তখন জীবনের সিংহদ্বারে মুক্তির আহ্বানে কবিকন্ঠ্যে বিঘোষিত হয়:


                            জেনেছিলাম একটি জাতির
                            চরম মুহুর্তে দাঁড়িয়ে —
                            জীবনও এমন কিছু নয়
                            আরো অনেক কিছু আছে
                            জীবনের সকল অধিকার
                            উপরে ফেলা যায় সহজেই,
                            যাতে নতুন অভিধান লেখা যায় —


এই নতুন অভিধানই আমাদের আজকের স্বাধীনতা,  আজকের এই মুক্তমাঠের উন্মুক্ত আকাশ দেখার একচ্ছত্র অধিকার।  


যুদ্ধোত্তর তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা,  জাতীয় জীবনের চরম বিপর্যয়,  বঙ্গবন্ধুর অমানবিক হত্যাকান্ড,  সামরিক শাসনাধীন নৈরাজ্য ,  নির্বাচনী অস্থিতিশীলতা,  সর্বোপরী স্বাদেশিক বিপর্যয় যে একজন মুক্তিযোদ্ধা কবির চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে তা  সন্দেহাতীত ভাবেই সত্য এবং কবি নুরুল হকের চিত্তে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বদেশ পরিক্রমাও যে জটিল এবং কুটিল ঘুর্ণাবর্তের সৃষ্টি করেছিল তাও স্বভাবতই অনুমেয়৷  একজন কবির কাছে বিশ্ব-মানবতার নৈতিক স্খলনের বেদনাবোধই সর্বাধিক গুরুতর বেদনা,  সুন্দর এবং নির্মলের সাধক হিসেবে স্বীকৃত  কবি  ঘনায়মান অন্যায়ের সপক্ষে স্বীয় অবস্থান কল্পনা করতে অপারগ।  ধর্ম, বর্ণ,জাতি নির্বিশেষে কবিচিত্তের মর্মমূলে প্রোথিত থাকে উচ্চ মানবিকতার বীজমন্ত্র আর এই বীজ থেকে সৃষ্ট বৃক্ষই কবিতা।  নুরুল হকের কাব্যে আমরা উচ্চ মানবিক অনুভুতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ  দেখতে পায়, 'আত্মদীপ ভব' কবিতায় দেখতে পায় মানবিক স্খলনে বেদনাদগ্ধ কবিহৃদয়ের আর্ত চিৎকার:


                           "নরকের অভ্যন্তরে
                            এই অন্ধকারে
                            কলজে জ্বলে
                            আলোর টুকরার মতো।"
                                                      (আত্মদীপ ভব, নূরুল হক)


'এই অন্ধকার' এবং 'ঘোর অন্ধকার' শব্দদ্বয় বস্তুত সমকালীন  মানবিক বিপর্যয়কে ইঙ্গিতবহ করে তুলেছে,  কবিহৃদয় মানবিক বিপর্যয় রূপ এই 'ঘোর অন্ধকারে' ব্যথীত,  আর এই বেদনা কবির অন্তর্লোকে নরকের যন্ত্রণাবোধকে  জাগ্রত করেছে। মানবতার পতনে কবির প্রত্যক্ষণ এক নারকীয় অনুভূতিতে নিমজ্জিত হয়েছে, তবুও কবি হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে নিমগ্ন হয়েছেন মানবতার পুনর্জাগরণের এক গভীর অনুধ্যানে:


                           ' রাতের গভীর তারা
                            যেরকম জাগে
                            আর ধুয়ে দেয় জগতের মুখ
                            তেমনি কোন দীপায়ন
                            সংগোপনে পোড়ায় আমাকে।'
                                                 (আত্মদীপ ভব,  নূরুল হক )


সমগ্র অন্ধকারকে দূরীকরণের প্রত্যাশায় কবি তার হৃদয়ের অভ্যন্তরে এমন এক জ্যোতির প্রকাশ আহ্বান করেন যা সমগ্র মানবিক অন্ধকারকে আলোকিত করবে যেমন নিশিতের অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করে দূরবতী নক্ষত্রের দল। এই 'দীপায়ন' এর অনুধ্যানেই কবিহৃদয়কে আশান্বিত করে এক নবতর ভুবনালোকের,  কবিহৃদয়ে সংগোপনে এই দীপায়নের কামনা তার উচ্চতর মানবিক দর্শনের বিম্বিত রূপ।


'বাসিন্দা' কবিতাটিতে পরিলক্ষিত,  কবির মগ্নচৈতন্য আচ্ছন্ন করে আছে এক পার্থিব দুঃখবোধ,  নৈরাশ্যে নিমগ্ন কবি ব্যাথাবিদীর্ণ কন্ঠে  তার হৃদয়জ অনুভবে   নিজেকে আবিস্কার করেন 'অভিশপ্ত আত্মা'  তথা পচমান, গলিত, মুল্যবোধহীন এক অবক্ষয়ের মধ্যে,  যেখানে তার পারিপার্শ্বকতায় নৈতিক স্খলনের বিগলিত ধারা পঙ্কিলতায় তাকে পরিবেষ্টন করে আছে। তার আশাহত হৃদয়ে  উচ্চারিত  হয়:


                    " আমি এক ভাগ্যহত নগরীর বাসিন্দা
                    যে নগরে
                                 কিছু অভিশপ্ত আত্মা নিয়ে
                        শুধু পথ-বিভ্রান্ত ঝড়ের মত ঘুরে বেড়ায়।  


পরক্ষণেই কবি পাপধারায় বিগলিত মানুষগুলোর চিত্রপট উন্মোচন করেন,  মানুষগুলোর অভ্যন্তরে নৈতিকতার কণাটুকু নেই।


                   " মানুষগুলো চূর্ণবিচূর্ণ নুড়ি,
                          এক পাথর থেকে
                          আরেক পাথরে গিয়ে
                           মাথা ঠোকে।
                          মানুষ, জলের নীচে, ধ্বংসপ্রাপ্ত মানুষ ।"


'এক পাথর থেকে আরেক পাথরে গিয়ে মাথা ঠোকে' স্বাতন্ত্র্য বর্জিত মানুষের বাস্তবধর্মী বর্ণনা এর চেয়েও নান্দনিকভাবে শিল্পসৌকর্যে প্রকাশ দুরূহ বটে৷ এই পঙক্তি দ্বারা কবি অবলীলায় শৈল্পিক অভিধায় বিশেষরূপে মানুষের চাটুকার বৃত্তিকে নৈতিক নিমজ্জনের কারণরূপে চিত্রিত করে নিমজ্জন থেকে মুক্তির পথটিকেও ইঙ্গিতবহ করে তুলেছেন।  
                        


প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাগুলোতে কবি নুরুল হকের আত্মানুসন্ধিৎসু সত্তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় একই সাথে কবি হৃদয়ের নির্জন প্রকোষ্ঠে লালিত প্রকৃতির এক গভীর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভব বৈকল্পিক দাঢ্যে উপস্থাপিত হয়েছে।  কবিসত্তার সাথে প্রকৃতির ভাবগত একীভূতকরণের একটি প্রবণতা প্রাসঙ্গিক রূপ পরিগ্রহ করে তার প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাগুলোকে করেছে বিশেষ ভাবরসে সিক্ত ৷ তার এই চেতনা অন্তর্দাহে দগ্ধ নয়,  অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রকম্পিত নয়; কবি সচেতন ভাবেই প্রকৃতির সাথে বিলীয়মান রূপে নিজেকে কল্পনা করে আস্বাদন করেন এক ইন্দ্রিয়াতীত তৃপ্তি। কবিতা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে কবির আত্মানুসন্ধানের বিঘোষিত আন্দোলনে।  কবির অন্তর্গত অভীপ্সা সুস্পষ্ট ভাবেই প্রকৃতির স্নিগ্ধ,শান্ত রূপ আস্বাদনের সুগভীর অভিপ্রেত ব্যক্ত করে।  উত্তরাধুনিক কবিদের কাব্য প্রবণতায় আত্মানুসন্ধান ক্রমবিবর্তনের পথ বেয়ে একীভূত হয়েছে গভীর মানবিক অনুভুতির সাথে।  কবি বিশ্বের বিকেন্দ্রীকৃত,  অবহেলিত,  অবজ্ঞাত মানবিকতাকে আপন অন্তরে ধারণ করে সমগ্র মানবতাকে কবিচিত্তের মানবতারসে জারিত করেন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে।


নুরুল হকের  কবিতায় এই সামগ্রিক মানবতাবোধের এক শিল্পিত প্রকাশ তার উত্তরাধুনিক কাব্যপ্রবণতার  পরিচায়ক। নাগরিক জীবনের নিরাবেগ চারদেয়ালে  অবগুণ্ঠিত না থেকে কবি হৃদয়ের কোথাও যে তরুশ্যাম,  বাল্য স্মৃতি বিজরিত নৈসর্গিক পরিবেশে প্রত্যাবর্তনের একটা গুরুতর ধারা প্রবহমান তা তার কবিতায় প্রায় সর্বত্রই পরিদৃষ্ট। তাই স্বভাবত নগরজীবনরূপী মরুভূমির তপ্ত বালিয়ারী অতিক্রম করে কবিহৃদয় কোন সবুজাভ প্রকৃতির বিজন মন্দিরে নিত্য নৈমিত্তিক নিঃশব্দে আরতি দিয়ে যায় তার কবিতায়! এই বোধ তার অন্তর্গত অনুভূতির নির্জনতম প্রকোষ্ঠে গভীর অনুরাগের সাথে আস্বাদিত হয়,  কবিহৃদয় তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির অনুরণনে বলে ওঠে —


                          "মাটি খুড়ে অনেক গভীরে নেমে
                                            কান পাতলে
                                 সমুদ্র-শঙ্খের ডাক,
                            পাখির ঝাপট শোনা যায়।
                                             (মাটি,  নূরুল হক)


'মাটি খুড়া' কী কবি হৃদয়ের আপন গহনদ্বারে আত্মসন্ধানকে ইঙ্গিতবহ করে তোলে না? কবিহৃদয় আত্মমগ্ন হয়ে রয় অপ্রাপ্তিতে ভরা জীবনের অপ্রাপ্য অনুভুতি রূপ 'সমুদ্র-শঙ্খের' ডাক। সনাতন ধর্মানুসারে শঙ্খ চিরন্তন মঙ্গল ধ্বনি র পরিচায়ক।  পাখির ঝাপট মুক্ত জীবনানন্দকে রূপান্বিত করে, স্বাধীনতাবোধকে,  সুবিশাল আকাশের নিমিত্তে দুরন্ত বেগে উড়ন্ত পাখিকে ইঙ্গিতবহ করে তোলে।  কবি তার চেতনার নাভিমূলে কান পেতে রয় সেই চিরন্তন মঙ্গল চেতনার আবাহনের অপেক্ষায় যা সমগ্র জাতীয়তায় আনয়ন করবে এক গভীরতম শান্তিময় মুক্তি,  সুপ্তি,  এভাবেই কবি নূরুল হকের কবিতায় ব্যক্তিক অনুভূতির অন্তরালে দন্ডায়মান এক গভীর মানবিক জীবনবোধ,  যেই জীবনবোধ ব্যক্তিসত্তার আত্মীকৃত অথচ বিশ্বমানবতার জন্য উৎসারিত।


চেতনার অন্তরালে সদা চলমান এক অচৈতন্য আমাদেরকে আমাদের মনের অজান্তে পরিচালিত করে জুগুপ্সার কাটাকীর্ণ পথে।  মানবিক আকাশ রক্তাক্ত হয়ে ওঠে এ পৈশাচিক অনুভুতিতে।  মানসিক মৃত্যু মানুষকে করে তোলে অমানবিক মানুষ। এই মানসিকভাবে মৃতদের কবি এক মৃত শালিকছানার রূপকে রূপকায়িত  করেছেন। যার দেহে নানাবিধ অপকর্ম রূপ পোকামাকড়ে ভরা,  বৌদ্ধিক মৃত্যু যাকে নির্বোধে পরিণত করেছে,  নৈতিক স্খলন অমানবিক মানুষে রূপান্তরিত করেছে কবি হৃদয় প্রচ্ছন্ন আক্ষেপে তাদেরকে সর্বনাশের অভিসারী রূপে আবিষ্কার করেছেন তার 'সর্বনাশের অভিসার' নামক কবিতায়।  


                       "যেতে যেতে দেখলাম
                        পথের ধারে পড়ে আছে
                        একটা শালিকের ছানা।
                        মৃত।
                        ……………………………………
                        শরীর তার এত লণ্ডভণ্ড
                        এবং এত সর্বস্বান্ত
                        এবং এত পোকা-মাকড়ের আক্রমণে ভরা
                        যে,
                        জীবনের সাজসজ্জা বলতে ছিটেফোঁটাও
                        আর নেই।
                        কে জানবে আর কে-ই বা বুঝবে
                        কোন ক্ষতি হয়ে গেল
                        এ জগতে,
                        কোনখানে
                        কার?


স্বীয় মনের মৃত্যুতে অকাতর অসতর্ক এই শালিক ছানা রূপী মানুষ আজ সমাজে ন্যূন নয়,  তাদের সংখ্যাটাও অনতিবৃহৎ নয়। T.S Elliott এর  'Hollowman' কবিতায় এই নৈতিকতাস্খলিত মানুষগুলোই , শূন্য চক্ষু কোঠরাবৃত,  মগজে খড়ভর্তি কাকতাড়ুয়া রূপে কল্পিত হয়েছিল যারা অন্তর্জাত  অনুভূতিশূন্য, নৈরাশ্য পীড়িত, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য  আর নূরুল হকের কবিতায় তারায় কল্পিত মৃতবৎ শালিকের ছানা রূপে।  


কবি কালিক তুলাদণ্ডে স্বীয় ভালোলাগাটুকু পরিমাপ করে দেখতে চেয়েছেন তার প্রকৃতিচেতনার অন্তরালে।  কবির এই প্রকৃতিচেতনা সহজাত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই,  তবে এই প্রকৃতি চেতনার অন্তরালে প্রধান এবং অন্যতম কারণ কবির  নাগরিক জীবনের প্রতি নিরুৎসাহ।  তাই বারবার তার মানসলোকে ভাসমান প্রকৃতির টুকরো টুকরো চিত্র তার বিদগ্ধ নাগরিক জীবনে প্রলেপতূল্য।  সামগ্রিকভাবে কবি হৃদয়ের এক নৈর্ব্যক্তিক প্রত্যক্ষণে প্রকৃতি ব্যক্তিরূপে গৃহিত হয়েছে,  মানবিক বিপর্যয়ে কবি মানুষের প্রতি আস্থা হারাননি তা যেমন সত্য,  তেমনি এই বিপর্যস্ত সমাজব্যবস্থায় নিজেকে অনিরাপদ বোধ করেছেন,  কবি নূরুল হক এক ঋত্বিক,  যিনি মানুষের জীবনবোধকে তার প্রকৃতিচেতনার সাথে মিশিয়ে দিয়ে মানবতার পূজাকেই আরাধ্য বিবেচনা করেছেন। তার নৈঃসর্গচেতনার আদ্যান্ত জুরে মিশে আছে এক গভীর মানবীয় অনুভূতির অন্তর্ভেদী সংবেদন,  মানুষ এবং নৈসর্গ একীভূত হয়ে গেছে এক সুসম আলিঙ্গনে।  কবি জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এক গভীর সংবেদনশীলতার সাথে,  তার 'পাদটীকা' নামক কবিতায়  তিনি জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক  পরম আস্বাদ্য রূপে —


                      "জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,
                       যা দেখে মানুষ
                       বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যায়।


হৃৎপিন্ডের স্পন্দিত তন্ত্রী প্রতিনিয়ত তার উপস্থিতি যেমন করে স্পন্দনে স্পন্দনে ঘোষণা করে চলে,  যেমন করে নক্ষত্রশোভিত নির্মেঘ আকাশ এক সুগভীর রহস্যে আপন হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্বমানবের মনের সমগ্র রহস্য,  যেমন করে দূর বৃন্দাবনের বংশীধ্বনিতে একদা রাধা হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল তেমনি করেই কাব্যজগত মানব অন্তরে এক গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে,  নক্ষত্রের মত হৃদয়কে আলোকিত করে,  কিংবা বংশীধ্বনির সুর লয়ে বিমোহিত আর ব্যকুল  করে চলে অবিরত ।  কবিতা জগতে বিচরণশীল প্রতিটি কবির মতই নূরুল হকের কবিতাসমগ্র  বাংলা সাহিত্যের  কলেবর বৃদ্ধি করেছে৷ কবির আত্মগত অনুভূতি পাঠকমনে নতুন ভাবনার উদয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক এই কামনা নিয়ে যবনিকাপাত করছি।