#রবি_ঠাকুরের 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি' নিয়ে আমার বন্ধুদের মনের মধ্যেও একরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করত, তাই তাদের এই বিভ্রমকে কিছুটা নিরসনের চেষ্টা করলাম।
#তথ্যের_ঋণ:— শুবাচ গ্রুপের আর্ষপ্রয়োগ সম্বন্ধীয় লেখা আর এক বন্ধুর একই বিষয়ের উপর লেখা কিছু যুক্তি; Quora -এর সাহায্য।
#কিছুটা নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছি।
#প্রথম_যযাতি:—
https://www.facebook.com/groups/shuvas/permalink/3374420709246013/?mibextid=Nif5oz

১) রবি ঠাকুরের লেখায় আঞ্চলিকতার ছাপ স্পষ্ট, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যেমন: তাঁর লেখায় আমরা 'গেলেম','গেলুম' এইসব আঞ্চলিক শব্দ দেখেছি।
    এখন, আমরা রবি ঠাকুরের জীবনী পড়ে জানতে পেরেছি যে, তিনি অধুনা বাংলাদেশেও বহু দিন ছিলেন আর সেখানকার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে তিনি রসদ খুঁজে পেয়েছিলেন আর তার প্রমাণ তাঁর বহু কবিতায়, বহু গানে, বহু গল্পে আমরা পেয়েছি।
যেমন:
' চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে'
     এখন এই বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার মানুষেরা তালাকে চাবি আর চাবিকে ছুরান বলে। তাছাড়া, এখনও গাঁয়ের বহু মানুষ কথ্য ভাষায় বলে, " সাইকেলে চাবি মেরে দিস"। আদতে, তালা দেওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে।
২) নজরুলের কবিতাতেও এর দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। যেমন তিনি 'মানুষ' কবিতায় বলেছেন।
" তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি। "
৩) আর্ষপ্রয়োগ: আর্ষের শাব্দিক অর্থ হল ঋষির উক্তি আর ব্যবহারিক অর্থ হল জ্ঞানীদের উক্তি। এখন কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলোর কিছুটা আইনের ফাঁক করে সাহিত্যের তাল ঠিক রাখার জন্য করা হয়, আর বৈয়াকরণরাও ভুল বলতে পারেন না কারণ, বিখ্যাত লেখকের লেখা পাঠকেরা সাদরে গ্রহণ করে নেয় আর অভিধানেও স্বীকৃতি মিলে যায়, তবে সেটা আপনি-আমি করলে সমর্থন পাব না, নামী সাহিত্যিক করলে সমর্থন পাওয়ার সুযোগ আমাদের চেয়ে বহুলাংশে বেশি থাকে। যেমন: রবি ঠাকুর তাঁর 'আবির্ভাব' কবিতায় লিখেছেন:
" এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক তব জীবনের পরসাদ।" চারুচন্দ্র বলেছেন, " গুরুদেব, বেতসের অর্থ তো  বেত, বাঁশ নয়, ওতে বাঁশি তৈরি হয় না।"
রবি ঠাকুর বলেছিলেন, " আর্ষপ্রয়োগ ধরে নাও, আজ থেকে বেতসের বিকল্প অর্থ বাঁশ।"  সাহিত্যে যে পেরেছে স্বেচ্ছাচার চালিয়েছেন আর এটা বৈধ, তাহলে রবি ঠাকুর কেন বাদ যাবেন। তবে, কিছু যুক্তি থাকতে হবে। যেমন: ছন্দের মাত্রা ঠিক রাখা।
খেয়াল করুন,
" ভেঙে মোর ঘরের চাবি   নিয়ে যাবি  
         কে আমারে!"
এখানে " ভেঙে মোর ঘরের তালা নিয়ে যাবি...." কী রকম বিদঘুটে শোনাচ্ছে না?
৪) Poetic lisense অর্থাৎ কবির নিজস্ব স্বাধীনতা; সোজা গোদা বাংলায় এর মানে হল একজন কবি শব্দের অর্থ ঠিক রেখে সেই শব্দ নিয়ে খেলা করতে পারেন।
যেমন:
" মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।"
অনেকের মতে, এখানে অশ্রু শব্দটা সংস্কৃত থেকে এসেছে, এর অর্থ যা ব্যাপ্ত করে। চণ্ডীদাসের সময় তাঁরা ব্যবহার করতেন অঝরু বা অঝোর। পরবর্তীতে, যুক্তিগতভাবে এর অর্থ হল চোখের জল। তাহলে, অশ্রুজলের অর্থ হবে চোখের জল জল, ব্যাকরণগত দিক থেকে এটা অশুদ্ধ হলেও শ্রুতিমধুর এবং বহুল প্রচলিত।
    আবার অনেকের মতে, অশ্রু ও জল যদি আলাদা ফাঁক ফাঁক করে রেখে লেখা হত, তাহলে এর অর্থ হত চোখের জল জল আর তাই এখানে এই যুক্তি খাটে না। তাদের যুক্তি উদাহরণস্বরূপ নিম্নে বর্ণনা করা হল:
অশ্রুজল= অশ্রুর জল (সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস)
অশ্রুজল= অশ্রু নামক জল (মধ্যপদলোপীকর্মধারয় সমাস)
অশ্রুজল= অশ্রু জলের ন্যায় (উপমানমূলক কর্মধারয় সমাস)
       তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে, অশ্রুজলের যুক্তিটা পোয়েটিক লাইসেন্সের মধ্যে পড়ে না। আচ্ছা, তাহলে লাজলজ্জা, লজ্জাশরম- এই রকম শব্দগুলো তো পোয়েটিক লাইসেন্সের আওতায় পড়ে!
     তাছাড়া, আরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেমন,
        ধর্ম----> ধরম
        কর্ম---> করম
         প্রকাশ--> পরকাশ
          বর্ষা---> বরষা
         প্রসাদ---> পরসাদ
         জন্ম---> জনম
         প্রাণ---> পরাণ
আশা করি, এই কোমল রীতিগুলো নিয়ে উদাহরণ হিসেবে কোনো কবিতার চরণ উদ্ধৃত করার প্রয়োজন পড়বে না।
এমনকি, কবিতায় গুরুচণ্ডাল দোষও কোনো দোষই না।
যেমন:
"ওইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।"
              ... কবর (পল্লীকবি)


৫) ধরে নিলাম চাবি শব্দের অর্থ চাবিই। তাহলেও এটা ভুল নয়।
যেমন: এই গানটা গীতবিতানের পূজা অধ্যায়ে আছে, তাই সিংহভাগ লোক দাবি করে এটা আধ্যাত্মিক গান। এখন, আধ্যাত্মিক মন সবসময় সর্বশক্তিমান স্রষ্টার কাছে চলে যেতে চায়, কিন্তু মোহ বাধা সৃষ্টি করে‌। এখন, এমনও হতে পারে কবি হয়ত বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর আত্মার ঘর থেকে মোহকে বের করে চাবিটাকে একেবারেই ভেঙে দিতে বলছেন। কারণ, চাবি থাকলে আবারও তা দিয়ে ঘর খোলা যাবে আর মোহ আবারও আত্মার ঘরে প্রবেশ করে আত্মাকে মোহময় করে দিতেই পারে।