==================================
        মায়ের কোল আলো করে শিশু আসে, শিশু হাসে। শিশুর মুখে কথা ফোটে, সে কথার ফুলঝুরিতে মায়ের মনে খুশীর দোলা লাগে। সকল ভাষার শিশুরা এভাবে মায়ের সাথে, মা শিশুর সাথে ভাব বিনিময় করে--- তার মাতৃভাষার মাধ্যমে।


     পৃথিবীর প্রায় ডজন খানেক ভাষা পরিবারের অধীনে
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাসহ প্রায় সাত হাজার ভাষা রয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের অধীন " শতম " শাখার একটি সমৃদ্ধ গতিশীল ভাষা হিসেবে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করে চলছে।


         শতম শাখার প্রাচীন কোন মুখের ভাষা থেকে বাংলাভাষার উৎপত্তি ঘটে থাকবে। অনেক পন্ডিত এ প্রাচীন ভাষাটি সংস্কৃত ভাষা মনে করলেও যুক্তি সংগত কারন নেই। কারন সংস্কৃত ভাষা জনগনের মুখের ভাষা কখনো ছিল না, এটি একটি লিখিতভাষা মাত্র।


   আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে, খেটে খাওয়া মানুষ যারা এ অঞ্চলের প্রকৃত অধিবাসী বা প্রাকৃতজন তারা যে ভাষায় ( প্রাকৃত ভাষা) কথা বলতো, সে ভাষার উপর
ভিত্তি করেই ধীরে ধীরে বাংলাভাষা নিরবধি সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। আমাদের ভাব প্রকাশ ও পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।


         বাংলাদেশ, পশ্চিমবংগ,ত্রিপুরা, আসাম, আরাকান, উড়িষ্যা, বিহারের প্রায় ৩০ কোটি লোকের মাতৃভাষা হলো  বাংলা। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলো ( ১৯০৭ সালে নেপালের রাজকীয় পাঠাগার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কতৃক সংগৃহীত)  বৌদ্ধ কবিদের রচিত ---- চর্যাপদ ও কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর রচিত--- ইউসুফ জোলেখা পুথি।


       ভাষাপন্ডিত ডঃ সুনীতি কুমার চট্যোপাধ্যায় মনে করেন বিহারের মগধ অঞ্চলের " মাগধী প্রাকৃত " থেকে
বাংলাভাষার উৎপত্তি। অন্যদিকে বহুভাষাবিদ ও ভাষা
পন্ডিত ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ফ্রান্সের সরোবন বিশ্ববিদ্যালয়ে " ডি লিট " গবেষনায় তথ্য পান যে, চর্যাপদের ১২ জন কবির মধ্যে সবার গুরু কাহ্নপা বরিশাল অঞ্চলের লোক হলেও তার
সাধনার কেন্দ্র ছিল বগুড়ার মহাস্থানগড়। অন্য কবিগন
মহাস্থানগড় এবং সন্নিহিত অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। এই পন্ডিতের মতে বাংলাভাষার উৎপত্তি গৌড়ীয় পাকৃত থেকে।


         আমরা হয়তো মনে করতে পারি যে, বাংলাভাষার জন্ম নিয়ে যে বিতর্ক তা পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার কৃতিত্ব জাহিরের চেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে ভাষার জন্ম ও বেড়ে ওঠার একক কৃতিত্ব কোন অঞ্চলের নয়। এ কৃতিত্ব ৩০ কোটি বাংলা ভাষাভাষীর পূর্বপুরুষ খালি গা ও নগ্ন পায়ের কৃষক, জেলে, মাঝি,কামার আর কুমারের।আমার স্নেহদায়িনী মায়ের আর ভ্রাতৃডোরে আবদ্ধ বোনের।  সংগ্রাম মুখর এদেশের পল্লী গ্রামের  আপামর জনসাধারনের।


      বাংলাভাষা ভাব প্রকাশ ও সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার জন্য অত্যন্ত উদার-প্রানবন্ত ভাষা। প্রাকৃতিক নিয়মে--- সে
সময়ের প্রয়োজনে অন্যভাষা থেকে উপযুক্ত শব্দ গ্রহণ করে নিজকে সমৃদ্ধ করতে কখনো ইতস্তত করে নাই।


       এ অঞ্চলের আদি অধিবাসী কোল, ভীল ও মুন্ডাদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গাংগ, ডিংগি,ডোল, টং ইত্যাদি চৈনিক প্রভাবিত খাঁটি বাংলা শব্দের উপর বাংলা ভাষার বুনিয়াদ রচিত হয়েছে। সংস্কৃত থেকে সে নিজকে পুস্ট করার জন্য আত্মস্থ করেছে তৎসম, তৎভব ও অর্ধতৎসম শব্দরাজি। আরবি-ফারসী থেকে শত-সহস্র আলোক দ্যূতিময় শব্দ নিয়ে নিজকে সমৃদ্ধ করতে সে সব সময় পারংগমতার পরিচয় দিয়েছে।


      উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি, পশতু,তুর্কি,চীনা,বার্মিজ,পালি সে যেমন নিয়েছে, তেমনি বিগত চারশ বছর যাবৎ একের পর এক দূ'হাতে নিয়ে চলেছে ----ইংরেজী, ফরাসী, পর্তুগীজ,ল্যটিন,স্পেনীশ শব্দ অবিকৃতভাবে বা একটু পরিবর্তন করে নিয়েছে নিজের সুবিধার জন্য।


       বাংলাভাষার কবি নোবেল জয়ী। কবি নজরুলের মত বিরল প্রতিভার অধিকারী কবি এ ভাষাতেই সাহিত্য
চর্চা করেছেন। বাংলা ভাষাভাষী প্রায় এক কোটি লোক
মধ্যপ্রাচ্য,বৃটেন,ইউএসএ, কানাডাসহ পৃথিবীর সকল মহাদেশে বাস করছে। এরা বাংলাভাষার বেসরকারী এম্ব্যেসেডর হিসেবে সারা বিশ্বচষে বেড়াচ্ছে।


     আমাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও মানবিকতা প্রতিষ্টিত
হলে বাংলা ভাষাবোধ থেকে আমরা আগামীদিনে বিশ্বদরবারে আমাদের ভূমিকাকে আরো বেগবান করতে পারবো। মানবিকতার মহানুভবতায় আমাদের সাহিত্যহবে বিশবমানের। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য হবে আমাদের পরিচয়ের পতপত উড়ন্ত পতাকা।


+++++++++++