নিভৃতচারী কবি ও ছড়াশিল্পী রহমান মুজিব। তিনি প্রচারবিমুখ এবং অন্তর্মুখী। অথচ তাঁর সাহিত্যসাধনা এবং শিল্পকর্ম শিশু ও তরুণদের অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। ‘আমি আত্মতৃপ্তির জন্য লিখি কিংবা সৃষ্টিতেই আমার আনন্দ’ হয়তো এ মনোভাব তাঁকে অন্তর্মুখী করেছে। যে সৃষ্টি তাঁকে তৃপ্তি দেয়- সে সৃষ্টির আনন্দবোধ যদি শিশু ও তরুণদের মানস জগতে প্রতিফলন ঘটাতে পারে- তবে তিনি কী আমাদের বঞ্চিত করছেন না?


সাহিত্যচর্চায় রহমান মুজিব আত্মনিবেদিত প্রাণ। একটা রচনা তাঁর এক একটা সন্তানতুল্য। আশির দশক থেকে তিনি কলমের কালিতে সন্তর্পনে আপন সৃষ্টিজগতকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন যত্নের সাথে। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাথরের চোখ দাও’ পাঠক মহলের প্রশংসা কুড়ায়। এ ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে প্রকাশিত ‘মিয়াঁও মিয়াঁও বিল্লিছানা (ছড়া-২০০০), ঝলকে ওঠে স্মৃতির ঠোঁটে (ছড়া-২০০২), ভালোবাসার ব্যালকনি (পদ্য-২০০৩), আলোর পাপড়ি (ছড়া-২০০৪), ছঙভঙ (ছড়া-২০০৪), তেলেসমাতি (ছড়া-২০০৬), পলিমাটি ডট কম (ছড়াসমবায়-২০১৫) প্রশংসিত হয়।


১৯৯৮ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক পত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজিনসহ জাতীয় দৈনিক যুগান্তর, সমকাল, ভোরের কাগজ, প্রথম আলো ইত্যাদিতে তাঁর সৃষ্টিকর্ম প্রকাশিত হয়েছে। আমার বিশ্বাস- তাঁর সৃষ্টিকর্ম হৃদয়বান কোন বোদ্ধা সাহিত্যিকের হাতে পড়লে, তিনি বলতে দ্বিধা করবেন না যে, রহমান মুজিব বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু সংযোজন করতে পেরেছেন।


কোন ভাব বা বক্তব্যকে ছন্দের ছাঁচে ফেলে শব্দচয়ন ও তার গাঁথুনীতে ছড়া বা কবিতাকে গড়ে তুলতে হয়। সচেতন কবি ও ছড়াশিল্পীকে তাই ছন্দকে আয়ত্ত করতে হয়। ছন্দ সচেতন রহমান মুজিব ছন্দের বিভিন্ন আঙ্গিক, ফর্ম বা রূপপ্রকল্প নিয়ে নিরীক্ষারত। অবিরত নিরীক্ষা সাধনায় তিনি দাঁড় করিয়েছেন একটি ফর্ম বা রূপপ্রকল্প। পরে যার নামকরণ করেছেন ‘রমুছাঁচ’। ৭৫টি রমুছাঁচ-এর সংকলনে ‌‘অমর একুশে বইমেলা-২০১৮’- তে প্রকাশ পেয়েছে রহমান মুজিবের ‘রমুছাঁচ’ বইটি।


রমুছাঁচ ৭ চরণের ছড়া বা কবিতা। ৫৬ থেকে ৮০ মাত্রায় এর বক্তব্য সমাপিতব্য। মিলবিন্যাস ‘কখখকগগক’। ১, ৪ ও ৭ চরণ সমিল, সমমাপের, দীর্ঘ। ২ এবং ৩ নম্বর চরণ হ্রস্ব, সমিল ও সমমাপের। আবার ৫ ও ৬ নম্বর চরণ হ্রস্ব, সমিল ও সমমাপের । ২ ও ৩ নম্বর চরণের সাথে ৫ ও ৬ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল এবং মাত্রা ভিন্ন বা একই হতে পারে। রংধনুর সাত রঙ বা সাতসুরের মতো রমুছাঁচের সাত চরণে একটি ভাব বা বক্তব্য পরিপূর্ণতা পায়। ১ম চরণে ভাবের সূচনা, ২-৬ নম্বর চরণে ভাবের বিস্তার এবং ৭ নম্বর চরণে বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটবে। ‘রমুছাঁচ’ চরণসংখ্যা বিষয়ে নতুনত্ব দাবি করে না। এর বিশেষত্ব চরণ বিন্যাস এবং মাত্রা বৈচিত্র্যে।


ছন্দ বিষয়ক সামান্য আলোকপাত:

অ+প+রাধ (অপরাধ) এবং অ+না+চার (অনাচার) শব্দ দুটির ১মটিতে ২টি মুক্তাক্ষর ‘অ, প’ ১টি বদ্ধাক্ষর ‘রাধ’ রয়েছে। ২য় শব্দটিতে ২টি মুক্তাক্ষর ‘অ, না’ এবং ১টি বদ্ধাক্ষর ‘চার’ রয়েছে। সব ছন্দে মুক্তাক্ষরকে ১ মাত্রা ধরা হয়। স্বরবৃত্তে বদ্ধাক্ষর যেখানেই থাক ১ মাত্রা; মাত্রাবৃত্তে বদ্ধাক্ষর শব্দের আদি-অন্ত-মধ্য যেখানেই থাক ২ মাত্রা এবং অক্ষরবৃত্তে বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে বা এককভাবে থাকলে ২ মাত্রা ধরা হয়। আর শব্দের শুরুতে বা মধ্যে থাকলে ১ মাত্রার মূল্য পায়। এভাবে ছন্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।


একই ফর্মে বিষয়বৈচিত্র্যকে সাবলীল, স্পষ্ট এবং অকপটে প্রকাশ করা দুরূহ কাজ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছন্দের মাত্রা ও মিলের খাতিরে কবিকে শব্দের সাথে আপোষ করতে হয়। কিন্তু শব্দকুশলী রহমান মুজিব তাঁর কারিশমা দেখিয়েছেন নিপুনতার সাথে। ‘রমুছাঁচ’ মৌলিক ছন্দ (স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত) ছাড়াও স্বরাক্ষরিক, অক্ষরমাত্রিক এবং স্বরমাত্রিক ছন্দে রচিত হতে পারে।


নিম্নে রহমান মুজিব রচিত রমুছাঁচের বিভিন্ন ছন্দ বিশ্লেষণ দেখানো হলো।


১. স্বরবৃত্তে রচিত রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণ:


‘আমার বুকে একটা নামই ঘড়ির মতো বাজে
প্রাণের প্রিয় মা-জননী
দিতেন যিনি দুধের ননী-
আব্বা তুমি রাগ করো না আছো মায়ের মাঝে।
এইটা কেমন ভাগ্য লেখা
দিন চলে যায় হয় না দেখা
ইচ্ছে করে সব ছেড়ে যাই- ইস্তফা দিই কাজে!’


                                                      (ঘড়ির মতো বাজে)


এ রমুছাঁচের ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৪+৪+৪+২, সমিল, সমমাপের এবং দীর্ঘ। ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৪+৪ সমিল, সমমাপের এবং হ্রস্ব। ২ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব স্বরবৃত্তে রচিত কবিতাটিকে আরও মাধুর্যময় করেছে। সময়ের প্রয়োজনে মায়ের থেকে সন্তান দূরদেশে কর্মরত থাকলেও মায়ের জন্য সন্তানের প্রতিমুহূর্তের কাছে পাবার আকুলতা এ কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।


২. অক্ষরবৃত্তে রচিত রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণ:


‘অঙ্গনে গোলাপ ফোটা- দৃষ্টিভ্রমে করি ধার
গন্ধহীন ফুল
কাগজে রাতুল
অশেষ অমূল্য ভেবে টবে রাখি- গড়ি হার।
স্বকীয় রতন
পাবে না যতন
এ স্বভাব বাঙালির কবে হবে পরিহার?’


                                            (করে হবে পরিহার)


এ রমুছাঁচের ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৮+৮ এবং ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর চরণের মূল পর্ব ৬ মাত্রার। ছাগল ভাবে বেড়ার ও পাশের ঘাসগুলো বেশি উপাদেয়- এ বক্তব্যের অনুরণন ঘটেছে অক্ষরবৃত্তে রচিত রহমান মুজিবের এ কবিতায়।


৩. মাত্রাবৃত্তে রচিত রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণ:


‘কিছু দিয়ে কিছু নিন এই রীতি সমাজে
অধিকার? ভাবালাপ
চায় শুধু লাভালাভ
অবিরাম ছুটে চলা নাই দাঁড়ি কমা যে!
দাম দিতে জ্বলে চাম
মাথা থেকে পায়ে ঘাম
ভেবে কেউ দেখলো না কত ব্যথা জমা যে।’


                                               (রীতি)


এ রমুছাঁচের ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের মূল পর্ব ৪ মাত্রার এবং অপূর্ণ পর্ব ৩ মাত্রার। অপরদিকে ২, ৩,  ৫ ও ৬ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৪+৪ যা মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে সিদ্ধ করে।


৪. স্বরাক্ষরিক ছন্দে রচিত রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণ:


‘অদ্য যে বীজ বপন হলো ভূমিতে
কাল যদি দাও পায়ে পিষে
বিছন ধুলায় যাবে মিশে
এমন হলে পারবে পুষ্প চুমিতে?
গাছ-পাতা-ফুল যত্নে জাগে
ফলের ফলন অনুরাগে
পুষ্ট-প্রেমে হও না বীজের সু-মিতে।’


                                      (যত্নে জাগে)


এ রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বরবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব ৪ মাত্রার এবং ১, ৪ ও ৭ চরণের অপূর্ণ পর্ব ৩ মাত্রার। অপরদিকে অক্ষরবৃত্তে ছন্দে ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৬+৪। অপরদিকে ১ ও ৭ নম্বর চরণের অপূর্ণ পর্ব ৩ মাত্রার এবং মূল পর্ব ১০ মাত্রার ঠিক থাকলেও ৪ নম্বর চরণে ১ মাত্রার ঘাটতি দেখা যায়। এক মাত্রার ঘাটতি না হলে কবিতাটি স্বরাক্ষরিক ছন্দে সিদ্ধ ছিল।


৫. অক্ষরমাত্রিক ছন্দে রচিত রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণ:


‘ঋতু গিয়ে ঋতু আসে দিন গিয়ে দিন
তুমি তো আসো না ফিরে
তীরভাঙা নদী-তীরে
অথচ কী করে আছো নদীতে আসীন!
ঢেউ লেগে ভূমি ধসে
অতঃপরও তুমি বসে
ঝিলিমিলি দেখা যায় জীবন রঙিন।’


                                      (ঝিলিমিলি দেখা যায়)


মাত্রাবৃত্ত ছন্দের হিসেবে এ রমুছাঁচের ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৬+২+৬, সমিল, সমমাপের, দীর্ঘ এবং ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৬+২, সমিল, সমমাপের, হ্রস্ব। অপরদিকে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৮+৬ এবং ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস ৬+২। অর্থাৎ এ রমুছাঁচটি অক্ষরমাত্রিক ছন্দের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


৬. স্বরমাত্রিক ছন্দে রচিত রমুছাঁচের ছন্দ বিশ্লেষণ:


‘যারা কেবল ঝগড়া করে বেহুদা
দড়িটাকে সর্প করে
বাহুবলে দর্প করে
আবোল-তাবোল যারা বলে হে খোদা
এবং যারা তথ্য ঢাকে
মিথ্যে দিয়ে সত্য ঢাকে
তাদের একটু বোধি-শোধি দে খোদা।’


                                              (দে খোদা)


স্বরবৃত্তে ছন্দে এ রমুছাঁচটির ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস (৪+৪+৩) এবং ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর চরণ (৪+৪) পর্ববিন্যাসে সিদ্ধ। আবার, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ১ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস (৫+৫+৩) এবং ৪ ও ৭ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস (৬+৪+৩)। অন্যদিকে ২ ও ৩ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস (৪+৫) এবং ৫ ও ৬ নম্বর চরণের পর্ববিন্যাস (৫+৫) মাত্রা শ্রুতিকটু না হলেও মাত্রাবৃত্তে ৭টি চরণের মূলপর্বই যদি ৫ মাত্রার রাখা যেত- তাহলে অসম্ভব একটা কাজ হতো। যদিও তা দুরূহ।


একাধিক রমুছাঁচের সমন্বয়ে রমুছাঁচ পরম্পরাও রচিত হতে পারে। রহমান মুজিবের ‘ জয়ের ভাষা’, ‘গানের সম্মিলন’, ‘জাগলে আপামর’ কবিতাগুলো তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। উপরের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, ছন্দে রচিত প্রত্যেকটি রমুছাঁচের মিলবিন্যাস ‘কখখকগগক’। রহমান মুজিব তাঁর রমুছাঁচে বিভিন্ন ছন্দের যে স্বাচ্ছন্দ্যময় খেলা দেখিয়েছেন তা অনস্বীকার্য। তাঁর সাহসী ভূমিকা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।


রমুছাঁচে শিশুতোষ স্বপ্নচারিতা, কঠিন বাস্তবতা, প্রেম, দ্রোহ, রাজনীতি, দেশ, সমাজ, প্রকৃতি, শ্লেষ, হাস্যরস ইত্যাদি নানা বিষয় স্বাচ্ছন্দ্যে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব- যা রহমান মুজিব করে দেখিয়েছেন।


১. বাস্তবতা:


‘হাতির মতো তোমার পায়ে আমার হলো পা পিষ্ট
বললে না তো ‘সরি-টরি’
উলটো মাথায় ভাঙলে ছড়ি
এমন স্বভাব যাদের হবে তারা কি নয় পাপিষ্ঠ?
মার্গারেটা জনের ছেলে
যদি জ্বলো বেগুন-তেলে
জানবো তোমার চেনার বাকি- আছে কোথায় পাপ-ইষ্ট।’


                                                 (তারা কি নয় পাপিষ্ঠ)


কিছু পায়াভারী লোক আছে- যাদের আদব-কায়দার কোন বালাই নেই। তাদের স্বভাবে কেউ আঘাত পেলেও বুক ফুলিয়ে থাকে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তিও যদি এমন আচরণের হয়- তবে কবির ভায়ায়, কোনটা পাপ আর কোনটা পূন্য- তার চেনার বাকি আছে। আজকাল এ সমস্ত লোকের প্রায়শ দেখা মেলে। কিন্তু দুর্বল লোকের নিরুপায় চক্ষুবিস্ফোরণ ছাড়া কিছুই করার থাকে না। যাদের হাতির মতো পদচারণায় জনগণ ভীত থাকে, তাদের চরিত্রকে রহমান মুজিব এ রমুছাঁচে পরিষ্কারভাবে চিত্রিত করতে পেরেছেন।


২. দেশ:


‘সংখ্যালঘু শব্দটাই বাংলাদেশে থাকবে না
রোজ সকালে স্বপ্ন দেখি
সেই ভাবনায় কাব্য লেখি
শ্যামল মায়ের সন্তানেরা দুখের লোনা চাখবে না।
ধর্ম-বর্ণ কে কোন দলের
সাঙ্গ হবে এ কোন্দলের
ভবিষ্যতের তরুণ এসে বিভেদ ফারাক রাখবে না।’


                                        (রোজ সকালে স্বপ্ন দেখি)


বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের পারস্পরিক সৌহার্দ্যে একটি দেশে শান্তি বিরাজ করে। সংখ্যালঘু শব্দটাই মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে। তাই কবি স্বপ্ন দেখেন- নবপ্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা সাস্প্রদায়িক কোন্দলের অবসান ঘটায় এবং দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।


৩. শ্লেষ:


‘বিয়েবাড়ি আলোকসজ্জা দেখতে পাবেন নিত্য
রঙবাহারি রঙিন আলো
একটা জিনিস বলবে ভালো
ভাসবে এতে আভিজাত্য- বাড়ির লোকের বিত্ত।
কিন্তু আপন ভিতরবাড়ি
আমরা কজন দেখতে পারি?
আসল আলো দেখতে হলে আলোয় ভরুন চিত্ত।’


                                                    (ভিতর-বাহির)


অভিজাতরা বিত্ত-বৈভবকে জাহির করে বিভিন্ন জৌলুস অনুষ্ঠানে। দিবালোকের সূর্য, রাতের বিদ্যুৎ বাতি কিংবা বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জা প্রত্যক্ষ বিষয়। কিন্তু ভিতরের আলো প্রত্যক্ষ নয়- যা চর্মচক্ষে ধরা দেবে। কিংবা তা বৈভবেও প্রকাশ পায় না। এ আলোর প্রকাশ উদারতা ও মনুষত্বে- যার চর্চা মানুষের পরিচয়কে উন্নত করে। এ বিষয়টিই এ রমুছাঁচে প্রস্ফুটিত।


৪. জীবনমুখী:


‘খুব বেশি প্রয়োজন আজ বাড়ি ফিরবার
পেছনের ভুলভাল
কাদাছোঁড়া গোলমাল
ভুলে গিয়ে ফুল হাতে ধারে কাছে ভিড়বার।
যদি ঘটে মিল
উড়ে যাবে চিল
ঘরভরা ছানা নিয়ে তুমি হবে নির্ভার।’


                                         (খুব বেশি প্রয়োজন)


ভুল এবং হিংসা-দ্বেষের আগুন সুখের বাগানকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে এবং পরিবার ও সমাজে বিপরীতমুখী সম্পর্কের সৃষ্টি করে। তাই এ রমুছাঁচে কবির আহ্বান, সহনীয় হয়ে আবার ফুল হাতে পাশাপাশি এসে দাঁড়াতে হবে- যাতে আত্মীয়-পরিজনদের মাঝে সুখের বন্ধন রচনা করা যায়।


৫. প্রকৃতি:


‘সূর্যমুখী ফুলের সাথে সূর্য করে কেলি
দেখতে গিয়ে মন জুড়াল
সরষেখেতে রোদের আলো
গোলাপ জবা বকুল গাঁদা কোথায় আছো বেলি?
জুঁই চামেলি হাসনাহেনা
একটুি এসে বাসনা দে-না
খোকা-খুকি সবাই মিলে আলোর সাথে খেলি।’


                                                  (আলোর সাথে খেলি)


আলোর সাথে ফুলের সম্পর্ক নাড়ীবৎ। দিবাদৈর্ঘ্যের হ্রাস-ব্রদ্ধির উপর ফুলফোটা নির্ভরশীল। সূর্যমুখী ও সরষেখেতে আলোর আভায় যে অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়- সে আলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জুঁই-চামেলি-হাসনাহেনার সুগন্ধে কবি খোকাখুকিদের সাথে উচ্ছ্বাসে খেলতে চেয়েছেন।


৬. সমাজ:


‘কারও নাই হুঁশ জ্ঞান ঝগড়াতে বাড়তি
ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি
বিভাজন ছাড়াছাড়ি-
জ্ঞানী হলে মাকে তোরা এই ভাবে মারতি?
বাদ দিয়ে নাচানাচি
যাওয়া ভালো কাছাকাছি
আরও ভালো হতো যদি এক হতে পারতি।’


                                             (মা যা চায়)


কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষেরা মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে। আপনজনকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করে। এদের হিতাহিত বোধ থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতো- ঐক্যের শান্তি বড় শান্তি। কবি এ কবিতায় ঐক্যের মূলমন্ত্রকে আঁকড়ে ধরার আহ্বান করেছেন।


৭. প্রেম:


‘তোমার  বুকে একটু পেলে হৃদয় রাখার করিডর
আনবো মেখে নূরের পরশ
হৃদয় হবে কোমল সরস
সরসতা শানায় সাহস তখন কারে করি ডর?
চাই না ভিন্ন ভূষণ-ভাষণ
পেলে তোমার প্রেমের শাসন
এ প্রেম হবে গায়ের ভূষণ চকমকানো জরিধর।’


                                                   (চকমকানো জরিধর)


প্রেম পঙ্গুকেও পাঁচিল টপকাতে সাহায্য করে। কবি সেই প্রেম আর প্রেমের শাসন পেলে- সব বাধা-বিপত্তিকে তুচ্ছ করে এর স্বর্গীয় সুখে হৃদয়কে প্রফুল্ল রাখতেন। কবির ভাষায়- যার বহিঃপ্রকাশ হতো চকমকানো জরিধরের মতো।


৮. রাজনৈতিক:


‘বিশ্বব্যাপী ঝুটঝামেলা জমে গেছে অন্তহীন
নিত্য চালাই পরের চর্চা
কজন পড়ি ঘরের কড়চা
দিনে দিনে সমাজ যেন হচ্ছে সাধু-সন্তহীন।
অনাচারকে আচার করি
ওতেই খুঁজি বাঁচার কড়ি
আমরা বুঝি প্রতিটা দিন পড়ছি হয়ে দন্তহীন।’


                                              (বিশ্বব্যাপী ঝুটঝামেলা)


সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা- যুদ্ধের ট্রাজেডি আর আন্তর্জাতিক কোন্দল জীবনের খবর হয়ে প্রতিনিয়ত পীড়া দিয়ে যাচ্ছে জনমনে। নিজেদের জীবনকে গুলিয়ে ফেলছি বিভাজিত সমাজের ঝুটঝামেলায়। এ উদ্বিগ্ন পরিবেশে সুস্থ-স্বাভাবিক-মননশীল মানুষ গড়ে উঠতে পারে না। তবুও কবির ভাষায়- চারিদিকের অনাচারকে আচার করে একটু শান্তিতে থাকার চেষ্টা করতে হয়।


৯. দ্রোহ:


‘দিকে দিকে জমে গেছে অপরাধ অনাচার
পথে পথে জঞ্জাল
মানুষের মনজাল
ফোঁস-ফাঁস ছাড়ে তাই কেউটেরা ফণা তার।
এসো আজ সোজা হই
নাগিনীর ওঝা হই
ভাঙা চাই বিষদাঁত চলবে না কণা ছাড়।


                                          (ওঝা হই)


ওঝা সাপকে বশ মানায়- এ কবিতায় ওঝা বলতে শান্তি আনয়নকারীকে বোঝানো হয়েছে। পথে অজস্র বিষাক্ত কাঁটা পড়ে থাকলে- কাঁটা সরিয়ে পথচলা কষ্টসাধ্য। অপরাধ আর অনাচারের বিরুদ্ধে মন তাই বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যারা আজ সমাজের কেউটে অর্থাৎ অপরাধী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, তাদের বিষদাঁত ভাঙার সময় এসেছে- অনেক সহ্য করেছি, তাই কোন ছাড় নয়- এ মন্ত্রে ন্যায়দণ্ডে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক।


১০. শিশুতোষ:


‘মামণি ওঠ, কী খাবি বল, নাস্তা না দুধ?
মাথার উপর সূর্য হাঁটে
এখনো তুই ঘুমাস খাটে
আর পারি না- তোর জ্বালাতে নাস্তানাবুদ!
ডাক না দিলে নড়বেও না
একটা কাজে ধরবেও না
এই মেয়েতে কেমনে রাখি আস্থা মাবূদ!’


                                          (নাস্তানাবুদ)


এ রমছাঁচে এমনি এক আদরের ছোট্ট মেয়ের কথা বলা হয়েছে- যার খাওয়ার প্রতি নেই খেয়াল- ঠিক সময় ঠিক কাজটা করতে তার অনীহা, মাকে তাই একটু মিষ্টি জ্বালাতন সহ্য করতে হয়। অতি আদরে অবাধ্য এই শিশুটির প্রতি মা কোন কাজে আস্থা রাখতে পারেন না। পরিমিত পরিমাণ সারপ্রয়োগে গাছের সুষম বৃদ্ধি ঘটে, তেমনি অতিরিক্ত সারপ্রয়োগে গাছটি মারা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক মায়ের এ কথাটি মনে রাখা জরুরি।


বক্তব্যকে স্পষ্ট-অর্থবহ এবং আকর্ষণীয় করতে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে রহমান মুজিব শব্দ নিয়ে গবেষণা করেছেন। অন্ত্যমিলযুক্ত রূপপ্রকল্প বা ফর্মে প্রায়শ ক্ষেত্রে সাধারণ মিলগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। এখানেও তিনি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন এবং অন্ত্যমিলকে করেছেন অনন্য। নিম্নে তার কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো:


(ক) ‘জয়ের ভাষা’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: জিন্না/ নিন না/ ঘিন্না
(খ) ‘কালের আলামত’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: সালামতে (ব্যক্তির নাম)/ আলামতে/ সালামতে (কুশলে থাকা)
(ঘ) ‘পাতা হবে নতুন কুঁড়ি’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: নির্ভেজাল/ ছিঁড়বে জাল/ ভিড়বে কাল
(ঘ) ‘মারক’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: মর্গ/ বর্গ/ অর্ঘ্য
(ঙ) ‘ম্যারেজ নিয়ে ম্যারেজ’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: আশাবাদে/ চাষাবাদে/ বাসা বাঁধে
(চ) ‘যে সুর তুমি নিত্য বাজাও’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: বাদ্যকার/ সাধ্য কার/ বাধ্যতার
(ছ) ‘আগুন গোলা থামা মা’ কবিতার নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: তামা মা/ দামামা/ থামা মা
(জ) ‘কষে দাও চাপুনি’ কবিতার ৫ ও ৬ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: কার আগারে/ কারাগারে
(ঝ) ‘তারা কি নয় পাপিষ্ঠ’ কবিতার ১, ৪ ও ৭ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: পা পিষ্ট/ পাপিষ্ঠ/ পাপ-ইষ্ট
(ঞ) ‘থাকে কোথায় মূল্যবোধ’ কবিতার ৫ ও ৬ নম্বর চরণের অন্ত্যমিল: পক্ষপাত/ দক্ষহাত


প্রত্যেকটি রচনায় এরকম চমৎকার অন্ত্যমিলের শিল্প রয়েছে। এছাড়াও ‌'রমুছাঁচ' বইটিতে রহমান মুজিবের সহজবোধ্য বর্ণনায় ‌'বাংলা ছন্দের রেখাপাত এবং রমুছাচেঁর ছন্দ' শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ যুক্ত হয়েছে। যা তরুণ লেখিয়েদের কাজে লাগবে।


রহমান মুজিবের গবেষণালব্ধ ‘রমুছাঁচ’ যাদের অন্তকরণে একটু হলেও দোলা দিতে পেরেছে/ পারবে- তাঁদেরকে আহ্বান করি- আসুন, শৈল্পিকতার নিপুনতায় রমুছাঁচ চর্চার সাহস দেখায়। সবশেষে- পাঠক মনে রমুছাঁচের দীপ্তিময় আলোকপাত কবির সৃষ্টিজগতকে আলোকিত করুক।