ভয় মানবিক এক অনুভূতি যা প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসার বোধ থেকে উদ্ভূত l নিজেকে সহ যাকে ভালবাসি, মন সর্বদা তার অনিষ্ট আশঙ্কায় আতঙ্কিত l সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকা, এই বুঝি কিছু হল l কিছু হয় না, তবু মন থেকে ভয়কে দূর করা যায় না l আবার কখনও কিছু একটা অঘটন ঘটেও যায় l নিজের, একেবারেই প্রিয়জনের, কিংবা পরিচিতজনের l সেই আঘাত সহ্য করে আবার জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে হয় l জীবনের পথে চলতে হয় l কিন্তু সেই অঘটনের স্মৃতিকে মন থেকে মুছে ফেলা যায় না l আর সেই স্মৃতি প্রিয়জনদের ঘিরে নিত্য নতুন ভয়ের আবহ তৈরি করে l
প্রিন্ট মিডিয়া, দূরদর্শন, সোসাল মিডিয়া ইত্যাদির কল্যাণে এখন কোথাও কিছু ঘটলে মুহূর্তেই সেটা জানা যাচ্ছে l অপরিচিতজনের ক্ষেত্রেও যে সকল  দুর্ঘটনাজনিত বা অন্য কোনো কারণে জীবনহানির ঘটনা ঘটছে, তার বিশদ তথ্য প্রতি মুহূর্তে আমাদের কাছে চলে আসছে l এই বিচিত্র রকমের দুর্ঘটনার তথ্যাদি আমাদের মনে সৃষ্টি করছে প্রিয়জনদের ঘিরে আজব রকমের সব ভীতি l
এরকম নানা কারণে যে আমরা ভয় পাই তার সুন্দর কাব্যিক উল্লেখ আছে কবি খায়রুল আহসান-এর "ভয় পাই" শীর্ষক কবিতাটিতে l কবিতার কথক বলছেন তিনি যানজটকে ভয় পান l রাস্তায় গাড়িঘোড়া আজকাল এত বেড়ে গেছে যে যানজট, জ্যাম এখন নিত্য ঘটনা l কোনো গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হলে পথ বন্ধ হয়ে যানজট হয় l আবার আন্দোলনকারীদের পথ অবরোধের কারণেও যানজট হয় l ঘণ্টার পর ঘন্টা গাড়ি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে l যাত্রী সাধারণের চরম দুর্ভোগ হয় l এরকম যানজটে আটকে গেলে, যখন কোনোদিকেই যাওয়া যায় না, অস্বস্তি হয় l মনে হয়, যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে l
আবার বাড়ির কাছাকাছি রিকশায় করে ঘোরা কোনো আগন্তুক যখন মাইকে নির্লিপ্ত ঘোষণা দেন, তখন কবি ভয় পান l ভিতরটা তাঁর আঁতকে ওঠে l কারণ এরকম অভিজ্ঞতা অতীতে তাঁর হয়েছে যে এজাতীয় ঘোষণা তাঁকে তাঁর পরিচিত কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়েছে l চেনা মুখের চিরপ্রস্থান তাঁকে ব্যথিত করে বলেই এরকম ঘোষণা কানে এলেই তিনি ভয় পান l
দূরদেশ থেকে কোনো স্বজন দেশে ফিরবেন l বহুদিন পর আত্মীয় পরিজন সকলে মিলিত হবেন l  এই আনন্দে সকলে যখন উদ্বেল, তখন আচমকা আসে দুঃসংবাদ ! কোনো দুর্ঘটনায় প্রবাসী স্বজনের জীবনাবসান হয়েছে l কাঠের তৈরি ঠান্ডা কফিনে এসে পৌঁছয় তার নিথর দেহ এবং লাগেজ l এই অভিজ্ঞতা হয়েছে জীবনে কয়েকবার l প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ l ফলে যখনই কথক কবি প্রবাসী কোনো স্বজনের ঘরে ফেরার কথা শোনেন, এক অজানা আশঙ্কাকে কিছুতেই তিনি মন থেকে দূর করতে পারেন না l
অসুখবিসুখ জীবনে লেগেই আছে l বড়ো রকমের অসুখ হলে মানুষ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয় l সেখানে চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে অনেকে বাড়ি ফিরে যায় l অনেকের সে সৌভাগ্য হয় না l হাসপাতালে ভর্তি হবার পর একজন রোগীর  আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কম দেখা হয় l সে থাকে ডাক্তার, নার্স, আয়া মাসীদের তত্বাবধানে l সবুজ এ্যাপ্রন পরা নির্বাক নার্স স্ট্রেচার ট্রলীতে করে মুমূর্ষ রোগীকে দ্রুতবেগে অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যান l  অপারেশনের আগে রোগীকে অজ্ঞান করা হয় l  তার নাক, মুখ মাস্ক দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় l পুরো বিষয়টা বিবশ রোগীকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় l এক অনিশ্চিত প্রত্যাশায় কাতর চোখে শূণ্যে তাকিয়ে অপলকে সে  দেবতাকে খোঁজে। হয়তো অচেতন অবস্থাতেই তার জীবনের ব্যথাহীন অন্ত হয়ে যায় l
আত্মীয় স্বজনদের হাসপাতালে দেখতে গিয়ে এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন সকলকেই হতে হয় l তাই যখনই কবি কোনো অসুস্থ স্বজনকে দেখতে হাসপাতালে যান, প্রচন্ড এক ভয় তাঁকে পেয়ে বসে l
জীবন অনিশ্চয়তাপূর্ণ l প্রতি পদে রয়েছে বিপদের আশঙ্কা l কিন্তু তাই বলে ভয় পেয়ে চিরকাল ঘরে থাকাও চলে না l কারণ, তাহলে জীবন অচল হয়ে যায় l আর বিপদের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, নিজের ঘরও সর্বদা বিপদমুক্ত নয় l সেখানেও ভয় আছে l সুতরাং সাবধান হতে হবে সেখানেও l
ভয় পাওযার একটি সদর্থক দিক হলো এই সাবধান হবার বিষয়টি l যেখানে ভয় পাই, সেখানে সাবধান হই l সাবধানতার কারণে অনেকক্ষেত্রে বিপদকে জয় করা সম্ভব হয় l সুতরাং, বলা যেতে পারে, জীবনে ভয় পাবারও প্রয়োজন আছে l
বর্তমান সমাজব্যবস্থায় চারিদিকে ভয় আতঙ্কের বিষয়টা বেড়ে গেছে l কবি তিনটি ক্ষেত্র উল্লেখ করেছেন l কিন্তু এর বিস্তার ব্যাপক l সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ নিত্য ঘটনা l নারী নির্যাতনের সংবাদ প্রায় প্রতিদিন শিরোনামে l শিশু অপহরণ, সাইবার ক্রাইম বিপন্ন করে তুলেছে মানবজীবন l এই সব কিছুর মধ্যে বেঁচে আছি l ভয় তো থাকবেই l তাই সাবধানের মার নেই l ব্যক্তিগত স্তরে এবং সমষ্টিগত  স্তরে l
যুগোপযোগী বিষয়ে সুন্দর কবিতা রচনার জন্য কবি খায়রুল আহসানকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা !!