বাস্তব ঘটনার মধ্যে অনেক শক্তি থাকে l কবিতাসম l সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে এরকম কিছু ঘটনার পেলব বর্ণনা কবিতার পর্যায়ে পৌঁছে যায় l আমাদের চারপাশে প্রতিমুহূর্তেই এরকম বহু ঘটনা ঘটে চলেছে l দেখবার জন্য চাই চোখ, ভাববার জন্য চাই কবিমন l আর তার সঙ্গে প্রতিবেদকের এক আবেগঘন সংযুক্তি l কবিতা যেন নিজেই ধরা দেয় l
কিছু ঘটনা আমাদের অনেকটাই ভাবিয়ে তোলে l চিরাচরিত ভাবনাগুলি যেন দোলা খেয়ে যায় l অতি সাধারণ ঘটনা, নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, সাধারণ কিছু কথাবার্তা, বার্তালাপ - তার মধ্যে যেন উঠে আসে চিরন্তন কিছু সত্য l তার অনুভব এবং কথায় তা প্রকাশ - যেন কবিতার জন্ম হয় l
আসরের কবি মোঃ নিজাম গাজী তাঁর "ছোটবোনের শিক্ষা" রচনায় যেন এরকম এক কবিতার সৃষ্টি করেছেন l
কবিতার মূল বিষয় হলো বিচার-বোধ l বিচারককে হতে হয় নিরপেক্ষ, নিষ্পক্ষ l তিনি ঘটনার বিশ্লেষণ করেন, অপরাধ কার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে সুনিশ্চিত হন, এবং কোনোরকম রাগ অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে, অপরাধীর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও সেই মুহূর্তে সম্পর্কের বিষয়টি বিস্মৃত হয়ে, নিরপেক্ষভাবে রায়দান করেন l একজন বিচারকের কাছে এটাই কাঙ্খিত l
বিচার শুধু বিচারালয়ে হয় না l গোটা পৃথিবীটাই এক বিচারশালা l প্রতিমুহূর্তে পরস্পরের সঙ্গে নানা কর্মে মানুষ আবদ্ধ l এই কাজকর্মের আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে সর্বদা আমাদের একটা বিচারবোধ নিয়ে চলতে হয় l সর্বদা সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোন্-টা করব, আর কোন্-টা করব না l
দেখা যায় বিচারের প্রশ্নে অনেকক্ষেত্রেই আমরা নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে পারি না l সম্পর্কের বাঁধন আমাদের বিচারবোধকে দুর্বল করে দেয় l আলোচ্য কবিতাটিতে যেমন অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষকের বিচার করার প্রশ্নে সঠিক, নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে পারে নি l শিক্ষক তাদের গুরুজন l পিতামাতার সমান l তাঁকে শাস্তি দেবার কথা তারা ভাবতে পারে নি l গুরু শিষ্যের এই সম্পর্ক সঠিক বিচারের পথে অন্তরায় হয়েছে l কিন্তু কবিতাটিতে শেষ পর্যন্ত বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে নি l
"দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে
শ্রেষ্ঠ সে বিচার l"
এই মহান উপলব্ধিকে পাথেয় করে শিক্ষকের নিজের বোন, শ্রেণীকক্ষে যার সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়, সবচেয়ে আপন - সেই আপনত্বের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সেই ছোট বোন বিচারের বাণী প্রতিষ্ঠা করেছে l তার নিজের দাদা, শিক্ষকও বটে, তাঁর অপরাধকেও সে ক্ষমা করে নি, যথোপযুক্ত সাজা ঘোষণা করেছে, ফাঁসি l যে মুহূর্তে তাকে বিচারকের আসনে বসানো হয়েছে, পার্থিব জগতের সমস্ত সম্পর্ককে সে ছিন্ন করেছে l একজন প্রকৃত বিচারকের ভূমিকা সে পালন করেছে l নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ, ব্যথাকে সে জয় করেছে l মনের ব্যথাকে সে নিজের মধ্যে রেখেছে l তার দ্বারা বিচারকে প্রভাবিত হতে দেয় নি l বিচার ব্যবস্থার যে মর্যাদা - তাকে স্থাপিত করেছে l
মনে পড়ে যায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিচারক বিক্রমাদিত্যের কথা l তার সিংহাসনের কথা l কথিত আছে, বহু বহুদিন পর, যখন বিক্রমাদিত্যের যুগের অবসান হয়েছে, তাঁর সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, তাঁর সিংহাসনটি, যার ওপর বসে তিনি বিচারকার্য সমাধা করতেন, সেই সিনহাসনটি মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল l মাটির ওপরে ঠিক সেই স্থানটিতে ছিল এক ছোট্ট ঢিবির মতো l কিছু বালক সেই স্থানটিতে খেলা করত l তারা বিচার করা খেলত l একজন সেই ঢিবির ওপর বসে বিচারক হতো l এক একদিন এক একজন বিচারক হতো l অন্য বালকেদের মধ্যে একজন অপরাধী সাজত l বাকী বালকেরা সেই অপরাধীর পক্ষে বিপক্ষে সওয়াল করত l একটা বিষয় আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেল, যখনই কোনো বালক সেই মাটির ঢিবিতে বসত, তার মধ্যে এক অদ্ভুত বিচারবোধ চলে আসত l কঠিন কঠিন সমস্যার আশ্চর্য সমাধান করে ফেলত l বিষয়টি জানাজানি হয় l দেশ-বিদেশের বহু বিচারপ্রার্থী সেখানে আসেন l এবং আশ্চর্যের কথা বহু জটিল বিচার সমাধা করে দেয় সেই পুঁচকে বালকেরা, সেই মাটির ঢিবিতে বসে l বিষয়টি সকলেরই কৌতুহল উদ্রেক করে l পরে মাটি খুঁড়ে সেখানে রাজা বিক্রমাদিত্যের সেই সিংহাসনটি পাওয়া যায়, যার উপরে বসলেই সেই বালকেরা এক একজন শ্রেষ্ঠ বিচারক হয়ে উঠত l সিংহাসনটিকে এই কারণে বলা হল "The Seat of Judgement" অর্থাৎ ন্যায়বিচারের আসন l ইতিহাসে, গল্পকথায় এরকম অনেক রাজার কথা শোনা যায় যাঁরা তাঁদের বিচার বিচক্ষণতার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন l যেমন মনে পড়ে রাজা শার্লেমনের নাম l
কবিতাটি পড়ে যেন মনে হয়, সেই ছোট বোনটি ন্যায়বিচারের আসনে বসেছিল l যে কারণে বিচারের রায় দিতে গিয়ে সে দাদার সম্পর্ক বিস্মৃত হয়েছে, শিক্ষকের সম্পর্ক বিস্মৃত হয়েছে - তার সামনে সে দেখেছে একজন অপরাধীকে, যার অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে সে বিচারের রায় ঘোষণা করেছে l শেষ পর্যন্ত বিচারের জয় হয়েছে l


সুন্দর কবিতাটির জন্য কবি  মোঃ নিজাম গাজীকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা !!!