কবি সুদীপ তন্তুবায় (নীল) "কপিরাইট হাসপাতাল" কবিতায় কবিদের চিকিত্সকের জায়গায় রেখেছেন, সভ্যতা ও মানবতা হয়েছে রোগী, এবং কবিতা হলো ওষুধ বা সামগ্রিক চিকিত্সাব্যবস্থা l  
লেখার কপিরাইট থাকে l তার অধিকারী হন লেখক বা কবি l হাসপাতালের কপিরাইট কার ? অবশ্যই তার মালিকের ! সরকারী হাসপাতালের ক্ষেত্রে সরকার l বেসরকারী হাসপাতালের ক্ষেত্রে সেই হাসপাতালের মালিকের l
কবিতার প্রসঙ্গে কথা শুরু করে হাসপাতালের কপিরাইট প্রসঙ্গ এল l কখন ? যখন কিনা কবিতার কথাগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং কবিতার চোখে ঘুম নেমেছে l অর্থাৎ কবিতা দুর্বল হয়েছে l কবিদের ক্ষমতা কমেছে l তেমন ভালো কবিতা আর সৃষ্টি হচ্ছে না l কবিতার কথায় নতুনত্ব নেই l সেই এক ভাব ও শব্দের চর্বিতচর্বণ l এর কারণ কি ? এর কারণ কবিদের মধ্যে প্রেরণার অভাব l প্রেরণার অভাব কেন ? কারণ, কবিরা দেখছেন, তাঁদের কবিতা লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না l ব্যর্থতার হতাশায় কবিদের সাময়িক ক্লান্তি আসছে l প্রেরণার অভাব ঘটছে l কবিতার আবার লক্ষ্য কি ? কোন্ লক্ষ্য সে পূরণ করতে পারছে না ? কবিদের ব্যর্থতার হতাশা আসছে কোথা থেকে ? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কবি দিয়েছেন কবিতাটিতে l তাঁর নিজের মতো করে l  
হাসপাতালের উপকরণ হলো অক্সিজেন মাস্ক, স্যালাইন, প্রেসক্রিপশন, বেড । তেমন জটিল রোগগ্রস্ত রোগী এলে এগুলির ডাক পড়ে l এবং এর সঙ্গে আরো বহু কিছু l নানা ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা, অপারেসন, ওষুধ, ইনজেকশন ইত্যাদি ইত্যাদি l আর কবিতা রচনার ক্ষেত্রে যখন দুর্বলতা ধরা পড়ে, তখন তারও চিকিত্সা প্রয়োজন l কবিতার মৌলিক বিষয়গুলি, কবিতার মূল উপাদানগুলির দিকে নজর দেবার প্রয়োজন হয় l বিষয়, ভাব, আবেগ, শব্দ, কথা, ছন্দ, অলঙ্কার, সর্বোপরি প্রেরণা ইত্যাদির সন্ধান চলে l
মানবতা, সভ্যতা - যুগ যুগ ধরে এগুলি কবিতার বিষয় l সভ্যতা সর্বদা মানবিক থাকে না l অমানবিক অসুস্থতা হয় তার l মানবতা তার অর্থ হারায় l মানুষের আন্দোলনের মিছিলে নেমে আসে দুর্বিনীত শাসকের আক্রমণ l জীবনহানি হয় l কঠিন মাটিতে দেহ লুটিয়ে পড়ে l অষ্টাদশীর দেহলাবণ্য কুড়ে কুড়ে খায় অসুস্থ, কামুক সভ্যতা l প্রকাশ্য সড়কে নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয় লাম্পট্যের তাড়নায় l যৌবন, প্রেম অপমানিত হয় l ভালবাসা হয় লাঞ্ছিত l নারীজাতির লাঞ্ছনার ঘটনা মানবতা ও সভ্যতাকে অসুস্থ করে যেন হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী করে l যেন বলা যায়, উন্নত যে মানবসভ্যতা নিয়ে আমরা গর্ব অনুভব করি তা ফিরে গেছে তার আদিম বর্বর অবস্থায়, শিক্ষার সব বিস্তার অর্থহীন হয়ে ফিরে গেছে প্রাক-প্রাথমিক বর্ণপরিচয়ের চন্দ্রবিন্দু চাঁদ-এ l
জীবনযুদ্ধে সংগ্রামরত সংসারী মানুষগুলো তাদের নিজেদের আখের সামলাতে ব্যস্ত থাকে l সমাজ, সভ্যতা গোল্লায় গেলে তাদের যেন কিছু যায় আসে না l সর্বত্র এক চিত্র - লোকালয় থেকে শ্মশান l ঈশ্বরও যেন এই ব্যবস্থার শরিক - তাঁর নিজের হিসাব বুঝে নিতে ব্যস্ত l


এই অসুস্থ সভ্যতার, এই বিকৃত মানবতার চিকিত্সার প্রয়োজনে হাসপাতাল কথাটি আসে l যুগ যুগ ধরে সভ্যতা ও মানবতাকে সঠিক দিশা দিয়ে আসছেন, যেন তার চিকিত্সার কাজে নিয়োজিত আছেন যত কবিকুল l যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছে কবিদের l সভ্যতা যেন গিলে খাচ্ছে l কাকে ? মানবতাকে l কেমন করে ?  বিকৃত করে, যেন অ্যালকোহলে পরিণত করে l
সেই মাদকাসক্ত সভ্যতার চিকিত্সাকল্পে কবিরা যুগ যুগ ধরে লিখে চলেছেন তিমিরনাশী রচনা সম্ভার l অনুরাগী পাঠককুল, মুগ্ধ কাব্য আলোচকেরা সেই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দিয়েছেন l যেন ফলমূল হাতে আত্মীয়রা হাসপাতালে এসেছেন অসুস্হ রোগীর সঙ্গে দেখা করতে এবং তার আরোগ্য কামনায় l কবিতার মন্তব্যে, তার আলোচনায় কোটি কোটি শব্দ খরচ হয় l হাসপাতালে রোগী দেখতে এসে সৌজন্যমূলক, পরামর্শমূলক কতো কথা হয় l অসুস্থ সভ্যতার সুস্থতার লক্ষ্যে কবির সঙ্গে পাঠক, আলোচকরাও নানা কথা বলেন l কিন্তু এই প্রয়াস কখনো কার্যকর হয়, অনেক সময় আবার হয়ও না l হাসপাতালে চিকিত্সা চলাকালীন অবস্থায় যেমন অনেক রোগী মারাও যান l মেনে নিতে হয় সেটা l
অনেক সময় আবার সমস্ত প্রয়াস ব্যর্থ হলো দেখে হতাশা আসে l হাসপাতালে ক্ষোভ বিক্ষোভ হয় l কবিরা যখন দেখেন তাঁদের সমস্ত সাধু প্রচেষ্টা বিফলে যাচ্ছে, সমাজ, সভ্যতা, মানবতাকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁরা ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন হতাশায় কবিরা ভেঙে পড়েন l কবিতা ছুটি চায় l দড়ি চায় আত্মহত্যা করবে বলে l
অনেক ভালো কথা যখন বিফলে যায়, কথা হারিয়ে যায় l নতুন করে কথা বলার উত্সাহ থাকে না l কথার এই বিবর্ণতায় কবিতার চোখে ঘুম নামে l


তাহলে কি কবিরা পরাজিত ? কবিতা কি হাসপাতাল বন্ধ করে ছুটিতে গেছে ? নিদ্রায় শায়িত ?
তা নয় l ঘুম-কম্বলের এই বিরতি সাময়িক l কবিরা অভ্যাসবশেই আবার জেগে উঠছেন l সমাজও তাই চায় l দিগন্ত জুড়ে কবিকুল নতুন উত্সাহে হাসপাতালের কপিরাইট অর্জন করেছেন l ঘুম বিসর্জন দিয়ে নতুন উদ্যমে সমাজ, সভ্যতা ও মানবতার চিকিত্সায় কবিরা তাঁদের লেখনীকে সক্রিয় রেখেছেন l
কবিরা ক্লান্ত হন না l তাঁদের ক্লান্ত হতে নেই l


অসাধারণ সুন্দর কবিতা উপহার দেবার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা !!!