ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে 'মরণ' কবিতায়  কবি রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
"মরণ রে,
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান l"
এই কবিতায় কবি জি,এম, হারুন-অর-রশিদ বলছেন,
"যদি মরে যাই মরণকে ভালোবেসেই মরবো।"
কবিগুরু আরও বলছেন,
"দিবস ফুরাওল, অবহুঁ ম যাওব,
বিরহতাপ তব অবহুঁ ঘুচাওব,
কুঞ্জবাটপর অবহুঁ ম ধাওব,
সব কুছ টুটইব বাধা l"
আর বর্তমান কবিতায় কবি বলছেন,
"যদি মরে যাবার আগে একটু সময় পাই
তবে আমার বুকটা
একেবারে খালি করে দিবো নিমেষেই।"
মৃত্যুচিন্তা মানুষের এক স্বাভাবিক অনুধ্যান l যত বয়স বেড়ে চলে, আমরা মৃত্যুর নিকটবর্তী হই l মৃত্যু আসার আগে শরীরে তার কিছু ছাপ পড়তে শুরু করে l আমাদের এই দেহে সেই লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করলে আমরা সেটা অনুভব করি l আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন নিজের শরীরকে একটু একটু করে বুড়ো হয়ে মৃত্যুর পথে যেতে দেখি l জন্মাবধি যে শরীর সঙ্গ দিয়ে আসছে সব কাজে, সব বয়সে - তার সঙ্গে এক সখ্যতা গড়ে উঠেছে, এক আপনত্বের অনুভব ! তাকে চোখের সামনে নিত্যদিন এভাবে বুড়িয়ে যেতে দেখে তার প্রতি করুণা হয় l পরম মমতায় তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে হয় l জীবনযুদ্ধে ব্যক্তির হয়ে সে অনেক সংগ্রাম করেছে, অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা সহ্য করেছে l শরীরে পড়েছে তার ছাপ l তার সেই ব্যথা, ক্লান্তি দূর করার প্রয়াস হয় স্নেহভরা কোমল হাতের পরশে l
এইভাবে বয়সভারে ন্যুব্জ দেহে প্রতিদিন হাত বুলাতে বুলাতে বয়স আরো বেড়ে যায় এবং একদিন সত্যিই মৃত্যু এসে হাজির হয় l মৃত্যুকে রোধ করা সম্ভব নয় l যা জন্মেছে, তাকে অবশ্যই একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে l কিন্তু আমাদের এই জীবন নিয়ে আমাদের অনেক ভাবনা থাকে l মরে যাবার আগে কিছু করণীয় থাকে l বেঁচে থাকার তাগিদেই জীবনভর বহু কাজ আমাদের করতে হয় l তার মধ্যে ন্যায়, অন্যায় - উভয়ই থাকে l শেষ যাবার আগে নিজেকে, নিজের সত্তাকে শোধন করার বাসনা জাগে l তখন জীবনের যা কিছু প্রাপ্তি, যা কিছু সঞ্চয় - তার শ্রেণীবিভাগ করে, একটির সঙ্গে নিজের একাত্মভাব অনুভব করা এবং অপরটিকে অস্বীকার করার প্রবৃত্তি হয় l দেহ এবং আত্মাকে পৃথক করে নিতে হয় l মৃত্যুতে দেহের বিনাশ হয় এই বোধ আসে, কিন্তু
"আমার বুকের গাঙচিল উড়ে যাবে কোন এক আকাশে,
আমার বুকে কিছু অভিমান আর বিরহ
তখনও জীবিত থাকবে,
আর থাকবে কিছু দুঃখ, কষ্ট,
ভালোবাসা আর কিছু অভিযোগ,
আর থাকবে একটা লুকানো অমানুষ।"
অর্থাৎ দেহের মৃত্যু সত্ত্বেও সেই মানুষটিকে ঘিরে তার কিছু গল্প, তার দুঃখ, কষ্ট, ভালবাসা, অভিযোগ - কিছু খ্যাতি, কিছু অখ্যাতি এই ধামে থেকে যাবে l
এখানেই আসছে ব্যক্তির পছন্দের প্রশ্ন l তিনি সারা জীবন ধরে জীবিকা নির্বাহের স্বার্থে যত ন্যায়, অন্যায় কাজ করে থাকুন, মৃত্যু-পূর্বকালে তিনি সেগুলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস করেন l নিজের "লুকানো অমানুষ" সত্তার সঙ্গে দূরত্ব স্থাপন করেন l তাঁর সজ্ঞান সত্তায় এই অমানুষ ছিল না, ছিল লুকিয়ে। তার কোনো দায় না নিয়ে তাকে ছেড়ে দেন তার নিজের হাতে,
"বুকের লুকোনো  অমানুষটা ছটফট করে
অভিশাপ দিবে দুনিয়ার সব মানুষকে,
আর অনায়াসে খুঁজে নিবে অন্য বুক।"
আর নিজের যে মনুষ্য সত্ত্বা, মনুষ্যত্ব, তাকে দিয়ে যেতে চান উত্তরসুরীকে l তিনি চান পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে তাঁর সুকীর্তির জন্য মনে রাখুক, তাঁর অপকর্মের জন্য নয়,
"যদি একটু সময় পাই ,
তবে কোন এক নবীন কবিকে দিয়ে যাবো
আমার সব অভিমান আর বিরহ,
যদি কবির বুকটা আর একটু বড় পাই
তবে দুঃখ আর কষ্টগুলোও দিয়ে দিবো,"
আর ভালবাসা - তার কতো রূপ l প্রণয়ের যে ভালবাসা, সে তো কেবল বিশেষ একজনের জন্য l তার জন্য সব ভালবাসা উজাড় করে দিবেন l
"আর "ভালোবাসা" দিয়ে যাবো
কোন এক"মনোলীনাকে"।"
মৃত্যুর পরেও সেই ভালবাসার জন তাঁকে পরম আন্তরিকতায় স্মরণ করবে এই সন্তোষ নিয়ে, হাসিমুখে, পরম তৃপ্তির বোধ নিয়ে তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন l
যাপিত জীবন সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ থাকবে কি ? হ্যাঁ, অভিযোগ আছে l কিন্তু সে অভিযোগ কারো কাছে জমা হবে না l গাঙচিল-এর ডানায় ভর করে অভিযোগরাশি মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে l
"শুধু অভিযোগগুলো বেঁধে দিবো
গাঙচিল এর ডানায়,"
জীবনের শেষ দিনগুলোতে মৃত্যু নিয়ে যে ভাবনারাশি আচ্ছন্ন করে রাখে মানব মনকে, কবিতায় তার সুন্দর রোমান্টিক উপস্থাপনের জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন !


**
হাত ভুলিয়ে < হাত বুলিয়ে
হাত ভুলাতে ভুলাতে < হাত বুলাতে বুলাতে
ভালোবাসাআর কিছু < ভালোবাসা আর কিছু
দুঃখ আর কষ্ট গুলো ও < দুঃখ আর কষ্টগুলোও
অভিযোগ গুলো বেধে < অভিযোগগুলো বেঁধে
গাঙচিল এর < গাঙচিল-এর
নিমিষেই < নিমেষেই
মরন < মরণ