কবি সাবরিনা জাহান তাঁর "এ দেশ তোমার নয়" কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরাধীনতার বেদনা l
মানুষের জীবনে এই পরাধীনতা নানা রূপে নানা সূত্র থেকে নেমে আসে l ব্যক্তির নিজের জীবন থেকে এর শুরু l তারপর ক্রমে পরিবার, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রব্যবস্থা হয়ে পররাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজ স্বাধীনতা হারানো পর্যন্ত তার বিস্তার l
স্বাধীনতা অর্থ নিজের অধীন থাকা l এখান থেকে ভাবতে শুরু করলে দেখা যায় ব্যক্তির পরাধীনতা শুরু হয় তার নিজের থেকে l মানুষ তাঁর ইন্দ্রিয়ের অধীন l ইন্দ্রিয় দ্বারা চালিত মানুষের সংযমশক্তি কম l ইন্দ্রিয়ের নির্দেশে মানুষ জীবনভর একের পর এক ভোগলালসার শিকার হয়ে যেন অন্য কারও জীবন যাপন করে l তার নিজস্ব সত্তা হারিয়ে ফেলে l এখানেই তার পরাধীনতার শুরু l আমরা ভুল করে ভাবি, আমার মন প্রতি মুহূর্তে যা চাইছে, যা প্রকৃতপক্ষে আমার ইন্দ্রিয়ের নির্দেশ, সে সব তাৎক্ষণিক পেয়ে গেলেই আমি স্বাধীন হলাম l প্রকৃতপক্ষে তা নয় l ইন্দ্রিয়ের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা, সার্বিক কল্যাণবোধ ইত্যাদির দ্বারা পরিচালিত হয়ে ব্যক্তি যদি তার কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনটি তার পাওয়া উচিত এবং কোনটি নয়, তাহলেই বলা যেতে পারে সেই ব্যক্তি স্বাধীন l জিতেন্দ্রিয় হয়ে ওঠা স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ l
শিশু তার পরিবারে যখন বড়ো হতে শুরু করে, পরিবারের যাঁরা অভিভাবক, শিশুর পিতামাতা, ও অন্য বয়স্ক লোকজনেরা, সেই শিশু কি খাবে, কি পড়বে, কার সঙ্গে মিশবে, জীবনে কেরিয়ার কোন পথে গড়ে তুলবে - ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে নিজেদের পছন্দ সেই শিশুর ওপর চাপিয়ে দিয়ে সেই শিশুর ওপর সর্বদা একটা চাপ বজায় রাখে l পরিবারিক এই শৃঙ্খলের মধ্যে শিশুর নিজের চাওয়া পাওয়ার কোনো মুল্য থাকে না l এটা তার জীবনে পরাধীনতার দ্বিতীয় আস্বাদ l  
এরপর থাকে সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ l নানা অনুশাসনের শৃঙ্খল l সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে সামাজিক অনুশাসন ব্যক্তিকে মানতে হয় l অনেকক্ষেত্রে এই অনুশাসন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মঙ্গল সূচিত করে l কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে যুগে যুগে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের নামে কত অমানবিক ব্যবস্থা অসহায় মানুষজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে l  
দেখা গেছে যে সমাজ যত দ্রুত এই মধ্যযুগীয় অমানবিক, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণকারী ব্যবস্থাগুলি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেই সমাজ উন্নতি ও প্রগতির পথে তত বেশি অগ্রসর হয়েছে l
পরাধীনতার পরবর্তী স্তর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস l রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অনেক ধরন আছে l রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে বর্তমানে বহু দেশ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আপন করে নিয়েছে l কিন্তু গণতন্ত্রের তত্ত্ব যা বলে, ব্যবহারিক গণতন্ত্র তার ধারেকাছে যায় নি l বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি বেশি করে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার l ওপরে গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে l নির্বাচন হয় l কিন্তু প্রতি পদে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রহসনে পরিণত করে একদলীয়, একতান্ত্রিক স্বৈর শাসন চলে l
এতক্ষণ পরাধীনতার যে রূপগুলি বলা হল, এই পরাধীনতাগুলি আপাতদৃষ্ট স্বাধীন ব্যক্তিকে ভিতর থেকে পরাধীন করে রাখে l মনের গভীরে পরাধীনতার এই বোধ নিয়েও সে বাইরে স্বাধীনতার এক খোলস পড়ে থাকে l
কিন্তু মানুষ ভেতরে, বাইরে; বাস্তবে এবং আনুষ্ঠানিকতায় সম্পূর্ণভাবে পরাধীন হয় যখন কোনো পররাষ্ট্র শক্তি অন্য একটি দেশের ভূখণ্ড অধিকার করে এবং সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে l শাসনের নামে বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন সেই পরাধীন জাতির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করতে শুরু করে l এ হল পরাধীনতার শেষ সম্পূর্ণ রূপ l
বর্তমান কবিতাটিতে কবি বলেছেন, যখন একটি স্বাধীন জাতি পরাধীন হয়, কোনো বিদেশী শক্তি সেই দেশ আক্রমণ করে সেই দেশের শাসককে পরাজিত করে তার শাসনভার নিজেদের হাতে নেয়, তখন সেই দেশের অধিবাসীরা ভোগ করতে শুরু করেন পরাধীনতার গ্লানি l নিজেদের কোনো বস্তুর ওপর তাদের অধিকার থাকে না l নিজের ঘর, অর্থ সব বিদেশী আক্রমণকারীদের সম্পত্তি হয়ে যায় l এখন শুধু তাদের দয়ার ওপর টিকে থাকা l গোটা পৃথিবী এই দৃশ্য দেখে, কিন্তু কোনো ভূমিকা নেয় না l নীরব দর্শক হয়ে থাকে l যুগে যুগে, কালে কালে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় l চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে এক উন্নত জাতি এক দূর্বল জাতিকে পদানত করে ও সেই দেশের সম্পদকে নিজেদের বলে দাবি করে l
কখনো অতিথি বেশে আসে বিদেশী শক্তি l তাদের সানন্দে বরণ করা হয় l আশ্রয় দেয়া হয় l আতিথ্য চলে l কিন্তু কিছুদিন পর বণিকের মানদণ্ড রাজদন্ড হয়ে স্বরূপ প্রকাশ করে l তখন আর আশ্রয়দানকারীর প্রতি কোন কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে না l তাকে তার ভূমে পরবাসী করে দেয়া হয় l দেশ দখল হয়ে যায় l কিছু প্রতিরোধ হয় l জীবনহানিও হয় কিছু l কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কিছু বিদেশী শাসকদের হাতে চলে যায় l মানবতা বিপন্ন হয় l নিপীড়ন, শোষণ চলে l দেশীয় শিল্প সংস্কৃতি সব ধ্বংস করে সর্বক্ষেত্রে বিদেশী আগ্রাসন চলে l
নিজেদের জীবন বাঁচাতে, পরিবার পরিজনের সম্ভ্রম বাঁচাতে, অনেকেই স্বদেশ  ত্যাগ করে অন্য দেশে পাড়ি দেয় l


পরাধীনতার বেদনাকে নিপুণভাবে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি l কবিকে জানাই শুভকামনা l