একটি অলীক প্রেমকাহিনী l অলীক বটে l কারণ প্রেম এখানে কোনো নারীর সাথে নয় l এ কোনো চিরাচরিত নারী পুরুষের প্রেমকাহিনী নয় l এখানে পাই কবিতাপ্রেমের কথা l
রূপক কবিতা l রূপক হিসাবেই কবিতার চরিত্রগুলি একের পর এক এসেছে এবং আপাত প্রেমকাহিনী বর্ণনের মধ্যে দিয়ে চিরাচরিত কবিতাসৃজনের যে প্রক্রিয়া তা  উপস্থাপন করা হয়েছে l
যে কোনো নতুন সৃজনের কিছু পূর্বশর্ত থাকে l থাকে প্রেমের উন্মেষ l থাকে পাত্র পাত্রী l থাকে উভয়ের উন্মাদনা l পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ l থাকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির অনুমোদন l প্রয়োজন সৃজনপ্রয়াস, সৃজনশক্তি l এই সৃজনশক্তি উপযুক্ত উত্তেজনা পেলে বিকাশোন্মুখ হয় এবং নব নব সৃষ্টিতে জগৎ সমৃদ্ধ হয় l
যুবা অশ্ব এখানে কবির রূপক l তার অশ্বশক্তি কবি - প্রতিভার l সমুদ্র তার প্রেরণা, এবং প্রেমিকা l
সেই প্রেরণার আকর্ষণে কবি বিবাগী, বেহুঁশ l চোখ বিস্ফারিত l পৌরুষত্ব সৃজন সঙ্কল্পে উন্মুখ l ছুটে চলে তার উদ্দিষ্ট  সমুদ্রের পানে l
পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি কবিতা সৃজন প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে l উদ্ভিদ মর্মরধ্বনি করে কবিকে সঙ্গ দেয় l গাছের শাখাগুলি দোল খেয়ে কবির মনে দোলা দেয় l প্রকৃতির যাবতীয় রহস্য, যুগযুগান্তর ব্যাপী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তুষের আগুনের মতো কবি প্রতিভাকে ধীরে ধীরে প্রজ্বলিত করে l একটি নতুন সৃষ্টির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছান কবি l একক কবি সম্ভাবনাহীন l কিন্তু তাঁর প্রতিভা, প্রয়াস, আনুষঙ্গিক সহযোগ, ঈশ্বরের আশীর্বাদ সব জুড়ে যায় l   বিপুল বিস্ময়ে অবলীলায় ভাবতরঙ্গে দোল খেয়ে কবির কবিতায় যাপন চলে l
কবির কাব্যপ্রেরণা নানারূপে তাঁকে উদ্দীপিত করে l নব নব ভাব কবির মনকে স্পর্শ করে l কবির কোনো বয়স হয় না l সব বয়সের উপযোগী বিচিত্র ভাব কবির মনকে আন্দোলিত করে এবং ভাষা ও ভাবের খেলায়, কাব্য সৃজনের অলীক উন্মাদনায় কবি মেতে ওঠেন l
ভাবের সঙ্গে বোধের সঙ্গম চলে l চলে প্রতিভার সঙ্গে প্রেরণার মিলন l একটি সার্থক কবিতা সৃজন একটি নতুন জীবন সৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয় l এখানেও মিলনের উত্তেজনা, প্রতিভা ও প্রেরণার মিলনসুখ, কবিতাসৃজনের প্রসবযন্ত্রণা ভোগ, কবিতা-ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্তি, এবং এক সার্থক কবিতার আত্মপ্রকাশ l
কবিতা সৃজনকালে কবি যেন ভাবের ঘুমে নিদ্রা যান l নিবিড় আবেগে তাঁর দু চোখ বুজে আসে l গাছের শাখার দোলা, পাখির কূজন, পারিপার্শ্বিক অরণ্যপ্রকৃতি, সবকিছু যেন কবিতা সৃজনের এক অনুরূপ পরিবেশ গড়ে তোলে l কবিকে ভাবপ্রাচুর্যে মত্ত করে তোলে l সেই মত্ততায় কবি জগৎসংসারের সব দায়বদ্ধতা ভুলে গিয়ে তাঁর সৃজনজগতে বিচরণ করেন l নানা ভাবের কবিতা লেখা হয় l যৌবন উন্মাদনা সৃষ্টির মধ্যে বিকশিত হয় l কবি তাঁর সৃষ্টি সময়কে অর্পণ করেন l
কবিতা সমাজে গৃহীত হয় নবজাতক সন্তানের স্নেহ ভালবাসায় l সমাজপরিবারের সকলে কাছে এসে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাসে তাঁদের ভালোবাসা জ্ঞাপন করেন l পরম স্নেহে কবিতার স্রষ্টা কবির প্রতি সকলে শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ বর্ষণ করেন l সাথী কবিগণ কবিকে আলিঙ্গন করেন l
কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া রহস্যময় l কখনো মিলনের আনন্দ কবিতার জন্ম দেয় l কখনো আবার বিরহের যন্ত্রণা l কিছু কবি মিলনের সুখ পান না l বিরহযন্ত্রণায় কষ্ট পান l এই যন্ত্রণা তাঁর কাব্যপ্রেরণা হয় l বিরহের মাঝে তিনি খুঁজে পান বিচিত্র কাব্যবিষয় l এই প্রাপ্তি কবিকে সৃজনশীল করে l অনুপম স্বাদের কবিতার জন্ম দেন কবি l
কবি তাঁর কাব্যসৃষ্টির মত্ততায় এতটাই মগ্ন থাকেন যে জাগতিক জগৎ অনেক পিছনে ছুটে যায় l তিনি দৈনন্দিন কর্মের জগতে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন l দায়বদ্ধতার প্রশ্নে তিনি পিছুটান অনুভব করেন l মনে হয় অনেক কর্তব্য তিনি করে উঠতে পারেন নি l দৈনন্দিন জীবনের পরিবারিক, সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁকে পিছুডাকে l সময় থাকতে কিছু জরুরী কাজ সেরে তোলার ব্যপারে সতর্ক করে l
কাব্যচর্চা, তার জন্য শ্রম, মেধা, সময় ব্যয় কবিকে জাগতিক জগতে লাভবান করে না l প্রতি পদে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন l তাই এই পথ ত্যাগ করার, ভুলেও পুনরায় এই পথে না আসার জন্য তিনি ভেতর থেকে এক আহ্বান শোনেন l
যার আহ্বানে তিনি বারে বারে এই পথে বিচরণ করেন, সে সব মরে গেছে এই ভাবনা নিয়ে চলার আহ্বান আসে ভেতর থেকে l ভুল করে এপথে এসেছিলেন l কাব্যচর্চার পথে ক্ষণিকের পথিক অতিথি ছিলেন এই বোধ জন্ম নেয় l এই ভুল পুনরায় না করে জগৎসংসারের লাভজনক কাজে মনোনিবেশ করার জন্য নির্দেশ পান তিনি l
কবি এখানে এক অতি বাস্তব ইঙ্গিত করেছেন l বলা হয়, কিশোর বয়সে, প্রথম যৌবনে সব বাঙালির মনেই কবিভাব জেগে ওঠে l কবিতা লেখাও শুরু করেন অনেকেই l কিন্তু ধীরে ধীরে, যেমন যেমন বয়স বাড়ে, কবির সংখ্যা কমতে থাকে l জাগতিক নানা হিসাবনিকাশ তাদের বাস্তববাদী করে তোলে এবং কবিতার পথ ছেড়ে এদের অনেকেই জীবন জীবিকা অর্জনের জন্য ভিন্ন পথ ধরে l অল্পক্ষণের জন্য কবিতার জগতে অতিথি পথিক হিসাবেই এদের মান্যতা থাকে l সামান্য কয়েকজন কবিতার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ থাকেন যাঁরা এইসব বৈষয়িক হিসাবকে গ্রাহ্য করেন না l লাভ-ক্ষতির আপাত হিসাবরহিত এই কবিকুল আজীবন কবিতার পথ আঁকড়ে থাকেন l
এই যে নিবেদিতপ্রাণ কবিকূল, তাঁরা জীবনের সব ঝড় ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে কবিতাচর্চার পথে থাকেন l কাব্যদেবীও তাঁদের প্রতি প্রসন্ন থাকেন l বিচিত্র কাব্যভাবের টলোমলো ধারা প্রবল বেগে বর্ষিত হয় তাঁদের কবি কল্পনায় l সেই কাব্যভাবকে প্রবল আবেগে আলিঙ্গন করে কবিতার বিষয়কে কথায়, সুরে, ছন্দে মূর্ত করে তোলেন কবি l সৃজন আনন্দে বিভোর থাকেন তিনি l প্রাণভরে সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করেন l পারিপার্শ্বিক জগৎ তাঁর সাধারণ বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে কি সঙ্কট সৃষ্টি করে তুলেছে সেদিক লক্ষ্য থাকে না তাঁর l বিপদ বেড়ে চলে l কিন্তু আরো দৃঢ়ভাবে কাব্যচর্চার পথ আঁকড়ে থাকেন তিনি l শেষ পর্যন্ত তাঁর সাধু প্রয়াস জয়যুক্ত হয় l সমস্ত বাধাবিপত্তি জয় করে দিনের শেষে অমর কাব্য আত্মপ্রকাশ করে l
জগৎপ্রকৃতি কাব্যপ্রচেষ্টার সফল প্রয়াসের আনন্দ উদ্-যাপনে শরিক হয় l আকাশে গাঙচিল ওড়ে l তার প্রতিবিম্ব জলে ফুটে ওঠে l মাঝিমাল্লা, পর্যটকের কলরোলে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে l নদীতীরে, সাগরতীরে সবুজশোভিত গাছের গোড়ায় দুরন্ত জলতরঙ্গ ছলছল শব্দে আছড়ে পড়ে এই আনন্দকে শতগুণ বাড়িয়ে তোলে l
রূপক কবিতায় নানা অনুসঙ্গ ব্যবহার করে কবি যেভাবে কবিতাচর্চার সামগ্রিক বিষয়কে অত্যন্ত সুচারুভাবে কবিতায় এনেছেন, তার জন্য কবি মৌলিক মজুমদারকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই l