কবি শ্রী সঞ্জয় কুমার মুখোপাধ্যায় "আত্মগরিমার ইতিকথা" কবিতাটিতে মানুষের জীবনাচরণে অহংকার বিষয়টি যে পরিত্যাজ্য এবং সহনশীলতা বিষয়টি শিক্ষণীয় - এই বার্তা তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন l বাস্তবতার নিরিখে তার পর্যালোচনা করা যায় l
মানুষের ব্যক্তিত্ব তার অহং ও বিনয়ের সমষ্টি l সমাজে নিজের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে চলতে হলে মানুষকে এই দুয়ের মধ্যে সংযোগ সাধন করে চলতে হয় l যেমন অতিরিক্ত বিনয় সঠিক নয়, কারণ ক্ষেত্রবিশেষে সেটি ব্যক্তির দুর্বলতা হিসাবে পরিগণিত হয়ে যেতে পারে l এরকম কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে অবশ্যই তাঁর অহম্ প্রয়োগ করতে হয় l তেমনই সর্বক্ষেত্রে অহম্ এর অতিমাত্রায় প্রদর্শন ব্যক্তিকে অহংকারী স্বৈরাচারী করে তোলে l রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, সমাজজীবনে যা নিন্দিত হয় l
পুরাণের গল্পে পাই, ব্রম্ভা, এক বিষধর সাপ যার দংশনে বহু মানুষ মারা যাচ্ছিল, তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন এই হিংসার জীবন পরিত্যাগ করতে l ব্রম্ভার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে সেই সাপ শান্তির জীবন গ্রহণ করেছিল l আর কাউকে দংশন করত না l কিন্তু ছেলেমেয়েরা এটিকে সেই সাপের দুর্বলতা মনে করল l ভাবল, সাপটি বুড়ো হয়ে গেছে l তাকে সকলে ঢিল মারতে শুরু করল l সাপটির মরণাপন্ন অবস্থা l ব্রম্ভা এই অবস্থায় সাপটিকে যখন দেখলেন, তাকে বললেন, তিনি দংশন করতে বারণ করেছিলেন, ফণা তুলতে বারণ করেন নি l আত্মরক্ষার জন্য জীবনে ফণা তুলবার প্রয়োজন আছে l এবার যখন সেই সাপটি ছেলেদের উদ্দেশে ফণা ধরল, ছেলেরা ভয়ে পালিয়ে গেল l সাপটিও রক্ষা পেল l তাকে আর কেউ বিরক্ত করত না l
মহাকাব্যগুলিতে আমরা এইরূপ আদর্শ জীবনাচরণের শিক্ষা পাই যেখানে ব্যক্তিত্বের সুচারু ব্যবহার দেখা যায় l একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে l তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই তাকে তাঁর জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণ  করতে হয় l যা একজন ব্যক্তিকে মানায় না, তাঁর ব্যক্তিত্বের এরকম কৃত্রিম প্রকাশ অশোভন l হয়তো অন্য কোনো ব্যক্তিত্ববান ব্যক্তির নকল করেন তিনি l কিন্তু তা কার্যকর হয় না l তার অভিনয় ধরা পড়ে যায় l তিনি অপদস্থ হন, অপমানিত হন l
আদর্শ জীবনাচরণের কিছু মানদণ্ড আছে l বেশি অহংকার প্রকাশ করতে হয় না l নিজমুখে নিজের প্রশংসা করাও শোভন নয় l প্রশংসা অপরের মুখ থেকে হওয়াই শ্রেয় l ইতিহাস সাক্ষ্য আছে কত আত্মগর্বী মানুষের কত পদস্খলনের l একের অহংকার ধিকৃত হয় l কিন্তু সেই আত্মগরিমা যদি দশের জন্য, দেশের জন্য হয় তাহলে তার মর্যাদা থাকে, মাধুর্য থাকে l


জগতে যা কিছু মহৎ, যা কিছু বিশাল, সূর্য, চন্দ্র, আকাশ, বাতাস - সব পরার্থে নিবেদিতপ্রাণ l তাদের মিথ্যা অহং নেই l মহৎহৃদয় ব্যক্তিগণ এরকম l কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষকে মিথ্যা অহংকার পেয়ে বসে l জীবনভর তাঁরা এই অহংকারের বশে নিজ আত্মাকে অস্বীকার করেন l জীবনের শেষ হয় l এই সঙ্গে অবসান হয় অহংকারের l মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার জায়গা থেকে তাঁরা চিরকালের জন্য মুছে যান l
অতি অহংকার তাই পরিত্যাজ্য l দেশ ও দশকে সঙ্গে নিয়ে, সমাজের বৃহত্তম স্বার্থে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সহনশীলতার শিক্ষা আবশ্যক l


কবিতার মাধ্যমে সুন্দর বার্তা দেবার প্রয়াস করেছেন কবি l কবিকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা l