মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের চরিত্র বদল হয় l যখন কৈশোর চলছে, তারপর যৌবনে পা দিচ্ছে, তখন সুন্দর পুরুষ বা সুন্দর নারী পরস্পরের প্রতি যে আকর্ষণ অনুভব করেন, তা কোনো যুক্তি তর্কের ধার ধারে না l এটা পৃথক বিষয় এই আকর্ষণের কথাটা সবসময় প্রকাশ করা যায় না, করা হয়ে ওঠে না নানা কারণে l কিন্তু কবিতায় প্রেমের এই ভাব প্রকাশ করতে তো কোনো বাধা নেই l প্রেমিক কবিদের তাই একটা বড়ো আশ্রয়স্থল হলো কবিতা যেখানে অবদমিত সব প্রেমের ভাবকে সুন্দর কথায়, ছন্দে ব্যক্ত করা সম্ভব l
বলা হয় - প্রেম অন্ধ l বলা হয় - প্রেমেতে মজিলে মন / কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম l একেই বলা হচ্ছে - প্রেমে পড়লে তখন আর যুক্তি তর্কের বোধ তেমন কাজ করে না l একবার যাকে ভালো লেগে যায়, তার কোনো দোষ চোখে পড়ে না l সমাজসিদ্ধ চিরাচরিত পর্যবেক্ষণ প্রেমিক কবির চোখে কোনো গুরুত্ব পায় না l সে তার নিজের প্রেমভাবে তখন এতটাই নিমজ্জিত যে সে তার প্রেমকে সুন্দর প্রমাণ করবার জন্য কাব্যিক, রোমান্টিক যুক্তি একের পর এক উপস্থাপন করে, অদ্ভুত সুন্দর সব চিত্রকল্প ব্যবহার করে এবং অন্য লোকে যাই বলুক, নিজের প্রেমের প্রতি বিশ্বাসে, ভালোবাসায় সে স্থির থাকে এবং দৃঢ় কণ্ঠে তা ঘোষণা করে l
এক বাদল সন্ধ্যায় ময়নাপাড়ার মাঠে কবি তার ভালোবাসার জনকে দেখতে পান l গায়ের রঙ কালো তার, গাঁয়ের সবাই তাই বলে l কিন্তু কবির প্রেমের কাছে তা হার মানে l কালোর মধ্যেই তিনি অপরূপ এক সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন, নামকরণ করেন "কৃষ্ণকলি" l কবি নিশ্চিত হন তার চোখ দুটো হরিণের চোখের মতো সুন্দর l কবি যুক্তির পর যুক্তি, চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প ব্যবহার করে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন, তার গায়ের রঙ কালো হলেও সে অপরূপ সুন্দরী l সে ঘোমটা ব্যবহার করে না, তার খোলা চুল পিঠের ওপর লুটিয়ে পড়ে l শ্যামলা রঙের দুই গাভীর ডাকে সাড়া দিয়ে ত্রস্ত পায়ে সে কুটির থেকে বেরিয়ে আসে l আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বাদলা মেঘের গুরু গুরু ডাক শোনে l তার কালো হরিণের মতো চোখ কবির কাছে দৃশ্যমান হয় l পুব দিক থেকে বাতাস ধেয়ে আসে l ধানের ক্ষেতে ঢেউ তোলে l কবি জমির ধারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন l তিনি নিশ্চিত নন হরিণ চোখ তাঁর ওপর পড়েছে কি না l
যখন জৈষ্ঠ্য মাসে ঈশান কোণে কাজল কালো মেঘ জমে, আষাঢ় মাসে তমাল বনে কালো ছায়া নামে, গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের পর শ্রাবণের কালো মেঘ যখন বৃষ্টির আভাস দেয়, তখন সেই কালো আভা আমাদের মনের খুশি বাড়িয়ে দেয় l তাই অন্য লোকে, গ্রামের লোকে কে কি বলল তাতে কবির কিছু যায় আসে না l ময়নাপাড়ার মাঠে বাদলা সন্ধ্যায়  তিনি তাঁর ভালোবাসার জনের যে কালো হরিণ চোখ দেখেছেন, সেটাই তাঁর কাছে সুন্দরের প্রতিমূর্তি, তিনি তাঁকেই প্রেম নিবেদন করবার জন্য প্রস্তুত l