জীবন সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই l এই জীবনকে ঘিরে কত রকমের দর্শন গড়ে উঠেছে l কত মতবাদ l রাজনীতির ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে, সমাজনীতির ক্ষেত্রে l এক একটি দর্শনে জীবনের ওপর একেক ধরনের অনুশাসন আরোপ করা হয়েছে l কোথাও ভোগবাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, কোথাও কৃচ্ছ্রসাধনাকে l কোথাও কর্মকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে l কোথাও সাধনাকে l এই সব কিছুর মধ্যে জীবন নানা রূপক শব্দাবলীর দ্বারা বর্ণিত l দিনের বিভিন্ন ভাগ জীবনের নানা পর্যায় সূচক l নানা রঙ এক একটি বিমূর্ত ধারণার প্রতীক যা জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট l
নানা ধর্মে ত্যাগ, কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনাকে মহত্ব দেয়া হয়েছে l কিন্তু যুগে যুগে মানবতাবাদী কবি শিল্পীরা জীবনে ভোগের গুরুত্বকেও মহিমা দান করেছেন l জনসংযোগ ত্যাগ করে নির্জন বনাঞ্চলে গভীর কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্যেই একমাত্র জীবন পূর্ণতা পায় ও সার্থকতা লাভ করে - এমনটা তাঁরা মনে করেন নি l কবি রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
"বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ l"
মানুষের সংসর্গ ত্যাগ করে, মানবজীবনের যে সব ছোটো ছোট পাওয়া, তাকে ঘিরে সুখ, দুঃখ, আবেগ অনুভূতি - এগুলিকে বাদ দিয়ে মানবজীবনে সার্থকতার পথ তাঁরা দেখেন নি l
আলোচ্য কবিতাটিতে কবি বলছেন সাধনার পথে গিয়ে তিনি একাগ্র হতে চান না l একাগ্র অর্থাৎ জীবনের সব রূপ রঙ রস সম্পর্ক ত্যাগ করা হবে l মনকে সম্পূর্ণরূপে  মুক্তি বা মোক্ষ লাভের জন্য একাগ্রচিত্তে নিয়োজিত করা হবে l মনের বিচলন থাকবে না l এক স্থানে, একটিমাত্র চরম ও পরম প্রাপ্তির আশায় সাধনায় নিয়োজিত করতে হবে মনকে l  
কবিতায় সকাল এবং রাত দুটি রূপক ব্যবহৃত হয়েছে l সকাল এখানে জীবন শুরুর প্রতীক আর রাত্রি বয়স্ক জীবনের প্রতীক l সকালকে বলা হয়েছে বিধবার সাদা থান কাপড় l সাদা রঙ শান্তি, সরলতা ও পবিত্রতার প্রতীক l শুরুর কালে জীবন শুভ্র, সুন্দর, শান্ত, পবিত্র থাকে l শিশুর সরলতা, পবিত্রতার Allusion আছে এখানে l জীবনের শুরুতে মানবজীবন সরল, পবিত্র থাকে l তারপর সে যত বড়ো হয়, প্রতিযোগিতামূলক এই পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নেবার জন্য তাকে করতে হয় সংগ্রাম l জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার জন্য তাকে অনেক ছল কপটের আশ্রয় নিতে হয় l হিংসা এসে উপস্থিত হয় মানবজীবনে l মানবজীবনের এই কলুষিত স্তরটিকে রাত্রি বলা হচ্ছে এবং হিংস্র বাঘের উপমা দেয়া হচ্ছে l এই নির্মল সকাল বা হিংস্র রাত্রি - সর্বত্রই মানুষ l পরিবেশ, পরিস্থিতি মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় l কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যেও মনুষ্যত্ব বেঁচে থাকে l নানামুখী চালে জীবনপ্রবাহ চলতে থাকে l
কবি কোনো একাগ্র সাধনার মোহে মানব সংসর্গ ত্যাগ করতে চান না l তিনি মানুষের মধ্যে থেকেই পবিত্র মনে জীবনের সকালকে উপভোগ করতে চান, তাকে ফলপ্রসূ করতে চান l
একটি শব্দ আছে পারদ l তাপের মাপক l মানব জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাতে, সুখ দুঃখের নানা অনুভবে উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করে l এই ওঠানামার প্রতিটি স্তরে বিশেষ বিশেষ ধরনের বোধ আসে l এগুলিই জীবনের অনুভব l কবি মানুষের সঙ্গে মিশে এই উত্তেজনা অনুভব করতে চান l নির্জন একাত্ম একাগ্র সাধনার পথ তাঁর নয় l
ভোগের জীবন কবির এখনও শেষ হয় নি l পৃথিবীর মানুষের দেহের সব ক্লান্তি, সবটুকু মদ পান করবেন তিনি l  মানুষের উচ্চাবচ দেহের পারদ আস্বাদ করবেন l
এর মধ্যেই তিনি জীবনের সার্থকতা দেখছেন l
এখনই "শমন" এলে তিনি সাড়া দিবেন না l এটাকে "জ্বালাতন" হিসাবেই দেখছেন তিনি l
সুতরাং কবির প্রার্থনা, চিরকাল তাঁকে মানুষের মধ্যে থাকতে দেয়া হোক l
জীবনমুখী, মানবতাবাদী কবিতা "মানুষের দেহের পারদ" এর জন্য কবি গৌরাঙ্গ সুন্দর পাত্র মহাশয়কে অভিনন্দন জানাই l