কবি পি.কে. বিক্রম "প্রেমময়" কবিতায় এমন এক প্রেমিককে উপস্থাপন করেছেন যে প্রকৃত প্রেমের অনুভব পেয়েছে l প্রেমের এই অনুভব তার মধ্যে এক আবেশ তৈরি করেছে যখন সব কিছুই তার ভালো লাগতে শুরু করেছে l প্রেমিকাকে ঘিরে প্রেমের অনুভবের নানা চিত্রকল্প সৃষ্টির মাধ্যমে কবি এক নিটোল প্রেমের কবিতা উপহার দিয়েছেন l


প্রেম হল ভালোবাসার এক রহস্যময় এবং উত্তেজনাপূর্ণ আবেগ বা অনুভূতি। এটি কোন ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ, আবেগীয় আকর্ষণ এবং তার থেকে উদ্ভূত আনন্দঘন অনুভূতি। গ্রীক সংস্কৃতিতে চার ধরনের  আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে - আগেপ, ফিলিয়া, স্টরজ এবং ইরোস l প্রেমের সঙ্গে ইরোসের সম্পর্ক অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানী চার্লস লিন্ডহোমের সংজ্ঞানুযায়ী প্রেম বা রোমান্স হল "একটি প্রবল আকর্ষণ যা কোন যৌন-আবেদনময় দৃষ্টিকোণ থেকে কাউকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরে l"


প্রেম কবিতার একটি সাধারণ বিষয় l জীবনে প্রেম আসে নি এমন মানুষ যেমন বিরল, তেমনই প্রেম বিষয়ে কবিতা লেখেন নি, তেমন কবিও বোধ করি পাওয়া যায় না l একটা বয়সে মানুষের জীবনে প্রেম আসে l যখন বয়স হয় ষোলো, প্রেমের সময় হল l যখন প্রেম আসে জীবনে, মানুষ একটু অন্যরকম হয়ে যায় l নিজের প্রেমভাবের প্রকাশ করবার জন্য মন চঞ্চল হয় l অনেকে তা সঠিক জায়গায় নিবেদন করতে পারেন l অনেকে পারেন না l সংকোচ জড়তায় আবদ্ধ হয়ে থাকেন l যারা পারেন, তাঁদের প্রেম হয় গ্রহণ হয়, নতুবা বাতিল হয় l প্রেমপ্রস্তাব গৃহীত হলে একরকম l আর যাদের প্রস্তাব বাতিল হয় তারা অন্যরকম l কবিতার জগতে এই উভয় রকমের প্রেমিক কবিরই দেখা মেলে l বিন্দাস প্রেমিক ও হতাশ প্রেমিক l দু ধরনের কবিতাই লেখা হয় l এক একটি কবিতায় এক এক ধরনের মনের অবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে l
ইংরাজি সাহিত্যে এরকম টুকরো প্রেমের বিষয় নিয়ে কবিতা লেখার চল শুরু হয় ষোড়শ শতকে সনেট রচনার মধ্যে দিয়ে l ইংরেজি ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেছিলেন Wyatt এবং Surrey l তারপর পরপর এলেন সিডনি, স্পেন্সার, শেক্সপিয়ার প্রমুখ l
যদিও ইতালিতে চতুর্দশ শতকে  পেত্রার্ক, দান্তে প্রমুখ ইতালীয় ভাষা অর্থাৎ লাতিন ভাষায় এই চর্চা শুরু করেছিলেন l ঊনবিংশ শতকে মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবেশ l
আবির্ভাব লগ্ন থেকে ইংল্যান্ড যাত্রা পর্যন্ত সনেট এর মূল বিষয় ছিলো প্রেম l একটি মহিলাকে উদ্দেশ্য করে সনেট রচনা করা হত এবং প্রেম বিষয়টিকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হত l প্রতিটি কবি যাঁরা সনেট রচনা করেছেন, তাঁদের এক বা একাধিক প্রেমিকা বা প্রেমের উৎস ছিল, যাঁদের উদ্দেশ্য করে সনেটগুলি লেখা হয়েছিল l জুটি করে বললে বিষয়টি এরকম - Petrarch - Laura, Dante - Beatrice, Surrey - Geraldine, Sidney - Penelope Devereux, Spenser - Elizabeth Boyle, Shakespeare - a Dark Lady এবং an aristocratic friend l
উল্লিখিত কবিদের অনেকের প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল l এই প্রত্যাখ্যানের বেদনা নিয়ে তাঁরা লিখে গেছেন একের পর এক অসাধারণ সনেট-কবিতা l যাদের প্রেম মঞ্জুর হয়েছিল, তাঁরাও তাঁদের সুখানুভূতি একের পর এক সনেটে বন্দী করেছিলেন l কিন্তু বলা হয় দুঃখের সনেটগুলি সুখবোধের সনেটগুলি থেকে ভাবে, ভাষায়, ভঙ্গিতে অনেক গভীর l এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ সঠিকভাবেই বলেছেন, "প্রতিটি সার্থক প্রেমের কবিতা বলতে বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে পায় নি, প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে l"


কবি পি. কে. বিক্রম. "প্রেমময়" কবিতায় প্রেমের অনুভবের এই বিষয়টি সুন্দরভাবে মেলে ধরেছেন l নিজের প্রেমের পরিণতি বিষয়ে সে আশাবাদী l প্রিয়ার সঙ্গে প্রেমময়, মধুর মিলনের কল্পনায় সে উদ্বেল l   প্রজাপতি প্রেমের অনুসঙ্গ l প্রিয়ার পরশে সেই প্রজাপতির উপস্থিতির বোধ জাগে l প্রেমের স্পর্শ এক অতিজাগতিক অনুভব নিয়ে আসে l সীমার মধ্যে অসীম বোধ হয় l প্রিয়াকে ঘিরে সমস্ত কিছু সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে ওঠে l ভালো লাগার এক বোধে মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে l  অতিকথনের অভ্যাস তৈরী হয় l প্রিয়ার চোখ জ্বলজ্বল করে l প্রকৃতির নিয়মে অধরের  অসংখ্য স্পর্শে প্রেম যাপনের চর্চা চলে l প্রেমের উত্তেজনা সীমাহীন l তখন সব কিছু প্রিয়াময় l মনের গহন গভীরে ঐ এক নামের অনুরণন চলে শতবার l সবুজ পৃথিবী মায়াবী রূপ ধারণ করে l সেই আলোয় প্রিয়ার মোহিনী রূপ দর্শন করে ভাবালু প্রেমিক l মেঘ রূপ ধারণ করে প্রেমের উত্তাপে প্রিয়ার প্রেমসাগর থেকে সবটুকু ভালবাসা শোষণ করে নেয় প্রেমিক l তখন সব কিছুই প্রেমময় l প্রেমের এই আবেশ সর্বাঙ্গ জুড়ে l মৌন প্রেমিক প্রেমসাগরের অতল গভীরে হারিয়ে যায় l


সুন্দর একটি প্রেমের কবিতা উপহার দেবার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা l


চিত্র:
লা বেল্লে ড্যাম স্যান্স মারসি (১৮৯৩), শিল্পী: জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজ (১৮৪৯-১৯১৭) l ইংরেজ কবি জন কীটস এর কবিতার ওপর আধারিত l