কবিতাটির মধ্যে কবি কখনো ব্যঙ্গের সুরে, কখনো স্বাভাবিক স্বরে বক্তব্য পেশ করেছেন। পুরো বক্তব্যকে স্বাভাবিক স্বরে একমুখী করে নিলে যা পাই, কবি বলছেন,
১) কবিতার সমালোচনা না হলে বুঝতে হবে কবিতাটি লক্ষ্য অর্জন করে নি। ত্রুটিপূর্ণ। সে কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছয় নি। অর্থাৎ কবিতার সমালোচনা কাঙ্খিত।
২) কবিতারা কবির সন্তানের  মত। অনেক সাধ্য সাধনা করে কবিতা রচিত হয়। সেই কবিতা সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত হোক, কবিরা তা মেনে নিতে পারেন না। সব কবিই সমালোচকদের বেজায় অপছন্দ করেন। অনেক কষ্টে ভেবে চিন্তে শব্দমালা রচনা করে সেটিকে ছন্দে বেঁধে কবিরা কবিতা লেখেন। কোথাকার এক উটকো আপদ এসে তাকে পোড়াবে, তাচ্ছিল্যের ধিক্কারে এক ফুঁয়ে ওড়াবে, কবিদের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কঠিন হয়।
৩) স্বয়ং রবিঠাকুরই যখন তাঁর কবিতার সমালোচনা সহ্য করেন নি, বাকি কবিদের কথা বলার আর কি প্রয়োজন !
৪) ১ নং পয়েন্ট এর পুনরুক্তি। শিল্পের প্রয়োজনে কটুকথা / সমালোচনা শোনাটাও বড় দরকার।
৫) যদিও এই সমালোচনার একটি বড়ো অংশ  ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্রুপখোঁচা হিসাবে রচিত। সমালোচকেরা যেটা নিজে পারেন না, সেটিকে খুব সহজেই "খারাপ রচনা" বলে চিন্হিত করে মন্তব্য করে বসেন। এই ঈর্ষাপরায়ণতা, বিদ্রুপাত্মক খোঁচা দেবার স্বভাব মানুষের স্বভাবদোষ।
৬) সব বিরুদ্ধ কথা / সমালোচনা ধ্বংসাত্মক নয়। অর্থাৎ যাকে আমরা বলি গঠনমূলক সমালোচনা, তা ক্ষতিকর নয়। অনেক সময় তার মধ্যে নতুন আলোর দিশা লুকিয়ে থাকে।
৭) শুধু প্রশংসা কবির খুব একটা উপকার করে না। প্রথমদিকে কিছুটা হয়তো প্রেরণাদায়ক, উৎসাহব্যঞ্জক, কিন্তু চেনা বৃত্তে বাহবা পেয়ে কবিদের সৃজনশীলতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যে সব শব্দ এসে মনকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়, মনে ঝড় তোলে, কবি সেইসব শব্দকে কবিতায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দ্বিধায় পড়েন, নতুন প্রয়োগ করবার মতো সাহস পান না l সেসব লিখতে গিয়ে কলম থামিয়ে দেন শুধু তাৎক্ষণিক বাহবা পাবার প্রলোভনে। এই বাহবা না পেলে তাঁর যেন কবিতা লেখার পরিশ্রমটাই বৃথা বলে মনে হয়।
৮) একটি কবিতাকে প্রকৃত অর্থেই যদি ভালো কবিতা হতে হয়, মহৎ কবিতা হতে হয়, তাহলে সেই কবিতাকে, তার ভাব, তার গঠনশৈলী, তার ভাষা, তার অলঙ্কার ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়কে   সমালোচনার আগুনে / সম-আলোচনার কষ্টিপাথরে  যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে।
৯) শুধু চেনালোকের প্রশংসার মোড়কে নিজেকে মুড়লে হবে না। কবিতাকে প্রকৃত কাব্য সমালোচনার অগ্নিপরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে দেখাতে হবে। হীরা যেমন না কাটলে তার দ্যুতি ছড়ায় না, কবিতাও তেমনি যত ব্যবচ্ছেদ হবে তত তার সুষমা ছড়াবে।


কবিতা সমালোচনা প্রসঙ্গে কবি আর্যতীর্থ "সমালোচনা" কবিতাটিতে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে ভারসাম্যমূলক বক্তব্য মেলে ধরেছেন।
কবির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরপর পয়েন্ট অনুযায়ী মন্তব্য করছি l
১ নং, ৪ নং, ৬ নং, ৭ নং, ৮ নং ও ৯ নং পয়েন্ট এ সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করলাম l
২ নং এ সহমত নই l হতে পারে কিছু কবি সমালোচনা সহ্য করেন না, কিন্তু আমার মনে হয় এরকম কবির সংখ্যা খুবই কম l এই আসরেই এমন অনেক কবিকে দেখেছি যাঁরা শুধু প্রশস্তিমূলক মন্তব্যে হাঁফিয়ে উঠেছেন, করজোড়ে প্রার্থনা করেছেন, আসরের প্রাজ্ঞ কবিগণ যেন তাঁদের কবিতা রচনার ভুলত্রুটি ধরে দেন, যাতে করে এই ভুল শুধরে নিয়ে তাঁরা কবিতা চর্চার কাজটিকে  আরো উন্নত করতে পারেন l
৩ নং পয়েন্ট এ বলা হয়েছে, রবিঠাকুর তাঁর কবিতার সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না l কথাটি সঠিক l রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী কবিরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধী গোষ্ঠী l এই বিরোধী গোষ্ঠীভুক্ত কবিগণ রবীন্দ্রকাব্যের নিন্দাসূচক আলোচনা করতেন l যদি রবীন্দ্রভক্ত কেউ এই নিন্দাসূচক আলোচনার বিরুদ্ধে না লিখতেন, তখন রবীন্দ্রনাথ নিজেই আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর রচনার বিরূপ আলোচনার বিপক্ষে কলম ধরতেন l রবীন্দ্রনাথ কেন সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না তার উত্তর আছে ৫ নং পয়েন্ট এ l রবীন্দ্রনাথ একজন মহৎ কবি যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন এক বিশেষজ্ঞ সাহিত্য সমালোচক l ফলে কোনটি সমালোচনা, এবং কোনটি ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্রুপখোঁচা - সেই বোধ রবীন্দ্রনাথের ছিলো l শুধু ঈর্ষাবশত রবীন্দ্রনাথের বহু কাব্য কবিতার অনৈতিক অন্যায় সমালোচনা হয়েছিল l বিশেষ করে করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় l এই ধরনের সমালোচনাকে রবীন্দ্রনাথ অপছন্দ করতেন l


কাব্য কবিতার আলোচনা করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি আলোচকের ধাপে ধাপে করা সমীচীন বলে মনে হয়,
১) যে কবিতাটির আলোচনা করা হচ্ছে তার কাব্যরস উদঘাটন করা l অর্থাৎ কবিতাটির পাঠোদ্ধার করা l নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে এটি করতে হয় l  
২) এক্ষেত্রে আলোচককে কিছু পরিমাণ কল্পনার আশ্রয় নিতে হতে পারে, কারণ কবিতায় অনেক সময় কিছু বিষয় স্পষ্ট বলা থাকে না l যদিও কবিতাটির মধ্যে তার ইঙ্গিত থাকতে পারে l এই ইঙ্গিত কখনো স্পষ্ট, কখনো একেবারেই ধোঁয়াশা। এই বাধা ডিঙিয়ে আলোচককে কবিতাটির মর্মমূলে প্রবেশ করতে হয় l
৩) কবিতা সমাজ নিরপেক্ষ নয় l মানবমন নিরপেক্ষও নয় l মানবমনের বহুবিচিত্র গতি কবিতার বিষয় l বাস্তবতার নিরিখে কবিতার বিষয়বস্তুকে সমাজপটভূমিতে প্রতিস্থাপিত করতে হয় l
৪) আলোচ্য কবিতাটির কবির মন এই কবিতাটির ক্ষেত্রে কিভাবে চালিত হয়েছে তার সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করাতে হয় l
৫)  একটি কবিতার ক্ষেত্রে সেই কবিতার কবি এবং তার আলোচকের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বুঝতে হয় l কবি জানেন কোন্ পটভূমিতে কবিতাটি রচিত হচ্ছে l তিনি কবিতা লেখেন এক আবেগজনিত অনুভব থেকে l বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয় l কবির অবচেতন মনের কোনো একটি ভাব একটি-দুটি  শব্দ আকারে কবিতাটির মধ্যে চলে আসতে পারে l কবি সচেতনভাবে হয়তো শব্দগুলি কোনো বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন নি l কবি এ ব্যাপারে অজ্ঞাত থেকে যান l কিন্তু আলোচক যখন কবিতাটি পড়েন, কবিতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, বিশ্লেষণী মন নিয়ে পড়েন l প্রতিটি শব্দের অর্থ সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ l কবিতাটির পটভূমি তাঁর জানা নেই l কবিতাটির মধ্যে তিনি যা পাচ্ছেন, পুরো কবিতার সাপেক্ষে কবিতাটির প্রতিটি অংশের পাঠোদ্ধার করবার প্রয়াস করেন তিনি l
৬) উপরোক্ত ধাপগুলি পার করার পর, আলোচক যদি কবিতাটিকে ঘিরে কোনো পরামর্শ দিতে চান, কবিতাটির গঠনগত, ভাষাগত, ভাবগত কোনো অসঙ্গতি বিষয়ে কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, গঠনমূলক কোনো সুপারিশ তিনি করতে পারেন l কবিগণ সদর্থকভাবেই তা গ্রহণ করবেন l


কিন্তু মনে করা যাক, কোনো আলোচক কবিতা আলোচনার শুরুতেই কবিতাটির একটি ভুল ধরলেন, একটি বিরূপ মন্তব্য করলেন এবং সেখানেই আলোচনাটি শেষ করলেন l তিনি তো ভাবলেন তিনি কি মহৎ সমালোচনাই না করলেন ! কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁকে নিন্দুক বলা হবে, সমালোচক নয় l নিন্দুক ও সমালোচকের মধ্যে এই যে পার্থক্য - এটা আমাদের বুঝতে হবে l এটা বুঝতে পারলে পাশাপাশি আমরা এটাও বুঝে যাবো, কেন কবিরা ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্রুপখোঁচাকে পছন্দ করেন না, কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানান l


বিশ্বভারতী সম্মিলনীর উদ্যোগে কলকাতায় নবীন এবং প্রবীণ সাহিত্যিকদের সভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, …"যে সমালোচনার মধ্যে শান্তি নাই, যা কেবলমাত্র আঘাত দেয়, কেবলমাত্র অপরাধটুকুর প্রতিই সমস্ত চিত্ত নিবিষ্ট করে, আমি তাকে ঠিক মনে করি নে। এরূপ সমালোচনার ভিতর একটা জিনিস আছে যা বস্তুত নিষ্ঠুরতা- এটা আমাকে পীড়ন করে। সাহিত্যিক অপরাধের বিচার সাহিত্যিকভাবেই হওয়া উচিত।"
যে সমালোচক কেবলমাত্র ছিদ্র অন্বেষক তাদের প্রতি কবির প্রশ্ন-
"কেন হীন ঘৃণ্য ক্ষুদ্র এ দ্বেষ,/ বিদ্রুপ কেন ভাই!"


সমালোচনা সম্বন্ধে ফরাসী ভাবুক ব্যক্তিত্ব জুবেয়ারের কতকগুলি মত বিষয়টি স্পষ্ট করে।
ক) "পূর্বে যাহা সুখ দেয় নাই তাহাকে সুখকর করিয়া তোলা একপ্রকার নূতন সৃজন।"
এই সৃজনশক্তি সমালোচকের। একটি কবিতা পাঠ হল। পাঠক কবিতাটি পড়ে তার রসাস্বাদন করতে পারলেন না। ঘটনাক্রমে ঐ কবিতাটির ওপর একটি আলোচনা তাঁর নজরে এল। সেখানে কবিতাটির পাঠোদ্ধার আছে, আলোচকের কল্পনায় কবিতার অস্পষ্ট জায়গাগুলোর স্পষ্টিকরণ আছে, সমাজবাস্তবতার নিরিখে কবিতাটির প্রতিস্থাপন আছে, কবির মনের বিশ্লেষণ আছে ইত্যাদি। আলোচনাটি পড়ে পাঠক মুগ্ধ হলেন। এবার পুনরায় সেই পাঠক যখন কবিতাটি পাঠ করছেন, তিনি আনন্দের সঙ্গে কবিতাটির পাঠোদ্ধার করতে পারছেন এবং তার রসাস্বাদন করতে পারছেন। অর্থাৎ পুর্বে যা সুখ দেয় নি, এখন তা সুখকর হলো। এটিই আলোচনার কাজ। কবিতার পুনর্গঠন। কবিগুরুর ভাষায়, "একটি গোলাপের পাশে আর একটি গোলাপ ফোটানো।"
খ) "লেখকের মনের সহিত পরিচয় করাইয়া দেওয়াই সমালোচনার সৌন্দর্য। লেখায় বিশুদ্ধ নিয়ম রক্ষা হইয়াছে কি না তাহারই খবরদারি করা তাহার ব্যবসাগত কাজ বটে কিন্তু সেইটেই সব চেয়ে কম দরকারি"'
গ) "অকরুণ সমালোচনায় রুচিকে পীড়িত করে এবং সকল দ্রব্যের স্বাদে বিষ মিশাইয়া দেয়।"
ঘ) "যেখানে সৌজন্য এবং শান্তি নাই সেখানে প্রকৃত সাহিত্যই নাই। সমালোচনার মধ্যে দাক্ষিণ্য থাকা উচিত -- না থাকিলে তাহা যথার্থ সাহিত্যশ্রেণীতে গণ্য হইতে পারে না।"


এমন যুগোপযোগী বিষয়, যা কবিতাচর্চা ও কবিতা আলোচনার ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক, তেমন একটি বিষয়ে যুক্তি-তথ্যবহুল এক উপযোগী কবিতা রচনা করে কবি আর্যতীর্থ আসরের সকল কবিকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন l
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা।