কবি এইচ আই হামজা রচিত "সুদিঠির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাই" এক ব্যতিক্রমী কবিতা যেখানে রূপকের মাধ্যমে প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কের এক করুন পরিণতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যা বর্তমান দিনের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ l প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতা একটি সাধারন ঘটনা এবং তার করুন পরিণতির খবর পত্র পত্রিকায়, দূরদর্শন সংবাদে প্রায়ই মেলে l প্রেম শুধু রঙের খেলা নয় l কপট প্রেম রঙহীন অন্ধকারও বটে, যার বোধোদয় বিলম্বে আসে l ক্ষতি হয়ে যাবার পর l তখন সব পথ রুদ্ধ l অবিবেচনা-প্রসূত প্রেম এই সুন্দর মানবজীবনকে যে অসুন্দর দর্শন করায় তার রূপচিত্র আছে কবিতাটিতে l এক সতর্কবার্তা - সকল প্রেমিকযুগলের জন্য l প্রেম কোনো ছোটোখাট খেলা নয় l জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত l সম্পর্ক গড়ে তোলার l যে সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ভবিষ্যৎ জীবনের বুনিয়াদ l গণনায় সামান্যতম ভুল হলে, বোঝার বিষয়ে অবিবেচক হলে, সাবধানী কদম না ফেলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলে তার পরিণতি যে কিরকম জীবনসংশয়কারী হতে পারে, আকারে ইঙ্গিতে কবিতাটিতে তার আভাস দেয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় l
ব্যর্থ প্রেম l বিশ্বাসঘাতী প্রেমিক l আশাহতা প্রেমিকা l বিবাহপূর্ব দেহজ প্রেমের সাক্ষ্য শরীরে l যা হতে পারত সুন্দর এক ভবিষ্যৎ, বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানি ও প্রত্যাখ্যান-এর বেদনায় তার অকাল নিধন l রক্তে ভেসে যায় স্বপ্নের চাদর l সোনার প্রতিমা লুটিয়ে পড়ে রক্তের স্রোতে l
প্রেম জীবনের এক অনুপম অভিজ্ঞতা l বয়সকালে তা শরীরমনে দোলা দিয়ে যায় l অনেক অনেক মানুষের ভীড়ে বিশেষ একজনকে মনে ধরে l প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় l যে সম্পর্কের গুরুত্ব অসীম, যার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দায়িত্বপালনের মধ্যে দিয়ে, সেই সম্পর্কে প্রবেশের পুর্বেও কিছু ভাবনা চিন্তা করা আবশ্যক l যে সম্পর্ক জীবনভর বইতে হবে, যেখানে কোনো এক পক্ষ বিশ্বাসভঙ্গ করলে অন্য পক্ষের জীবন সংশয় হতে পারে, বুদ্ধি বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে শুধু ভালোবাসার আবেগে, শুধু তাত্ক্ষণিক দেহজ কামনার তাড়নায় এই সম্পর্ককে ঘিরে অনেকটা পথ এগিয়ে গেলে, যদি গণনার ভুল হয়, যদি কথার খেলাপ হয়, তাহলে সমূহ ক্ষতি l আনন্দময় জীবনে দুঃখের শেষ থাকে না l জীবন তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে নরক যন্ত্রণায় শেষ হয় l জীবনকে তখন বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও সমস্যা হয় l অকালেই জীবনদীপ নিভে যায় l  
কবিতায় সুদিঠি সেই নারী-চরিত্র, প্রেমের ফাঁদে বেঁধে যার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে l আর প্রতিবেদক কবি সেই পুরুষ চরিত্র যার বিশ্বাসঘাতকতায় দুটি জীবনের বিনাশ হয়েছে l তাঁর কপট ভালোবাসাহীন বিবাহপূর্ব দেহলালসার শিকার হয়েছে এক সরলা তরুণী যার সঙ্গে সহমরণ হয়েছে সেই বিশ্বাসহন্তা প্রেমিকের ঔরসজাত সেই তরুণীর গর্ভস্থ সন্তান l দুটি অমূল্য জীবনের হত্যার দায় যার মাথায়, শুধু নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের সেই দায়, সেই পাপ ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন সেই বিশ্বাসহন্তা খল প্রেমিক l
বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই সম্পর্কের সূত্রপাত l সম্পর্ক গড়ায় বহুদূর l মেয়েটি গর্ভবতী হয় l এখন অতি সত্বর বিয়ে না হলে চলে না l মেয়েটির দিক থেকে ছেলের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় l ছেলেটি ছলনার আশ্রয় নেয় l এক নিশুতি রাতে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে l প্রেমিকের প্রতি সরল বিশ্বাসে অনন্যোপায় সেই গর্ভবতী মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে এক রেল স্টেশনে তার পুরুষের অপেক্ষা করে l দেহের ভেতর আর একটি প্রাণের অনুভব, মনে নতুন জীবনের স্বপ্নরাশি, নতুন এক চাদর বিছিয়ে সে অপেক্ষা করে যায় l তার সুপুরুষ প্রেমিক কথা দিয়েছে সে আসবে l সেখানে বারুদের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ আসন্ন বিপদের সঙ্কেত বহন করে l
অথচ পথ চেয়ে থাকে সুদিঠি। কথা হয়েছে এই অন্ধকার রাতে তারা বেরিয়ে যাবে কোন এক অজানা সভ্য সমাজের খোঁজে। রাত ভীষণ কালো, এই নিকষ কালো রঙ অন্ধকার ভবিষ্যতের রূপক l কিন্তু সুদিঠির বিশ্বাস ছেলেটি আসবে। কারণ ছেলেটি কথা দিয়েছে ! শেষ ট্রেনের হুইসেল বেজে চলেছে ক্রমাগত l একটু পরেই তো ট্রেন ছেড়ে দিবে l তাহলে সে এখনও আসে না কেন ? মেয়েটির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ l মাথায় ভেঙে পড়েছে আকাশ l ট্রেন যথাসময়ে চলে যায় l সবাই চলে যায় যে যার গন্তব্যে l শূন্য প্লাটফর্ম l সঙ্গী বলতে শুধু দুটি কুকুর l নিয়ন আলোয় আবেশি ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন l সুদিঠির চিন্তাশক্তি, দৃষ্টিশক্তি কমে আসে l ঝাপসা দূরের পথে তাকিয়ে থাকে l এতক্ষণে সে বুঝতে পারে ছেলেটি তাকে প্রতারণা করেছে l তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে l তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে l যে ছেলেটি প্রতিরাতে তাকে রঙবেরঙের স্বপ্ন দেখিয়েছে, আসল সময়ে যখন জীবন এক জটিল বাঁক নিয়েছে, ভালবাসার দায় নিতে সেই ছেলেটি অনুপস্থিত l
তলপেটে হাত দিয়ে মেয়েটি বুঝতে পারে অনাগত কারো উপস্থিতির কথা l মেয়েটি ভাবতে থাকে, অন্য সকলের জন্য এই রাত্রি শেষ হয়ে যাবে l সকালের দুরুন্ত সূর্যে প্রান্তর আলোকিত হয়ে উঠবে l সকলে যে যার গন্তব্যের পথে ছুটবে l কিন্তু তার জীবনে এই কালরাত্রির শেষ নেই l তার জীবনে আর কোনো সকাল আসবে না l প্রেমের এই বিশ্বাসভঙ্গে জীবনের প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে সে l আত্মহনন করে l রক্তাক্ত দ্বিখণ্ড দেহ পড়ে থাকে প্লাটফর্মে! রক্তের স্রোতে লাল বিছানায় লুটিয়ে পড়ে সোনার প্রতিমা l প্রেমের রাজ্যে কালঘুমে চলে যায় সুদিঠি। সমস্ত জীবনের পাণ্ডুলিপি, কতো স্বপ্ন, সব ধূসর হয়ে যায় l তার জন্য সব ব্যর্থ হয়ে যায় l সভ্যতা ব্যর্থ l পুরুষত্বের অহংকার ব্যর্থ l সকালের সূর্য, মহাকাল সাক্ষী থাকে এক অমানুষ পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতায় দুটি জীবন অকালে শেষ হয়ে গেল l
প্রেম কোনো ছেলেখেলা নয় l জীবনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত l শুধু আবেগে ভেসে গিয়ে নয় l চোখ, কান খোলা রেখে, বুদ্ধি, বিবেচনাকে সঙ্গে নিয়ে এই পথে হাঁটা উচিত l তবেই এই জাতীয় দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব - রূপক কবিতাটির মধ্যে এই বার্তা আছে l


সাম্প্রতিক নানা ঘটনার দ্বারা প্রাণিত এক সমাজমনস্ক কবিতা উপহার দেবার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন !


**  
দেহ পরে আছে < দেহ পড়ে আছে