বিগত ০৪-০৯-২০১৭ তারিখ প্রকাশিত ৮৮ তম "উত্তরে উত্তরে"তে দেখলাম কবি সঞ্জয় কর্মকার মহাশয়ের দুটি কবিতা l প্রথম কবিতাটির শিরোনাম  "মুক্ত মনের লেখা - নতুন ঠিকানা" l বিষয়টি সুন্দর - পরাধীনতার বেদনা এবং স্বাধীনতার আর্তি l  
স্বাধীনতার প্রশ্নে  মানবচরিত্রের বৈপরীত্যময় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে l যে মানব কবিকূল স্বাধীনতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে কবিতা লিখছেন, তাদেরই সহোদর অন্য কেউ মানুষের স্বাধীনতা হরণ করছে l মানবজাতি সম্বন্ধে, তার শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয় l সেই সঙ্গে এটাও বলা যায় যে পৃথিবীতে যত রকমের প্রাণী এবং জীব আছে তার মধ্যে অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করার মানসিকতা একমাত্র মানবজাতির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় l অন্য কোনো প্রাণী বা জীব অপর প্রাণীকে পরাধীন বা বন্দী করে রাখে না l জীবেদের মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক আছে l এই প্রশ্নে তারা একে অপরকে হত্যা করে জীবনধারণ করে l কিন্তু শুধু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য বা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী বা জীব অপরের স্বাধীনতা হরণ করে না l মানুষ শুধু অপর একদল মানুষকেই পরাধীন করে থেমে যায় নি, সে তার জেলখানার মধ্যে বন্দী করেছে তাবৎ প্রাণীকে l কখনো ভালোবাসার অভিনয়ে, কখনো হিংস্র শক্তির প্রয়োগে l বনের পশু, জলের মাছ, আকাশের পাখি, গৃহপালিত জীব - কাউকে সে বাদ দেয় নি l এই প্রাণীকূল তাঁদের এই অধীনতা কিন্তু খুশিমনে মেনে নেয় নি l স্বাধীনতার জন্য তারাও যে  ব্যাকুল - বিভিন্ন কবির কবিতায় তা ফুটে উঠেছে l
কবি সঞ্জয় কর্মকার তাঁর "মুক্ত মনের লেখা - নতুন ঠিকানা" কবিতাটিতে এই বিষয়টি ধরতে চেয়েছেন l
কবিতার শুরুতেই পাই একতরফা কথোপকথন l কথক কবি তাঁর পোষা বুলবুল পাখির সঙ্গে অ্যাকোয়ারিয়ামে বন্দী রঙবেরঙের মাছেদের সম্বন্ধে গল্প করছেন l এই সুদৃশ্য মাছেদের স্বাভাবিক বাসস্থান হলো সাগর মহাসাগর l কিন্তু মানুষ শুধু নিজেদের আনন্দের জন্য অন্যায়ভাবে তাদের অ্যাকোয়ারিয়ামে বন্দী করে রাখে l সারাটা দিন মাছগুলি এক জলেতেই এদিক ওদিক
ঘুরতে থাকে l বাচ্চা, বুড়া, সব বয়সের মানুষ সেই দৃশ্য দেখে মজা নেয়। বিষয়টি অত্যন্ত অন্যায় l
সেই মাছেদের দেহের রূপ-বাহারই তাদের বিপদের কারণ হয় l অতল সাগর থেকে তুলে নিয়ে এসে অ্যাকোয়ারিয়ামে তাদের পরাধীন করে রাখা হয় l  
এই পরাধীনতা কিন্তু তাদের বিষন্ন করে l এক সাগর কান্না বুকে নিয়ে ওরা অধীন জীবন যাপন করে l
একই কথা পাখির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য l খাঁচায় বন্দী পাখি যখন কিচিরমিচির করে তখন সে আসলে তাকে মুক্ত করে দেবার আর্জি জানায়, যাতে করে সে মনের সুখে নীল আকাশে উড়তে পারে l বন্ধ খাঁচায় তার দম বন্ধ হয়ে আসে l তাই কিচিরমিচির কান্নায় অসীম আকাশের প্রার্থনা জানায় সে l
একই অবস্থা বনের পশুদের l বাঘ, সিংহ - যারা বনের রাজা, বন কাঁপিয়ে ছুটে বেড়ানো যাদের ধর্ম, তাদের যদি চিড়িয়াখানায় বন্দী করে রাখা হয়, তাহলে সেটা তাদের পক্ষে মোটেই সুখকর হয় না l বাচ্চা বুড়ো টিকিট কেটে হুড়োহুড়ি করে তাদের দেখতে আসে l আর খাঁচায় বন্দী হয়ে পশুরাজদের সেই অবমাননা সহ্য করতে হয় l অন্যের স্বাধীনতা হরণ করার মানুষের এই প্রয়াস অত্যন্ত অমানবিক l কথক কবি জানেন তাঁর পোষা সাধের বুলবুল পাখিটিকে তিনি যদি খাঁচায় বন্দী করেন, তাহলে সেই বুলবুলও শিস্ দিয়ে স্বাধীনতার দাবি জানাবে l
কবির হৃদয় এমনিতেই কোমল হয় l এই কথক কবিটিও কোমলস্বভাব l কবিতা লেখেন l মানুষের হাতে পশুপাখির এই বন্দিদশা দেখে তাঁর কবিহৃদয় ব্যথিত হয় l তাঁর মনে আজব আজব খেয়াল আসে l তাঁর ইচ্ছা জাগে, তিনি নিজে চিড়িয়াখানা গড়বেন এবং পশুপাখিদের বদলে সেখানে পুরবেন দুইপায়া জন্তুদের যারা নানারকমের অপরাধ সংঘটিত করে সমাজটাকে ক্রমাগত দূষিত করে চলেছে l এই অপরাধী মানুষদের বন্দী করে তিনি চিড়িয়াখানায় জীবনভর আটকে রাখবেন l একটুখানি খাঁচার মধ্যে সারাটা জীবন কাটাতে হবে তাদের l  টিকিট হবে ১০ টাকা করে l একটা লাঠি থাকবে l টিকিট কেটে যারা সেই চিড়িয়াখানায় ঢুকবে, সবাই ঐ লাঠি দিয়ে দু-পায়া অপরাধী বন্দীদের দুটি করে বারি মারবে l সেই চিড়িয়াখানার নাম হবে "জন্তু দানো রক্ষপুর" l
কবির উত্তেজনার পারদ যখন কমে আসে, তাঁর মনে হয় তাঁর এই খেয়ালগুলি স্বাভাবিক চিন্তার ফল নয়, একটু অস্বাভাবিক l নিজের প্রকৃত কাজ বাদ দিয়ে এইসব আজগুবি গল্পগাথায় তিনি মজে গেছেন l এইসব উল্টোপাল্টা ভাবনা এসে তাঁকে বিরক্ত করে - এগুলি পছন্দ নয় তাঁর l কবির প্রকৃত কাজ কবিতা লেখা l কাব্যভাবনায় নিমজ্জিত থাকা l বুলবুল পাখি যেমন স্বাধীনতা পেলে শিস্ দিয়ে গানের সুর ধরে, ডানা মেলে নীল খোলা আকাশে উড়ে বেড়ায়, তিনিও তেমনি চান কল্পনা ডানায় ভর করে কাব্যচর্চার মাধ্যমে তাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে l পাখির যেমন গান, কবির তেমন কাব্যসাধনা l পাখির ডানা, কবির কল্পনাশক্তি l পাখির নীলাকাশ, কবির ঈশ্বরপ্রাপ্তি l পাখির প্রকৃত ঠিকানা মানুষের তৈরি খাঁচা নয় l তার প্রকৃত আবাস হলো নীলাকাশ l তেমনই মানুষের আবাস এই নশ্বর পৃথিবী হলেও, তার প্রকৃত চাওয়া হল  ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ, ঈশ্বরের আশীর্বাদ,
"হে ঈশ্বর পরম তুমি-আমার মাঝে মিলতে ডানা-
প্রণাম তোমায় মেনেই নিলাম-নতুন আমার এই ঠিকানা।"


"উত্তরে উত্তরে" খ্যাত কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা !