আলোচনার দুটো অংশ ।


১) আধুনিক জীবনে সাহিত্য  চর্চার প্রয়োজনীয়তা আছে কি?


এবং
২) সাহিত্যচর্চা ও বিজ্ঞানচর্চা - কার গুরুত্ব বেশি ?


বিষয় দুটি একই :


মূলত বিষয় দুটি একই । কারণ আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ । আধুনিক যুগে সাহিত্য প্রাসঙ্গিক কি না, বিজ্ঞানের যুগে সাহিত্য প্রাসঙ্গিক কি না, একই কথা ।
বিষয়টা যেন এরকম - অতীত দিনে সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন ছিলো, এবিষয়ে কোনো সংশয় নেই । কিন্তু আধুনিককালে সাহিত্যের সেই প্রয়োজন আছে কি না, এ বিষয়ে সংশয় আছে ।
অতীত দিনে মানুষের জীবন কেমন ছিলো, যখন সাহিত্য প্রাসঙ্গিক ছিলো ? এবং বর্তমান জীবন কেমন হয়েছে, যখন সাহিত্যের এই প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন জেগেছে ? আমরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করবো ।


কোনো দুটি যুগ এক নয় :


প্রথম কথা হলো কোনো দুটি যুগই পুরোপুরি এক নয় । মানুষ সজীব, চলিষ্ণু । তার জীবন, ধ্যান, ধারণা, আদর্শ অচল অটল নয় । যুগে যুগে তার পরিবর্তন হয়েছে । সেই পরিবর্তন সাহিত্য ও শিল্পে প্রতিফলিত হয়েছে । কারণ সাহিত্য হলো জীবনের দর্পন এবং মানুষের জীবন হচ্ছে সাহিত্যের উপকরন । রামায়ন মহাভারত বা আরব্য উপন্যাসের যুগে মানুষের জীবন আর শেক্সপিয়ার এর যুগে মানুষের জীবন এক নয় । শেক্সপিয়ার এর যুগের জীবন আর রবীন্দ্র নজরুলের যুগের জীবনে আকাশ পাতাল পার্থক্য । কিন্তু এই প্রত্যেক জীবনের ছবি এবং সেই সময় সেযুগের সাহিত্যের উপকরণ হয়েছে । এবং সব যুগেই সাহিত্য প্রাসঙ্গিক থেকেছে । প্রতিটি নতুন যুগ সেই যুগের সাপেক্ষে আধুনিক এবং তাই, আজকের যে প্রশ্ন সে প্রশ্নের উত্তর প্রতিটি যুগকেই তার নিজের মতো করে খুঁজতে হয়েছে ।


প্রাচীন যুগে সাহিত্যের বিষয়বস্তু :


প্রাচীন যুগে সাহিত্যের প্রধাণ বিষয়বস্তু ছিলো নরনারীর প্রণয়, তার সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া । সীতাহরণ । রামরাবণের যুদ্ধ । রামায়ন । দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ । কৌরবপান্ডবের যুদ্ধ । মহাভারত । হেলেন হরণ । এথেন্স স্পার্টার যুদ্ধ । ইলিয়াড ।  অবসর প্রধাণ জীবনে এটাই ছিলো বড়ো ঘটনা এবং সেই সময় সাহিত্য ছিলো অবসরভোগী সমাজের অবসর বিনোদনের বস্তু ।


আজকের জীবন ও সাহিত্য :


কিন্তু আজ জীবনে এতো অবসর নেই । বৈজ্ঞানিক নানা আবিষ্কারে জীবন দ্রুততর হয়েছে, গনতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার বিকাশ হয়েছে । এখন শ্রমিক অর্থাৎ মেহনতি জনতা দেশের সামাজিক জীবনের প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । তাঁদের জীবনের বিচিত্র ঘটনা ও সমস্যা আজ সাহিত্যের বিষয়বস্তু হয়েছে । তাই প্রণয়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনসংগ্রামের দলিল হয়ে উঠছে আজকের সাহিত্য ।


যুগের পরিবর্তনে সাহিত্যের পরিবর্তন :


সাহিত্যের নানা ধারায় আমরা দেখবো সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য কিভাবে নিজেকে পরিবর্তন করে নেয় এবং এভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ।


উপন্যাস সাহিত্যের ক্রম বিবর্তন :


উপন্যাস সাহিত্যে আমরা দেখি বঙ্কিমের যুগে মনোমুগ্ধকর কাহিনী পরিবেশন রীতি ছিলো । এই ধারা থেকে কিছুটা সরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন  "চোখের বালি" 'চতুরঙ্গ' উপন্যাস । লিখনশৈলীর নতুনত্ব এলো "শেষের কবিতা" উপন্যাসে । গল্পের প্রাধান্য সত্বেও শরৎচন্দ্রে পেলাম সামাজিক নানা সমস্যার চিত্রায়ন, বিশেষ করে গ্রামীন সমস্যা ও সমাজে নারীর অবস্থান । এলেন বাংলাসাহিত্যে খ্যাতনামা তিন বন্দ্যোপাধ্যায় - তারাশংকর, বিভূতি ও মানিক । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন খন্ড সময়ের কথাকার । তাঁর আখ্যানে খন্ড সময়ের মানুষ সুখ, দুঃখ; হিংসা, দ্বেষ; প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে আদিম জৈবিকতায় । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঔপন্যাসিকের রাজনৈতিক বোধ ও জীবনবীক্ষা । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছ ঘটনাকে বেঁধে দেন মহাকালের গতিতে । তার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রকৃতিহৃদ্যতা ও আধ্যাত্মিক বোধ । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সচেতন শিল্পী। তাঁর অভিজ্ঞতা দর্শন ও সিদ্ধান্ত পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই তিনি কলম ধরেন ।


কবিতার ক্ষেত্রে বিবর্তন :


কবিতার ক্ষেত্রেও দেখি কাহিনীপ্রধাণ কবিতা থেকে যুগের বিবর্তনে কবিতা কিভাবে খন্ড দৃশ্যের বর্ননা, চিত্রপ্রধান এবং সবশেষে বিমূর্ততায় এসে ঠেকেছে ।


এইভাবে যুগে যুগে সাহিত্য পাল্টে গেছে এবং সেই যুগের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক থেকেছে ।


সাহিত্য ও বিজ্ঞান : বিরোধী নয়, সহায়ক :


সাহিত্য ও বিজ্ঞান পরস্পরের বিরোধী নয়, সহায়ক  । যখন বিজ্ঞান আজকের মতো এতো উন্নত ছিলো না, তখনও সাহিত্য ছিলো । মুখে মুখে ছিলো, কিন্তু ছিলো । তারপর বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির সাথে সাথে সাহিত্যও পরিবর্তিত হয়েছে । বিজ্ঞানকে আশ্রয় করেই সাহিত্য এগিয়েছে । কতো কতো বই পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে । পৃথিবীর এক প্রান্তে সৃষ্ট সাহিত্য মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে । হাজার হাজার বছর আগে রচিত কালোত্তীর্ন সাহিত্য মুদ্রিত হয়ে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে ।


সাহিত্য ও বিজ্ঞান পরষ্পরের পরিপূরক :


সাহিত্য ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক । সাহিত্য বিজ্ঞানকে উদ্দীপিত করে । নতুন আবিষ্কারের প্রেরণা জোগায় । কবি কবিতায় পাখি হয়ে উড়ে যাবার স্বপ্ন দেখেন । বিজ্ঞান এরোপ্লেন আবিস্কার করে । জুল ভার্ন "Twenty Thousand Leagues under the Sea" উপন্যাসে ডুবোজাহাজের ধারণা দিয়েছিলেন । পরে বিজ্ঞান ডুবোজাহাজ আবিস্কার করে । জুল ভার্নের কল্পিত ডুবোজাহাজের নাম ছিলো 'নটিলাস' । বিজ্ঞানের জগতে  আবিষ্কৃত ডুবোজাহাজের ঐ নামই রাখা হয় সাহিত্যকে সম্মান দিয়ে । বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার ও তত্বে লেখকেরাও উপকৃত হন । চিন্তা চেতনায় প্রগতিশীল হন ।


গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস :


গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যিনি গাবো নামেও পরিচিত, একজন কলম্বীয় সাহিত্যিক, ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
"নিঃসঙ্গতার একশ বছর" (Hundred Years of Solitude" বইয়ের লেখক হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত । বইটিতে তাঁর লেখনীতে তিনি লাতিন আমেরিকাকে এতো সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করেছেন যে বলা হয় লাতিন আমেরিকা যদি না থাকতো, এই বই পড়ে তা সৃষ্টি করা যেত ।


ইংরাজ কবি কীটস :


ঐতিহাসিকভাবে কবি এবং সাহিত্যিকদের মাঝে একটা বাঁধা ধারণা ছিল যে বিজ্ঞান ও কলা বা সাহিত্য পরস্পর বিরোধী।  ইংরেজ কবি কীট্স্ নিউটনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছিলেন যে আলোকের সূত্রের দ্বারা রংধনুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করে তিনি রংধনুর সৌন্দর্যকেই ক্ষুন্ন করেছেন। কিন্তু নিউটন তো সত্যেরই উন্মোচন করেছিলেন তাঁর ব্যাখ্যায় । আর এটাও তো বলা হয় যা সত্য, তাই সুন্দর । তাহলে নিউটন সত্যের উন্মোচন করে সৌন্দর্য্যের হানি করেছেন, এটা কি বলা যায় ? আর কীটসই তো তাঁর কবিতায় বলছেন,
"Beauty is truth, truth beauty, —that is all / Ye know on earth, and all ye need to know"
(Ode On A Grecian Urn)
ফলে কবিরাও যে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এই তথাকথিত বিরোধ অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন না সেটাই বোঝা যায় । কবিতার আবেগ আর বিজ্ঞানের বেগ কোথায় যেন মিলে যায় ।


নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যান :


এ বিষয়ে প্রয়াত নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যানকে জড়িয়ে একটা ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় ক্রিস্টফার সাইক্স্ (Christofer Sykes) এর লেখা “No Ordinary Genius” বইতে ।
ফাইনম্যানকে তাঁর এক শিল্পী বন্ধু হাতে একটা ফুল ধরে তাঁর দিকে তাক করে বলেন, “একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই ফুলের সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম, আর তুমি এটাকে ভেঙ্গে চুরে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর সৌন্দর্যকেই বিলীন করে দাও”। এর উত্তরে ফাইনম্যান বলেছিলেন যে একজন শিল্পী ফুলে যে সৌন্দর্য দেখতে পান, তিনিও সেই একই সৌন্দর্য দেখতে পান, কিন্তু উপরন্তু তিনি ফুলের ভেতরকার সৌন্দর্যকেও দেখতে পান, যেমন কি ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা ফুলের পাপড়ি গঠিত হয়, কিভাবে বৈবর্তনিক উপযোজনের কারণে কীটপতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য ফুলের সুন্দর রঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, এই সব, যা থেকে তাঁর শিল্পী বন্ধু বঞ্চিত।


ওয়াল্ট হুইটম্যান :


আর একজন কবি, আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তাঁর “যখন বিজ্ঞ জ্যোতির্বিদকে বলতে শুনলাম” (“When I heard the Learn’d Astronomer”) কবিতায় লিখেছেন কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর এক বক্তৃতা শুনতে শুনতে একঘেমেয়ি বোধ করে কবি বক্তৃতাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান এবং বাইরে রহস্যময় রাতের আঁধারে,  একান্ত নিভৃতে আকাশের তারার পানে চেয়ে থেকে মনের শান্তি ফিরে পেলেন ।
এভাবে কখনো আপাত বিরোধ এবং কখনো সমন্বয় উভয় পথে সাহিত্য ও বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে ।  


পরিশেষে :


পরিশেষে বলবো, বিজ্ঞানসহ যতো বিষয়ের চর্চাই চলুক, সাহিত্যসংস্কৃতি চর্চা সভ্যতাকে  পূর্নতা  দেয় । তাই মানুষকে সম্পূর্নরূপে জানতে হলে সাহিত্যপাঠ আবশ্যিক ।


** ভিডিও সৌজন্য - দেবদাস মৈত্র