খুব ছোটবেলায় যখন প্রথম সিনেমা দেখা শুরু করেছিলাম, একটা জিনিস দেখে অবাক হয়ে যেতাম যে একটি সিনেমায় যে খলনায়ককে মরে যেতে দেখলাম, পরে আর একটি সিনেমায় তিনি বেঁচে উঠেছেন  এবং একইরকম অন্যায় কাজ করছেন l আবার হঠাৎ কোনো সিনেমায় দেখতাম লোকটি ভাল হয়ে গেছেন l ব্যাপারটা অবাক লাগত l একটা লোক মরে গিয়েও বেঁচে যায় কি করে আর কোন্ জাদুবলে একটি খারাপ লোক হঠাৎ আবার ভালো হয়ে যায় !
একটু যখন বড়ো হলাম, নাটক দেখতাম l সেখানে দেখি একই ব্যক্তি বিভিন্ন নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে  অভিনয় করছেন l তখন এতটুকু বুঝতে শিখেছি যে সেই ব্যক্তি চরিত্রাভিনেতা l সুন্দর অভিনয় দিয়ে এক একটি নাটকে এক এক ধরনের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলছেন l ঐ চরিত্রগুলির কোনোটিই তিনি স্বয়ং নন l তিনি এক একটি চরিত্রে অভিনয়ের দ্বারা একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, একটা মূল্যবোধকে তুলে ধরছেন l
আর একটু বড়ো হলাম l স্কুলপাঠ্য বইএর বাইরেও কবিতা পড়তে শুরু করেছি l গড় বাঙালি যে বয়সে পৌঁছলে নিজে কবিতা লিখতে শুরু করে, নিয়ম মেনে সেই বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করলাম l
কবিতা লিখতে এবং পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম কবিরা উত্তম পুরুষে কথা বলছেন l ধরে নিলাম, কবি নিজের কথা বলছেন l কবির কবিতা পড়ে কবির সম্বন্ধে একরকম ধারণা হলো l সেই কবির আরো অন্য কবিতা পড়লাম l অন্য অনেক কবির একাধিক কবিতা পড়লাম l লক্ষ্য করলাম কবিতাভেদে কবির ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে l তখন মনে প্রশ্ন জাগল, কবিতার 'আমি' কি তাহলে কবি স্বয়ং নন ? অন্য কেও ? কবি কি এক একটি কবিতায় এক একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন ? যখন যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তার স্বর কবির কণ্ঠে ? নিজের ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করে সমষ্টিগত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন কবি ?
হ্যাঁ, ঠিক তাই l কবিতার 'আমি' সর্বদা কবি স্বয়ং নন l যে সমাজের দর্পণ হল সাহিত্য, সেই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে কবি উত্তম পুরুষে কথা বলেন l সেখানে কবির নিজের কথাও থাকে, কিন্তু সর্বদা নয় l কবিতায় উত্তম পুরুষের ব্যবহারে কবি এইভাবে আত্ম থেকে নৈরাত্মতে ভ্রমণ করেন l
মহত্ত্বর মানবসত্তার সাথে সম্মিলনের স্বপ্নে  নিজেকে ভেঙে ব্যক্তি থেকে 'আমি' পর্যায়ে পৌঁছাতে হয় কবিকে l কবি স্পষ্ট উচ্চারণে চিরকালীন মানব-অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেন কবিতায়। মানুষের দারিদ্র্য, তাদের ঈশ্বরধারণা, প্রচলিত ধর্মের অনাচারের বিরুদ্ধে সমাজের ক্ষোভ কবিতায় আসে l বাংলা কবিতায় এই চর্চার পুরোধা নজরুল ইসলাম। প্রায় শুরু থেকেই নজরুল ইসলাম তার দ্রোহাত্মক মনোভঙ্গির কারণে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সমগ্র চেতনা জুড়ে কৃষিজীবী, শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষের পদধ্বনি শোনা যায় l এই সমাজ-সচেতনতা থেকেই নজরুলের ‘আত্ম’ শক্তির উত্থান ঘটে। ব্যক্তি মানুষ নয়, তার ভেতরের সত্তাপ্রবাহ জেগে ওঠে l কবি কথা বলেন, কিন্তু কার সাথে? টি এস  এলিয়ট বলছেন কবির ‘আমি’ কখনো ব্যাপক শ্রোতৃমণ্ডলীর সাথে কথা বলে, কখনো তা নিরপেক্ষ, কখনো কবির নিজেরই সাথে। একজন মানুষের অস্তিত্ব টুকরো টুকরো হয়ে থাকে, তার  অজ্ঞাতে। রবীন্দ্রনাথ তাই প্রতিদিন নিজেকে তাঁর জীবনদেবতার সামনে দাঁড় করিয়েছেন- ‘প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।’ কে এই জীবনস্বামী, কবির অস্তিত্ব না বিবেক ? নজরুল নিজেকে ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড় করান নি l তাঁর আমিত্বকে প্রতিপক্ষ করে তুলেছেন : ‘আমি মানব দানব দেবতার ভয়/ বিশ্বের আমি চির দুর্জয়/ জগদীশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য’।
নজরুল নিজেকেই উদ্বোধন করলেন পরমসত্তা জগদীশ্বররূপে। এই এক থেকে বহু এবং বহু থেকে একক সত্তায় সংলগ্ন হওয়ার মধ্যেই কবির আমিত্বের বিচরণ l আমিত্বের ওজস্বী উচ্চারণ থেকে নিজের সত্তাকে নিরপেক্ষ করার এক আকাঙ্খা নজরুলকে নৈরাত্ম রীতিতে নিয়ে যায়।
নজরুলের : ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে/ মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে/ মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/ আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’
এখানে নিরপেক্ষভাবে নজরুল ‘আত্ম’কে প্রযুক্ত করেছেন l অর্থাৎ এই বাক্যবন্ধে নজরুল নিজের সঙ্গে আমাদের সকলকে আনন্দের সহযাত্রী করে নিয়েছেন। এখানে নৈর্ব্যক্তিকতা যেমন আছে- আত্ম আনন্দও আছে। সেজন্য নজরুল সব সময় এক ‘আমি’ থেকে ভিন্ন ‘আমি’তে দৌড়ে ফিরেছেন। আত্ম থেকে নৈরাত্মে গিয়ে শান্তি চেয়েছেন।
নজরুল নিজের মধ্যে সমষ্টির আবির্ভাব অনুভব করেছিলেন l তাঁর দ্বিতীয় সত্তা তাকে প্ররোচিত করতো, সংহারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করে তুলতো- এই হচ্ছে আবেগ, এই হচ্ছে কবিতার প্রকৃত চালিকা শক্তি l এর সাথে আমিত্বের এবং ভেতরের দ্বৈতসত্তার যোগ আছে l
একজন কবির ক্ষেত্রে আত্মজ্ঞান ও আত্মমুক্তি - দুটোই গুরুত্বপূর্ণ l তিনি নির্বাচন করে নেবেন যুগোপযোগী রীতি। নজরুল কোনো রীতিকেই অনিবার্য না ভেবে অনবরত নিজেকে ভেঙেছেন, ‘আত্ম’কে খুলে খুলে দেখাতে চেয়েছেন, প্রকাশের দুরন্ত সাহসে নৈরাত্মকেও দিয়েছেন অপার মহিমা,
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু,
আর আমি জাগিব না
সারাদিনমান কোলাহল করি কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না।”
নজরুল কারো ধ্যান ভাঙাবেন না এরকম আত্মঅঙ্গীকার করলেও তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা, বাঁধভাঙা দ্রোহ, সত্যের পক্ষে অবস্থান, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধ ঘোষণা সমাজের ধ্যান ভাঙাতে তাঁকে বাধ্য করে। আত্মজগৎ থেকে হেঁটে নৈরাত্মের জগতে বারবার পরিভ্রমণ করেছেন তিনি।
জীবনানন্দ দাশও আত্মগত আমিকে উজ্জীবিত করে তুলেছেন। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটতেছি পৃথিবীর পথে’ l এই আমি সর্বজনীন কবিতার ইতিহাসের স্বীকৃত আমি।
কবি যখন উত্তমপুরুষে কবিতা লেখেন, সেই এক 'আমি'র মধ্যে অনেক 'আমি' থাকে l তাই কবিতার  'আমি'কে সর্বদা কবি স্বয়ং মনে করলে ভুল হবার অবকাশ থেকে যায় l


কৃতজ্ঞতা স্বীকার : রেজাউদ্দিন স্টালিন