কবিতা-সাহিত্য ও সমাজের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক l কবিতা সমাজ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে l আবার সমাজ তীর হারা নদীর মতো l চলার পথে কবিতা তার তীর বেঁধে দেয়।
অন্নদাশঙ্কর রায় বলছেন, “সাহিত্য যেমন সমাজ থেকে কিছু নেয়,/আবার সমাজকেও সাহিত্য অনেক কিছু দেয়।”
কবি সাহিত্যিক সাহিত্য সৃষ্টিতে কল্পনার আশ্রয় নেন। তবে এই কল্পনার সাথে বস্তুগত বিষয়ও থাকে। এই বস্তুস্পর্শ লাভ করা যায় জীবন তথা সমাজ থেকে।


কবিতা সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকে এর নিদর্শন পাওয়া যায় l আনুমানিক দু’হাজার বছর পূর্বে মিশরে লিখিত বিভিন্ন কাহিনীতে সে সময়ের সমাজ-বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাহিত্যেও সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনায় সমাজের ছবি বার বার ধরা দিয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে সমাজ সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ রচনায় রাশিয়ার সমাজবাস্তবতার চিত্র পাই। সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাসের রচনাবলীতে গুপ্তযুগের ভারতবর্ষের একটি আনুপূর্বিক জীবনচিত্রের সন্ধান পাই। চার্লস ডিকেন্স, ফ্লবেয়ারের কথাসাহিত্যে সমাজের বাস্তবচিত্র যথাযথভাবে রূপায়িত হয়েছে।


পৃথিবীর সব দেশের সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও সমাজজীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের সূচনাপর্ব থেকেই কবি-সাহিত্যিকদের সমাজচেতনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। এগুলো বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। তাঁরা নিগূঢ় তত্ত্বকথা বলতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত রূপক, প্রতীক ও অলংকারের। তাই ধর্মকে ছাপিয়ে মানুষ ও সমাজবাস্তবতাই এখানে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। সেই হাজার বছর আগে বাঙালি সমাজে শ্বশুর-শাশুড়ি পরিবৃত যৌথ সমাজ ছিল। সেকালের মানুষরা নৌকা তৈরি করত, শিকার করতে বনাঞ্চলে যেত এবং নারীরা ছিল আজকের মতোই প্রসাধনপ্রিয়। দারিদ্র্যপীড়িত সমাজজীবনের চিত্র রয়েছে চর্যাপদে। ৩৩ নং চর্যায় স্পষ্ট বলা হয়েছে
"টালত মোর ঘর, নাহি পড়বেসী
হাড়ীত ভাত নাহি, নিতি আবেশী।"


অর্থাৎ, টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই।
হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ নিত্য অতিথি আসে। চর্যাপদে খুঁজে পাওয়া যায় বর্ণাশ্রমপীড়িত, দারিদ্র্যপীড়িত শ্রেণিভিত্তিক সমাজের চিত্র।


বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের রচনা বৈষ্ণবসাহিত্য ও মঙ্গলকাব্য l
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কৃষ্ণ ও রাধার হৃদয়-বেদনার কথামালা হলেও তা যেন সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এ কাব্যে কৃষ্ণ অশিক্ষিত যুবক, দেবতা নন। অন্যদিকে রাধাও দেবী নন। তিনি মানবিক বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ l তার সমাজে লোকলজ্জা আছে, নারী-পুরুষের প্রেম আছে, অসম বিবাহ ও তার বেদনাময় পরিণতি আছে, হাঁচি টিকটিকি প্রভৃতি কুসংস্কার আছে, নারীদের বিচিত্র সাজসজ্জা আছে l
মঙ্গলকাব্যগুলিতে পাই দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা ও পৃথিবীতে তাঁদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী l এটাও দেখি যে যেসব দেব-দেবী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তাঁরা প্রথমে সমাজের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর শ্রেণির পূজা পেয়েছেন, পরে সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্তে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তৎকালীন সমাজজীবনের দুঃখ, দারিদ্র্য, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতির চিত্র মঙ্গলকাব্যগুলিতে রূপায়িত হয়েছে।


উনিশ শতকের শুরু থেকেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা ঘটে। তখনকার মানুষের সামাজিক জীবনচর্চার পরিচয় পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ রচনায়, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ ও মীর মশারফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’-এর মতো নাটকে।  ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নব বাবুবিলাস" (১৮২৫) রচনায় ‘বাবু’র সঙ্গে ‘বাবু’র ধারক ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় । ক্যাথেরিন ম্যুলেন্সের লেখা ‘ফুলমনি ও করুণা’র বিবরণে (১৮৫২) খ্রীষ্ট ধর্মান্তরিত বাঙালি পরিবারে ধর্মজীবনের সমস্যাকে কেন্দ্র করে এক পূর্ণতর সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ (১৮৭৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ (১৯১০), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় পাই।


গীতিকবিতা উনিশ শতকের বিশিষ্ট সৃষ্টি। ব্যক্তি হৃদয়ের উপলব্ধি এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির মূল প্রেরণা হলেও সেখানেও সমাজচেতনা স্পষ্ট। আঠারো শতকের শেষার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে কবিগান ও শায়েরের সৃষ্টি হয়েছিল তা তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ও অব্যবস্থারই ফল।
বাংলা কবিতায় সমাজজীবনের নানা দিক ফুটে উঠেছে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার প্রধান লক্ষণ হলো যুগ চেতনা ও সমাজ-মনস্কতা। কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যের মাধ্যমে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।  জসীমউদ্দীন এর কবিতায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও সমাজজীবন প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর কবিতায় প্রথম ঘোষণা করেন, “আমি কবি যত কামারের আর কুমারের, মুটে মজুরের।” শ্রমজীবী সমাজকে তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় তুলে ধরেছেন।
স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যেও সমাজচেতনার বিষয়টি লক্ষণীয়।


মানবজীবন এবং মন - এই দুই এর ভিত্তিতেই সাহিত্যসৌধ নির্মিত হয়। সমাজজীবনে নানা সংকট বিদ্যমান। সাহিত্য সমাজকে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ চিনিয়ে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।


** তথ্যজনিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার : মোঃ মোস্তফা কামাল
** ভিডিও সৌজন্য : সমীর প্রামানিক