গতকাল (১৪-০২-২০১৮) আলোচনার পাতায় "কবিতা আন্দোলনের নামে কবিতা অর্গ্যাজম" রচনার শেষে শ্রদ্ধেয় কবি প্রবীর চ্যাটার্জী হাংরি আন্দোলনের কবিরা সাহিত্যবিপ্লবী ছিলেন, নাকি যৌনবিপ্লবী - এমন একটি প্রশ্ন রেখেছেন l সেই পটভূমিকায় সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রয়োগ প্রসঙ্গে কিছু কথা নিবেদন করব l
মানুষ যতো বড়ো মাপেরই হোন না কেন, তাঁর শরীরে যৌনাঙ্গ থাকে l সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যৌনাঙ্গের ব্যবহারও জরুরী l কিন্তু সমাজ, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে যৌনাঙ্গের ব্যবহারের ওপর কিছু বাধানিষেধ আরোপিত হয়েছে l দেশকাল ভেদে এই বাধানিষেধের কিছু তারতম্য থাকলেও, মোটের ওপর একটা শালীনতা থাকে l এই শালীনতা মেনে চলাটাই ভব্যতাজ্ঞান l
জীবনে চলার পথে অভিজ্ঞতাপ্রসূত কিছু কথা জন্ম নেয় যা প্রবাদ বা প্রবাদসম l স্থানীয় ভাষায় বা মান্য ভাষায় দেশে দেশে এমন অনেক কথা নানা প্রসঙ্গে শোনা যায় l এই উক্তিগুলো যেন খুব অল্পকথায় আমাদের জীবনের মার্গদর্শন করায় l কোনো বিষয়ে কি করণীয়, যেন তা বলে দেয় l
একটি কথা শুনি, " আপ রুচি খানা, পর রুচি পঢ়না"l অর্থাৎ বাড়িতে আপনি যেমন খুশি খান, বাইরের কেউ দেখছে না l আপনার নিজের বিষয় l কিন্তু যখন আপনি বাইরে বেরুচ্ছেন, বাইরের লোক আপনাকে দেখছে, তখন শালীন পোশাক পড়েই আপনাকে বেরুতে হবে l শালীনতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে l কোন্ টা শালীন, কোন্ টা নয় l তবু সব সমাজেই একটা মান্য রুচি থাকে l তার অনুসরণ করা উচিত l
একটি কথা আছে, "শতং বদ, মা লিখ" অর্থাৎ বলার সময় যতটা সাবধানতা অবলম্বন করা হয়,  লেখার সময় তার থেকে অনেক বেশি সাবধান থাকা উচিত l উত্তেজনার বশে মুখ ফসকে একটা দুটা বাজে কথা বেরিয়ে যেতে পারে, তাকে ফিরিয়ে নেয়া যায় না l "ধনু হইতে শরের ন্যায় বাক্য একবার মুখ হইতে নির্গত হইলে তাহাকে আর ফিরানো যায় না" l তার জন্য যা ঝড় ঝামেলা হয়, সেটা সামলাতে হয় l কিন্তু লেখার সময় আমরা অনেকটা সময় পাই l প্রকাশের আগে লেখা সংশোধনের সুযোগ থাকে l ফলে এমন কিছু লেখা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন, যা দেশের, সমাজের রুচিতে বাধে l
এই পটভূমিকায় যৌনঙ্গের ব্যবহার বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে l বিবাহিত দম্পতির নিজেদের মধ্যে যৌনাঙ্গের ব্যবহারে সামাজিক, আইনগত অনুমোদন আছে l কিন্তু সেক্ষেত্রেও বাধানিষেধ আছে l এই যৌনমিলনকে তাঁরা প্রকাশ্য রাজপথে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে পারেন না l একই সূত্র ধরে বলা যায় কবিতা, সাহিত্যে শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গেও একটা বাধানিষেধ মেনে চলা বাঞ্ছনীয় l সাধারণ সামাজিক জগতে যে বাধানিষেধ আছে, লেখালেখির জগতে সেই প্রতিবন্ধকতা থাকবে না কেন ?
একজন কবি বা লেখক, তিনি যতো বড়ো মাপেরই হোন না কেন, তিনি তাঁর দেহে যৌনাঙ্গ ধারণ করেন সেটা সবাই জানেন, কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে যেমন দেখানো যায় না, বস্ত্রের দ্বারা আড়াল করতে হয়, তেমনি  কবিতায়, গল্প-উপন্যাসে সেই যৌন অঙ্গের নাম, বা সেগুলির ব্যবহারজনিত শব্দও অনুমোদন করা যায় না, সেগুলিকে মনের আড়ালে রাখতে হয় l একটা কথা বুঝতে হবে সভ্য জীবনে আড়ালের প্রয়োজন আছে l সব কিছু প্রকাশ্যে আনা যায় না l বক্তব্য থাকতে পারে l সেক্ষেত্রে সরাসরি আপত্তিকর অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করে ইঙ্গিত, ব্যঞ্জনা, রূপকের আশ্রয়  নেয়া যেতে পারে l আপত্তিকর শব্দগুলির  প্রকাশ্য ব্যবহার সেই কবি-লেখকের বিকৃত যৌনমানসিকতার প্রকাশ হিসাবেই দেখতে হবে l কোনো আন্দোলনের নামে, বাস্তবতার নামে সাহিত্যে অশ্লীল ভাষার ব্যবহার একটা অপচেষ্টা l অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করেও কবি-লেখক তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করতে পারছেন - এখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা l
সাহিত্যে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয়, উপযুক্ত প্রসঙ্গ সেই ব্যবহারকে বৈধ করে দেয় এবং উপযুক্ত প্রসঙ্গ ব্যতীত তা অশ্লীলতার মাত্রা পায় l এইভাবেই বড়ো মাপের কিছু কবি লেখকদের লেখায় অশ্লীল শব্দের ব্যবহারকে স্বীকৃতি দেবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় l অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গি, প্রসঙ্গ, প্রয়োজন ও উপস্থাপনার নিপুণতা বিষয়টিকে উপেক্ষা করা যায় না । শিশুকে স্তন পান করানোর যে দৃশ্য হামেশাই মানুষ প্রত্যক্ষ করে থাকে তার মধ্যে যৌনতা নেই, আছে মাতৃত্ব- সেটি বাস্তবের পৃথিবীতে হোক কিংবা সিনেমার দৃশ্যে l কিন্তু সমস্যা হলো এখানেই বাধে গোলমাল l ফাঁক গলে সব অশ্লীলতা সাধারণ অনুমোদন দাবি করে বসে l
যা আমরা প্রকাশ্যে সন্তানদের সামনে, বাবা মায়ের সামনে, ছাত্র ছাত্রীদের সামনে বলতে পারি না, দেখাতে পারি না - কবিতা সাহিত্যে অকারণে এমন যৌন উত্তেজক শব্দ, যৌনাঙ্গের উল্লেখ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় l লেখা নির্বিশেষে, লেখক নির্বিশেষে একই মানদণ্ড হওয়া উচিত l