কবিতা লিখেছি কিছু l পড়েছি বেশ কিছু l আর নানা সাহিত্যবাসরে কবিকণ্ঠে কবিতা শোনার সুযোগও হয়েছে বার কয়েক l এই সামগ্রিক অভিজ্ঞতার নিরিখে সময়ের দাবী অনুভব করে বর্তমান রচনাটির অবতারণা l
কবিতা কেন লিখি ? প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক l কারণ তো একটা বা একাধিক থাকতেই হবে l সবাই তো লেখেন না l তাহলে যারা লেখেন, তারা কেন লেখেন ? তাগিদটা কিসের ? সব কবির ক্ষেত্রে নিশ্চয় কারণ এক হতে পারে না l কিন্তু কারণ ভিন্ন হলেও ফলটা একই হচ্ছে l ফল এক হলেও সব কবি এক ধরনের কবিতা লেখেন না l কবিতার অনেক ভাগ আছে l এমনিতেই ছড়া, পদ্য, কবিতা তিনটি ভিন্ন শ্রেণীতে পড়ে l সেগুলির আবার অনেক ভাগ আছে l একজন কবি কেন কবিতা লিখছেন  তার ভিত্তিতে কবিতার রূপ তিনি বেছে নেন l যে বিষয়টি বলার, তার অনুকূল পদ্যরূপ তাঁর রচনায় পাই l
অনেক সাহিত্যবাসর হয় l স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর হয় l সেখানে কবিরা তাদের রচনা নিজ কণ্ঠে পাঠ করেন l পাঠকেরা কবির কণ্ঠে কবিতা শুনবার সুযোগ পান l এমনিতে কবিতা পাঠ করা, আর যিনি সেই কবিতাটি লিখেছেন তাঁর কণ্ঠে কবিতাটির পাঠ শোনা - দুটি ভিন্ন জিনিস l কবিতায় এমনিতেই অর্থবোধের অনেক আড়াল থাকে l কবিকণ্ঠে কবিতা শুনলে সেই আড়ালের জট অনেকটা খুলে যায় l
কিন্তু তবু এই সাহিত্যবাসরগুলি, এই স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরগুলি কবি কেন কবিতা লিখছেন সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না l এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ বাসর যার কাজই হবে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা l এই আসরে কবি যারা আসবেন তাদের কাছে এই প্রশ্ন থাকবে l সঙ্গে থাকবে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, যেমন যে কারণে তিনি কবিতা লিখছেন, লেখার মাধ্যমে সেই কারণটি সার্থক হয়েছে বলে তিনি মনে করেন কি না, হলে কতখানি এবং পরবর্তীতে লেখা চলাকালীন তাঁর লেখার উদ্দেশ্য সংশোধিত বা পরিবর্তিত হয়েছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি l কবিরাই বা শুধু প্রশ্নের আক্রমণের মুখে থাকেন কেন ? পাল্টা প্রশ্ন করা হোক পাঠকশ্রেণীকে, তারা কবিতা পড়েন কেন, কবিতা শোনেন কেন ? প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা হোক, কবিতা পড়ে বা শুনে তাঁদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে কি না, কতখানি হয়েছে এবং কোন কবির কবিতা পাঠ করে তিনি মনের খোরাক পেয়েছেন, এবং কোন কবির কবিতা পড়ে তিনি সুখ পান নি l কোনো লুকোচুরি নয়, কোনো রাখঢাক নয়, কোনো তোষামোদ নয় - প্রশ্ন হোক সরাসরি, উত্তর আসুক সোজাসাপটা l পাঠক বলুন তিনি কবির কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করেন l কবি বলুন কোন প্রেক্ষাপট থেকে কি ধরনের লেখা তাঁর কলমে আসে l এই পারস্পরিক ভাব বিনিময় থেকে উভয় উভয়কে চিনবেন এবং তার পরিণামে সৃষ্ট কবিতা পাঠককুলের হৃদয়গ্রাহী হবে l
বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যসংস্থাগুলি কোনো product বাজারে ছাড়ার আগে market survey করে l producer ও consumer meeting হয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে l কবিতাকেও একটা product ভেবে নিই না কেন, আর পাঠক ও সাহিত্যবাসরের শ্রোতাদের consumer l এদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেলে মন্দ কি ? বাজারের চাহিদা জানি না, শুধু শুধু কাগজে ছাপার অক্ষরে সংবাদপত্রের কলাম এর আকারে কবিতা নামে লেখা আত্মপ্রকাশ করল l পাঠক হয় সেটা এড়িয়ে গেলেন, কেউ পড়তে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁর মনে হলো কবিতাটি হয় দুর্বোধ্য, বা এলোমেলো কিছু শব্দবন্ধ, যাকে ঠিক কবিতা পদবাচ্য বলে তিনি মেনে নিতে পারেন না l আমি বলছি না এখানে পাঠকের অনুভবটাই সর্বক্ষেত্রে সঠিক l কিন্ত ছন্দের প্রয়োগ কবিতায় সঠিকভাবে না থাকলে, সেই কবিতাগুলি পাঠের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে এবং এক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে l কেন নবজাত কবিতাকে এই অনাদর এর মুখে এগিয়ে দেওয়া ? পাঠককে এই ভ্রম থেকে বার করার দায়িত্ব তো কবিকেই নিতে হবে l আর সেটা তখনই সম্ভব যখন আমনে সামনে বসে হবে খোলাখুলি আলোচনা l
অনেক পাঠককে বলতে শোনা যায় আধুনিক কবিতা পড়ে তাঁরা কিছুই বুঝতে পারেন না, মাথা ধরে যায়, বিরক্তি এসে যায়, কবিতা পড়ে ভালোলাগার কোনো বোধ তৈরি হয় না l কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে অর্থ বুঝতে পারলে ভালোই, যদিও অর্থ বোঝাটাকে ততটা আবশ্যিক বলে মনে করা হয় না l কিন্তু ভালো লাগার বোধটা তৈরি হওয়া খুব জরুরী l কবিতা পড়তে যদি ভালো না লাগে, সেটা কবিতার দুর্বলতা হিসাবেই ধরা হয় l ছন্দ ব্যবহারে ত্রুটি থাকলে, সাধু চলিত গুরুচণ্ডালী দোষ হলে, ভাষা ও ভাবের প্রকাশে অসংলগ্নতা থাকলে, ধারাবাহিকতার অভাব থাকলে, কবিতায় শব্দের ব্যবহার সুবিন্যস্ত না হলে, যার ফলে ধ্বনিসুষমা বা ধ্বনি মাধুর্য সৃষ্টি না হলে ইত্যাদি বহুবিধ কারণে কবিতা পড়তে ভালো না লাগতে পারে l
কবিকে অবশ্যই এই বিষয়গুলিতে যত্নবান হতে হবে l