মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমার চার সন্তান এবং  চেয়েছিলাম,
পৃথিবীর আলো-বাতাসে সন্তান জন্ম দিতে।
আমার স্ত্রী-ও সন্তানের উষ্ণতা উপভোগ করতে ভালোবাসেন!
কিন্তু বাঁধ সেধেছে আমার হৈতিষী নামক স্বজনেরা;
তাই, এ  দৌড়ের গতি বাড়াতে পারিনি আমি।
কিন্তু, আমার প্রচণ্ড রাগ হয়েছে,
রোগের মতোন ক্রমান্বয়ে বেড়ে গিয়েছিলো আমার ক্ষোভ।


মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমার চার সন্তানের খাবারের ভাত-রুটি-তরিতরকারী...
কঠিন মাটির বক্ষ চিড়ে কুড়িয়ে আনি।
বুকের পাঁজরের আঘাতে আঘাতে পাথর ভেঙে
তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ-প্রসাধন,
তাদের খাতা-কলম-বইয়ের সংস্থান করি।
পরিশ্রমী কৃষকের সাথে হাতে রেখে কাজ করে যাই।
আমি ভিক্ষা করি না; আমি চুরি না; সন্ত্রাসও না;
তবুও, আমাকে অবহেলা করো কারণে অকারণে।


মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমার কোন পদবী নেই; শিরোনামহীন একজন মানুষ।
আমার বাবা, তাঁর বাবা, তাঁরও বাবা...
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে লাঙল পরিবারের সদস্য ছিলেন;
আমার বংশতালিকায় কৃষক ব্যতিত আর কোন নাম নেই।
উচ্চজাত এবং অভিজাত থেকে আমার জন্ম নয়।
তাঁরা খাল-বিল-নদী সেঁচে প্রচুর মাছ ধরতো,
নিজেরা খেতো এবং বিলোতো।
অতঃপর, অতিরিক্ত মাছগুলো শুকোতে দিতো;
সারা বাড়ি শুঁটকির মৌ মৌ গন্ধে ভরে যেতো!
আহা! কী সোঁধালো ঘ্রান!
তাঁদের ঘামের মূল্য দিয়ে, জীবনের সব সুখ কিনে নিতো।


মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমার দাদার, দাদার বাড়িটি কুঁড়েঘর ছিলো।
নলখাগড়া বাঁশ-ছনের, মাটিতে তৈরী;
প্রতি বর্ষার শেষে আবার মেরামত করে নেয়া হতো।
আমার জন্মের আগে,
ক্রমবর্ধমান যুগের সন্ধিক্ষণ থেকেই;
তাঁরা নদীর পাড়ে বসবাস করে আসছেন;
মাছে-ভাতে বাঁচবার সৌখিনতা নিয়ে।
সেই নদীজলে আমি সাঁতার শিখেছি,
প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেয়া আমি একজন মানুষ মাত্র;
আমাকে মানুষরূপে বাঁচতে দাও!


মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমার গড়ন না-উচ্চ, না-বেঁটে- মাঝারি আকার।
আমার গায়ের রঙ কালচে বাদামি,
চোখের মণি উজ্জ্বল কালো,
চুলগুলো ফিনফিনে নয়; শক্ত, কালো, মজবুত,
আমার বৈশিষ্ট্য অন্যরকম এবং আলাদা।
কথাবার্তায় অন্যদের মতো চতুরতা মাখা ধূর্ততা নেই।
গ্রামের জলবায়ুতে ভেজা মাতৃভাষার মধুর টান আছে
আমার কণ্ঠে, আমার উচ্চারণে।
আমার জন্মগত ঠিকানা-
গাছে ঢাকা নির্মল শ্যামল সুন্দর একটি গ্রাম।
যেখানে রাস্তঘাটের কোন নাম নেই; নম্বর নেই।
যেখানে সমস্ত লোক ক্ষেতে, ঝোপের আড়ালে,
তাদের জরুরী কর্ম সারে এবং বর্ষায় নৌকার নালে বসে।
আমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখে তোমার রাগের কী আছে?


মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমার পূর্বপুরুষদের পাটের জমি,
ধান-কাউনের জমি, খিরাই-বাঙ্গি-আলুর জমি,
তিল-গর্জন-সর্ষের জমি তুমি চুরি করে নিয়েছো।
যে জমিতে আমার পূর্বপুরুষেরা চাষ করতো
আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জীবনা রোপণ করার জন্য।
তোমরা জোটবদ্ধ হয়ে, বিভিন্ন কলা-কৌশলে,
আমার নাতি-পুতিদের আবাসগুলোকে কেড়ে নিচ্ছো।
এখন সেখানে তোমরা বড় বড় অট্টালিকা গড়ো,
শ্রমিকের কারাগার- রক্ত শোষণের কারখানা!
আমোদের, বিলাসের রিসোর্টের নষ্টঘর।
এখন সেখানে ইট-পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখি না।
এসব দেখে আমার রাগ হয়,
রাগগুলো রোগের মতোই ক্রমশঃ উর্ধ্বপানে বেড়ে যায়।


মনে রেখো তুমি, আমি একজন বাঙালি।
আমি মানুষকে কখনোও ঘৃণা করি না।
কারোর সম্পত্তি লুণ্ঠন করি না, হস্তগত করি না,
চুরি অথবা কুক্ষিগতও না।
তবুও, আমি এবং আমার সন্তানেরা ক্ষুধার্ত হয়ে যাই।
তখন রোগের মতো রাগগুলো ক্রমে ক্রমে বেড়ে যায়,
চেতনার শেকড়সমূহ রাগের ঘূর্ণিতে তোলপাড় করে উঠে।
ইচ্ছে জাগে আমার পূর্বপুরুষের সম্পত্তির আত্মসাৎকারীর
হাড়-মাংস-মগজ চিবিয়ে চিবিয়ে খাই।


সাবধান! আমার ক্ষুধা থেকে, তুমি সাবধান হয়ে যাও।


০৭/০৬/২০২২
মিরপুর, ঢাকা।