এখনো আপনার কথা মনে পড়ে, স‌্যার।
যখন দাঁড়াই বিকেলের বারান্দায়
হারিয়ে যাওয়া অতীতের মুখোমুখি।
যদিও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উলটপালট হয়ে গেছে
আমাদের জীবন, জগত-সংসার।
আজ অবসরক্ষণে মনে পড়ে-
যখন ছিলাম বিদ্যালয়ের দুরন্ত-কিশোরী-
ফুরফুরে হলুদ-মন প্রজাপতির মত:
আকাশের গায়ে প্রতি রাতে স্বপ্নের তারা বুনতাম,
বাস্তববর্জিত কল্পনার রঙ মেখে।
আকাশময় সোনারঙ তারাদের মাঝে
উজ্জ্বলতর একটি তারকা ছিলো।
সেই তারকা আমার আপন, আমার প্রেম;
সেই তারকা ছিলেন আপনি, স্যার!


যখন আপনি আমাদের বাড়ি আসতেন-
গোবেচারা রূপ, শান্ত-শিষ্ট, অবনত মাথা;
যেন, জ্ঞানের ভাণ্ডার মাটির পাতিলে ভরে
সাবধানে ধিরে ধিরে সিঁড়ি বেয়ে আসতেন!
ভাবখানা এই- খানিকটা এদিক-ওদিক তাকালেই
অসাবধানতায় পড়ে গিয়ে ভেঙে যাবে,
জ্ঞান ভরা সে পাতিলখানি;
তাতেই হয়তো ঘটে যাবে জীবনের সাড়ে সর্বনাশ!
আপনার চোখগুলো ছিলো অনিন্দ্য সুন্দর!
ভরাট কণ্ঠস্বর, প্রশস্ত বুক, সিংহ পুরুষ!
বারবার তাকাতাম, আড়চোখে নয়, সরাসরি,
যদি চোখে চোখ পড়ে এ আশায়।
তখন, আকাশে আকাশে বিদ্যুৎচমক,
বজ্রধ্বনি বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠে,
চোখের ভাষায় বোঝাবো বলে মনের ভাষা;
লোকে যারে কয়, প্রাণের আবেগ- মধুময় ভালোবাসা।
ব্যর্থ হয়ে কত মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়েছি গোপনে গোপনে।
মায়ের নিকটে বলেছি ইনিয়ে বিনিয়ে।


আমাদের ভাইহীন চারবোনের সংসারে,
আপনি ছিলেন আমাদের মায়ের দৃষ্টিতে তাঁর প্রথম সন্তান;
তাই, আমার কোন অভিযোগ মূল্য পেতো না কখনো।
কিন্তু, তা সত্বেও আমি কল্পনায় ফুলের মালায় জড়াতাম আপনাকে,
বুকের পশমে নাক ঘসে ঘসে গন্ধ শুঁকতাম
আদিম মানবী হাওয়ার মতো।
অথচ, কখনোসখনো কলম, পেন্সিল, ইরেজার তুলতে গিয়ে
হাতে হাত লেগে গেলে-
'দুঃখিত' বলে এমন ভাব করতেন,
খুনের মত অপরাধ করে ফেলেছেন।


আমার লেখাপড়ার প্রতি বড়ো নিরাশাবাদী ছিলেন, আমার জননী।
যখন, সেই জননীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম,
স্কুল সমাপ্তির হৃষ্টপুষ্ট সনদের ডালি।
আমি জানি, সেই সনদের মোটাতাজাকরণে
আপনার অবদান ছিলো একলব্যের দ্রোণাচার্যের মতো।
তেমনি সুখের দিনে
জীবনের প্রয়োজনে সবকিছু ছেড়েছুড়ে একদিন
সময়ের ডিঙি নায়ে পাল তুলে চলে গেলেন আপনি।
তারপর, শুরু হলো ইতিহাস!
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বয়ে যেতো শোঁ শোঁ করে,
চেতনায় জলোচ্ছ্বাস, ভাঙন চলতো আমার অন্তরে।
অব্যক্ত কথারা মাথার ভেতরে কিলবিল করে
কেড়ে নিতো ঘুম, মনের প্রশান্তি।
কত যে খুঁজেছি আপনাকে হিসেব-নিকেশ নেই;
পিতার শাসনে সংসার বাঁধার আগে এবং তারপরেও;
কোথাও খুঁজে পাইনি।
কালের কালির আস্তরণ ঢেকে দিয়েছিলো প্রায়
আপনার সেই হাসিমাখা সুন্দরম ছবি।


গত একুশের মেলা থেকে আমার কলেজ পড়ুয়া ছেলে
আরো অনেক বইয়ের সাথে একখানা কাব্যগ্রন্থ আনে
কবির অটোগ্রাফসহ।
এপিট-ওপিট দেখতে গিয়েই ছেৎ করে উঠে বুক,
এই সেই কবি- আমারই প্রিয় স্যার!
যাঁর অটোগ্রাফ অঙ্কের খাতার পাতা থেকে
এ হৃদয়ের শ্বেত-পাথরে খোদিত হয়ে আছে,
কতো কত কাল ধরে।
যাঁর চোখের ভেতরে খুঁজেছি আকাশ,
অব্যক্ত বেদনার বাতাসে উড়ায়েছিলাম
কিশোরী জীবনের রঙিন ঘুড়ি...


ভালো থাকুন সুন্দরমনের মানুষ।
ভালো থাকুন আমার প্রিয় স্যার।


০২/০৮/২০১৭
মিরপুর, ঢাকা।