গৃহে পঁহুছিয়া রাই          বলে কোনো ক্ষুধা নাই
          ভূমিপরে করিল শয়ন,
ভাবে আর কাঁদে শুধু        হেই কালারূপ জাদু
          তার লাগি করে অনশন।
সই মুখে প্রিয় কথা          স্মরে বুকে ভরে ব্যথা
          রুধিতে নারে নযনবারি ,
(ভাবে) হেই তনু কান্তিময়          হল ধূলি ধূসরময়
          'হা কপাল' মোর নাম স্মরি।
মোর মন এইক্ষণে          ছুটে যায় তার পানে
          জেগে জেগে দেখিনু স্বপন ,
নিই তারে ক্রোড় পরে          কত যে সোহাগ ভরে
          মুছায়ে দি ধূলি আবরণ।
এতেক ভাবিয়া কালে          অঙ্গ অবশ হলে
          দুখ পরে সুখ ছোঁয়া দেয় ,
রোদনে ক্লান্ত মন          শ্রান্ত সে অকারণ
          কাঁদিতে কাঁদিতে ঘুমায়।

পরদিন প্রথম প্রহরেই সখীগণ আসিয়া উপস্থিত। রাধারাণী দোর বন্ধ করিয়া নিদ্রায় অচেতন দেখিয়া তাহারা কহিল,

"উঠ গো উঠ গো সই          হইয়াছে ভোর
জাগিয়া তাকাও ওই          ভাঙ ঘুমঘোর ,
কৃপা করি খুলো এই          কাষ্ঠল ডোর
রূপজালে বাঁধিবে সেই          হরি চিতচোর। "

আখর :

ডাক শুনি চমকিয়া          রাধারাণী জাগে
শরম হরষে মিলে          নব অনুরাগে ,
লাজভরে ধীরপদে          করিয়া গমন
খুলে আগলখানি          আনত বদন।

সখীগণ ঘরে প্রবেশিয়া রাধারানীকে আপাদমস্তক ভালো করে নিরীক্ষণ পূর্বক বলে ,

"ওহে প্রাণপ্রিয় সখী          বিমস চন্দ্রমুখী
          একি রূপ হেরি তব আজি
বুঝি রাতে স্বপনে          গিয়াছিলে কুঞ্জবনে
          প্রেমরাগে রক্তিম সাজি ;
কত কি করিয়াছ          তনুময় মাখিয়াছ
          পিরীতি ফাগুয়া বরণ ,
ধরা পড়িবার ভয়ে          সরো দেখি ধীরপায়ে
          দুহাতে ঢাকিয়া নয়ন।"

এরপর তাহারা গাহিয়া উঠে বলে :

"লাজে মরে যাই রে -
ওষ্ঠ কাঁপে থর থর
লাজে মরে যাই রে -
দেহ বলে ধর ধর
লাজে মরে যাই রে -
খসি যায় কঞ্চুলী  
লাজে মরে যাই রে -
অঙ্গময় বিজুলী
লাজে মরে যাই রে -
প্রেমাবেশে বিকুলি
লাজে মরে যাই রে -
মোরা সব রাইআলি
লাজে মরে যাই রে -"

আরো যোগ করে, বলে -

"হায়া দূর করি দাও          বাঁধিয়া পরাণ
চলো যাই নদীপারে          করিবারে স্নান ,
স্নান সমাপন করি          বাঁধি দিব চুল
কন্ঠেতে মণিহার          কর্ণেতে দুল।
আতর ভরি দিব          তব তনুময়
চন্দন দিয়া তাহে          হবে মধুময়।
কুসুম চয়ন করি         বাঁধিব বিনুনী
তিলক কুমকুমে দিব        খসিবে নিছনি।
অতঃপর পাঠাইব          কালা সন্দর্শনে
দেখিয়া বধিবে তারে          প্রেমানল বাণে ,
বুঝাইবে রাইধনের          নাহি তুলনা
লভিবে না শ্যাম যারে          না সহিলে যাতনা।
মোরা সবে সখীগণ          ঐছন হেরি
আনন্দ প্রসাদ লব          দুইহাত ভরি। "

আখর :

এরপরে সবে মিলি          যায় নদীপানে চলি
          কলসির পরে মন নাই
শ্যামপ্রিয়া নন্দিনী          শ্যামভাবে ভাবিনী
          চলে আজি বধিতে কানাই।
ক্রমে হল উপনীত          যমুনা তীরস্থ
          কোকিলা কুহকে বিজনে ,
তটিনীর ঘাটে বসি          তামসী তাপসী
          কত কি যে ভাবে মনে মনে।
ভাবিয়া না পায় থই          ভয় লাগে ভাবে ওই
          বেণু বুঝি বাজিল বিহানে ,
সখীরা আনন্দভরে          গুন গুন গান করে
          স্নাপন করে যতনে।
যমুনা থমকি যায়          বহে চলা ভুলি যায়
          অপলকে হেরে রূপমা ,
পবন রুধিয়া বয়          প্রভাকর তন্ময়
          ক্ষিতি পান করে সুষমা।
শাখী পরে বিহঙ্গ          করে কত রঙ্গ
          হরষে কোলাহল করে ,
পতঙ্গ নাচিয়া ধায়          মাতনে চমকায়
          মাতঙ্গ বৃংহণ স্বরে।
অপর তীরেতে শুয়ে          ভাবে একমনা হয়ে
          ধূলি ধূসরিত ঘনশ্যাম ,
সহসা কি হলো আজ          ঘটে বুঝি পরমাদ
          ঘোচে বুঝি বিষাদিত যাম !
তাই বলে,"ওরে শুক          কহিয়া জুড়াও বুক
          কি আনন্দ উথলিছে হায় !
চঞ্চলা প্রকৃতি          কিসে হইল স্থিতি
          প্রাণ করে যেন বাহিরায়।
রঙীন স্বপনজাল          দেখিতেছি এই হাল
          কি করিয়া হল সহসা ?
স্বপন না সত্যি এ          বুঝাও তুমি আমারে
          দূর করি অনুসন্ধিৎসা ।"

শুক উত্তর করে ,

"কি কহিব তোমা প্রভু          পূর্বে পাইনি কভু
          এত সুখ মেদিনীপরে ,
দেশ-কাল ভুলিয়াছি          ভুলিয়া কাঁদিতেছি
          দুইজনে জড়াজড়ি করে।
শৃঙ্গার করিবারে          আছেন অপরপারে
          অনুভালোচনা গৌরী ,
প্রণয় গুলাল মাখি          অসিতাঞ্জন আঁখি
          আসিবে বধিতে শৌরি।
হস্তে কুসুম মালা          তাহে প্রেম বিষ ঢালা
          পরাইবে তব কন্ঠে ,
শেষ হবে উপবাস          পূরিবে তব আশ
          মিলন মধুর ছন্দে।
তাই বলি শ্রীহরি          স্নান করো ত্বরা করি
          মিটাও এ ধূলি আবরণ ,
শ্বেত চন্দন মাখি          নিজেরে সাজাও দেখি
          হিরণ্য খচিত আভূষণ।
পীত বস্ত্র ধর          শিখণ্ড শিখর
          মুছিয়া বিষাদিত কালিমা ,
মঞ্জিরা লও তুলে          বাজাও জগৎ ভুলে
          আপন প্রেমের মহিমা।"

                (নবম অঙ্ক সমাপ্ত)