দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তোকে দেখিনা অনি,
আর যে কখনো দেখা হবেনা তাও জানি !
তবু আমার একান্ত ব্যাক্তিগত ধূলোপড়া মনের আবেশ,
বেখেয়ালে ডায়েরিতে লিখলাম- কেমন আছিস, অনিমেষ ?
আমাকে মনে পরে তোর এখনো ?
অন্তু রে, যেরকম ছিলাম তখনো ।
হ্যাংলা-পাতলা, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল,
প্রতিদিন ক্লাসের পড়ায় করতাম ভুল ।
তালপাতার সিপাহি বলে ক্ষেপাতিস খুব,
আমি কিন্তু মেয়েদের মত লজ্জায় নিশ্চুপ ।
তবু যেন কেমন করে দু‘জনাতে ভালো বন্ধু হলো
তোর বাবা, ধীরেণ কাকা যেদিন চিরতরে চলে গেল ।
শ্মশানে মুখাগ্নি পর্যন্ত সাথেই ছিলাম তোর,
ফিরলাম যখন রাত্রি হলো ভোর ।
কাঁদলি, বিলাপ করলি, স্মৃতিকথা শুনালি চোখে মুখে
পাথর মন তো নয়, সহজেই ভিতরে গেলি ঢুকে ।
তারপর স্কুল পেরিয়ে একদিন কলেজে পদার্পণ,
মনে আছে সময়টা- উনিশশো একাত্তর তখন ।
জুলুমটা প্রথম ছাত্রদের উপরেরই নেমে এলো,
ছাত্র, যুবকদের বেছে বেছে ক্যাম্পে ধরে নিলো ।
হঠাৎ একদিন ফর্সা না হওয়া ভোরে হন্তদন্ত হয়ে এলি
অন্তু, বাড়িতে আছিস না-কি, আরে রাস্কেল কই গেলি ?
কাঁধে রাইফেল, শার্টে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে-
আমি একেবারে বিস্ময়বিহ্বল হতভম্ব ঘর থেকে বেড়িয়ে ।
অশ্রুহীন পাথর চোখে বললি, ওরা বাঁচতে দেয়নি মাকে,
বরবরতার চিহৃ মাখা শরীর জুড়ে এগিয়ে দিলি অনিতাকে ।
দেখে রাখিস, আদরের ছোট বোন বড় বিশ্বাস করি তোরে
পরক্ষণে নিমেশেই হারিয়ে গেলি সেই ফর্সা না হওয়া ভোরে ।
এটাই শেষ দেখা নয়, হিসাব আছে, আরও এসেছিলি দু‘বার;
উসকোখুসকো চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি, কি যেন খুঁজছিলি বারেবার ।
আমিই বললাম, ও ভালো আছে । অনি, তুই কেমন আছিস !
হাসলি ।বড় অপার্থিব হাসতে হাসতে বললি, বিয়ে করেছিস ?
আমার কেন যেন মনে হলো- আমাকে নয়,
অনিতার বিয়ে নিয়েই তোর যত সংশয় ।
তারপর আর তোর সাথে দেখা হয়নি, অনি
তোর বোন, অনিতাই এখন আমার অর্ধাঙ্গিনী ।
সমাজ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে এ কথা জোর দিয়ে বলবোনা তোরে
আমিই ছেড়েদিলাম, তোর মত- কোন এক ফর্সা না হওয়া ভোরে ।
উত্তরবঙ্গ ছেড়ে ঢাকার সাভারে এখন বাসা,
স্মৃতিসৌধের সাথে রোজ হয় মেলামেশা ।
যুদ্ধ কবেই হয়েছে শেষ, তোর যুদ্ধ কি এখনো অনেক বাকি ?
অনেক কথাই বলার তোকে, আসার আশায় কানপেতে থাকি ।
জানিস, অনিতার ছেলে এখন পুলিশের বড় অফিসার,
বুকের নেম প্লেটে- চকচক করে ‘অনিমেষ’ নাম তার ।
শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে এখনো বেখেয়ালে নিত্য গুগলে ঢুঁ-মারি,
ভালো থাকিস, বার্ধক্যের তাগাদায় আমিও আসবো হয়তো তাড়াতাড়ি ।