জীবনটা ভালোই কেটে যাচ্ছে। ২৭ বছরের জীবনে যে এত্ত কিছু
একসাথে পেয়ে যাব তা আমি বা তন্বী কেউ ভাবিনি। ভাবছেন
তন্বী কে? আমার বউ, আমার জীবন সাথী। পড়ালেখা যদিও খুব
বেশি একটা করতে পারিনি। কারিগরী বোর্ডের
আন্ডারে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা করেছি। তাই কত....! ছোট্ট
একটা পরীর মত মেয়ে হয়েছে আমাদের। নামটাও রেখেছি সেই রকম,
“লিয়ানা ফাতিহা”। এই তো সেদিন জুনের ৬ তারিখে ছোট্ট
একটা বাবু আল্লাহ্ আমাদের কে দুপুর ৩টার দিকে দিয়ে গেল। এখন
সারাদিন ওকে দেখেই পার হয়ে যায় আমাদের দুজনের। প্রেমের
বিয়ে আমাদের। অনেক বাধা-বিপত্তি পার করে আজ আমরা এক
সাথে আছি। তাই এখনো দুজন দুজনাকে ছাড়া কিছু বুঝিনা। আমার
বউ তো আমাকে প্রায়ই বলে, “আমাকে একা রেখে মরে গেলে কিন্তু
খবর আছে!” শুনে হাসি...তা ছাড়া আর কি করব বলেন? মৃত্যু তো আর
আমার হাতে নাই।
ছোট খাটো একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি আমি। টুক-টাক দিন চলে যায়
আরকি। আমার বা তন্বীর কারোই সেরকম কোন উচ্চাশা নাই।
আমরা যে একসাথে আছি এই আনন্দই ৫বছর ধরে শেষ করতে পারিনি!
২২বছর বয়সে বিয়ে করে কি বিপদেই না পড়েছিলাম! থানা-পুলিশ,
পালানো, নির্ঘুম রাত কাটানো....বিশাল উত্তেজনাকর ঘটনা!
সে কথা না হয় আর একদিন বলব। বর্তমানে স্ত্রী কন্যা নিয়ে ছোট্ট
একটা দুই রুমের বাসায় বাংলাদেশে যতটুকু শান্তিতে থাকা যায়
আছি আর কি। ধুর...যে কথা লিখতে বসলাম তা বাদ দিয়ে কি সব
জীবন বৃত্তান্ত বলছি আপনাদের! কিছু মনে করবেন। আমি একটু
বাচাল প্রকৃতির (আমার বউ এর মতে)!
আমার মেয়েটা খুব লক্ষী। ভাবছেন নিজের সন্তান বলে বলছি?
না...না...আপনিও এসে দেখে যেতে পারেন। আজ তার বয়স ৩ মাস
পূর্ণ হলো। আর এই ৩ মাসে সে কখনোই উচ্চস্বরে কান্না-কাটি, জেদ
করেনি। শুধু প্রবলেম একটাই...আমার মত আমার মেয়েও ঘুমাতে চায়
না! আমার বউ তো বলে যে পুরোই নাকি আমার মত
হয়েছে...হাঃ হাঃ হাঃ! বউ আমার খুব লক্ষী....কখনই আমার
কাছে কিছু চায় না! মাঝে মাঝে ভাবি মানুষ এইরকমও হয়! কিন্তু
আসলেই এইরকম না হলে আমার মত ছোট-খাটো ব্যবসায়ী মানুষের
কাছে মুষ্কিল হয়ে যেত! দেখেছেন....আবার গল্প ফেঁদে বসেছি!
আপনারা মনে হয় অনেকেই লেখা শেষ না করেই চলে গেছেন, তাই
না....গেলে যান...অনেকদিন পর ব্যস্ত জীবনের
ফাঁকে দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়েছি...হেলায় হারাবো কেন?
সকালে প্রতিদিনের মতই বউ এর ডাকে বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভাঙলো! ঘুম
আমার খুব প্রিয়। উঠতে চাইছিলাম না...কিন্তু যখন বলল যে বাবুর
দুধ শেষ হয়ে গেছে দুধ কিনতে হবে, তখন আর শুয়ে থাকতে পারলাম না।
উঠে হাত-মুখ ধুয়ে শার্টটা গায়ে জড়িয়েই বেরিয়ে পড়লাম সাহেব
বাজারের “বিস্কুট বিপণীর” উদ্দেশ্যে। মেয়ের আমার কপাল মন্দ!
মায়ের দুধ পেটে সহ্য হয় না। ডাক্তার বলেছে ল্যাকট্রোজ
না কি যেন নাম, ঐ টা বেশি। তাই কৌটার দুধ খাওয়াতে হচ্ছে। আর
এদিকে এক প্যাকেট দুধ ৪দিনও যায়না ঠিকমতো! বলেন তো, আমি স্বল্প
আয়ের মানুষ। আমার পক্ষে কি আর ৪০০/৫০০টাকা খরচ করে ৪দিন
পর পর গুড়ো দুধ কেনা সম্ভব? তাই বলে আবার
আমারে মেয়েটাকে কেউ ধমক দিয়ে বসবেন না যেন! আমার তো একটাই
লক্ষী মেয়ে। করলাম না হয় একটু কষ্ট! বাসা থেকে না খেয়েই
বেরিয়ে পড়লাম। একটা রিকশাও পেয়ে গেলাম...রিকশাওয়ালার
সাথে ভাড়া মিটিয়ে উঠে পড়লাম। দোকানে যেয়ে দেখি ৩৪৫টাকার
দুধ ৩৯৫টাকা হয়ে গেছে!
কেমন লাগে বলেন? আসলে আমরা যারা স্বল্প আয়ের মানুষ
তাদের এই দেশে বসবাস করা খুব কঠিন! দুধের প্যাকেট টা নিয়ে দ্রুত
বাসায় যেতে হবে। বাবু আমার এতক্ষণে হয়তো ক্ষুধায় অস্থির
হয়ে গেছে! সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টের এই চার মাথার মোড়
টা সবসময় ব্যস্ত থাকে। তার উপর আবার যমের মত
পুরো রাজশাহী ধরে ঘুরে বেড়ায় রাজশাহী ভার্সিটির বাস গুলো।
আর ট্রাফিক আইন মানা তো দূরের কথা ভাংতেই যেন সবাই ব্যস্ত।
যারা দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন। এখন
তো সকাল...শহরে সবে ব্যস্ততার শুরু। রাস্তাটা পার হয়েই আবার
রিকশা নিতে হবে....তারপর সোজা বাসা। ডানে-
বামে তাকিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে চমকে উঠলাম!
চারদিক অন্ধকার হয়ে উঠল! লোকজন চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“আহ্হারে! মারা যাচ্ছে! মারা গেল!” আমি তো অবাক....!
কে মারা গেল! এই মাত্রই তো সব দেখতে পাচ্ছিলাম! বাবার হাত
ধরে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কেউ ব্যস্ত
ভাবে কাঁচা বাজারের ব্যাগ নিয়ে দৌড়াচ্ছে, কেউবা আবার
অফিসমুখী....কিন্তু চোখের সামনে থেকে অন্ধকারটা সরছে না কেন?
কি হলো? কে মারা যাচ্ছে?
আজব তো! হ্যাঁ...এই তো এবার দেখতে পাচ্ছি! কিন্তু ঝাপসা!
শরীরটা একবারে হালকা লাগছে। উঠে দাঁড়ালাম আমি।
মনে হচ্ছে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি! সব লোকজন দেখি এদিকে ভিড়
করে আসছে। সবাই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ খেয়াল
করলাম হাতে দুধের প্যাকেট নাই! আমার দুধের প্যাকেট কই? দুধের
প্যাকেট? এই যে ভাই...আমার বাবুর দুধের প্যাকেট টা দেখেছেন?
‘বায়োমিল-স’....এই মাত্র ৩৯৫ টাকা দিয়ে কিনেছি! ছোট্ট
মেয়েটা আমার না খেয়ে বসে আছে! আমি দুধ নিয়ে গেলে তারপর
খাবে! প্লিজ....কেউ দেখেছেন কি? আমার কাছে তো আর টাকাও
নাই! ৫০০টাকার একটায় নোট ছিলো! এখন কি হবে! মাহফুজের কাছ
থেকে আবার ধার নিবো? নাহ্.... তাহলে? আরে..ঐ তো বায়োমিল-
সয়ের প্যাকেট টা পড়ে আছে....যাক বাবা...এত্ত ভিড়ের মধ্যেও
প্ওয়া গেল! কিন্তু একি!!! প্যাকেটটা রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে তো!
আর পাশে ঐ রক্তাক্ত শরীরটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে!!
শার্টটা তো আমারই!স্যান্ডেল ও আমার মত, যদিও আরেক পার্ট
দেখতে পাচ্ছি না। ধুর...চোখের মাথা খেয়েছি মনে হয়!
এটা তো আমারই শরীর! কেমন নিস্থর-রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে।
মাথার উপর দিয়ে বাসের চাকাটা চলে গেছে! হলুদ হলুদ ঘিলু
গুলো চারদিকে ছড়িয়ে গেছে! তাই চেহারাটা চিনতে পারছিলাম না।
ও....তাহলে আমিই মারা গেছি! অদ্ভুত ব্যাপার! এতক্ষণ টেরই
পায়নি! আসলে আগে কখনো মরে দেখিনি তো, তাই
অনুভুতিটা জানা ছিলো না। এই ভার্সিটির বাসগুলো আসলেই যে কি!!
এত লোকের ভেতর আমাকেই মারতে হবে? আর
মারবি তো ভালো কথা আরেকদিন মারিস....আজ না বাবুর দুধ
কিনতে এসেছি? এটা কি ঠিক হলো? এখন নিষ্পাপ
বাচ্চাটা কি খাবে??
অবশ্য মরে গিয়ে খুব একটা খারাপ লাগছে না। শরীরটা পাখির
পালকের মত হালকা হয়ে গেছে। কেমন যেন কুয়াশার ভেতর
আছি আমি। সবাইকে দেখতে পাচ্ছি....আরে..আমি এগুলা কি ভাবছি?
আমার তো বাসায় যেতে হবে।সর্বনাশ....অনেকক্ষণ
হয়ে গেছে....এইসব অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?
লিয়ানা আমার না খেতে পেয়ে হয়তো কাঁদছে। ওর মা তো মনে হয়
বাসাতেই ঢুকতে দিবে না! কি যে আছে কপালে! যায়
রওনা দিই....আজ হাঁটতে হাঁটতেই যেতে হবে মনে হচ্ছে! যে ভিড়
বাজারে! লোকজন হুমড়ি খেয়ে আমার লাশটাকে দেখছে....কয়েকজন
তো আবার ভাংচুর ও শুরু করে দিয়েছে। নাহ্...এখানে আর
থাকা যাবে না। তন্বী শুনলে বকা দিবে। আর আমি তো এখন
সন্তানের বাবা...এসবের ভেতর থাকতে নাই। হাঁটা ধরলাম
বাড়ির দিকে....মজার ব্যাপার হলো কেউ আমাকে দেখতেই
পাচ্ছে না! কিন্তু রাস্তার কুকুরগুলো কেমন করে যেন
কুঁকড়িয়ে তাকিয়ে আছে। থাকুক...আমার থামলে চলবে না।
বাসার সামনেটা সেইরকমই আছে। লোকজন সব ব্যস্ত। এদিকে কেউ
কিছু জানে না। বাসায় ঢুকতেই ভয় লাগছে। এই
থেঁতলানো চেহারা দেখে তন্বী আর বাবু তো ভয় পেয়ে যাবে!
তারপরও ঢুকে পড়লাম। আজ আর কলিং বেল টিপতে হল না। বউ
আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা মাঝে মাঝেই ক্ষুধায়
কেঁদে উঠছে! আহারে! তন্বীর উদাস চেহারা আর মেয়ের
কান্না শুনে আরেকবার মরে যেতে ইচ্ছা হল! ওরা এখনও খবর
পায়নি মনে হয়। আমি মেয়েটার কাছে গেলাম, “এই যে মা!
বাবা চলে আসছে। কিন্তু আজতো একটু কষ্ট করতে হবে। তোমার দুধের
প্যাকেটটা রক্তে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। আরেক প্যাকেট কেনার মত
টাকাও নেই আমার কাছে! সমস্যা নাই আজ আমরা সবাই
না খেয়েই থাকবো, কেমন?” তন্বীকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে! ও
কি টের পেয়ে গেছে নাকি! না মনে হয়।
টিং টং...টিং টং....এই সময় আবার কে আসলো!
আচ্ছা, অর্ক....কি হলো আবার! ছেলেটাকে ভদ্রতা শেখাতেই
পারলাম না! কতবার বলেছি কলিংবেল একবার টিপে কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করতে। ও আসলে তো আমাকে ফোন দিয়ে আসে।
ছেলেটা এভাবে হাঁপাচ্ছে কেন? ভাবি ভাবি বলে চিৎকার
করছে কেন?
দাঁড়া...আজ তোর খবর আছে! শালা অর্ক! তন্বী দরজা খুলতেই
হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল।
“ভাবি, ভাই বাজারে যেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে,
হসপিটালে আছে..আপনি এখনি চলেন।” ওরে মিথ্যুক! আমি অসুস্থ না?
তোদেরকে আমি মিথ্যা বলা ‍শিখিয়েছি! তন্বী তো শুনেই হাউমাউ
করে কেঁদে উঠল! “কি হয়েছে? বল? কি হয়েছে ওর?”
“না তেমন কিছুই হয়নি..আপনি আগে চলেন।” কেমন মিথ্যুক দেখেছেন
আপনারা! আমার মাথার উপর দিয়ে বাসের চাকা চলে গেছে আর
বলছে কিছু হয়নি!
এদিকে পুলিশ আমার লাশটা রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে আসলো।
সেই চির চেনা পরিবেশ। কতবার যে কত মানুষের জন্য এসেছি। মাত্র
তিন মাস আগেই মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে গেলাম এখান থেকে আর
এখন নিজেই এসেছি লাশ হয়ে! বউ আমার
বাবুকে কোলে নিয়ে ছুটে আসলো। ছোট বাচ্চাটা এখনও বুঝতেই
পারেনি যে সে এতিম হয়ে গেছে। বাবা, মা, বোন, চাচা, মামা,
শ্বশুর, শ্বাশুড়ী বন্ধুরা অনেকেই এসেছে দেখছি। বাহ্! একসাথে এত
পরিচিত মুখ দেখে ভালোই লাগছে।
লিয়ানা....আমার মামনি, ওকে আর একটু কাছে আনছে না কেন?
মেয়েটাকে কেমন বিসন্ন দেখাচ্ছে! ও কি টের পেয়ে গেছে যে ওর
বাবা আর নাই! ও আর বাবার কোলে চড়ে ঘুরতে পারবে না!
কি জানি, ছোট বাচ্চারা তো ফেরেস্তার মত, হয়তো সব
বুঝতে পারছে।ওদিকে আমার বউ দেখি কাঁদছে! মহা মুষ্কিল! তন্বী,
ছিঃ! এইভাবে কাঁদতে হয় না। আমি তো তোমাদের ছেড়ে যেতে চায়নি।
কিন্তু আমার কি দোষ বলো? ঘাতক বাস তো আমাকে বাঁচতে দিল না।
তুমি ভেঙে পড়ো না প্লিজ! আমি আর তুমি একসাথে কত বিপদ পার
করেছি ভেবে দেখো....কখনো কি আমাকে হতাশ হতে দেখেছো?
তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে বাবুর কি হবে? ও তো কেবল তিন
মাস। আরও অনেক দিন বাকি আছে...এখন থেকে তো আমি সবসময়
তোমাদের সাথে ছায়ার মত থাকতে পারবো। প্লিজ একটু শান্ত হও!
আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না। সারারাত জেগে থাকবো না।
এখন তো কেয়ামত পর্যন্ত ঘুমিয়েই কাটাতে হবে। তোমার
হাতে খাওয়া খুব মিস করবো। তারপরও কি করবো বলো?
এটা কি আমার দোষ?
আমি তোমাকে হয়তো ভালোবাসা ছাড়া কোনদিনই
দামি দামি শাড়ি গয়না দিতে পারিনি। কিন্তু ভালোবাসার
উপরে আর কিছু হয় বলো?
লিয়ানা ফাতিহা....নামটা আমার দেয়া। আমার একমাত্র
সন্তান, আমার সব। মারে, পারলে ক্ষমা করো আমাকে।
পিতা হিসাবে তোমার এই ক্ষুদ্র জীবনে যতটুকু সামর্থ্য ছিলো করেছি।
আফসোস তোমাকে বড় দেখে যেতে পারলাম না! কত
ইচ্ছা ছিলো তোমাকে মানের মত করে মানুষ করব।
আমি যা পাইনি তার সব তোমাকে দিব। হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাবো,
শপিং করবো, খেলবো, তোমার বিয়ে দিব.....তারাপর নাতি-নাতনির
সাথে আনন্দ করে পরপারে যাব। কিন্তু
হারামজাদা বাসটা তা হতে দিল নারে মা! এই বয়সে তুমি এতিম
হয়ে গেলে! তোমার জীবন টা অনেক কঠিন হয়ে গেল। জীবনের
প্রতি পদে আমার অভাব বুঝতে হবে তোমাকে। তাই বলে কিন্তু
ভেঙে পড়লে চলবে না। অনেকেই আছে যাদের বাবা-মা দুটোই নাই।
তোমার তো তাও মা আছে। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। বড়
হয়ে মাকে দেখে ‍শুনে রাখতে হবে না? মার তো এখন তুমি ছাড়া আর
কেউ থাকলো না। মাগো, একটাই দোয়া করি তোমার জন্য, সবসময়
সত্যকে সত্য বলে জানিও....মিথ্যার আশ্রয় নিও না কখনো। তোমার
জন্য হয়তো টাকা পয়সা, ধন সম্পত্তি কিছুই রেখে যেতে পারলাম
না। কিন্তু তোমার মাকে রেখে গেলাম। মাকে কখনোই অসম্মান
করো না। এই মানুষটা তোমার বাবার জন্য সব বিসর্জন দিয়েছে।
অনেক কষ্ট তার মনে।
বাবা...আমার বাবা। একমাত্র ছেলের লাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল
করে চেয়ে আছে। কখনোই আমাদের দুই ভাইবোনের উপর কোন কিছু
চাপিয়ে দেননি এই মানুষটা। আমার সব অনিয়ম, অন্যায় আবদার মুখ
বওজে মেনে নিয়েছেন। তারপরও অবুঝ আমি সবসময় তার সাথে উপদেশ
গুলো অমান্য করেছি। বাবার ইচ্ছা ছিলো আমি যেন
পড়ালেখা করে অনেক বড় হই। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আব্বু,
আমার উপর অনেক রাগ করে আছো, তাই না? তমি আমার
কাছে আসছো না কেন? কাছে এস আমার মাথায় একটু হাত
বুলিয়ে দাও। তোমার সন্তানকে তো আর বেশিক্সণ কাছে পাবে না।
আমাকে চলে যেতে হবে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?
আমার মা, তার কান্না কেউ থামাতে পারছে না।
প্রাইমারী স্কুলের টিচার আমার মা। ছোট থেকেই আমাদের সে রকম
সময় দিতে পারেনি। কিন্তু যতক্ষণ কাছে থেকেছে বুকে আগলে রেখেছে।
মাগো....কেঁদে আর লাভ নাই। আমি তো আর ফিরবো না মা। তোমাদের
কাছে আমার দুইটা কলিজার টুকরা রেখে গেলাম। পারলে একটু
দেকে রেখো। কতদিন তোমাকে দুঃখ দিয়েছি! পারলে ক্ষমা কর মা।
মাদের মন তো অনেক বড়্ ক্সমা করবে না মা?
অর্চি...আমার একমাত্র ছোট বোন। এই পাগলী, তুই এই
ভাবে কান্নাকাটি করলে হবে? আর সবার মত তুই ও যদি এরকম করিস
তা হলে কেমন হয় বল? তুই না কত কিছু বুঝিস। একটু থাম আপু। ঐ দেখ
লিয়ানা তোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে একটু কোলে কেরে আমার
কাছে নিয়ে আয়.....আমি যেমন তোকে ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ
করেছি, আমার মেয়েটাকেও একটু দেখিস। তোকে কিন্তু আর্মি অফিসার
হতেই হবে। আর আমি তো চলেই গেলাম...বাবা মাকে তোকেই
দেখে রাখতে হবে কিন্তু। বাবা-মার মনে কখনোই কষ্ট দিবি না প্রমিস
কর। আমি যে ভুল গুলো করেছি সেগুলা তুই কখনই করবি না, ঠিক আছে?
বন্ধুদের মধ্যেও অনেকে এসেছে দেখছি। এই শুভ্র, কিশোর, সেলিম, বিশ্ব
তোরা বোকার মত দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? কাছে আয় গাধার দল।
আমি তো পারছি না। সোহের টা আবার আহাম্মকের মত কাঁদছে কেন?
ওকে কেউ থামা! আরে গাধা, এই
ভাবে কাঁদলে কি আমি ফিরে আসবো! আমি আর
তোদেরকে জ্বালাবো নারে। রুবেল মামা, আপনার সাথে আর
গাড়িতে ঘোরাও হবে না। এই শোন, তোদের কে যদি কোন কষ্ট
দিয়ে থাকি মানে রাভিস না প্লিজ। আর আমার মেয়েটার দিকে একটু
খেয়াল রাখিস।
বাবা, আমাকে এখানে ফেলে রেখেছো কেন? আমি বাসায় যাবো।
ধুর...এই গন্ধ মেডিকেলে কেউ থাকে। আমাকে প্লিজ বাসায়
নিয়ে যাও। আমি শেষ বারের মত আমার বিছানায় আরেকটু
ঘুমাতে চাই। পুলিশরা বলছে আমার নাকি পোস্ট মর্টেম করবে!
কি লাভ বলো বাবা? পোস্ট মর্টেম এ নাকি অনেক কষ্ট হয়।
আমাকে নিয়ে চলো। আমি এখানে থাকবো না।
দুপুরের পর হসপিটালের সমস্ত ফরমালিটি সেরে আমাকে নিয়ে সবাই
বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু বাসার চারপাশে এত্ত ভিড়
কেন? ওমা....এত এত পরিচিত মুখ কিন্তু আমি তো কারও সাথেই
কথা বলতে পারছি না। সবাই কি মনে করবে! বাসায়
দেখি আত্মী স্বজন ভর্তি। সবার চোখে পানি। কেমন লাগে বলেন
আপনারা? এভাবে সবাই মিলে কাঁদলে কি হবে! কত কাজ
বাকি এখনো!
কে? জনি ভাই নাকি? এত দেরি হলো কেন? কাজে গেছিলেন? আপনাকেই
তো খুজছিলাম এতক্ষণ। আপনার তো বিশাল দায়িত্ব। আমার কবর
খুড়তে হবে না? আপনাকে তো আগেই বলে রেখেছি। আর শোনেন,
আপনার ভাবির খোজ খবর নিতে ভুলবেন না কিন্তু। মেয়েটাও থাকলো।
অবশ্যই সবসময় দেখে রাখবেন। স্কুলে নিয়ে যাবেন....চিপস
কিনে দিবেন.....আর আমার গল্প শোনাবেন। আমার মেয়েটাকে যেন
কেউ কষ্ট না দেয়। তা না হলে কিন্তু আপনার খবর আছে। ভুত
হয়ে আপনার ঘাড় মটকাবো আমি!
আসরের মধ্যে গোসল কমপ্লিট। সাদা কাফনে জড়িয়ে আমাকে এখন
বাসার ডাইনিং এ রেখেছে। সন্ধ্যার একটু আগে আমাকে কবর
দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল সবাই। ঠিক আছে, আমি চলে যাবো, কিন্তু
আমার মেয়েটা কই? এই তন্বী, মেয়েটাকে আমার কাছে একটু আনো।
শেষবারের মত ওকে একটু ছুঁয়ে দেখবো। কি হলো? কে আছো? আমার
মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে আসো! মেয়ে আমার প্রত্যেকদিন
বিকালে বাইরে ঘুরতে বের হত আমার সাথে। পাউডার মাখালেই
খুশি হয়ে যেত, ভাবতো বাইরে নিয়ে যাব। তিন মাস বয়সেই
বাবাকে চিনে ফেলেছিলো। কত কথা বলতো আমার সাথে...এখনই
মা বলতে পারে। আর কয়দিন পর বাবা বলাও শিখে যেত।
পাকানি হবে একটা! কিন্তু আফসোস মেয়ের মুখে বাবা ডাক
শুনতে পেলাম না!
এইবার মনে হয় আমাকে কবর দেওয়ার জন্য
টিকাপাড়া গোরস্থানে নিয়ে যাবে। শেষ বারের মত
বাড়িটা ঘুরে দিখলাম। আর কোনদিন তো আসা হবে না! আমাদের ঘর,
কম্পিউটার, আমার প্রিয় ল্যাপটপ, ছোট্ট লিয়ানার বিছানা আরও
কত কি! স-ও-ব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে! কি আর করার আছে! যায়....আর
তো থাকা যাবে না। সবাই মিলে খাটিয়ায়
তুলে আমাকে নিয়ে গোরস্তানের দিকে রওনা হল। পুরো পাড়ায়
কান্নার রোল উঠল নতুন করে। রিয়ন আর বাবা সামনে ধরেছে। শুভ্র
আর সোহেল ধরেছে পিছনে। তন্বী, লিয়ানা, অর্চি, আম্মু....কই
তোমরা? আমার কাছে আসো.....শেষবারের মত আমাকে দেখে যাও।
আমি তো আর থাকবো না। আমার মেয়েটাকে আমার কাছে কেউ
নিয়ে আসছো না কেন? আমি তো শেষবারের মত ওকে একবার
দেখতে চাই! মাগো...কই তুমি? ও লিয়ানা....লিয়ানা.....বাবার
কাছে আসো একবার.....তোমার কপালে শেষ বারের মত একটা চুমু
দিতে চাই।
মাগরিবের আগে জানাজা শেষ হলো...অনেক দূর দূর থেকেও
অনেকে এসেছে। নামায শেষে বাবা সবার কাছে আমার
হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল। বাবা অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে! মাগরিবের
নামায শেষ হতেই আমাকে কবরে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাহ্....জনি ভাইতো ভালোই কবর বানিয়েছে। কবর....কেয়ামতের
আগে এটাই আমার স্থায়ী ঠিকানা। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?
আমাদের প্রত্যেককেই কবরে যেতে হবে। কিন্তু আমি মনে হয় একটু আগেই
চলে এলাম! কবরে শোয়ানোর পর সবাই তিন মুঠো করে মাটি দিল।
আমি অন্ধকারে চাপা পড়ে গেলাম.....অন্ধকার....নিকষ
কালো অন্ধকার! সবাই যে যার মতো চলে গেল। কিন্তু
বাবা এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এখনো...।
বাবা....তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না তোমাকে দেখে আমার কষ্ট
হচ্ছে! প্লিজ চলে যাও....প্লিজ!
কবর সম্পর্কে আগে অনেক ভয় ছিলো! না জানি কেমন লাগবে থাকতে।
কিন্তু এখন কি ভয় পেলে চলবে। এখানে তো আর তন্বী ঘুম
দিয়ে দিবে না! এটাই এখন আমার স্থায়ী ঠিকানা। অভ্যাস
হযে যাবে ধীরে ধীরে....।
অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কিছুই করার নাই। একটু পরই হয়তো বিচার শুরু হবে।
কিন্তু ভাবছি কি দোষ ছিলো আমার? আল্লাহ্ কেন আমার তিন মাসের
মেয়েটাকে এতিম করলো? কেন এত অল্প বয়সে আমার
বউকে বিধবা হতে হলো? যে বাবা কোলে পিঠে করে বড় করেছে কেনই
বা তার কাঁধে চড়ে কবরে আসতে হলো? আমি কার কাছে এর বিচার
চাইবো? হতভাগী বউ আমার এতিম মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাবে?
কি করবে? মেয়ের দুধ কেনার টাকাই বা কোথায় পাবে? মেয়ে আমার
কার কাছে বায়না ধরবে? আমার এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর
কি আপনারা কেউ দিতে পারবেন? কারো কাছে উত্তর আছে? কি হলো?
কেউ কথা বরছেন না কেন? আর কতদিন আপনারা চুপ করে থাকবেন?
আর কত লিয়ানাকে এভাবে পিতৃহারা হতে হবে? আর কত
তন্বীকে এই ভাবে অল্প বয়সে বিধবা হতে হবে? ছোট
বাচ্চাটাকে নিয়ে মেয়েটা একন কোথায় যাবে? আর কত
বাবাকে এই ভাবে ছেলের লাশ কাঁধে বইতে হবে? আর কত রুবায়েত
অদক্ষ চালকের হাতে প্রাণ দিলে আপনারা বুঝবেন? প্লিজ
জেগে উঠুন সবাই। আমার মত, আমার সন্তানের মত, আমার
পরিবারের মত আর কারো জীবনে যেন এইরকম না হয়। সবাই সোচ্চার
হন। আমরা বাঁচতে চাই...এবাবে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হতে চাই
না আর.................।।