আমি কেমন কবি


কয়েকদিন আগে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউস করতে করতে bangla-kobita .com সাইট টি হটাত আমার নজরে আসে এবং এর থেকে কিছু পড়ার পরে হুট করে কবিতার আসরে যোগ দিই| ভেবেছিলাম এটা হয়ত আমার মত অনিয়মিত আনাড়ী কবিদের জায়গা যেখানে মাঝে মাঝে দুয়েকটা কবিতা দেওয়া যাবে, যা কেউ পড়লে পড়বে| কয়েকদিনেই উপলব্ধি করলাম যে এ আসরে অসংখ্য কবি প্রতিদিন কয়েকশ কবিতা প্রকাশ এবং আলোচনা করেন| এর ভিতরে অসংখ্য স্বনামধন্য কবি সাহিত্যিকই আছেন শুধু তাই নয়, অসংখ্য নতুন প্রজন্মের কবি আছেন যাদের ভাব, ভাষা, ছন্দ ও প্রকাশ ভঙ্গি শুধু অন্যরকম তাই নয় বরং আমার কল্পনার অনেক উর্ধে| তাই ভাবলাম এ আসরে যদি থাকতেই হয় আমার নিজের বিনোদন আর উত্কর্ষ সাধনের জন্যে এবং মাঝে মাঝে দু একটা লেখা দেওয়ার জন্যে, তাহলে কবিতা লেখার ব্যাপারে আমার প্রকৃত চিত্রটা সবার কাছে তুলে ধরা দরকার যাতে আমার লেখার ভাব, ভাষা, বিষয় এবং মান নিয়ে কেউ মনক্ষুন্ন না হন এবং মনে করলে নিজেদের অমূল্য সময় ফলপ্রসু কোনো কাজে লাগাতে পারেন|


আমি কোনো প্রতিষ্ঠিত, বা নিয়মিত কবি বা সাহিত্যিক নই| ছাত্র জীবনে বরাবর আমি বিজ্ঞানের এবং পরে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ছিলাম| এরপর  বিশ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং এ শিক্ষকতা করি| তারপর গত নয় বছর কোম্পানীতে উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছি - এর বিগত পচিশ বছরই বাংলাদেশের বাইরে: প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং এখন অস্ট্রেলিয়াই|  বাসায় মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের বাইরে বাংলা ভাষায় বা কবিতায় চর্চা প্রায় শুন্য বললেই চলে| স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে তা হটাত করে এই ষাট বছরের কাছাকাছি বয়সে আসরের এই সমস্ত নিবেদিত কবি সাহিত্যিকদের ভিতরে কবিতা নিয়ে পাগলামীর ইচ্ছা হলো  কেন? সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আরো আগের দিকে যেতে হয়|


কবিতার বই লিখে কবি আখ্যা নেব এরকম বড় ধারণা আমার লেখার সম্পর্কে কোনদিন ছিলনা, আর সে রকম দুরাশা নিয়ে আমার কবিতাগুলো লেখা নয়| কিভাবে এর সূত্রপাত হলো তা বলার আগে আরো আগের কিছু কথা বলা দরকার| যখন প্রাইমারি এবং হাইস্কুলে লেখাপড়া করতাম তখন কবিতা পড়তে ভালো লাগত, কবিদের জীবনী পড়তে ভালো লাগত, কবিতা এবং কবিতার বইয়ের উপর আলোচনা, সমালোচনা পড়তে ভালো লাগত| মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের উপর কয়েক লাইন ছন্দও লিখতাম| আমার খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু ছাড়া এটা তেমন কেউ জানতনা| আমার হাইস্কুলের শ্রদ্ধেও বাংলা শিক্ষক যিনি লাইব্রেরিয়ান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করতেন তিনি প্রথম আমার ভিতর আমার বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিক ধরনের জটিল সাহিত্যের বইগুলো পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেন এবং আমাকে লেখার ব্যাপারে কিছুটা অনুপ্রেরণা দেন|তিনি স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে ব্যাপারটা আলাপ করেন| এরপর কয়েকবার বিজ্ঞান এবং অন্য বিষয়ের আর একজন শিক্ষক আমাকে আহবান জানান ইসলাম ধর্মভিত্তিক কবিতা লিখে আশেপাশের কয়েকটা গ্রামে অনুষ্ঠিত ধর্ম সভায় আবৃত্তি করার জন্যে, এবং আমি তা কয়েকবার করি| ওগুলো আদৌ কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনত কিনা আর শুনলেও কেউ বুঝত কিনা সে সম্পর্কে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ ছিল| তবে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করত ছেলেটা কারগো? ছেলেটার বুদ্ধি ভালো মাশাল্লাহ| যাদের একটু কবিতা সম্পর্কে জ্ঞান ছিল তারা হয়ত জিজ্ঞেস করত "ছেলেটা কার লেখা কবিতা পড়ল গো"? ব্যাপারটার এভাবেই ওখানে সমাপ্তি হত|


আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখানে বলা যায়| আমাদের স্কুল থেকে একবার বনভোজনে গিয়েছিলাম| নদীর তীরের মাঠে আম কাঠালের বাগানের ভিতর নিতান্তই গ্রাম্য পরিবেশে বনভোজন| পরেরদিন ক্লাসে শিক্ষকের খুব আফসোস হলো যে ক্যামেরায় বনভোজনের কোনো ছবি রাখা হয়নি| হঠাত আমার এক বন্ধু বলে বসলো, স্যার ক্যামেরা ছিল এবং ছবি নেওয়া হয়েছে, প্রসেস করে কাল দেখাবো| ব্যাপারটা কিন্ত তখনও আমার মাথায় আসেনি| বুঝলাম ক্লাস শেষে যখন বন্ধুটি আমাকে একা নিয়ে চাপ দিল যে একটা কবিতা বা ছড়ায় বনভোজনের সমস্ত চিত্রটা আমাকে তুলে ধরতে হবে| সেদিন রাতে আমার চোখে সমস্ত অনিদ্রা দিয়ে বন্ধুটি নিশ্চয় সুখো নিদ্রায় কাটিয়েছিল| পরেরদিন শিক্ষক ছবি দেখতে চাইলেন, বন্ধুটি আমার সারা রাত্রি লেখা কবিতাটি পাঠ করে শুনালো| প্রথমটাই আমি দ্বিধা সংকোচে ভুগছিলাম, পরে দেখলাম ক্লাসশুদ্ধ সবাই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করলো| শিক্ষক বললেন এরচেয়ে ভালো ক্যামেরা আর ভালো ছবি আর হয়না| কথা হলো যার হাতের লেখা ভালো তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে ফ্রেমে বাধায় করে স্কুল অফিসে টাঙানো হবে|


যখন বিজ্ঞান বিভাগে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার বিজ্ঞানের শিক্ষক অত্যন্ত মনক্ষুন্ন হয়ে বলেছিলেন, তোর ভিতরের সাহিত্য প্রতিভাকে খুন করতে যাচ্ছিস| সত্যি কথা বলতে এরপর বাংলা সাহিত্য পড়া এবং চর্চা দুটোই মুটামুটি বন্ধ ছিল| হলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অবশ্য বরাবর কবিতা আবৃত্তি করতাম যদিও কখনো কোনো পুরুস্কার মেলেনি| তবে সংক্ষিপ্ত নাট্য অভিনয় করে পর পর তিনবার তৃতীয় পুরুস্কার পাই| হলের দেয়াল পত্রিকায় অবশ্য একবার একটা কবিতা লিখেছিলাম| দেখেছিলাম কয়েকজন বন্ধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে পড়েছিল, তবে বেশিরভাগই তেমন কোনো মন্তব্য করেনি| তবে একজন বন্ধু খুবই হেসেছিল এবং মন্তব্য করেছিল পুরো ব্যাপারটাই একটা ননসেন্স, কারণ মুর্দারা কখনো মিছিল করতে পারেনা| এখানে উল্লেখ্য আমার কবিতাটির নাম ছিল 'মুর্দার মিছিলে'| সুতরাং সেই মুর্দাদের সাথে আমার কবিতা লেখাকেও কবর দিয়েছিলাম|


এর অনেক পরে, বন্ধুরা BUET-86 Yahoo Group Email তৈরী করলো আর সেখানে নানান বন্ধুরা নানান বিষয়ে লেখালেখি শুরু করলো| হঠাত করে Google এ বাংলা অক্ষর লেখা শুরু হলো| ঠিক এই সময় আমাদের বন্ধু আফজাল একটা বাংলা কবিতা ইংলিশ অক্ষরে লিখে গ্রুপে ইমেল করলো| আমি সেটা বাংলা অক্ষরে লিখে গ্রুপে আবার ইমেল করে নীচের কটা ছন্দ লিখে পাঠালাম:


এতো কিছু শিখেছ বাংলা লেখা শেখনি
বাংলা কবিতা বাংলায় লেখনি
বন্ধুর কাছ থেকে এই মাত্র শিখলাম
তোমার কবিতা তাই বাংলায় লিখলাম  
চলে যাও গুগুলে নিচে তার পথ
বাংলায় লিখে পূরাও তব মনোরথ!


খলিল
http://www.google.com/transliterate/indic/BENGALI


সুতরাং ছন্দ লেখার ব্যাপারটা এভাবেই আবার শুরু হলো| বিরাট কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, ভাব, ভাষা, ছন্দ, উপমা এবং  উত্প্রেক্ষার তেমন কোনো যত্ন ছাড়াই কাজের ফাকে ফাকে কিছু বন্ধুদের, কিছু নিজের কথা ছাড়া ছাড়া ভাবে সময়ে অসময়ে ছন্দ মিলিয়ে এই BUET-86 ইমেল গ্রুপে লেখা| হঠাত আমার বউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে| একদিন খুব পিড়াপিড়ি করলো আমি কি কোথায় লিখি দেখানোর জন্যে এবং পড়ে শোনানোর জন্যে| আমার বড় মেয়ে খুব সুন্দর বাংলা বলে এবং বুঝে| সুতরাং মা এবং মেয়েকে 'মাগো তোমায় মনে পড়ে' এবং আরো কয়েকটা কবিতা পড়ে শোনালাম| ওরা ভাবাপ্লুত হলো এবং পছন্দ করলো| অনেকটা ওদের আর BUET -86  Yahoo  গ্রুপের কয়েকজন বন্ধুর মাঝে মাঝে কিছু উত্সাহ বা "বাহ চমত্কার" গোছের উত্সাহ থেকে চালিয়ে যাওয়া|  


লিখতে গিয়ে বারবার উপলব্ধি করি বহুদিন বাংলা সাহিত্য থেকে দুরে থাকার পর আর বিগত পচিশ বছর ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াই বাস করার পর বাংলা সাহিত্যের উপর কতটা দখল হারিয়েছি| শুদ্ধ বানান বাংলাভাষার একটা অপরিহার্য্য অঙ্গ| অনেক ক্ষেত্রেই সেই শুদ্ধ বানান হয়ত লেখা সম্ভব হয়নি ধারাবাহিকভাবে বাংলাভাষার চর্চার অভাবে, অথবা অনেক ক্ষেত্রে transliteration  এ সঠিকভাবে লিখতে না পারার কারণে| সুতরাং এখানে সময় অসময়ের মনের কথাগুলো সহজভাবে বলার প্রয়াসের চেয়ে বড় কোনো সাহিত্য আছে বলে আমি  দাবী করিনা| তাই পাঠকদের কাছে নিতন্তই অনুরোধ আমার কবিতা গুলোকে শুধু সেই মাপকাঠিতে দেখার জন্যে| এর মধ্যে যারা আমার "আত্ম পরিচয়" এবং "কবির বিড়ম্বনা" কবিতা দুটি পড়েছেন তারা উপলব্ধি করেছেন যে আমার কবিতাগুলোকে আমি নিজেও খুব বেশী উচু মানের হিসাবে মূল্যায়ন করিনা| তবে আমি সহজ ভাষায়, সাধারণ ছন্দে (যার অবশ্য অনেক সময় পতন বা পরিবর্তন ঘটতে পারে), বিষয়ভিত্তিক সরাসরি কিছু কিছু বক্তব্য কটাক্ষ্য অথবা ব্যঙ্গর ধারায় লিখে থাকি - যারা আমার "একুশের ভাবনা", "জুয়াড়ী", "বুদ্ধি নিবি" এবং "শিক্ষার কারখানা" কবিতাগুলো পড়েছেন  সহজেই উপলব্ধি করবেন| কাজের মাঝে মাঝে ওরকমই কিছু লেখা এবং এই আসরে তা দেওয়ার চেয়ে বড় কোনো পরিকল্পনা বা প্রত্যাশা আমার নেই - আমার আসরের প্রথম কবিতা "শুরুর শংকা" পড়লে বুঝতে পারবেন|


আর লম্বা না করে আজকের মত এখানেই শেষ করতে চাই| তবে যাবার আগে বলি, আসরে এসেই যখন পড়েছি, আরো কিছু দিন থাকব, উপভোগ করব শিখব, এবং মাঝে মাঝে অনেক কে খোচাবো বা জলাব| ভবিষ্যতে আরো লেখার আশা রেখে আজ এখানেই শেষ করলাম|


খলিলুর রহমান
পার্থ, অস্ট্রেলিয়া
২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬