বুদ্ধি হলে নাম জেনেছি ভরস পাগল
সত্যিকারের নামটি কি তার আর কোনদিন হয়নি জানা
শুভ্র ধুসর পাঞ্জাবিটা গা’য়ের ‘পরে
ভরস হাটে ধুলোমাটির গাঁয়ের পথে
পরনে লুঙ্গি, কাঁধে ঝুলি, মাথায় পরা সাদা টুপি
শুভ্র লম্বা দাড়ি গোফের মুখটি যে তার সদায় নড়ে।
ভরস পাগল ভিক্ষুক নয়;
একটি পেলে দুটি টাকা কারো কাছে চায়নি সে
দুটি থাকলে তিনটি কাপড় কারো কাছে নেয়নি সে।


মনে পড়ে, প্রথম যেদিন এলো ভাঙ্গা ঘরে
চৌকির উপর বসেছিল টেবিলের একপাশে
চেয়ারটাতে আমি বসে করছি পড়াশোনা
নিম্নস্বরে চাইল আমার কলম, খাতাখানা
ঝকঝকে তার হাতের লেখায় লিখল আধেক পাতা
ইংরেজিতে কি লিখেছে হয়নি বুঝার বয়স;
আমায় দিয়ে ভরস পাগল বলল নীচু স্বরে,
তোমার মা'কে শুধিয়ে এসো, "খাবার কিছু হবে?"


মা বলল, ওরে খোকা, ভরস পাগল নয়,
শিক্ষিত এক চাকরিজীবি, ব্রিটিশ যখন ছিল
ওপার বাংলার মেয়ে আমি, আমার চেনা ছিল
রক্তক্ষয়ী দেশ বদলের সে’সব কালো দিনে
লুকিয়েছিল পায়খানাতে প্রাণ বাঁচানোর তরে।
যখন এলো এই দেশেতে মনটা গেল ম'রে
ছেলে মেয়ে বৌয়ের সাথে যায়নি সে আর ঘরে
পথের পরে পথ পাড়ি দেয় রাত কাটে মসজিদে
ভরসের সেই ব্রেন টা যেন আল্লাহ দেয় রে তোরে।


গরিব ঘরের বাসী খাবার টিনের একটা প্লেটে
যতনে মা সাজিয়ে তা দিল আমার হাতে
দৈন্য-লাজে মাথা নীচু খাবারগুলি নিয়ে
ইতস্ততায় দিলাম তু’লে ভরসের দুই হাতে।
ভরস খেয়ে তৃপ্তমনে তুললো দু'টি হাত
কেউ জানে না কি চেয়ে সে করলো মুনাজাত।
এরপরে সে এমনি ক’রে যতবারই এলো
খাতায় কিছু লিখে দিয়ে তারপরে সে খেলো;
যেন লেখাটা তার কাজ, আর খাওয়াটা মজুরি।


বাড়ির পাশের বড়মিয়া ছিলেন জমিদার
জমিদারী গেলেও আছে আভিজাত্য তার
বিরাট বড় অট্টালিকা শান শওকত ভরা
বড়মিয়ার ছোট ছেলে আমার সহপাঠি
সেই সুবাদে জানা ছিল বাহির ভিতর বাটি।
বড়মিয়া বাহির বাড়ি, ব্যস্ত অনেক কাজে
খেলছি আমি তারই পাশে ছোট ছেলের সাথে।
হঠাৎ সেথায় ভরস এসে নিম্নস্বরে কয়
বড়মিয়া ক্ষুধায় আছি, যদি খাবার হয়!
ভরস সেথা মেঝেই বসে, তার কিছুক্ষণ পরে
কাজের মেয়ে খাবার দিল কলাপাতার 'পরে।
হাত দু'টিকে গুটিয়ে ভরস কেমন চেয়ে রয়,
হঠাৎ উঠে খাবারগুলো পাতায় জড়িয়ে নেই
সামনে একটা বকুল গাছের নীচে ছিল ঝোপ
খাবারগুলো সেথায় জোরে ফেলে দিল ছুড়ে
দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলো সমুখের গেট দিয়ে
সবাই যখন হতভম্ব রইলো শুধু চেয়ে
বড়মিয়া দাত খিচালো “বেটা বদমাইশ"।


এরপরে তো এই জীবনে অনেক সময় গেলো
দেখেছিতো অনেক মিছিল, অনেক আন্দোলন
রক্ত ঢালা প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের ঝড়
শুধু আজো পায়নি খুঁজে আমার দুটি চোখে
কারো প্রতি অবহেলার নীরব প্রতিবাদ
প্রতিবাদের সেই জীবনকে জানাই জিন্দাবাদ।


রচনা: ৩ জুন, ২০১৬