কবিতা এবং মনস্তত্ত্ব দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এ দুটির মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কি? কবিতা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক শিল্প। আর সেই কারণেই কবিতা ও মনস্তত্ত্বের ভেতরের নিবিড় সম্পর্কটা অস্বীকার করা যায় না, তবে জটিল রহস্যটা আবিস্কার করা সহজ নয়। তর্ক আসতেই পারে বিজ্ঞান শিল্প নয়, আর শিল্পও বিজ্ঞান নয়; দুটোরই তাদের নিজস্ব পৃথক পরিধি আছে। আর এ দুটোকে বুঝতে হলে তাদের পৃথক বিশেষত্ব দিয়েই বুঝতে হবে। আবার অন্যদিকে শিল্পেরও একটা বিজ্ঞান আছে, আর বিজ্ঞানেও কিছু শিল্প আছে। তেমনিভাবে যখন আমরা শিল্প ও মনস্তত্ত্বের কথা বলি তখন আমরা শুধু সেই শিল্পের কথা বুঝি যা মনস্তত্ত্বের বিশেষত্ত্বকে ক্ষুণ্ণ না করে তার সাথে মিশে যায়। আর সেটা কিভাবে সম্ভব?


মনস্তত্ত্ব এক ধরনের বিজ্ঞান যা মানুষের সচেতন ও অবচেতন মনকে বুঝার চেষ্টা করে এবং সেই মনের প্রভাবে মানুষের আচার আচরণে (স্বভাবে) বিভিন্নতা বুঝার চেষ্টা করে। একজন ব্যক্তি যা করে (কাজ) তার মধ্যে দিয়েই কিন্তু তার স্বভাব বুঝা হয়। তবে তার কাজের প্রকৃতির পেছনে থাকে তার অনুভূতি, দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তাভাবনা এবং অন্যান্য মানসিক প্রক্রিয়া। কবিতা আসলে একজন ব্যক্তির (কবির) শিল্পকর্ম যা দিয়ে বুঝা যায় তার চিন্তাভাবনা, কল্পনা, সচেতনতা, অভিজ্ঞতা যা সমস্টিগতভাবে কবির আবেগময় প্রকাশ ঘটায় ছান্দিক ভাষাতে। সুতরাং একজন কবির কবিতা বুঝা অনেকাংশেই কবির স্বভাব বুঝা আর স্বভাবের পেছনের কারণ (অভিজ্ঞতা) বুঝা। আর এই কর্মটিই তখন মনস্তাত্ত্বিক কর্ম হয়ে দাঁড়ায়।


আধুনিক মনস্তত্ত্বে অবচেতন ও অচেতন মনের প্রক্রিয়াকে চেতন মনের প্রক্রিয়ার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কারণ এই অবস্থায় মানসিক প্রক্রিয়া কোনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না, পরিস্রাবিত হয় না। অর্থাত তার চিন্তার সঠিক ছবি পাওয়া যায়। তবে অচেতন মনে যে প্রক্রিয়া চলে তার পাঠোদ্ধারে বাস্তবিক সমস্যা থাকায় অবচেতন মনকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে যখন একজন কিছু কথা বলে ও কাজ করে যার মধ্য দিয়ে তার মানসিক প্রক্রিয়াটা বুঝা যায়। ঠিক তেমনি একজন কবি যখন কবিতা লেখে তখন তার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার মন একটা অবচেতন অবস্থাতে পৌছায় যখন তার চারিদিকে যা কিছু ঘটছে তা দেখার চেয়ে, ভাবার চেয়ে এবং বলার চেয়ে তার মনের প্রক্রিয়াতে যে রূপ দেখে তাই নিয়ে ভাবে ও প্রকাশ করে। সাধারণ ভাষায় এই যে অবস্থা এটিকেই আমরা কবির সাধনা বলে থাকি। আর এই সাধনায় যে যত সিদ্ধ তার কবিতায় তত হৃদয়ের ছোঁয়া পাওয়া যায়, তার কবিতা হয়ে ওঠে তত অকৃত্রিম। আর এই সাধনার বাইরে যে কবিতা লেখা তাতে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও পরিস্রাবিত চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায়, তবে হৃদয়ের ছোঁয়া কম থাকতে পারে। কোন ধরনের কবিতা নিয়ন্ত্রিত সমাজে বসবাসরত মানুষের জন্যে মঙ্গলময় তা এখানে আলোচনার বিষয় নয়। তবে আশা করি মনস্তত্ত্ব ও কবিতার ভেতর একটা যোগসূত্র স্থাপনে কিছুটা সফল হয়েছি।


মনস্তত্ত্বের মূল কৌশলটা হল একজন ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তিমূলক মানসিক অবস্থায় আনা যখন অকপট মনের কথা, ভাবনা শোনা যায়। ঠিক একই ভাবে অনেক কবি অবচেতন ও অকপট মানসিক অবস্থায় স্বাকারোক্তিমূলক কবিতা লিখে থাকে যেখানে ঘৃণা, প্রেম, বিক্ষোভ, স্রষ্টার প্রতি প্রার্থনা, সমর্পণ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, প্রত্যাখান, বিদ্রোহ প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। যদিও নিতান্তই আত্মস্বীকারোক্তিমূলক, তবু তা প্রকাশের পর তার একান্ত নিজের না থেকে তা অনেকের হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যাদের কবির অভিজ্ঞতা ও মননশীলতার সাথে নিজের অভিজ্ঞতা মিলে যায়, তারাই সে কবিতাতে উল্লেখিত 'আমি' বা 'আমার' জায়গা দখল করে।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে কবির কবিতা থেকে কবির স্বভাব আবিস্কার করতে একজন মনস্তাত্ত্বিকবিদের সমস্যাগুলি কী? আমি মনে করি কবিতা বুঝা এবং একজন কবির অধিকাংশ কবিতা বুঝা। একজন মনস্তাত্ত্বিকবিদকে জোর করে এ কাজটি নাও করানো যেতে পারে। কিন্তু একজন বিজ্ঞ কবিতা পাঠক মনস্তাত্ত্বিকবিদের কাজ করতে পারে - হয়ত অবচেতন মনে করেও থাকে। আর এই কারণেই হয়ত এক এক কবি এক এক জন পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতা পাঠকদের প্রতি আহবান রইল কিছুটা মনস্তাত্ত্বিকবিদ হয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান পড়ে দেখি রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারি কিনা, নজরুলের কবিতা গান পড়ে দেখি নজরুলকে চিনতে পারি কিনা, মধুসূদন ও জীবনান্ন্দের কবিতা পড়ে দেখি তাঁদের জীবনে অন্তমিলের অভাব খুঁজে পাই কিনা, জীবনানন্দের অতৃপ্ত নিরানন্দ মনের প্রতিফলন পাই কিনা তাঁর কবিতায় বারবার রুপসী বাংলার কোন এক বনলতা সেনের কাছে দুদণ্ড তৃপ্তি খুঁজতে আসার আকুতিতে। আমার প্রিয় কবি কেন আমার প্রিয় তার উত্তর খুঁজে পাই কিনা। ভিন্ন ধারার একাধিক কবি কেন আমার প্রিয় হল তার উত্তর খুজে পাই কিনা।  


"আমি সকল পুরুষকে পড়েছি,
নারীর কী প্রত্যাশা আর কী প্রাপ্তি বিবাহে?
কেন সে পায় না একাধিক স্বামী?”


"আমি সব সময় চেয়েছি ভালোবাসা,
যদি না পাই ঘরে, একটু দূরে হাটতে দোষ কী?"


"আমি একজন পুরুষ পেলাম,
তাকে ভালোবাসলাম,
তার মাঝে প্রত্যেক পুরুষ দেখলাম  -
যে একজন নারী চায়;
আর আমি প্রত্যেকটি নারী হয়ে শুধু ভালোবাসা চেয়ে গেলাম।"


"আমি সেই, যে হারালো তার পথ;
অপরিচিতের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুক এখন -
পাই কিছু ভালোবাসা - অন্তত টুকরো, খুচরো।"


কেরালার মহিলা কবি কমলা দাসের কবিতায় কেন আসলো এমন নিষিদ্ধ ইঙ্গিত আবহমান কালের প্রচলিত পুরুষ নারীর প্রচলিত বিবাহিত জীবনের প্রতি? কবি কমলা দাসের এইসব কবিতাগুলি কি স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা নিজ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে, নাকি একজন চরম নারীবাদীর পরিকল্পিত কিন্তু অপরিশীলিত শিল্প?  


আমার পরের লেখাতে কবিতা ও মানসিক স্বাস্থের ভেতর একটা সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করব যার ওপর অনেক কবির অজান্তেই গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে অনেক।


সবার জন্যে শুভেচ্ছা রইল।


Source: Relation between Poetry and Psychology with special reference to the Poetry of Kamala Das by Tawhida Akhter, IOSR Journal of Humanities and Social Science, Vol. 9, Issue 6 (Mar. –Apr. 2013), pp 13 – 16 (http://www.iosrjournals.org/iosr-jhss/papers/Vol9-issue6/C0961316.pdf?id=6179).