মুক্তকছন্দ এবং মিশ্রছন্দ নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা ৷


কবিতা সাহিত্য শাখার একটি অন্যতম স্তম্ভ, এই কবিতা রচনা করতে গিয়ে অনেক ছন্দের আবিষ্কার হয়েছে, এই ছন্দগুলোর একটি করে নাম দেওয়া হয়েছে, এবং সেই নাম অনুযায়ী সে ছন্দগুলোর মাত্রা কাঠামো নিয়ম কানুন বেঁধে দেওয়া হয়েছে, আবার যুগে-যুগে কালে-কালে সে ছন্দগুলোর নামও পরিবর্তন  হয়েছে,  যেমন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত ছন্দ, এ-ছন্দগুলোর নাম আরও অনেকে অনেক ভাবে দিয়েছে, এভাবে পরিবর্তন পরিবর্ধন সংস্করণ হয়ে আসতেছে যুগ-যুগ ধরে, আচ্ছা যাই হোক যে নামই দেওয়া হোক না কেন, সে নাম অনুযায়ী যেন ব্যাকরণের সাথে মিল থাকে, সে নামের অর্থের সাথে ব্যাকরণের অর্থ যেন ঠিক থাকে, সে নামের শাব্দিক অর্থের সাথে ছন্দের নিয়ম কাঠামো ব্যবহার যেন ঠিক থাকে এটাই আমার প্রত্যাশা ৷


এখানে আমার আলোচনার মূল বিষয় হলো মুক্তকছন্দ এবং মিশ্রছন্দ নিয়ে, এ-দুটি ছন্দ নিয়ে অনেকে অনেক ব্যাখ্যা প্রদান করে, এ-দুটি ছন্দ নিয়ে অনেকে অনেক নিয়ম কানুন গঠন প্রণালী প্রকাশ করে, আসলে ছন্দ-তো তখনেই সার্থক হয় যখন নামের অর্থের সাথে গঠন প্রণালী ঠিক থাকে ৷


যেমন মুক্তকছন্দটি আবিষ্কার করেছে মুক্ত শব্দ থেকে, মুক্ত শব্দের অর্থ হলো; স্বাধীন,  খোলা, বাধাহীন, লাগামহীন, আবদ্ধ নয় এমন; অবরুদ্ধ নয় এমন, নিষ্কৃতি বা ছাড় পেয়েছে এমন, বন্ধ নয় এমন, বাঁধা নয় এমন ৷


মিশ্রছন্দটি প্রকাশ পেয়েছে মিশ্র শব্দ থেকে, মিশ্র শব্দের অর্থ হলো;  মিশ্রিত, সংযুক্ত; মিশ্রণজাত,  মিশ্রিতকরণ, অপরের সঙ্গে মিশ্রিত করা হয়েছে এমন, অ-বিশুদ্ধ খাঁটি নয় এমন,  আসল নয় এমন, ভালো জিনিসের সাথে খারাপ জিনিসের মিশ্রণ, কত রকমের জিনিস এক সাথে  মিশানো হয়েছে এমন ।


আমরা উপরে মুক্ত এবং মিশ্র শব্দের অর্থ দেখলাম, এখন  এগুলি শব্দের ছন্দ কেমন হবে? যেমন অনেকে মিশ্রছন্দকে মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ হিসেবে বলে, মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আর এক নাম, তাহলে এটা কেমন হলো? যদি শব্দের শাব্দিক অর্থের সাথে ছন্দের অর্থের মিল না থাকে, তাহলে সে ছন্দ নিয়ে-তো মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি থাকবে ৷


এখানে আমাদের একটি বিষয় পরিষ্কার মনে রাখতে হবে, আমরা যদি কোন ছন্দের মাঝে স্বাধীনতা পাই তা আমাদেরকে গ্রহণ করে নিতে হবে,  যেমন আমরা মুক্তকছন্দ এবং মিশ্রছন্দের মাঝে যে স্বাধীনতা পাইতেছি তা আমাদেরকে গ্রহণ করে দিতে হবে, ব্যাকরণ আমাদেরকে সে স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে, তাকে আমরা কেন পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করবো? যে ছন্দে আমরা ছন্দ  মিশ্রণ করতে পারতেছি, ব্যাকরণ সে মিশ্রণ করার অনুমোদন  দিয়েছে, তাকে কেন আমরা সঠিক করবো?  তাই অতি বাড়াবাড়ি সাহিত্যের জন্য ভালো না, সব কিছুতে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করা ঠিক না, অনেকে আবার এমন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অনেককে অ-কবি বলে গালি দেয়, এটা কিন্তু ঠিক নয় ৷


আবার অনেকে অতীতের কবি সাহিত্যিকদের উদ্ধৃতি দেয় তারা কি ভুল করে গেছে? মানুষ মাত্রই ভুল হয়, যেমন আমাদের ভুল হয়, তেমনি তাদেরও ভুল হয়েছে, কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, যেমন প্রবোধচন্দ্র সেন সে নিজেই স্বীকার করেছে তার ছন্দ সম্পর্কে নামগুলো দেওয়া বিজ্ঞান সম্মত হয়নি,  বর্তমান প্রজন্মের কবি সাহিত্যিক গবেষক কালাচাঁদ মৃত্যুর,  তিনি যেমন স্বরবৃত্ত ছন্দকে শ্রুত্যাক্ষরবৃত্ত নাম দিয়েছেন, অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে দৃশ্যাক্ষরবৃত্ত নাম দিয়েছেন, ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে বর্ণবৃত্ত নাম দিয়েছেন, এভাবে সে সাহিত্য জগতে অনেক পরিবর্তন পরিবর্ধন সংস্করণ করেছেন, যার কারণে তাকে বর্তমান প্রজন্মে ছন্দ-সম্রাট হিসেবে উপাধি দেওয়া হয়েছে, তাই ভুল শুদ্ধ সবার মাঝে থাকতে পারে, তাই সবকিছুরে মূল হলো গবেষণা, এবং ব্যাকরণের দিক নির্দেশনা, ব্যাকরণের নীতি অর্থ অনুসরণ করা, ব্যাকরণের নীতি অর্থ অনুসরণ করলে গবেষণা করলে সঠিক বিষয়টি সনাক্ত করা যাবে, সঠিক তত্ত্ব উপস্থাপন করা যাবে, সঠিক পথ পন্থা বাহির করা যাবে, সঠিক নাম রাখা যাবে, যে নামগুলো হবে ব্যাকরণ ভিত্তিক এবং বিজ্ঞান সম্মত, সে ছন্দের নামের অর্থের সাথে ছন্দের নিয়ম কানুন কাঠামো হুবহু মিল থাকবে, তাই আমাদেরকে বেশি বেশি গবেষণা করতে হবে, তবে সে গবেষণা হতে হবে ব্যাকরণ অনুযায়ী, শব্দের বা ছন্দের শাব্দিক অর্থ অনুযায়ী, বিজ্ঞানের তত্ত্ব  অনুযায়ী, তবেই আমরা অনেক কিছুর সমাধান করতে পারবো ৷


তাই মুক্তকছন্দ যেহেতু আমাদেরকে ছন্দ বসানোর স্বাধীনতা দিয়েছে, তাই আমরা আমাদের ইচ্ছে মতো ছন্দ বসিয়ে একটি সুন্দর কাব্য রচনা করবো,  মিশ্রছন্দ যেহেতু আমাদেরকে ছন্দ মিশ্রণ করার স্বাধীনতা দিয়েছে তাই আমরা সুন্দর সুন্দর ছন্দ  ব্যবহার করে একটি মোহনীয় কাব্য তৈরি করবো, তবে মিশ্রছন্দের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে তা হলো; সে ছন্দের কবিতাগুলো যেন পারস্পরিক বাক্যের এবং ছন্দের উচ্চারণ আরও শ্রুতিমধুর এবং সুরালো হয়,  এবং সে ছন্দের ভাষাগত দিক যেন আরও উন্নত এবং সহজ সরল হয়, এদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, কারণ কবিতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে কবিতার প্রেমে বন্ধী করানো, আর মানুষ কবিতার প্রেমে তখনেই বন্ধী হবে, যখন কবিতার মাঝে শব্দ বিন্যাসের সুন্দর গঠন থাকবে,  এবং পারস্পরিক বাক্য ও ছন্দের উচ্চারণ শ্রুতিমধুর ও সুরালো হবে, তখন মানুষ কবিতার প্রেমে অবশ্যই বন্ধী হবে, তাই আমরা কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোর উপর খুবেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবো, আশা করি মুক্তকছন্দ এবং মিশ্রছন্দ নিয়ে সবার জড়তা এবং নানামুখী ধারণা অনেকাংশ দূরীভূত হবে ৷