সেই আটত্রিশ বছর আগে দেখা এক নদী
নদীর জল জলের ঢেউ
বুকের আরশীতে আসমানি রূপ
কলকল ছলছল উদাস-উন্মুখ
পাগলপারা দুই পাড়
কত বদলে গ্যাছে আজ
তার সে জলের ঘুঙুর কূলের কণ্ঠহার!


সেই কাশবন ঘাসবন ঝাউবন উড়ানীর চর
সেই টিটিব খঞ্জনা অঞ্জনা বালিহাসের ঝাঁক
সেই গাংশালিক মাছরাঙাদের ঘর
সেই বানজরান ভাটিয়ালী তান কবিতার বাঁক।
দুই পাড়ে ধেনু চড়া বেণু ধরা রাখালের মাঠ
এপার ওপারে গাঁ মাঝে খেয়া ঘাট।
ঘাটে নামা হাটের মানুষ দোকানীর ভীড়
দুইপাড়ে কত যাত্রী আলাপন নিভির।
জলকেলি জলভাঙা ডানপীঠে কিশোর কিশোরী
আঁচল টানিয়া গোসলরত লজ্জাবতি নারী
ভরা ঘাগরি গাঁয়ের নাগরী দোদুল দোদুল চরণ
ভেজা শাড়ী ভেজা শরীর মধুর ক্ষরণ
ফিরে যেতে যেতে পথে ছড়ায় কারুকাজ
সুন্দরতম সেই ছবি কত বদলে গ্যাছে আজ।


সেই আটত্রিশ বছর আগের দেখা ভোর
রাত্রীর সুবাসিত বাতাস শেষ প্রহর
পাখি কাকলির কূজন মন্দিরের ঘণ্টা মসজিদের আজান
ঢেঁকিশাল ঢেঁকির পাড় ধান বানার সে কী মধু তান
পূজার ঘর শানের ঘাট উঠোনে উনুনে ব্যস্ত রমণী।
কিষাণ কিষাণীর সেঁওতিদোন খাল কাঁচা সকাল
তাজা জলে মাঠকে মাঠ নতুন ধরণী।
ঝরা আম পড়া জাম বইচি বাগান তোলপার করে ফেরা
এপাড়া ওপাড়ার উল্লসিত ছেলে মেয়ের দল
সখিনা জরিনা পার্বতীদের পাতা কুড়ানো নাড়া ভুরানো  
গোবর ঘাঁটার আনন্দ কোলাহল
মালাগাছি ডালাসাজি বিনুনী সিঁথির ভাঁজ
কত বদলে গ্যাছে আজ।


আটত্রিশ বছর আগের সেই
ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব ধান কাটার দিন
পৌষের মেলা চৈত্র সংক্রান্তি  
হাজার ব্যাস্ততা শোধিতে মহাজনি ঋণ।
সেই ঘোর দৌড় বাইসের পাল্লা ষাঁড়ের লড়াই
ঘুড়ি কাটা দড়ি টানা লাঠির বড়াই
সাপ-সাপুড়ের নাচ সাথে যাদুর বীণ
ঢাক ঢোল চমক ঠমক নর্তকীর
জারি সারি গানের পালা ঐতিহ্য বাঙালীর
হাতে ডুলা কাঁধে গামছা মুখে ভূবন ভোলা হাঁসি
দোকানী খদ্দেরে প্রাণখোলা বুলি কত ভালোবাসা বাসি
আহারে সেই সোনার মানুষগুলো এখন কই?
সেই সোনালী রোদের ভোর
সেই পূর্ব দুয়ারীর দোর
সেই পলাশ পিয়াল বকুল সুঁইচোর
সেই চাতাল রৌদ্র মাতাল অর্ধ উলঙ্গ ছেলে
সেই ঝাঁকড়া চুলের কবিয়াল
সেই ডালা সেই বালা মালির সই
এখন কই?
সেই মঠখোলা সেই বটতলা
সেই বৈরাগী বাড়ী বইচি বাগান
বনের ঘুঙুর উদাত্ত সুর আনপথিকের গান
ফিরে কী আর পাব সই?